post

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস

মতিউর রহমান আকন্দ

১৬ ডিসেম্বর ২০১৬
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) মুসলিম লীগের এই অগণতান্ত্রিক মনোভাবের ফলে পাকিস্তানের উভয় অংশেই এই দলের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে আরম্ভ করে। মূলত ১৯৪৮ সাল থেকেই মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তায় ধস নামতে থাকে। এত কিছুর পরও ১৯৪৭ এবং ১৯৪৮ সালের প্রথমদিকে রাজনৈতিক দিক থেকে পাকিস্তান সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ ছিল। বিশেষ করে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর জীবদ্দশা পর্যন্ত তার সম্মান ও গগনচুম্বী ব্যক্তিত্ব বিভিন্নমুখী মতামতকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়। কিন্তু মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর প্রায় সাথে সাথেই মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পরিবর্তন দেখা দেয়। আর এই পরিবর্তনের সূত্র ধরেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিভিন্নমুখী সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে আরম্ভ করে। পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য প্রথম গণপরিষদ গঠনও পাকিস্তানের প্রারম্ভিক রাজনৈতিক জীবনের একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। গণপরিষদ গঠন প্রসঙ্গে অধ্যাপক কেইথ কেলার্ড বলেছেন, আইনের আনুষ্ঠানিক আশীর্বাদ ছাড়াই পাকিস্তানের গণপরিষদের জন্ম হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনবলে ভারতীয় আইনসভার অধীনস্থ যে সকল অঞ্চল পাকিস্তানে যোগদান করে, সেসব অঞ্চলে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হয় একটি গণপরিষদ। এই নির্বাচিত সদস্যদের সংখ্যা ছিল ৬৯ জন। পরবর্তীকালে তা ৭৪ জনে উন্নীত করা হয়। নির্বাচিত এই কয়েকজন প্রতিনিধির হাতেই নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ভাগ্য নির্ধারণের গুরু দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ভারত স্বাধীনতা আইন অনুসারে গণপরিষদকে দেয়া হয়েছিল একটি দ্বৈত ভূমিকা। প্রথমত, কেন্দ্রীয় আইনসভা হিসেবে কাজ করা; দ্বিতীয়ত, এমন একটি সংবিধান প্রণয়ন করা যা নবগঠিত রাষ্ট্রের প্রয়োজন সাপেক্ষে ভারত স্বাধীনতা আইন এবং ভারত শাসন আইনের যে কোনো বিধি সংশোধনের ক্ষমতা রাখবে। এই গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে করাচিতে, ১৯৪৭ সালের ১০ আগস্ট। প্রথম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন শ্রী যোগেশচন্দ্র মন্ডল। তার মাত্র ১ দিন পরেই অর্থাৎ ১১ আগস্ট জিন্নাহ সর্বসম্মতিক্রমে গণপরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন ততদিন তিনি এই গণপরিষদের সভাপতি ছিলেন। পাকিস্তানের অনিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি, সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য প্রভৃতি কারণে সেই সময়কে ‘অরাজনৈতিক পরিবেশ’ বলে অভিহিত করা যেতে পারে। এরূপ নীতিহীন অরাজনীতির চর্চা কায়েদে আযমের মৃত্যুর পর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে আরও প্রকট আকার ধারণ করে। তাঁর মৃত্যুর পর খাজা নাজিমউদ্দিন গভর্নর জেনারেল পদে নিযুক্ত হন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তখন সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রীর প্রকৃত ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হন, কারণ খাজা নাজিমউদ্দিন সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অসম্মান বা উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রীর কাজে অবৈধ হস্তক্ষেপ করেননি। কিন্তু লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর পাকিস্তানের রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ এর। প্রারম্ভ থেকেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে যে অস্পষ্টতা ও গোঁজামিলের পরিচয় পাওয়া গেছে, গোলাম মোহাম্মদ তার কাজে সেটার আরও যথার্থতা প্রমাণ করেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রীর স্থলাভিষিক্ত না হয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় খাজা নাজিমউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীর পদে নিযুক্ত করে নিজে নামেমাত্র প্রধান হিসেবে গভর্নর জেনারেলের পদ গ্রহণ করেন। তার সকল কর্মকাণ্ডের পেছনে সমর্থন ও মদদ জুগিয়েছে সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্র। কারণ গোলাম মোহাম্মদ নিজেও একজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা ছিলেন এবং সেই সময়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তারকারী প্রদেশ পাঞ্জাবের অধিবাসী হিসেবেও বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তানের সকল উচ্চপদস্থ আমলা ও সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই ছিল পাঞ্জাবের অধিবাসী। পাকিস্তানের প্রথম দশকে রাজনীতিতে অযোগ্য রাজনীতিবিদদের সমাবেশের আধিক্য হেতু আমলা ও সামরিক বাহিনী সবসময়ই নেপথ্যে থেকে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পরবর্তীতে এই সকল আমলা ও আর্মির সহযোগিতায় মোহাম্মদ আলীও পাকিস্তানের রাজনীতিতে অনিয়মতান্ত্রিক অরাজকতাময় এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করেন। ভারত বিভাগের পর স্বাধীন পাকিস্তানে যে রাজনৈতিক এলিট শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে তারা মূলত প্রত্যেকেই ছিলেন ভারতের অধিবাসী। তাঁরা তাদের পৈতৃক আবাস ভারত ত্যাগ করে মুসলমান হিসেবে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। প্রকৃতপক্ষে, পাকিস্তান রাষ্ট্রে তাঁদের যেমন শিকড় ছিল না, তেমনি ছিল না এ অঞ্চলে তাদের নির্বাচনী এলাকাও। তারা রাষ্ট্র ও জাতি গঠনে যতটা না ভূমিকা পালনের জন্য রাজনীতি চর্চা করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি চর্চা করেছেন ক্ষমতাসীন থাকার লক্ষ্যে। তারা পাকিস্তানের রাজনীতিকে স্থায়ী, স্থিতিশীল ও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ক্রিয়। নির্বাচন অনুষ্ঠান, গণসমর্থন আদায়, সুস্থ ও উত্তম সংবিধান প্রণয়ন প্রভৃতি বিষয়ে তাঁদের অনীহা ছিল প্রকট। সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সহযোগিতায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত ও কেন্দ্রীয়করণ করে রাখাই ছিল তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য। আন্দোলন ও সংঘাতের সূচনা পাকিস্তানের ইতিহাসে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের আন্দোলন ও সংঘাতের সূচনা হয় মূলত রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করেন। জ্ঞানতাপস ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার প্রতিবাদে বলেন, ‘যদি বিদেশী ভাষা বলে ইংরেজি ভাষা পরিত্যক্ত হয়, বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষারূপে গ্রহণ না করার কোন যুক্তি নেই। যদি বাংলা ভাষার অতিরিক্ত কোন দ্বিতীয় ভাষা গ্রহণ করতে হয়, তবে উর্দু ভাষার দাবি বিবেচনা করা উচিত।’ সচেতন শিক্ষিত মহলের দাবি সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য পাকিস্তানের শাসক মহল উর্দুকে খরহমঁধ ভৎধহপধ বা ব্যবহৃত সাধারণ ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার চেষ্টায় লিপ্ত হন। এ দ্বন্দ্বই পরবর্তীতে শিক্ষাঙ্গন থেকে অফিস আদালত ও সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়। ঢাকার বিভিন্ন সভা সমাবেশের মূল দাবি ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। এ আন্দোলন গণমানুষের সমর্থন লাভ করে। ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ ঢাকায় পালিত হয় ঐতিহাসিক হরতাল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার রক্ত দানের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের সূচনা হয় যা পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়। খাজা নাজিমুদ্দিনের অদূরদর্শিতা ১৯৫৩ সালের এপ্রিলে খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকার ভেঙে দেয়া থেকেই শুরু হয় পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কট। গণপরিষদের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকার ভেঙে দেন। গোলাম মোহাম্মদ ১৯৫৪ সালে একইভাবে পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদও ভেঙে দেন। তার এসব কার্যকলাপকে ‘সাংবিধানিক অভ্যুত্থান’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সি-ইন-সি জেনারেল মোহাম্মদ আইউব খানের সমর্থনে গভর্নর জেনারেল গোলাম মেহাম্মদ খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকার বরখাস্ত করেছিলেন। ১৯৬৪ সালের অক্টোবরে করাচিতে গভর্নর হাউজে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট আইউব স্বীকার করেন যে, খাজা নাজিমুদ্দিন ও গভর্নর জেনারেলের মধ্যে বিরোধ শুরু হলে তিনি গভর্নর জেনারেলের পক্ষ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে সি-ইন-সি জেনারেল আইউব প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি তার মেয়াদ বৃদ্ধি এবং নিজের বাসভবন সুসজ্জিত করার জন্য তাকে অনুরোধ করেন। প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন তার অনুরোধ রক্ষা না করায় তিনি গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদের পক্ষ নেন। ১৯৫১ সালে খাজা নাজিমুদ্দিন ক্ষতিপূরণ প্রদান করা ছাড়া জমিদারি উচ্ছেদ করায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা তার প্রতি চটে যায়। অধিকাংশ জমিদার ছিলেন পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবিরা ছিল গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদের স্বজাতি। তাই তিনি নাজিমুদ্দিনকে বরখাস্ত করে নিজের জাতির ক্ষতির প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। তবে তিনি ব্যক্তিগত ক্ষতির আশঙ্কা থেকে তাকে বরখান্ত করেন। নাজিমুদ্দিনকে বরখাস্ত করে গোলাম মোহাম্মদ বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকেও প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্তি দেন। মোহাম্মদ আলী বগুড়ার মন্ত্রিসভায় জেনারেল মোহাম্মদ আইউব খানকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়। সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মন্ত্রিসভায় নিযুক্তি দানের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরা হয় এবং সামরিক শাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা পরে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী থেকে গভর্নর জেনারেল হন। স্বাস্থ্যগত কারণে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদকে পদত্যাগে বাধ্য করে তিনি নিজে সে পদ গ্রহণ করেন। ১৯৫৫ সালের ৮ আগস্ট গভর্নর জেনারেল মীর্জা একইভাবে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়াকেও বরখাস্ত করেন। ১৯৫৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান গণপরিষদ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন সংশোধন করে গভর্নর জেনারেল ক্ষমতা খর্ব করার উদ্যোগ নেয়। সংশোধনী প্রস্তাব করা হয় যে, গভর্নর জেনারেলকে মন্ত্রিসভার সঙ্গে পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গণপরিষদের সাব-কমিটি গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা খর্ব করার খসড়া চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ গণপরিষদ ভেঙে দেন। বিলুপ্ত গণপরিষদের স্পিকার মৌলভী তমিজউদ্দিন খান বোরখা পরে একটি রিকশায় চড়ে পেছনের দরজা দিয়ে সিন্ধু হাইকোর্টে উপস্থিত হন। ৭ নভেম্বর তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মঞ্জুর আলম গণপরিষদ ভেঙে দেয়ার আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। সিন্ধু হাইকোর্ট গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদের আদেশকে বেআইনি ও অবৈধ হিসেবে রায় দেয়। হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে সরকার সুপ্রিম কোর্টে আপিল দায়ের করে। প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ মুনিরের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চ সিন্ধু হাইকোর্টের রায় নাকচ করে দেয়। বিচারপতি মুনির তার রায়ে বলেন, জিন্নাহর নেতৃত্বে অর্জিত পাকিস্তানের স্বাধীনতা ব্রিটিশ রাজার সার্বভৌম ক্ষমতার অধীনস্থ হওয়ায় গণপরিষদ সার্বভৌম ছিল না। লর্ড ডিপলকের যুক্তিকে সমর্থন করে তিনি বলেন, পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেনি। দেশটি ইতঃপূর্বে ডোমিনিয়ন মর্যাদাপ্রাপ্ত অন্যান্য দেশের মতো একটি ডোমিনিয়ন। কিন্তু বিচারপতি এ. আর. কর্নেলিয়াস তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন। কর্নেলিয়াস ছিলেন দ্বিমত পোষণকারী একমাত্র বিচারপতি। তিনি ব্রিটিশ কমনওয়েলথে ডোমিনিয়ন মর্যাদা সম্পর্কে বিচারপতি মুনিরের ব্যাখ্যার বিরোধিতা করে বলেন ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে যে, পরিপূর্ণ স্বাধীন মর্যাদা নিয়ে রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে। তিনি ইতঃপূর্বে ডোমিনিয়ন মর্যাদা প্রাপ্ত দেশগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানের নয়া ডোমিনিয়ন মর্যাদার পার্থক্য তুলে ধরেন। বিচারপতি কর্নেলিয়াস আরো বলেন, পাকিস্তান কেবলমাত্র ডোমিনিয়ন নয়, একটি স্বাধীন দেশ হিসেবেও জন্ম নেয়। তিনি জানতে চান যে, গণপরিষদ সার্বভৌম না হলে এ ক্ষমতা কার হাতে। প্রধান বিচারপতি মুনির বিচারপতি কর্নেলিয়াসের অভিমত খন্ডন করে বলেন, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছে জনগণ। ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ বা প্রয়োজনের তাগিদে গভর্নর জেনারেল সরকার ও গণপরিষদ বাতিল করেছেন। বিলুপ্ত গণপরিষদ এখন আর পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব নয়। তাই নতুন করে গণপরিষদ গঠন করতে হবে। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের এ রায় দেশের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দেয়। ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ তত্ত্ব পরবর্তীতে সামরিক স্বৈরশাসনের বহু অনিয়মের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী নতুন করে গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানে তখনো কোন সংবিধান ছিল না। এ গণপরিষদ পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনা করে। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ নয়া সংবিধান কার্যকর হয় এবং পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নূন ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ১৯৫৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু আইউব খান সামরিক শাসন জারি করায় এ নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। মোহাম্মদ আইয়ুব খান যুক্তরাজ্যের স্যান্ডহার্স্ট রয়াল মিলিটারি অ্যাকাডেমি থেকে কমিশন-পূর্ব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ, চমৎকার ব্যক্তিত্ব, আকর্ষণীয় দেহ-সৌষ্ঠবের অধিকারী একজন ভালো জেনারেল ছিলেন। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ‘কমান্ডার-ইন-চিফ’ হিসেবে চমৎকার দায়িত্ব পালন করছিলেন। একজন পেশাগত সৈনিকের গৌরব ও কৃতিত্ব নিয়ে তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিতে পারতেন। রাজনীতিতে তাঁর কোনো আগ্রহ থাকলে তিনি তা অবসর নেয়ার পরও করতে পারতেন। কিন্তু সে রকম সম্মানজনক পথ অনুসরণ না করে তিনি সৈনিকের শপথ ভঙ্গ করেছিলেন এবং এর জন্য তাঁকে অসম্মানিত হতে হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় তিনি পাকিস্তান ভাঙার কাজটি ত্বরান্বিত করেছিলেন এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সেনাবাহিনী কর্তৃক রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পথপ্রদর্শক ছিলেন। তিনি তাঁর ১০ বছরের (১৯৫৮-১৯৬৮) শাসনকে ‘উন্নয়নের দশক’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ছিল অনৈক্য, অসন্তোষ, মূল্যবোধের অবক্ষয়, দুর্নীতির বিস্তার, রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বিলুপ্তি, ধনীর আরও ধনী হওয়া এবং দরিদ্রের আরও দরিদ্র হওয়ার দশক। তাঁর মৌলিক গণতন্ত্রের ধারণাটি ছিল গণতন্ত্রের অস্বীকৃতি। ১৯৫৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন চলাকালে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে চেয়ার ছুড়ে ও মাইকের স্ট্যান্ড দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হলে দু’দিন পর হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনা গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য মোটেও অনুকূল ছিল না। পাকিস্তানে গণতন্ত্রের দুর্দিনে প্রতিবেশী ভারতে গণতন্ত্রের ছিল সুদিন। ভারতে গণতন্ত্র ছিল একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ১৯৬৪ সালে প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত নেহেরুর মৃত্যু নাগাদ দেশটির রাজনৈতিক অবস্থা ছিল নিটোল। ১৯৪৭ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং আমৃত্যু এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অন্য দিকে প্রতিবেশী পাকিস্তানে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। আইউব খান ক্ষমতা দখল করার আগে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত দেশটিতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সাতজন। তারা হলেন লিয়াকত আলী খান, স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী বগুড়া, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আই আই চুন্দ্রিগড় ও ফিরোজ খান নূন। পাকিস্তানে যদি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বিকশিত হওয়ার সুযোগ থাকত এবং কার্যকর হতো, তাহলে পাকিস্তান অনেক বেশি শক্তিশালী হতো। তার পরিবর্তে তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের নামে তিনি জন-অংশগ্রহণশূন্য এমন এক রাজনীতির সূচনা করেছিলেন, যা ছিল মূলত তাঁর সমর্থকদের জন্য খোলামেলাভাবে রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ ও লুটপাটের এক স্বর্ণযুগ। তিনি ইউনিয়ন কাউন্সিলের মোট ৮০ হাজার চেয়ারম্যান ও মেম্বারের একটি গোষ্ঠীকে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মৌলিক গণতন্ত্রের সদস্য বা বিডি বেসিক ডেমোক্র্যাট মেম্বার। একই প্রক্রিয়ায় বিডি মেম্বাররা তাঁদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করতেন। ওয়ার্কস প্রোগ্রামের (বর্তমানের কাজের বিনিময়ে খাদ্য বা কাজের বিনিময়ে টাকা কর্মসূচি) মূল সুবিধাভোগী ছিলেন এবং সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন। তাঁরা কায়েমি স্বার্থবাদী একটি শ্রেণীতে পরিণত হয়েছিলেন। তদুপরি তারা ছিলেন পুরোপুরি আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে। এ কারণে আইয়ুব খানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া বা তাঁর দলীয় লোকজনের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে নির্বাচিত হওয়া কঠিন হতো না। জনগণের মঙ্গলার্থে এই ধারণার উৎপত্তি হয়নি। বরং এর উৎপত্তি হয়েছিল আইয়ুব খানের ক্ষমতাকে স্থায়ী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর জন্য, জনগণের কপালে যা-ই ঘটুক। সব স্বৈরাচারের সমস্যা এ রকমই। নিজেদের প্রভুত্ব টিকিয়ে রাখা তাঁদের স্বভাবজাত। তাঁরা কমবেশি সবাই একই ধারা অনুসরণ করেন। আইয়ুব খান তার ক্ষমতারোহণের প্রাক্কালে রাজনীতিবিদদের কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছিলেন এবং তাদের গায়ে কালিমা লেপন করেছিলেন। অথচ খুব তাড়াতাড়ি তিনি রাজনীতিবিদদের সহযোগী বনে গিয়েছিলেন অথবা রাজনৈতিক ক্ষমতা ভাগাভাগি করার ভান করেছিলেন। ফলে জন্ম নিয়েছিল তার নিজের রাজনৈতিক দল ‘কনভেনশন মুসলিম লীগ’। আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেছিলেন ‘বিশৃঙ্খলা দমন করা এবং দেশকে স্থিতিশীল ও সঠিক পথে পরিচালনার লোক দেখানো কারণে। কিন্তু কাজটি তিনি সম্পন্ন করতে পারেননি। বরং, তিনি নিজেই একের পর এক এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, যার মধ্যে বিশৃঙ্খলার বীজ নিহিত ছিল। তিনি দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিলেন, ফলে তাঁরই অনুগ্রহভাজন জেনারেল মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। অর্থনৈতিক বৈষম্য ১৯৪৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রফতানি বাণিজ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অবদান ছিল ৭০ শতাংশ। অন্য দিকে আমদানি বাণিজ্যে এ অঞ্চলের হিস্যার পরিমাণ ছিল মাত্র ২৫ শতাংশ। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের টেক্সটাইল মিল ছিল ১১টি এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ৯টি। ১৯৭১ সাল নাগাদ পূর্ব পাকিস্তানে টেক্সটাইল মিলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫৬টি এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ১৫০টি। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পারে যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে। এ উপলব্ধি থেকে প্রেসিডেন্ট আইউব খান তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ করেন এক হাজার ৬ শ’ কোটি রুপি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ করেন এক হাজার ৪শ কোটি রুপি। উভয় অংশের বৈষম্য দূরীকরণে সরকার কোট ব্যবস্থা চালু করে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগে পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য বরাদ্দ করা হয় ৪০ শতাংশ। ২০ শতাংশ ছিল মেধাভিত্তিক নিয়োগদানের জন্য বরাদ্দ। ১৯৬৭ সালে আইউব মেধাভিত্তিক কোটা প্রত্যাহার করেন এবং এ ২০ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ছেড়ে দেন। তবে দেরি করে ফেলায় তার এ উদ্যোগ সুফল বয়ে আনতে ব্যর্থ হয়। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামো ছিল অত্যন্ত নাজুক। এ দুর্দশা পাকিস্তানে যোগদানের আগেই ছিল। ঢাকা ছিল একটি মফস্বল শহরের মতো। কৃষকদের মেরুদন্ড ছিল ভাঙা। বৃহৎ পুঁজির মালিক একজনও ছিলেন না। শিল্প ও কলকারখানা ছিল না। কৃষি ছিল জীবিকার একমাত্র মাধ্যম। তাই পূর্ব বাংলার সংস্কৃতি বা কালচারকে ঠাট্টা করে বলা হতো এগ্রিকালচার। অন্য দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থা ছিল তুলনামূলকভাবে সচ্ছল। সেখানে প্রচুর ধনী লোক ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিল আদমজী, ইস্পাহানি, বাওয়ানী, দাউদ প্রভৃতি পরিবার। ২২টি পরিবারের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার ব্যাপক অসন্তোষ জন্ম নেয়। পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণপরিষদে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত ৪০ জনের মধ্যে ২৮ জন ছিলেন ভূস্বামী ও জমিদার। পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে ২০ জন ছিলেন আইনজীবী এবং ৯ জন ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাট, চা ও চামড়ার স্থান ছিল শীর্ষে। এ তিনটি উপকরণ উৎপাদিত হতো পূর্ব পাকিস্তানে। ডান্ডি ও মানচেস্টারে পাট রফতানি করা হতো। কিন্তু কৃষকরা পাটের ন্যায্য মূল্য পেতো না। তখনকার দিনে চাল ছিল মোটামুটি সস্তা। তবে পাকিস্তানের উভয় অংশে চালের দাম সমান ছিল না। তাই শ্লোগান উচ্চারিত হতো ২০ টাকা মণ দরে চাল চাই ১০ টাকা মণ দরে গম। পাকিস্তান আমলের কিছু কিছু উন্নয়নকে অস্বীকার করা যাবে না। সেই আমলে পূর্ব পাকিস্তানে আদমজীসহ ৮৪টি জুটমিল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ব্রিটিশ আমলে পূর্ব বাংলায় পাট উৎপাদিত হলেও জুট মিলগুলো ছিল হুগলি ও কলকাতায়। ১৯৪৭ সালে বঙ্গদেশ বিভক্তকালে ১০৮টি জুটমিল, ১৮টি স্টিল মিল ও ১৬টি পেপার মিলের একটিও পূর্ব বাংলায় পায়নি। ৩৮৯টি কটন মিলের মধ্যে পূর্ববাংলা পেয়েছিল ৯টি, ১৬৬টি চিনিকলের মধ্যে ১০টি ও ১৯টি সিমেন্ট ফ্যাক্টরির মধ্যে ৩টি। পাকিস্তান আমলে প্রথম স্টিল মিল স্থপান করা হয় চট্টগ্রামে। গোটা পাকিস্তানে কোন সার কারখানা ছিল না। তিনটি সার কারখানা সব ক’টি স্থাপন করা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে। বঙ্গদেশ বিভক্তির সময় পূর্ব বাংলার প্রধান প্রধান কাপড় কলগুলোর মালিক ছিলেন হিন্দু। ঢাকেশ্বরী কটন মিলের মালিক চিরন বাবু সূর্য কুমার বসু এবং লক্ষ্মী নারায়ণ কটন মিলের মালিক ছিলেন জগন্নাথ কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক বাবু রমেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী। চিত্তরঞ্জন কটন মিলের মালিকও ছিলেন হিন্দু। ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলায় বসবাসকারী হিন্দুদের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ শতাংশ। অথচ ৮০ শতাংশ সম্পদের মালিক ছিল তারা। শহরাঞ্চলের অট্টালিকা ও সহায় সম্পত্তির ৮৫ শতাংশ ছিল হিন্দুদের দখলে। এক হাজার ২৯০টি হাইস্কুল এবং ৪৭টি কলেজ পরিচালিত হতো হিন্দুদের অর্থায়নে। করাচি রাজধানী করার ভুল সিদ্ধান্ত করাচিকে পাকিস্তানের রাজধানী করায় দুই অঞ্চলের মধ্যে মানসিক ব্যবধান প্রসারিত হয়। এই বন্দর নগরী রাজধানীর মর্যাদা পাওয়ায় সেখানে অফিস-আদালত, শিল্প ও কলকারখানা গড়ে উঠতে থকে। রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ করা পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তাদের মনে এমন একটি ক্ষোভ জন্ম নেয় যে, রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করলেও তারা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করতে পারেনি। ধীরে ধীরে এ ধারণাও জোরদার হয়ে ওঠে যে, পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে কলোনি ছাড়া আর কিছু মনে করে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকসংখ্যার আবাসস্থল পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা দেশের কেন্দ্রীয় রাজধানীর মর্যাদা পেলে ইতিহাস হতো অন্য রকম। তাতে কেবল পূর্ব পাকিস্তান তথা ঢাকার উন্নতি হতো তাই নয় পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিদ্যমান স্থায়ী অসন্তোষও দূর হতো। পূর্ব পাকিস্তানের আয়তন ছিল ৫৫ হাজার এবং পাশ্চিম পাকিস্তানের ৩ লাভ ১০ হাজার বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ও আয়তনে সামাঞ্জস্য না থাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রশ্নে দুটি অঞ্চলের মধ্যে দুটি পৃথক ধারণা জন্ম নেয়। জনসংখ্যায় সংখ্যালঘিষ্ঠ হলেও পাকিস্তান আয়তনে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় প্রায় ৫ গুণ বড় হওয়ায় তাদের মধ্যে একটি বিগ ব্রাদারসুলভ মনোভাব গড়ে ওঠে। এ মনোভাব থেকেই করাচিকে রাজধানী করা হয়। এ কারণে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পাকিস্তান বলতে পশ্চিম পাকিস্তানকে বুঝাতো। জাতীয় ঐক্য গঠনে ব্যর্থতা পাকিস্তানিরা একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে ব্যর্থ হয়। ভারত থেকে আগত শরণার্থীরা পাশ্চিম পাকিস্তানে চিহ্নিত হয় মুহাজির এবং পূর্ব বাংলায় বিহারি হিসেবে। অন্য দিকে পাকিস্তান থেকে যেসব হিন্দু শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তারা মূল ¯্রােতের ভারতীয়দের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। তাদেরকে আলাদা কোনো উপনাম দেয়া হয়নি। তাদেরকে আলাদা করে চেনার কোন উপায়ও ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানে মাথা গুনতি করে বলা যেতো কে জন্মগতভাবে পাকিস্তানি এবং কারা ভারত থেকে এসেছে। এ বিভক্তি একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিগঠনে অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে। ভারতে জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল পাকিস্তানের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। কিন্তু সে দেশে কোনো অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ভারতীয়দের মধ্যে ক্ষোভ জন্ম নেয়নি। অন্য দিকে পাকিস্তানে পাঞ্জাবিদের প্রতি বাঙালি এবং বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবি তথা গোটা পশ্চিম পাকিস্তানিদের ঘৃণা ছিল চরমে। পাকিস্তান মানেই ছিল পাঞ্জাব। পাকিস্তানি মানেই যেন ছিল পাঞ্জাবি। একটি অঞ্চলের বিরুদ্ধে আরেকটি অঞ্চলের ঘৃণা বিদ্বেষ থেকে দেশটি ভাঙনের পথে অগ্রসর হয়। পাকিস্তানের এক অঞ্চলের ভাষার সঙ্গে আরেক অঞ্চলের অমিল থাকায় তারা একে অন্যকে পৃথক জাতি হিসেবে দেখতে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানিরা তাদের নিজস্ব ভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের আশা করতো। কিন্তু দেশের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহ তার বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, ÔUrdu and alone Urdu shall be the state language of Pakistan.’ জিন্নাহর কাছ থেকে বাঙালিরা এ ধরনের উক্তি আশা করেনি। এ ক্ষোভ বিন্দু থেকে সিন্ধুতে পরিণত হয়। পূর্ববঙ্গের জনগণ তাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানে জীবন বাজি রেখে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেও বাংলা ভাষার অন্যতম অংশীদার পশ্চিমবঙ্গ ছিল নীরব। যেখানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদানে রক্ত দেয়া তো দূরে থাক, কোথাও কোন সমাবেশ অথবা একটি ক্ষুদ্র মিছিলও বের হওয়ার কথা শোনা যায়নি। পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর হিসাব ছিল ভিন্ন। ভারতের সম্মিলিত জনসংখ্যার ক্ষুদ্রাংশ হওয়ায় এবং ভারতের হিন্দু ঘেঁষা জাতীয়তাবাদের প্রতি অবিচল বিশ্বাস থাকায় দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষাভাষী হয়েও তারা ভাষার মতো স্থানীয় ইস্যু নিয়ে মাথা ঘামায়নি। সামরিক শাসন পর পর দু’টি সামরিক অভ্যুত্থান ছিল রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের পতনের অন্যতম কারণ। সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের নামমাত্র প্রতিনিধিত্ব থাকায় সামরিক শাসন ছিল পূর্ব পাকিস্তানিদের কাছে একটি আতঙ্ক। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে ¯œায়ুযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করা হাতের মোয়ায় পরিণত হয়। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ হিসেবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়ায় ১৯৫৮ সারের ২৭ অক্টোবর সিইনসি জেনারেল মোহাম্মদ আইউব খান রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দল করেন। তার ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের ১১ বছরের সংসদীয় গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটে এবং দেশে সামরিক শাসনের যুগ শুরু হয়। রাজনীতিকদের তিনি হেয় দৃষ্টিতে দেখতেন। ক্ষমতার দাপটে সামরিক বাহিনীর অফিসাররা বেসামরিক লোকজনকে ‘ব্লাডি সিভিলিয়ানস’ হিসেবে গালি দিতেন। সামরিক বাহিনীর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের একটি মনোভাব কাজ করতে থাকে। জনগণের সঙ্গে তাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। দেশ শাসনে অংশীদারিত্ব না থাকায় সামরিক বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের অশ্রদ্ধা ও ঘৃণার সঞ্চার হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ প্রেসিডেন্ট জেনারেল মোহাম্মদ আইউব খানকে পাকিস্তান ভাঙনের জন্য দায়ী করছেন। তারা বলছেন যে, তিনি পাকিস্তানে প্রথমে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল না করলে ইয়াহিয়া খান তার পদাঙ্ক অনুসরণ করার সাহস পেতেন না। রাজনৈতিক সমস্যা রাজনীতিবিদরা সমাধান করার সুযোগ পেতেন এবং গণতান্ত্রিক শাসন সমুন্নত থাকতো। গণতান্ত্রিক শাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে অস্বীকার করায় পাকিস্তান ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গেছে। হামদুর রহমান কমিশন একাত্তর সালের বিপর্যয়ের জন্য ইয়াহিয়া খানকে যতটা অভিযুক্ত করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছে প্রেসিডেন্ট আইউব খানকে। কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়, তার আমলেই পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর নৈতিক পদস্খলন ঘটে এবং তারা দেশ রক্ষার চেয়ে রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে বেশি। তাতে সশস্ত্র বাহিনীর পোশাদারিত্ব মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ হয়। পাকিস্তানের ভাঙনের জন্য অধিকাংশ পাকিস্তানি লেখক আইউব খানের নীতিকে দায়ী করেছেন বেশি। ইয়াসমিন নিয়াজ মহিউদ্দিন তার ‘পাকিস্তান : অ্যা গ্লোবাল স্টাডিজ হ্যান্ডবুক’ শিরোনামে একটি পুস্তকের ১৬৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,  Ayub’s policies aso led to the ultimate split of Pakistan. Dissatisfaction with Ayub’s government was strongest in East Pakistan, though West Pakistan soon followed suit. The East Pakistani’s who had strongly supported Mohammad Ali Jinnah’s dream of a separate Muslim state, found that despite being the majority, they were poorly represented in positions of economic and political power. In a government where military and bureaucracy were very important, the East Pakistanis fared poorly since only 5 percent of the army officers and less than a third of civil servants were East Pakistanis.’ অর্থাৎ ‘আইউবের নীতিমালা চূড়ান্তভাবে পাকিস্তানের ব্যবচ্ছেদ ঘটায়। আইউব সরকারের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষোভ ছিল গভীর এবং শিগগির পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাদের অনুসরণ করে। পূর্ব পাকিস্তানিরা একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র কায়েমে জিন্নাহর স্বপ্নকে বলিষ্ঠভাবে সমর্থন করেছিল। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক অবস্থানের তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল অত্যন্ত নগণ্য। সামরিক বাহিনী ও আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত একটি সরকারের আওতায় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের ৫ শতাংশ এবং সিভিল সার্ভিসে এক-তৃতীয়াংশের চেয়ে কম ছিল পূর্ব পাকিস্তানি।’ সশস্ত্র বাহিনীতে বৈষম্য পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীতে প্রতিনিধিত্ব নগণ্য হওয়ায় বাঙালিদের ক্ষোভ ধূমায়িত হতে থাকে। সামরিক বাহিনীতে ভর্তির ব্যাপারে বাঙালিদের প্রতি উপেক্ষার সূচনা হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। উপমহাদেশ বিভক্তিকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালি মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র এক শতাংশ। পলাশীর যুদ্ধে বাঙালিরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করায় এবং ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহে জড়িত থাকায় ব্রিটিশরা বাঙালি বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের বিশ্বাস করতো না। পাকিস্তান আমলে সশস্ত্র বাহিনীতে নিজেদের প্রতি বৈষম্যের অভিযোগ তুললেও বাঙালিরা সামরিক বাহিনীতে যোগদান করতে চাইতো না। মেজর আবদুল গনি ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রোজিমেন্ট গঠন করেন। ডিসেম্বরে গঠন করা হয় ইস্ট বেঙ্গল রোজিমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাটালিয়ন। ১৯৬৬ সালে কোয়েটায় ইন্সট্রাক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় বাংলাদেশের মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দু’টি বাঙালি ব্যাটালিয়ন গঠনে সহায়তা করেন। ১৯৫২ সালে ঢাকায় একটি ক্যাডেট স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। মাত্র ১৫ জন ছাত্র যোগ দেয়ায় এ ক্যাডেট স্কুল বন্ধ করে দিতে হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের ভর্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য ভর্তি স্থগিত রাখেন। কোট বৃদ্ধি পাওয়ায় পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙালি ক্যাডেটদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ১৯৭১ সাল নাগাদ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙালি ক্যাডেটদের সংখ্যা ৩০ শতাংশে উন্নীত হয়। কিন্তু তার আগে ১৯৬৫ সাল নাগাদ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙালি সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। কমান্ড পর্যায়ে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল খুব কম। অধিকাংশ ছিলেন টেকনিক্যাল ও প্রশাসনিক বিভাগে। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদর দফতর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের পাঠান অথবা পাঞ্জাবিদের মতো সামরিক জাতি হিসেবে বিবেচনা করতো না। এ ক্ষোভ দূর করার জন্যই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বাঙালিদের অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ার আরেকটি কারণ। যুদ্ধকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মেজর জেনারেল ছিলেন ১৭ জন। তাদের মধ্যে খাজা ওয়াসিউদ্দিন ছাড়া বাদবাকিরা ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। দূরদর্শী নেতৃত্বের ঘাটতি ষাটের দশকে বাংলার দুই অবিসংবাদিত নেতা শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু ছিল একটি অপূরণীয় ক্ষতি। তাদের মৃত্যুতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। শেরেবাংলা সাম্প্রদায়িক না হলেও তিনি অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেই অবহেলিত মুসলিম সমাজের উন্নতির প্রতি মনোযোগ দেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তার থাকায় তিনি মুসলমানদের শিক্ষার দ্বার খুলে দেয়ার সুযোগ পান। জমিদারি বিলুপ্তি ও প্রজাস্বত্ব আইন করে তিনি কৃষকদের মুক্তি দেন। মন্ত্রী হিসেবে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, তার কার্যক্রমে বাংলার দু’টি পরস্পর স্বার্থবিরোধী সম্প্রদায় খুশি হতে পারে না। তাই তিনি হিন্দু ও মুসলমানদের প্রতিক্রিয়ার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। হিন্দুরা খুশি হলে শেরেবাংলা বুঝতে পারতেন যে, তিনি মুসলমানদের কোন ক্ষতি করেছেন। আবার তাদেরকে দুঃখ ভারাক্রান্ত হতে দেখলে বুঝতেন, তিনি মুসলমানদের উপকার করেছেন। উপমহাদেশের মুসলিম রাজনীতিবিদরা এ মানদন্ডে নিজেদের কাজকর্মের বিচার করতেন। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের মুসলিম রাজনীতিবিদরা উপমহাদেশের ঐতিহাসিক বাস্তবতা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন। তাদের অদূরদর্শিতায় পাকিস্তানের রাজনীতি ভয়ঙ্কর সঙ্কটের দিকে ধাবিত হয়। চীন-ভারত যুদ্ধ : মার্কিন নীতি ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক দৃশ্যপটে গুণগত পরিবর্তন সূচিত করে। এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইউব খানকে উৎখাতের সিদ্ধান্ত নেয় মার্কিন প্রশাসন। পরিকল্পনা রচনার দায়িত্ব পড়ে সিআইএ-র ওপর। আইউব খান পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখল করেন ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে। অথচ দেখা গেল, এক সময় মার্কিন প্রশাসন তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আইউব খান বঞ্চিত হয়ে গেছেন মার্কিনি বন্ধুত্ব থেকে। কেন এ রকমটি ঘটে? চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধই আনে এই পরিবর্তন। অপরদিকে, যে ভারতকে একদা সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত মনে করা হতো ওই যুদ্ধ দৃশ্যত সেই ভারতকে সা¤্রাজ্যবাদের নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপুটে অধিকমাত্রায় ঠেলে দেয়। ভারতের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে আসে গুণগত পরিবর্তন। চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধের পর ভারতের ক্ষেত্রে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গিতে কতটা পরিবর্তন সূচিত হয়, তার দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত এভারেল হ্যারিম্যানের ভাষ্য থেকে। ১৯৬৩ সালের গোড়ার দিকে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি তার ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত এভারেল হ্যারিম্যানকে পাঠান ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওয়াহেরলাল নেহেরুর সমাজতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা নিতে। দিল্লিতে কয়েকদিন কাটানোর পর ওয়াশিংটন ফেরার পথে পালাম বিমানবন্দরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কমিউনিজমের বিস্তার রোধে পন্ডিত নেহেরুর সমাজতন্ত্র কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সমর্থন দিয়ে যাবে। চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে বিতর্কিত ম্যাকমোহন লাইন নিয়ে। ১৯৬২ সালের ১৩ অক্টোবর চীন ভারতকে কাশ্মির এলাকার লাদাখ সীমান্ত থেকে তার সৈন্য সরিয়ে নিতে বলে। ভারত চীনের এই দাবি অগ্রাহ্য করায় এক সপ্তাহ পর ২০ অক্টোবর দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনী সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ২০ নভেম্বরের মধ্যে কাশ্মিরের লাদাখ এলাকার দু’হাজার বর্গমাইল এবং তিব্বত সীমান্তের নেফা (উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকা) এলাকার দেড় হাজার বর্গমাইল ভারতীয় ভূখন্ড চীনের দখলে চলে আসে এবং ২১ নভেম্বর চীন একক যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে দখলীকৃত সমগ্র এলাকা থেকে সৈন্য অপসারণ করে ম্যাকমোহন লাইনের ওপারে চলে যায়। যুদ্ধ চলাকালীন ২৮ অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি এক চিঠিতে কমিউনিস্ট চীনকে রুখতে ভারতের সহায়তায় এগিয়ে আসতে অনুরোধ জানান আইউব খানকে। চিঠিতে প্রেসিডেন্ট কেনেডি কাশ্মির সমস্যাকে আঞ্চলিক সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, সমস্যার গুরুত্ব তিনি অনুধাবন করেন এবং বিষয়টিকে মোটেই হালকাভাবে নিচ্ছেন না। তবে এই মুহূর্তে চৈনিক আগ্রাসনকে রুখে দাঁড়ানোই মুখ্য বিষয়। তিনি বলেন, আগ্রাসন রোধে বাইরে থেকে ভারতের জন্য সাহায্য প্রেরণ করা যেতে পারে। কিন্তু আঞ্চলিক সহায়তা তার চেয়ে হবে অধিকতর কার্যকর। প্রেসিডেন্ট কেনেডি এই চিঠিতে চীনের বিরুদ্ধে প্রকারান্তরে পাকিস্তানকে ভারতের সঙ্গে এক শান্তি চুক্তিতে আসতে বলেন যা সামরিক চুক্তিরই নামান্তর। আইউব খান সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে মার্কিন প্রশাসন তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়। এ ঘটনার তিন বছর আগেই আইউব খান মার্কিন সরকারের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার কারণে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নেন আইউব ১৯৫৯ সালে চীন-পাকিস্তান সীমান্ত চিহ্নিতকরণের মধ্য দিয়ে এ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এর বদলে পাকিস্তান জাতিসংঘের চীনের সদস্য পদ লাভের বিষয়টি সমর্থন করে। জাতিংঘের দরজা তখন চীনের জন্য ছিল রুদ্ধ এবং তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ-নীতির অন্যতম দিক ছিল কমিউনিস্ট চীনকে জাতিসংঘে ঢুকতে না দেয়া। চীনের পক্ষে এই ভূমিকায় আইউবের প্রতি বিশেষভাবে নাখোশ হন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কেননা, মার্কিনিদের শত্রু তালিকায় মাও সেতুং-এর চীন ছিল শীর্ষে এবং পাকিস্তান-চীন সীমান্ত চিহ্নিতকরণের পর থেকেই চীন দিনে দিনে হয়ে যায় পাকিস্তানের পয়লা নম্বরের বন্ধু। ওই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সকল কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল কমিউনিজমকে রোখা; দুই বৃহৎ কমিউনিস্ট রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের প্রভাব বলয়কে সংকুচিত করে তাদেরকে এক ঘরে করে রাখা। সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন সম্পর্কই ছিল না। ১৯৪৯ সালে মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর থেকে ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিকসনের নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারী, পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের সফরের আগ পর্যন্ত চীন নামক দেশটি ছিল মার্কিন প্রশাসনের কাছে একটি ‘নিষিদ্ধ দেশ’। অতএব, এহেন চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তানি প্রয়াসকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বভাবতই সুনজরে দেখতে পারে না। আর এই নিষিদ্ধ দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে যে ব্যক্তিটি বিশেষ তৎপরতা দেখাবেন, তিনিও একই কারণে মার্কিন প্রশাসনের কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষ তৎপরতা গ্রহণে আইউবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো মার্কিন প্রশাসনের কাছে বিরাগভাজন ব্যক্তিতে পরিণত হন। তাকে সরিয়ে দেয়ার চাপ প্রয়োগ করে তৎকালীন মার্কিন সরকার। কিন্তু আইউব খান মার্কিনি চাপ প্রতিহত করে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে স্বপদে বহাল রাখেন। এ বিষয়টিও তার সম্পর্কে মার্কিন প্রশাসনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। আর যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল মার্কিনিদের সুবাদে পাকিস্তানের ‘দুশমন’ তার প্রতিও আইউব খান বন্ধুত্বের হস্ত প্রসারিত করেন পাকিস্তানে সিআইএ-’র গোপন সামরিক ঘাঁটি তুলে দিয়ে। ষাট দশকের গোড়াতে পাকিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক অবিশ্বাস ও তিক্ততা পর্যায়ের। এ সময় পেশোয়ারের বাটাভের এলাকায় ছিল সিআইএ-’র গোপন সামরিক ঘাঁটি। এ ঘাঁটি থেকে সিআইএ ইউ-২ গোয়েন্দা বিমান পাঠায় সোভিয়েত অভ্যন্তরে। সোভিয়েত মিসাইল পাইলট গ্যারি পাওয়ারসহ ইউ-২ অপারেশন বিমান নামিয়ে আনে ভূমিতে এবং তৎকালীন রুশ প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুশ্চভ পাকিস্তানকে এই বলে হুঁশিয়ার করে দেন যে পেশোয়ারের ব্যাটাভের রুশ মিসাইলের নাগালের মধ্যেই আছে। অতএব, আইউবকে মার্কিনিদের নাখোশ করেই বাটাভেরের সিআইএ’র গোপন অপারেশন ঘাঁটি দিতে হয় বন্ধ করে। এ ঘটনার পরই আইউবকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মার্কিন প্রশাসন। আইউবের বিদেশনীতিতে সোভিয়েট ইউনিয়নের ব্যাপারে সূচিত হয় পরিবর্তনের ধারা। (চলবে)

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির