post

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস

মতিউর রহমান আকন্দ

০২ জানুয়ারি ২০১৭
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) এখানে প্রাসঙ্গিক কারণেই প্রশ্ন এসে যায় যে, মার্কিনিদের সহায়তায় ১৯৫৮ সালে আইয়ুব আসেন পাকিস্তানের শাসনক্ষমতায়, সেই আইয়ুব মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে অর্থাৎ ১৯৬১ সালের শুরু থেকেই তার মদদদানকারী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন কেন? পঞ্চাশ দশকের শেষপাদ থেকে পাকিস্তানের উদীয়মান ধনিক শ্রেণীর ভিত গড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু তার বিকাশের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় সামরাজ্যবাদী একচেটিয়া পুঁজি। পাকিস্তান তার উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য সা¤্রাজ্যবাদী দেশগুলোকে তাদের বাজার উন্মুক্ত করে দেয়ার দাবি জানায়। উপরন্তু দ্রুত শিল্পায়নের জন্য অপরিহার্য যে ভারি শিল্প, তা গড়ে তোলার পদক্ষেপে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ওই সামরাজ্যবাদী লগ্নি পুঁজি। আইয়ুব খান যেহেতু পাকিস্তানের উদীয়মান ধনিক শ্রেণীর প্রতিনিধি, নিজ শ্রেণী স্বার্থেই সা¤্রাজ্যবাদের সঙ্গে সংঘাত তার অনিবার্য হয়ে ওঠে। আইয়ুব খানের ভাষায়, ‘যদি উন্নত দেশগুলো আমাদের সঙ্গে বাণিজ্য করতে না চায়, আমরা কী করবো? আমাদের বৈদেশিক পণ্যের চাহিদা মেটানো দূরে থাক, তাদের দেয়া ঋণ পরিশোধ করবো কিভাবে? প্রদত্ত ঋণের সুদই বা মেটাবো কী করে? এই পরস্পরবিরোধী স্বার্থ নিয়ে বিশ্বব্যাপী একটা বড় রকমের সংঘাত একদিন লেগেই যাবে। আমি মনে করি, পরিণামে ধনবাদী দেশগুলো একদিন দেখবে যে তারা একঘরে হয়ে গেছে। যদি তারা আমাদের জন্য তাদের বাজার উন্মুক্ত করে না দেয় তাদের শিল্পের কাঠামোগত দিকের তেমন পরিবর্তন না আনে, যাতে ছোট ছোট দেশগুলোর জন্য পণ্য উৎপাদনের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং তারা আংশিক প্রক্রিয়াজাত কম উন্নতমানের জিনিস তৈরি করতে পারে। .... দৃষ্টান্তস্বরূপ, আমেরিকানরা সবাই আশা করে এবং অনুমতি দিয়েছে যে পাকিস্তান তাদের দেশে বছরে ২৫ মিলিয়ন গজ কাপড় রফতানি করতে পারবে। এটা পরিমাণের দিক দিয়ে অতি নগণ্য এবং হাস্যকর পরিমাণও বটে। কাপড় পাকিস্তানের একটি অন্যতম প্রধান রফতানিযোগ্য পণ্য। অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে একই নীতিমালা প্রয়োগ করা হয়েছে। ... কয়েক বছর আগেও ব্রিটেনের সঙ্গে আমাদের কোন লেনদেন সমস্যা ছিল না। অথচ পাকিস্তান থেকে সুতা ও সুতি কাপড় আমদানির ওপর কোটা আরোপ করে। ১৯৬২ সালে বিষয়টি ব্রিটেনের কমনওয়েলথ সচিব মি. ডানকান স্যান্ডসের কাছে উত্থাপন করি। তিনি জানান, ম্যানচেস্টারের বস্ত্রশিল্প দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং সরকারকে ম্যাচেস্টারবাসীদের ভোটের কথা ভাবতে হয়েছে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী ম্যাকমিলানকে জানালে তিনি বলেন, ‘এই ভোটের ব্যবসার ধরনই আলাদা। আমরা তাদেরকে (ভোটার) উপেক্ষা করতে পারি না। ....তাহলে কেন আমরা শুধু ইউরোপ এবং আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যিক গিঁটে বাঁধা থাকব? যাদের সঙ্গে সম্ভব তাদের সাথেই বাণিজ্যিক বন্ধনে আবদ্ধ হবো এবং এমন ব্যবস্থা আমরা অবলম্বন করবো যাতে আমাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে তাদের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারি। ....এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ কারণে আমি আফ্রো-এশীয় দেশগুলোর দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছি। (মোহাম্মদ আইয়ুব খান : ফ্রেন্ডস নট মাস্টারস, পৃষ্ঠা-১৮৪-১৮৫) আফ্রো-এশীয় দেশসমূহের দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। আইয়ুব খান সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করলেও ওই মাসে সম্মেলন আর হতে পারেনি। সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলেও তার পক্ষে তাতে যোগদান করাও ছিল দুঃস্বপ্নের শামিল। কেননা, সম্মেলনের আগেই সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখে সিআইএ’র আঘাত আসে তার ওপর। সিআইএ’র সে আঘাত মোকাবেলায় তিনি তখন ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে। অনুষ্ঠেয় আফ্রো-এশীয় দ্বিতীয় সম্মেলনের ব্যাপারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান যে ভূমিকা নেন, তাতে তার ওপর মার্কিন প্রশাসনের আগ্রহ থাকার কারণ আর বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট থাকে না। এই সম্মেলনে মালয়েশিয়ার অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতায় দাঁড়িয়ে যান আইয়ুব খান। আর তার অন্তর্ভুক্তির পক্ষে নামেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত নেহেরু। ১৯৬৩ সালে তৎকালীন মালয় প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুর রহমানের মালয়েশিয়া ফেডারেশন গঠনে সারা ইন্দোনেশিয়া প্রচন্ড রোষে ফেটে পড়ে। ওই বছর আগস্ট মাসে মালয় এবং ব্রিটিশ সরকার সারাওয়াক ও উত্তর বোর্নিওর (সাবাহ) মালয় অংশ এবং ব্রিটিশ আশ্রিত অঞ্চল নিয়ে মালয়েশিয়া ফেডারেশন গঠনের পরিকল্পনা ঘোষণা করে। ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করে এই অভিযোগে যে, সেখানকার জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই ফেডারেশন গঠন করা হবে। ফলে ফেডারেশন গঠন পরিকল্পনা স্থগিত রাখা হয় এবং পরে জাতিসংঘ মহাসচিব প্রেরিত একটি মিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে মালয়েশিয়া ফেডারেশনের জন্ম হয় ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসে। ইন্দোনেশীয় প্রেসিডেন্ট সুকার্নো মালয়েশিয়া গঠনকে ওই এলাকার জনগণের বিরুদ্ধে একটি সা¤্রাজ্যবাদী চক্রান্ত বলে ঘোষণা করেন এবং ১৯৬৪ সালে মালয়েশিয়ার ভূখন্ডে নেমে যায় ইন্দোনেশীয় সৈন্য। সুকার্নোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর সুবান্দ্রিও একুশ লাখ সদস্য সংগ্রহ করেন ‘ক্রাশ মালয়েশিয়া-মালয়েশিয়াকে খতম কর’ কার্যক্রমে। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদে মালয়েশিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করলে প্রেসিডেন্ট সুকার্নো জাতিসংঘ থেকে বেরিয়ে আসেন। ঘোষণা দেন, জাতিসংঘ সা¤্রাজ্যবাদীদের দাবার ঘুঁটি। তিনি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জাতিসংঘ গড়ে তোলার আহ্বান জানান এবং দ্বিতীয় আফ্রো-এশীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি কার্যক্রম হাতে নেন। ১৯৬৫ সালের জুলাই মাসে দ্বিতীয় আফ্রো-এশীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সকে সম্মেলন স্থান করা হয়। কিন্তু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কয়েক মাস আগে এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট বেন বেল্লাকে অপসারণ করে ক্ষমতায় আসেন হুয়ারি বুমেদিন। ফলে দ্বিতীয় আফ্রো-এশীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের বিষয়টি দোদুল্যমানতার মধ্যে নিপতিত হয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বুমেদিন সম্মেলন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে স্থির প্রতিজ্ঞ থাকেন। ওই বছর জুলাইয়ের পরিবর্তে সেপ্টেম্বর মাসে সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সম্মেলনে সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তির সমর্থন এবং মালয়েশিয়ার অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতার সিদ্ধান্ত নেন আইয়ুব। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু নেন উল্টো ভূমিকা। তিনি দাঁড়িয়ে যান মালয়েশিয়ার অন্তর্ভুক্তির সমর্থনে। ১৯৬৫ সালের ৩ এপ্রিলে মস্কো সফরে যান আইয়ুব খান। সেখান থেকে সরাসরি ওয়াশিংটন সফরের পরিকল্পনা ছিল তার। আইয়ুব ওই সফরের মাধ্যমে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসতে চেয়েছিলেন। তার ওই সফর পরিকল্পনাকে অত্যন্ত ‘অভদ্রোচিতভাবে’ প্রত্যাখ্যান করে তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন। প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন জানিয়ে দেন যে আইয়ুব খানকে ওয়াশিংটনে অভ্যর্থনা জানানো হবে না। অতএব, এটা পরিষ্কার যে ওয়শিংটনের কাছে আইয়ুবের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায় অনেক আগেই এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তিতে পরিণত হওয়ার মুহূর্ত থেকেই আইয়ুবের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। মার্কিন প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় আইয়ুবকে ‘যেতে হবে’। সিদ্ধান্ত মোতাবেক আইয়ুব উৎখাতের পরিকল্পনা তৈরিতে নেমে পড়ে সিআইএ। তারা দুটো পদ্ধতি অবলম্বন করে- একটি সামরিক, অপরটি রাজনৈতিক চাপ। সামরিক চাপ ব্যর্থ হলে শুরু করা হবে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির প্রক্রিয়া। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধই হচ্ছে সিআইএ-’র সামরিক চাপ আর ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে অনুষ্ঠিত ডানপন্থী পাঁচ দলীয় জাতীয় সম্মেলনের লিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান উত্থাপিত ছয় দফা প্রস্তাব সেই রাজনৈতিক চাপ। আইয়ুবের ওপর মার্কিন প্রশাসন তথা সিআইএ’র যে চাপ আসছে, পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা তা জানতে পায় এমন সময় যখন আইয়ুবকে নেমে পড়তে হয় যুদ্ধের ময়দানে সিআইএ পরিকল্পিত বাইরের চাপ মোকাবেলায়। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এ তথ্য জানতে পায় হল্যান্ডে তাদের এক বিশ্বস্ত সূত্রের মাধ্যমে। ওই সূত্রটি হচ্ছে হল্যান্ডে তৎকালীন পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত কুদরত উল্লাহ শেহাব। এর আগে তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষাসচিব। এই ব্যক্তি চীনের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন বলে আইয়ুবকে মার্কিন চাপে তাকে প্রশাসন থেকে সরাতে হয় এবং হল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হয়। রাষ্ট্রদূত শেহাবের সঙ্গে ন্যাটোর (উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা) এক পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা, যিনি ছিলেন জেনারেলের পদমর্যাদাসম্পন্ন, তার সঙ্গে ছিল বন্ধুত্ব। ন্যাটোর ওই জেনারেল ছিলেন হল্যান্ডের অধিবাসী। তিনি পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতকে জানান যে চলতি বছর (১৯৬৫) সেপ্টেম্বর মাসে এশিয়ার দুটো দেশ ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানে সিআইএ আঘাত হানতে যাচ্ছে। পাকিস্তানের ব্যাপারে তিনি শুধু এইটুকুই বলতে পারেন যে আইয়ুব উৎখাতে ব্যর্থ হলে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের প্রক্রিয়ায় নামা হবে এবং সে চাপ পূর্ব পাকিস্তান থেকেই শুরু করা হতে পারে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধই সেই সামরিক চাপ আর পূর্ব পাকিস্তান থেকে উত্থাপিত ছয় দফা প্রস্তাব অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সেই রাজনৈতিক চাপ। ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা ১৯৬২ সালের চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধে আইয়ুব খানের ভূমিকায় পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে ভারত। পাকিস্তানকে দুর্বল করার লক্ষ্যে সে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত করার পরিকল্পনা নেয়। ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার ওপর সে পরিকল্পনা তৈরির দায়িত্ব অর্পিত হয়। ১৯৬২ সালে তৎকালীন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (Director of Intelligence Bureau: D.I.B) জানতে পায় যে কলকাতার ভবানীপুর এলাকার একটি বাড়িতে, যা ছিল ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার অপারেশনাল সদর দফতর, সেখানে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামে একটি গোপন সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। তার উদ্দেশ্য, পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রে পরিণত করা। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এও জানতে পায় যে চিত্তরঞ্জন সুতার ও কালিদাস বৈদ্য নামক দুই পাকিস্তানি নাগরিকের সঙ্গে এই গোপন সংগঠনের যোগাযোগ রয়েছে। তাদেরকে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট বলে মনে করতো। গোয়েন্দা সংস্থা আরো জানতে পায়, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামক সংগঠনটি সংখ্যালঘিষ্ঠ এলাকায় বিশেষ করে ফরিদপুরের সংখ্যালঘিষ্ঠ অঞ্চলে তৎপর রয়েছে। ছাত্রদের মধ্যে ওই সংগঠনটি কিভাবে এবং কী পরিমাণে জড়িত ছিল, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সেটা আবিষ্কার করতে পারেনি। পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা জানতে পারেনি ঠিকই, তবে ওই সময়ই ছাত্রদের মধ্যে ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার অনুপ্রবেশ ঘটে যায় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের দাবি সংবলিত লিফলেট ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা তার গোপন সংগঠন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের মাধ্যমে বিলি করে। ১৯৬৮ সালে ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে পুনর্গঠিত করা হয় এবং নামকরণ করা হয় ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং সংক্ষেপে ‘র’ (Research and Analyses Wing : Raw) গঠিত হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানে পূর্বতন ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সৃষ্ট স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ ছাত্রদের মধ্যে অধিক মাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র ও ছয় দফা কর্মসূচি মৌলিক গণতন্ত্রপদ্ধতির অধীনে পাকিস্তানে সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন Cambined Opposition Party (COP)সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী মিস ফাতেমা জিন্নাহকে পরাজিত করে ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালের প্রথম দিকে মৌলিক গণতন্ত্রীদের দ্বারা তথাকথিত গণভোট (‘হ্যাঁ-না’ ভোট অনুষ্ঠান করে আইয়ুব খান ১৯৬৫-এর পূর্বের মেয়াদের পাঁচ বছরের জন্য তাঁর শাসনকে জায়েজ করেছিলেন। ইতঃপূর্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি পদে আসীন থাকাকালীন ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর তিনি পাকিস্তানব্যাপী সামরিক আইন জারি করে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেছিলেন। তখন ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২৮ অক্টোবর অর্থাৎ ২২ দিনের মধ্যেই ইস্কাদার মির্জাকে দেশত্যাগে বাধ্য করে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক দুটি পদেই অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ৭ অক্টোবর ১৯৫৮ আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে পাকিস্তানে তাঁর ভাষায় Revolution বা ‘বিপ্লব’ ঘটিয়েছিল। সেনাবাহিনী প্রধানের দেবোর ক্ষমতা গ্রহণ ‘বিপ্লব’-এর সংজ্ঞায় না পড়লেও তাঁর এহেন গর্হিত কাজকে মহিমান্বিত করার জন্য তিনি Revolution বা বিপ্লব শব্দ ব্যবহার করে তাঁর ক্ষমতা গ্রহণকে বৈধ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। সেই সুবাদে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর থেকে তথাকথিত গণভোট বা আস্থাভোট অনুষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত তাঁর ক্ষমতায় থাকাকেও তিনি বৈধ (?) করে নিয়েছিলেন। তিনি যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন তাঁর সামরিক পদ ছিল ‘জেনারেল’। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিজেকে এক ধাপ পদোন্নতি দিয়ে ‘ফিল্ড মার্শাল’ পদ গ্রহণ করেন। যে জেনারেল যুদ্ধের সময় এক বা একাধিক ‘আর্মি’ সফলতার সঙ্গে কমান্ড করেন, সাধারণত তাঁকে ‘ফিল্ড মার্শাল’ পদে উন্নীত করা হয়। আইয়ুব খানের ‘ফিল্ড মার্শাল’ হওয়ার বিষয়টি এ রকম মনে হয়েছিল, জনপ্রতিনিধিদের হাত থেকে ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে আইয়ুব খানের নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ পরিচালনা করে জয়লাভ করেছিল। ১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রচারাভিযানের সময় পাকিস্তানের উভয় অংশে অনুষ্ঠিত জনসভা ও পথসভাগুলোতে মিস জিন্নাহ আইয়ুব খানের চেয়ে অধিকসংখ্যক মানুষকে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং তাঁর প্রতিই ছিল বেশির ভাগ জনগণের আস্থা। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে জনগণের কোনো ভূমিকাই ছিল না। কেননা ভোটাধিকার সীমাবদ্ধ ছিল পাকিস্তানের দুই অংশ থেকে ৪০ হাজার করে মোট ৮০ হাজার তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রী বা Basic Democrats-দের (BD Members) নিয়ে গঠিত নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদেরকে আইয়ুব খান ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’-এর ভিত্তিতে যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা সত্ত্বেও আইয়ুব খান নির্বাচনে বিরাট ব্যবধানে পরাজিত হতেন। এমনকি মৌলিক গণতন্ত্র পদ্ধতির অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও মিস ফাতেমা। জিন্নাহর সঙ্গে তাঁর প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান খুব বেশি ছিল না এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ভোটের ব্যবধান খুবই সামান্য ছিল। ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি মৌলিক গণতন্ত্রীদের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে আইয়ুব খান পুনরায় শাসনক্ষমতায় আসীন হন। আইয়ুব খানের গোপনে চীন সফর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ১৯৬৫ সালের ১৯-২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যবর্তী রাতে চীন সফরে যান। তিনি এত গোপনে চীন সফরে গিয়েছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের নিরাপত্তা রক্ষীরাও টের পায়নি। পরিচালক যথারীতি প্রেসিডেন্টের বেডরুমে চা নিয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুট্টো চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে চৌ এন লাই ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তানকে সর্বাত্মক সহায়তা দানের প্রতিশ্রুতি দেন। চীনের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, তুরস্ক ও জর্দানের মতো মুসলিম দেশগুলোর সমর্থনের সঙ্গে চীনের সমর্থন যোগ হওয়ায় যুদ্ধে পাকিস্তান বিজয়ের শিরোপা পরিধান করবে। এ ক্ষোভ থেকে তিনি আইউবের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। যুদ্ধবিরতি ২২ সেপ্টেম্বর দু’টি দেশকে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। পরদিন যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে মধ্যস্থতা করে। তাসখন্দ বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সৈন্য প্রত্যাহারে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ১৯৬৬ সালে স্বাক্ষরিত এ চুক্তিতে দু’টি দেশ ১৯৬৫ সালের আগস্ট নাগাদ বিদ্যমান সীমান্তে সৈন্য প্রত্যাহারে সম্মত হয়। সরকারি দাবি এবং পাকিস্তানি মিডিয়ার খবরে কান দিয়ে কট্টরপন্থী ও আনাড়ি পাকিস্তানিরা বিশ্বাস করতো যে, তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সামরিক বিজয় বিসর্জন দিয়েছে। পাকিস্তানের পত্র-পত্রিকার খবরে এমন ধারণা প্রচার করা হয়েছিল যে, তাদের সামরিক বাহিনী যুদ্ধে অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাসখন্দ চুক্তিকে পাকিস্তানে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়ার একটি চুক্তি বলে মনে করা হয়। যুদ্ধের ফলাফলে ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ ১৭ দিন স্থায়ী মাঝারি আকারের হলেও তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। তাসখন্দ চুক্তির শর্তানুযায়ী দু’টি দেশ তাদের ব্যবহৃত ভূখন্ড ফেরত পায়। যদিও এ চুক্তিকে পাকিস্তান ও বাদবাকি বিশ্বে একটি অচলাবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ এমন কিছু ঘটনার জন্ম দেয় যা উপমহাদেশের ভাগ্য নির্ধারণ করেছে। যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় ভারতে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ভারতের তুলনায় পাকিস্তানের ক্ষতির পরিমাণ ছিল বেশি। বহু সামরিক ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে, হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে এবং অস্ত্র সরবরাহ হ্রাস পেলে পাকিস্তান অনিবার্যভাবে পরাজিত হতো। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির ভারতীয় সিদ্ধান্তে সে দেশের জনগণের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ জন্ম নেয়। ভারতীয়রা বিশ্বাস করতো যে, যুদ্ধে তারা বিজয়ের পথে ছিল। ভারত ও পাকিস্তান উভয়ে তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধি করে এবং উপমহাদেশে স্নায়ুযুদ্ধের বীজ উপ্ত হয়। কয়েকটি ঘাটতি পূরণে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেমের উন্নয়ন ঘটানো হয়। এ প্রচেষ্টার মূলে ছিল গোয়েন্দা তথ্য লাভের সীমাবদ্ধতা দূর করা। ভারত বৈদেশিক গুপ্তচরবৃত্তির জন্য রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং ‘র’ গঠন করে। যুদ্ধকালে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে ভারত পক্ষপাতমূলক হিসেবে বিবেচনা করেছিল। ভারত মনে করতো, যুদ্ধ শুরু করেছে পাকিস্তান। কিন্তু ওয়াশিংটন দেশটিকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে কিছুই করেনি। ভারত ধীরে ধীরে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সামরিক ও রাজনৈতিক মিত্রতা গড়ে তোলে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ববর্তী বছরগুলোয় এ সম্পর্ক জোরদার হতে থাকে। ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের তুলনায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে ভারতের জন্য একটি রাজনৈতিক ও কৌশলগত বিজয় হিসেবে দেখা হয় এবং প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে একজন বীর হিসেবে সম্মান দেখানো হয়। পাকিস্তানিদের প্রতিক্রিয়া অধিকাংশ পাকিস্তিানি যুদ্ধে তাদের সেনাবাহিনীর তৎপরতাকে প্রশংসার চোখে দেখতো। শিয়ালকোটে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাফল্যের স্মারক হিসেবে ৬ সেপ্টেম্বরকে পাকিস্তানে জাতীয় প্রতিরক্ষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। স্থলবাহিনীর ভূমিকার তুলনায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল। গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বীরত্ব সম্পর্কে প্রচারিত অতি কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করতো যে, সামরিক জাতির সন্তান পাকিস্তানি সৈন্যরা যুদ্ধে ভারতকে পরাজিত করতে সক্ষম। কিন্তু বাস্তবে তা ভুল প্রমাণিত হওয়ায় পাকিস্তানি লেখকগণ সেনাবাহিনীর কঠোর সমালোচনা করতে থাকেন। পাকিস্তান ভূখন্ড দখল করেছিল যতটুকু খুইয়েছিল তার চেয়ে বেশি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো পাকিস্তান কাশ্মির দখলের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকগণ কাশ্মির দখলের ব্যর্থতাকে পাকিস্তানের জন্য একটি পরাজয় হিসেবে দেখছেন। বহু পাকিস্তানি পদস্থ কর্মকর্তা ও সামরিক বিশেষজ্ঞ অপারেশন জিব্রাল্টারের পরিকল্পনায় ত্রুটির সমালোচনা করেছেন। অপারেশন জিব্রাল্টার থেকেই যুদ্ধের সূচনা হয়। তাসখন্দ ঘোষণাকে পাকিস্তানে একটি দুর্বল চুক্তি হিসেবে দেখা হয়। খুব কম পাকিস্তানিই যুদ্ধের পর বিরাজিত পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিল। পাকিস্তানের তদানীন্তন পররাষ্টমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর পরামর্শে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান দেশবাসীর মাঝে সশস্ত্র বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে একটি আশাবাদ জাগিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধে সামরিক লক্ষ্য অর্জনে পাকিস্তানের ব্যর্থতা প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের জন্য একটি রাজনৈতিক দায় হয়ে দাঁড়ায় কাশ্মির দখলে ব্যর্থতার পটভূমিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অজেয় ভাবমূর্তির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বিরোধিতার জন্ম নেয়। ষাটের দশকের শুরুতে পাকিস্তানের অর্থনীতিতে দ্রুত অগ্রগতি ঘটছিল। কিন্তু যুদ্ধে এ অগ্রগতি ব্যাহত হলে একটি বিশাল আর্থিক বোঝা দেশটির ঘাড়ে চেপে বসে। সহায়তা না দেয়ায় পাকিস্তান তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চরম অসন্তুষ্ট হয়। যুদ্ধের পর পাকিস্তান ক্রমাগত সামরিক সহায়তা ও রাজনৈতিক সমর্থনের একটি বিশ্বস্ত সূত্র হিসেবে চীনের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। অনেকেই বলছেন যে, ভুট্টোর পরামর্শে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছিলেন। ভুট্টো ছিলেন ভারতবিদ্বেষী। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির নিয়ন্তা ছিলেন তিনি। ভুট্টো প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে ধারণা দিয়েছিলেন যে, কাশ্মিরের বাইরে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে না এবং পাকিস্তান জয়লাভ করবে। কিন্তু তার কোনো কথাই সত্যি হয়নি। ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের একটি শান্তি চুক্তি হয়। ৪ জানুয়ারি দু’দেশের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। ১০ জানুয়ারি তাসখন্দ ঘোষণা দেয়া হয়। ঘোষণায় বলা হয় (১) পাকিস্তানি ও ভারতীয সৈন্যদের যুদ্ধ-পূর্ববর্তী অবস্থানে প্রত্যাহার করতে হবে। (২) উভয় দেশ একে অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে। (৩) দু’টি দেশ অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে। (৪) দু’নেতা দু’দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় কাজ করবেন। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের পরই পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুট্টোও ছিলেন। কিন্তু তিনি দেশে ফিরে তাসখন্দ চুক্তির বিরোধিতা করতে থাকেন। পরে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে ইস্তফা দেন। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান পিপলস পার্টি গঠন করে সারা দেশে তোলপাড় করে ফেলেন। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত তাসখন্দ চুক্তির প্রতি সমর্থন জানান। তবে তিনি যুদ্ধকে ভুল হিসেবে আখ্যায়িত করেন। অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরের পরদিন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন। তার পরলোকগমনের মধ্য দিয়ে কার্যত তাসখন্দ চুক্তি অকার্যকর হয়ে যায়। (চলবে)

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির