post

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস

মতিউর রহমান আকন্দ

০৯ জুন ২০১৬
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) ১৯ জুন ১৯৬৮ তারিখ বেলা ১১টার সময় বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা ট্রাইব্যুনাল কক্ষে তাঁদের আসন গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মনজুর কাদের সরকারপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি ছিলেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব যখন পাকিস্তানে সামরিক আইন বা মার্শাল ল জারি করেন এবং আইয়ুব খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠিত হয়, তখন মনজুর কাদের সেই মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন। নানা কারণে মনজুর কাদের বাঙালিদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন। সেই মনজুর কাদের যখন এই মামলায় সরকারপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি বা চিফ প্রসিকিউশন কাউন্সিলর নিযুক্ত হন, তখন আইয়ুব খানের হীন উদ্দেশ্য সম্পর্কে আর কোনো সংশয় থাকে না। মনজুর কাদের বিচারকার্যের সূচনা করেন। তিনি বিশেষ ট্রাইব্যুনালকে উদ্দেশ করে ৪২ পৃষ্ঠার মোট ১০০ অনুচ্ছেদের একটি অভিযোগনামা (স্টেইটমেন্ট অব দি কেইস বা কমপ্লেইন্ট) পাঠ করেন। তিনি যখন অভিযোগনামা বা কমপ্লেইন্ট পাঠ করছিলেন, তখন সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলির কথা মনে করে আমি কিছুটা রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম। বিশেষ করে ৫২, ৫৭ ও ৫৮ অনুচ্ছেদগুলো পাঠ করার সময় অনেক পুরোনো কথা আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল। উল্লিখিত অনুচ্ছেদগুলোতে আমার নিজের জড়িত থাকার কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। আমার বিরুদ্ধে আনীত মূল অভিযোগ সত্য ছিল। তবে ঘটনাবলির বিস্তারিত বিবরণে কিছুটা গরমিল ছিল। কোনো কোনো ঘটনায় বা সভায় আমি উপস্থিত থাকলেও অভিযোগনামায় তা উল্লেখ করা হয়নি। তবে অভিযোগনামা যেভাবে গঠন করা হয়েছিল, আমার বিরুদ্ধে আনীত মূল অভিযোগ প্রমাণ করতে তা যথেষ্ট ছিল। প্রতিটি ঘটনা বা সভায় অন্ততপক্ষে একজন সাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চিত করে অভিযোগনামা প্রস্তুত করা হয়েছিল এবং তা করতে প্রকৃত ঘটনাবলির কিছু কিছু বিকৃতি বা পরিবর্তন করা হয়েছিল। ৫২, ৫৭ ও ৫৮ অনুচ্ছেদগুলো ছাড়া অন্যান্য অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা ঘটনাবলি সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত কোনো ধারণা ছিল না বা ব্যক্তিগতভাবে আমি সে সম্পর্কে অবহিত ছিলাম না। কিন্তু বিভিন্ন সময় মামলার অন্যান্য অভিযুক্তদের সঙ্গে আলোচনা করে আমি নিশ্চিত হয়েছি, অভিযোগনামায় উল্লিখিত সব ঘটনা সঠিক ছিল। যদিও কিছু কিছু বিকৃতি বা অতিরঞ্জনও ছিল। ছোট ঘটনাকে বড় করে উল্লেখ বা প্রচার করা পাকিস্তানিদের কৌশল ছিল। যেমন, আমাদের একটি প্রতিনিধিদলের ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা গমন-সম্পর্কিত। অভিযুক্ত ৩ স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান এবং অভিযুক্ত ৩৩ মোহাম্মদ আলী রেজা আগরতলায় গিয়েছিলেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্ভাব্য অস্ত্র এবং অর্থ সরবরাহ সম্পর্কে তারা আলোচনা করতে গিয়েছিলেন বলে পাকিস্তানিরা অভিযোগ করেছিল। এ সম্পর্কে অভিযোগনামার ৮৩, ৮৪, ৮৫, ৮৬, ৮৭ ও ৮৮ অনুচ্ছেদ আইনের দৃষ্টিতে পাঠ করলে এবং ট্রাইব্যুনালের উত্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে শুধু আমাদের দুজন প্রতিনিধির আগরতলায় যাওয়া ছাড়া অন্য কিছুই প্রমাণিত হয় না। অথচ পাকিস্তানিরা এবং তাদের প্রচারমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে এত হইচই করেছিল যে, মামলাটি ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ বলে পরিচিতি লাভ করেছিল। যদিও মামলাটির রাষ্ট্রীয় নাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য’। আগরতলায় যাওয়ার পর সেখানে কাদের সঙ্গে অভিযুক্তদের কী আলোচনা হয়েছিল এবং সেই আলোচনার ফলাফল কী হয়েছিল, অভিযোগনামায় তার উল্লেখ ছিল না। ২৯ জুলাই ১৯৬৮ মামলার শুনানি পুনরায় শুরু হয়। স্যার থমাস উইলিয়ামস যথাসময়ে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হয়েছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রখ্যাত আইনজীবী জনাব মাহমুদ আলী কাসুরী এবং জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো (মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী) অভিযুক্তদের পক্ষে প্রতীকী অংশগ্রহণ করেছিলেন। শুরুতেই স্যার থমাস উইলিয়ামস মামলাটির শুনানির ক্ষেত্রে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করে যুক্তি উত্থাপন করলেন ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৮ পাকিস্তানের সংবিধানের সঙ্গে যা সাংঘর্ষিক ছিল এবং সে কারণে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা প্রচলিত আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই রায় দিয়ে দিলেন, তাঁরা ট্রাইব্যুনালের গঠন-প্রক্রিয়া বা বিচারিক কাজে ট্রাইব্যুনালের আইনগত সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন বা আপত্তি গ্রহণ করবেন না। অতঃপর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বিচারিক কাজ শুরু করেন। লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন (অভিযুক্ত ২) এবং অপর কয়েকজন অভিযুক্তের সঙ্গে ১৯৬৪ সালের প্রথম দিকে মোয়াজ্জেম হোসেনের করাচির বাসভবনে তাঁর একটি বৈঠকের উল্লেখ করে তিনি তাঁর সাক্ষ্য শুরু করেন। তিনি উল্লেখ করেন, সশন্ত্র পন্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবহিত করার উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিপ্লবী সংস্থার অন্যান্য সদস্যের সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত ওই বৈঠকে গৃহীত হয়। তিনি আরও সাক্ষ্য দেন, ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিপ্লবী সংস্থার কতিপয় সদস্যের বৈঠক হয়েছিল ১৯৬৪ সালের ১৫ থেকে ২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কামাল উদ্দীন আহমেদের করাচির বাসভবনে। ওই বৈঠকে লেফটেন্যান্ট মোজাম্মেল হোসেন এবং লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনসহ অপর কয়েকজন অভিযুক্ত উপস্থিত ছিলেন। লেফটেন্যান্ট মোজাম্মেল হোসেন আরও সাক্ষ্য দেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বৈঠকে উল্লেখ করেন, বিপ্লবী সংস্থার পরিকল্পনার সঙ্গে তাঁর নিজের চিন্তার মিল রয়েছে। লেফটেন্যান্ট মোজাম্মেল হোসেনের সাক্ষ্যমতে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে এবং সে জন্য প্রয়োজন সশস্ত্র বিপ্লব। বঙ্গবন্ধু তাঁর পক্ষ থেকে বিপ্লবী সংস্থার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যাবতীয় সাহায্য-সহযোগিতারও আশ্বাস দেন। মোজাম্মেল তাঁর সাক্ষ্যে আরও বলেন, ১৯৬৫ সালের ১৫ থেকে ২১ জানুয়ারির মধ্যে করাচিতে বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী সফরের সময় বিপ্লবী সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় করাচিতে লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের বাসায়। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু তাঁর পূর্বের আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেন এবং বিপ্লবী সংস্থার কর্মকান্ড বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। মোজাম্মেল একজন রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোডের ৩৩৭ ধারা মোতাবেক তাঁকে বা ক্ষমা করা হয়েছিল। সরকারপক্ষের প্রথম সাক্ষী লে. মোজাম্মেল হোসেন মোটামুটি ভালোভাবেই তাঁর সাক্ষ্য প্রদান করেছিলেন। সরকারের লক্ষ্য ছিল, মামলার শুরুতেই বঙ্গবন্ধুকে ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা এবং তাঁকে ১নং অভিযুক্ত হিসেবে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর যৌক্তিকতা প্রমাণ করা। যদিও পাকিস্তান সরকারের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ ছিল যে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার অনেক আগেই লে. কমান্ডার (তখন লে.) মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে পাকিস্তান নৌবাহিনীর একদল দেশপ্রেমিক বাঙালি সশস্ত্র পন্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য একটি বিপ্লবী সংস্থা গঠন করেছিলেন, কিন্তু অভিযোগনামায় সরকারপক্ষ বঙ্গবন্ধুর জড়িত হওয়ার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে মামলাটি সাজিয়েছিল। সরকারপক্ষের পরবর্তী সাক্ষী অর্থাৎ পিডব্লিউ-২ ছিলেন কামাল উদ্দিন আহমেদ। কামাল উদ্দিন আহমেদকে রাজসাক্ষী না করে করা হয়েছিল নিরপেক্ষ সাক্ষী বা আইনের ভাষায় Independent Witness। উদ্দেশ্য ছিল রাজসাক্ষী মোজাম্মেল হোসেনের সাক্ষ্যকে করোবোরেট করা বা নিরপেক্ষ সাক্ষ্য দ্বারা শক্তভাবে প্রমাণ করা। কারণ, শুধু রাজসাক্ষীর সাক্ষ্য দ্বারা কোনো অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা আইনের দৃষ্টিতে সঠিক নয়। কিন্তু সরকারপক্ষের পরিকল্পনা ভেস্তে গিয়েছিল। দুই নম্বর সাক্ষী কামাল উদ্দিন আহমেদের সাক্ষ্য সরকারপক্ষের অভিযোগের ভিত্তি ভেঙে অনেকাংশে চূরমার করে দিয়েছিল। কামাল উদ্দীন আহমেদ একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক ছিলেন। তিনি পরিকল্পিতভাবে ট্রাইব্যুনাল কক্ষে একটি নাটকের অবতারণা করেছিলেন। তাঁকে বলা হয়েছিল ১নং অভিযুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে Accused Dock-এর আইডেনটিফাই বা শনাক্ত করতে। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কামাল উদ্দীন আহমেদের দীর্ঘদিনের চেনাজানা ছিল এবং তিনি ছিলেন তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। কিন্তু কামাল উদ্দীন আহমেদ এ রকম ভান করলেন যে, তিনি বঙ্গবন্ধুকে কোনো দিনই দেখেননি। তিনি কয়েকবার Accused Dock-এর পাশ দিয়ে গেলেন, এলেন এবং শেষ পর্যন্ত নাটকীয়ভাবে অভিযুক্ত ১৭ সার্জেন্ট জহুরুল হককে দেখিয়ে বললেন, ‘ইনিই শেখ মুজিবুর রহমান’। একইভাবে তাঁকে যখন বলা হলো অভিযুক্ত ২ লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে শনাক্ত করতে, তিনি অভিযুক্ত ৬ আহম্মেদ ফজলুর রহমানকে দেখিয়ে দিলেন। এভাবে অভিযুক্ত ১০ রুহুল কুদ্দুসকে তিনি অভিযুক্ত ৬ আহম্মেদ ফজলুর রহমান হিসেবে এবং অভিযুক্ত ৮ এবিএম আব্দুস সামাদকে অভিযুক্ত ৫ নূর মোহাম্মদ হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন। সরকারপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি জনাব মনজুর কাদের সঙ্গে সঙ্গে জনাব কামাল উদ্দিন আহমেদকে Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী হিসেবে ঘোষণা করলেন। জনাব কামাল উদ্দীন আহমেদকে Cross Examine অর্থাৎ জেরা করার অনুমতিও জনাব মনজুর কাদের ট্রাইব্যুনালের কাছে চাইলেন। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল সঙ্গে সঙ্গে জনাব কামাল উদ্দিন আহমেদকে জেরা করার অনুমতি জনাব মনজুর কাদেরকে প্রদান করলেন। জনাব কামাল উদ্দিন আহমদে জেরার উত্তরে মামলার অভিযোগনামায় উল্লিখিত সব ঘটনা অস্বীকার করলেন এবং তাঁর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের লোমহর্ষক বিবরণ তুলে ধরলেন। জনাব কামাল উদ্দিন আহমেদ বিশেষ ট্রাইব্যুনালকে আরও বললেন, তাঁর মূল সাক্ষ্য বা Examination-in-Chief-এ তিনি যা বলেছেন তা সত্য নয়, সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং সরকারপক্ষের আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তারা ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে তাঁকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করেছেন। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবনন্দি দিতেও তদন্ত কর্মকর্তারা, বিশেষ করে মেজর হাসান তাঁকে বাধ্য করেছিলেন। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে কামাল উদ্দিন আহমেদের সাক্ষ্য বা বক্তব্য চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। অভিযুক্তদের পক্ষে ঘটনাটি বিজয়ের সূচনা করেছিল। মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের আইনজীবীর মুখে প্রথম হাসি দেখা গেল। তার চেয়ে বড় কথা হলো, রাজনৈতিকভাবে বিষয়টির তাৎপর্য ছিল অকল্পনীয়। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল থেকে দ্রুত বাইরে খবর চলে গেল এবং পরদিন পত্রিকান্তরে আরও গুরুত্বসহকারে খবরটি ছাপা হলো। এর পর থেকে দেশে-বিদেশে বাঙালিরা এই মামলা সম্পর্কে এবং ট্রাইব্যুনাল কক্ষের ঘটনাবলি ও কার্যবিবরণী সম্পর্কে আরও আগ্রহসহকারে জানার চেষ্টা করে। সরকারপক্ষের তৃতীয় সাক্ষী ছিলেন বিমানবাহিনীর সাবেক করপোরাল আমির হোসেন (পিডব্লিউ ৩)। তিনিও একজন রাজসাক্ষী ছিলেন, যাকে ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোডের ৩৩৭ ধারা মোতাবেক যথারীতি ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়। আমির হোসেন সরকারপক্ষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন। তাঁর সাক্ষ্যর ওপর সরকারপক্ষ তাদের অভিযোগ প্রমাণ করার ক্ষেত্রে দারুণভাবে নির্ভর করেছিল। প্রকৃতপক্ষে আমির হোসেন ছিলেন সরকারপক্ষের মূল সাক্ষী। তিনি সরকারপক্ষের অভিযোগ প্রমাণ করতে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য প্রদান করেন। তিনি সরকারপক্ষের নির্ভরযোগ্য সাক্ষী হিসেবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে শক্ত ভূমিকা পালন করেন। আমাদের আইনজীবীদের জেরার উত্তরে তিনি সদম্ভে সরকারপক্ষের বক্তব্য প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন। তিনি প্রকৃতপক্ষেই লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের (অভিযুক্ত ২) বিশ্বস্ত সহককর্মী ছিলেন। লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের আরেকজন বিশ্বস্ত সহকর্মী ছিলেন স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান (অভিযুক্ত ৩)। আমাদের বিপ্লবী সংস্থার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় সব কর্মকাণ্ড এই দুই ব্যক্তি জানতেন। কিন্তু অমানুষিক নির্যাতনের পরও স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান স্বীকারোক্তিমূলক জনাববন্দি দেননি। দুঃখের বিষয়, আমির হোসেন শেষ পর্যন্ত রাজসাক্ষী হতে সম্মত হয়েছিলেন। তিনি ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৬৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সব ঘটনা বিশ্বস্ততার সঙ্গে ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেন। করাচি, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে বিপ্লবী সংস্থার বিভিন্ন সভা এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বিবৃত করেন। ১৯৬৭ সালের নভেম্বর মাসে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আমির হোসেনের Examination-in-Chief-এ তিনি লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের স্বহস্তে লিখিত একটি ডায়েরি ট্রাইব্যুনালে প্রমাণ করেন। ডায়েরিটিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। আমির হোসেন সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে, তিনি লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন হস্তাক্ষর চেনেন এবং ডায়েরিটি লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের নিজের হাতে লেখা। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ডায়েরিতে কয়েকজন বিশিষ্ট অভিযুক্ত এবং সাক্ষীর সাংকেতিক নাম নেম্নোক্ত ভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছিল : নাম অভিযুক্ত/সাক্ষী নম্বর সাংকেতিক নাম : শেখ মুজিবুর রহমান অভিযুক্ত-১ পরশ লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন অভিযুক্ত-২ আলো আমির হোসেন পিডব্লিউ ৩ উল্কা লে. মোয়াজ্জেম হোসেন পিডব্লিউ ১ তুহিন সুলতান উদ্দীন আহমেদ অভিযুক্ত-৪ কামাল স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান অভিযুক্ত-৩ মুরাদ আহমেদ ফজলুর রহমান অভিযুক্ত-৬ তুষার নূর মোহাম্মদ অভিযুক্ত-৫ সবুজ রুহুল কুদ্দুস অভিযুক্ত-১০ শেখর জনাব আমির হোসেনের সাক্ষ্য সরকারপক্ষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমাদের আইনজীবীরা তাঁকে গুরুত্বের সঙ্গেই জেরা বা Cross examine করেন। আমাদের আইনজীবীদের মধ্যে প্রথম যিনি তাঁকে জেরা করেন, তিনি ছিলেন স্যার থমাস উইলিয়ামস। এরপর জেরা করেন জনাব আব্দুস সালাম খান। এই মামলায় সরকারপক্ষের মোট সাক্ষীর সংখ্যা ছিল ২৫১। এদের মধ্যে ১১ জন ছিলেন রাজসাক্ষী, যাদের ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোডের ৩৩৭ ধারা মোতাবেক ক্ষমা প্রদর্শন বা Pardon করা হয়েছিল। সর্বশেষ সাক্ষী বা সাক্ষী নম্বর ২৫১ সাক্ষ্য প্রদান করেন ১৯৬৯-এর ২৩ জানুয়ারি। মামলার বিবরণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চারজন রাজসাক্ষীর সরকারপক্ষে বা প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষ্য না দেওয়া, যদিও তাঁদের ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছিল এই শর্তে যে তাঁরা সরকারের পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন। কিন্তু সরকারি বন্দিশালায় থেকে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে তাঁরা সরকারের বিপক্ষে এবং অভিযুক্তদের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। তাঁদের নাম নিম্নরূপ : -জনাব কামাল উদ্দিন আহমেদ (পিডব্লিউ ২)। তাঁকে রাজসাক্ষী হিসেবে examine না করে নিরপেক্ষ সাক্ষী বা Independent Witness হিসেবে examine করা হয়েছিল। -জনাব এবিএম ইউসুফ (পিডব্লিউ ১০)। তিনি একজন রাজসাক্ষী ছিলেন। -জনাব আবুল হোসেন (পিডব্লিউ ২৫)। তাঁকেও নিরপেক্ষ সাক্ষী বা Independent Witness হিসেবে examine করা হয়েছিল। -জনাব বঙ্কিম চন্দ্র দত্ত (পিডব্লিউ ১৭০)। তাঁকেও নিরপেক্ষ সাক্ষী বা Independent Witness হিসেবে examine করা হয়েছিল। বিচারকার্য চলাকালীন একদিন আমাদের আইনজীবীদের অন্যতম ব্যারিস্টার কে. জেড. আলম ট্রাইব্যুনাল কক্ষের ভেতরে আমাদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করেন। তিনি আমাদের জানালেন যে, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার (বর্তমানে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার শুভবিবাহ সম্পন্ন হয়েছে এবং সে উপলক্ষে মিষ্টি বিতরণ করা হচ্ছে। বিবাহকার্যের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন শরীয়তপুর সদরের আলহাজ মাওলানা আব্দুর রব খান।” আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি সংবাদপত্রে বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়। মামলাকে কেন্দ্র করে ও স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের অগণতান্ত্রিক শাসনের অবসানের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠে। পাকিস্তানের উভয় অংশেই এ আন্দোলন গতিশীল হতে থাকে। ১৯৬৯ সালে এ আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। সকল রাজনৈতিক দল মিলে ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি গঠন করে। গ্রেফতার, মামলা, পুলিশের গুলি ও ছাত্রনেতৃবৃন্দের আত্মদানের মধ্য দিয়ে এ আন্দোলন সফলতা পায়। গণআন্দোলনের প্রচন্ডতার বিচার শেষ হওয়ার আগেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটি তুলে নেয়া হয়। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানসহ মামলার সকল আসামি মুক্তি লাভ করে। কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি রমনা রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ডিএসি (DAC) স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের উভয় অংশে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য ব্যাপক গ্রেফতার অভিযান চালানো হয়। এই গ্রেফতার অভিযানে পশ্চিম-পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোও গ্রেফতারের শিকার হন। তার গ্রেফতার আন্দোলনকে নতুন গতি দান করে। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রাক্তন এয়ার মার্শাল আজগর খান এক ব্যক্তির শাসন অবসানের লক্ষ্যে গণআন্দোলনে যোগদান করেন। এসব ঘটনা পাকিস্তানে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নতুন পটভূমি রচনা করে। ১৯৬৯ সালের ৭ ও ৮ই জানুয়ারি ঢাকায় জনাব নুরুল আমিনের বাড়িতে দুই দিনব্যাপী বৈঠকে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগ-এর (৬ দফা) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের সভাপতি জনাব নুরুল আমিন, জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের তোফায়েল আহম্মদ, পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এর সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান-এর স্বাক্ষরে নিম্নলিখিত ৮ দফা দাবী আদায়ের উদ্দেশ্যে ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয় : -ফেডারেল পার্লামেন্টারি সরকার। -প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটাধিকার ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন। -অবিলম্বে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার। -নাগরিক স্বাধীনতার পুনর্বহাল ও সকল কালাকানুন বাতিল বিশেষত বিনাবিচারে আটক আইনসমূহ ও বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স বাতিল। -শেখ মুজিবুর রহমান, খান আবদুল ওয়ালী খান, জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ সকল রাজনৈতিক বন্দী ও ছাত্র-শ্রমিক-সাংবাদিক বন্দীদের মুক্তি এবং কোর্ট ও ট্রাইব্যুনাল সমীপে দায়েরকৃত সকল রাজনৈতিক মামলা সংক্রান্ত সকল গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার। -১৪৪ ধারা মোতাবেক সর্বপ্রকার আদেশ প্রত্যাহার। -শ্রমিকদের ধর্মঘট করার অধিকার বহাল। -নতুন ডিক্লারেশনসহ সংবাদপত্রের উপর আরোপিত সকল বিধি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং বাজেয়াপ্ত সকল প্রেস, পত্রিকা ও সাময়িকীর পুনঃবহাল অথবা ‘ইত্তেফাক’ ও চাত্তান’ সহ বাতিলকৃত ডিক্লারেশন পুনঃবহাল এবং আদত মালিকের নিকট প্রগ্রেসিভ পেপারস লিমিটেডকে পুনঃফেরত দান। (সূত্র : জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫- অলি আহাদ) Democratic Action Committee (DAC) এর কেন্দ্রীয় আহ্বায়কের দায়িত্ব পি. ডি. এম. সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান ও পূর্ব পাকিস্তানের আহ্বায়কের দায়িত্ব খোন্দকার মুশতাক আহমদের ওপর দেয়া হয়। এ জোটের আন্দোলনেও জামায়াতে ইসলামী পূর্বের মতোই বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। Democratic Action Committee (DAC) ১৭ জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে দেশব্যাপী দাবি দিবস পালনের আহবান জানায়। ঐ সময় অর্থাৎ ৭ ডিসেম্বর ১৯৬৮ সাল হতে ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা বলবৎ ছিল। Democratic Action Committee (DAC) এর কর্মসূচি চলাকালে ১৬ জানুয়ারি ১৯৬৯ সরকার যে কোন শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সরকারের নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে দাবি দিবস পালিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ এক ছাত্রসভার আয়োজন করে। বটতলার এ ছাত্রসভায় সরকার আরোপিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। সংগ্রামী ছাত্রসমাজ সরকারের বিধি-নিষেধের প্রাচীর ধূলিসাৎ করে স্বৈরাচারী শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর করে তোলে। তদানীন্তন ঢাকা শহরে গুরুত্বপূর্ণ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এ আন্দোলন পরিচালিত হয়। ক্রমশই রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসভার ডাক দেয়া হয়। এ সভা যাতে সফল না হতে পারে সেজন্য পুলিশ, ই,পি, আর বাহিনী ছাত্রদের আন্দোলনে বাধার সৃষ্টি করে। আন্দোলনরত ছাত্ররা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পুলিশ ছাত্রদের মিছিল লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ১.৫৫ মিনিটে ঢাকা সেন্ট্রাল ল’ কলেজের ছাত্র এ. এম. আসাদুজ্জামান মারাত্মকভাবে যখম হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে মুহূর্তেই সে নিহত হয়। তার নিহত হওয়ার সংবাদ সমগ্র ঢাকা শহরকে প্রকম্পিত করে তোলে। শহীদ আসাদের তপ্ত খুন সংগ্রামী ছাত্র আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত করে। শহীদ আসাদুজ্জামানের মৃতদেহ হস্তান্তর করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অস্বীকার করে। ১৯৬৯ সালের ২১ জানুয়ারি অপরাহ্ন ১টার সময় পল্টন ময়দানে এ. এম. আসাদুজ্জামানের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ জানাযায় ইসলামী ছাত্রসংঘের তদানীন্তন সভাপতি মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী উপস্থিত হন। পল্টন ময়দানের এ জানাযায় লক্ষাধিক মানুষ উপস্থিত হয়েছিল। আসাদ হত্যার প্রতিবাদে ২১ জানুয়ারি ১৯৬৯ ঢাকা শহরে সাধারণ হরতাল পালনের আহ্বান জানানো হয়। সেই সাথে ঘোষিত হয় তিন দিনের কর্মসূচি। গায়েবানা জানাজা শেষে পল্টন ময়দান থেকে ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করে বিশাল শোক মিছিল ঢাকা শহরের রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। শোক মিছিলে জুলফিকার আলী ভুট্টো যোগ দিয়েছিলেন। ছাত্র-আন্দোলন নতুন রূপ ধারণ করে। ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষিত হয়। পাকিস্তানের উভয় অংশে গড়ে উঠে সরকার বিরোধী আন্দোলন। Democratic Action Committee (DAC) ২১ জানুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ৮ দফার সমর্থনে, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী হরতাল পালনের আহ্বান জানায়। ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের মিছিল, সমাবেশ সরকারকে বেশামাল করে তোলে। ২৪ জানুয়ারি ১৯৬৯ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয় দশম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক, মকবুল ও রুস্তম আলীসহ ৪ জন এবং আহত হয় ১৫ জন। নিহতদের জানাযা পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়। জানাযা শেষে লাশ নিয়ে জনতার মিছিল এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। জনতার এই সংগ্রামকে দমন করার জন্য সেনাবাহিনী তলব করা হয়। রাত ৮টা থেকে ২৪ ঘণ্টার জন্য জারি করা হয় কারফিউ। ঢাকা থেকে বহির্গামী ট্রেন সার্ভিস, অভ্যন্তরীণ বিমান সার্ভিস ও ঢাকা-করাচি টেলিকমিউনিকেশন বাতিল হয়ে যায়। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্টি হয় অচলাবস্থা। ছাত্র-জনতার সুদৃঢ় আন্দোলনের ফলে সন্ত্রস্ত সরকার আন্দোলন দমনে বেপরোয়া হয়ে পড়ে। কারফিউ এর সময় ও এলাকা বর্ধিত করা হয়। কারফিউ লঙ্ঘন করে শ্রমিক সমাজ মিছিল বের করে। অত্যন্ত নির্মমভাবে সেনাবাহিনীর গুলিতে ২৫ জানুয়ারি তেজগাঁও চৌধুরী কেমিক্যালস ওয়ার্কস এর কর্মচারী জনাব ইসহাক এর সহধর্মিণী আনোয়ারা বেগম নিজের কন্যাসন্তানকে স্তন্য দান কালে মর্মান্তিক ভাবে নিহত হন। সেনাবাহিনীর বুলেটে প্রাণ হারায় তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র আব্দুল লতিফ। সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত হয় ১২ জন। ঢাকা, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ ও করাচিতে আন্দোলন প্রচন্ড রূপ ধারণ করে। এসব এলাকায় কারফিউ এর মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। করাচিতে স্বশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে ৬ জন শাহাদাত বরণ করে। পাকিস্তানের উভয় অংশে আন্দোলন দমনের জন্য সরকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নগ্নভাবে ব্যবহার করে। করাচি, লাহোর, পিন্ডি, পেশোয়ার, হায়দরাবাদ, কোয়েটা, ঢাকা, খুলনা, নারায়াণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিটি জনপদ গণবিদ্রোহের জোয়ারে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এ পরিস্থিতিতে ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান রাওয়াল পিন্ডি থেকে লাহোর বিমান বন্দরে অবতরণ করে সাংবাদিকদের নিকট প্রকাশ করেন যে, বর্তমান সমস্যাবলির সমাধানের উদ্দেশ্যে তিনি ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দের সাথে রাওয়ালপিন্ডিতে এক বৈঠকে মিলিত হবেন। সাংবাদিকদের তিনি জানান যে, ইতোমধ্যে বিভিন্ন নেতাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য তিনি বিরোধী দলীয় নেতা নওয়াবজাদা নাসরুল্লাহ খানকে অনুরোধ জানিয়েছেন। আইয়ুব খানের সেই পত্রটি ছিল নিম্নরূপ : Nawabzada Shahib In the Course of my brodcast onthe 1st of January 1969 I said that I along with my colleagues would like to have the first opportunity to meet the representatives of the opposition parties to mutually discus the political problems which are agitating the people’s mind & to seek their assistance in finding solution thereto . I am therefore, requesting you convenor of Democratic Action Committee to invite on my behalf whomsoever you like to attend a conference in Rawalpindi on the 17th of February, 1969 at 10 a.m. if this is suitable & convenient to you. I am suggesting this date because before that I expect to be in East Pakistan but I shall be avaiable to discuss any preliminaries in Dacca should that be considered necessary by you. I shall be very happy indeed if you & such representatives of the opposition parties as you may nominate would accept the invitation. I shall also be happy if you and your colleagues would stay in Rawalpindi as my guests during the conference. In view of the public interest in the matter I feel that communication should be made available to the press for publication at the earliest possible opportunity. I am sure you will have no objection to this. With kind regards, Yours sincerely, Signed: Field Marshall Mohammad Ayub Khan নওয়াবজাদা সাহেব ১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে আমি বলেছিলাম যে, আমি এবং আমার সহকর্মীবৃন্দ বিরোধীদলসমূহের প্রতিনিধিবৃন্দের সাথে প্রথম সুযোগেই জনগণের মনে বিরাজমান সমস্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা পূর্বক এইগুলি সমাধানে উপনীত হওয়ার জন্য মিলিত হতে চাই। ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটির আহবায়ক হিসেবে আপনাকে আমি এই মর্মে অনুরোধ জানিয়েছি যে, যদি আপনার নিকট উপযোগী বিবেচিত হয় তা হলে আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, সকাল ১০টায় রাওয়ালপিন্ডিতে এক সম্মেলনে যোগদান করার জন্য আপনার পছন্দ মাফিক ব্যক্তিবর্গকে আমার পক্ষ হতে দাওয়াত করবেন। আমি উক্ত তারিখের কথা এই কারণে বলছি যে, সম্ভবত এর পূর্ব পর্যন্ত আমাকে পূর্ব পাকিস্তান থাকতে হবে। কিন্তু যদি আপনার নিকট প্রয়োজন অনুভূত হয় তা হলে আমি যে কোন প্রাথমিক আলোচনা করার জন্য ঢাকায় প্রস্তুত থাকব। যদি আপনি ও আপনার মনোনীত বিরোধীদলীয় প্রতিনিধিবৃন্দ এই দাওয়াত গ্রহণ করেন তাহলে আমি অত্যন্ত সুখী হব। আমি আরো সুখী হইব যদি আপনি আপনার সহকর্মীরা সম্মেলন চলাকালে আমার মেহমান হিসেবে রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থান করেন। জনস্বার্থের খাতিরে আমি মনে করি এ পত্রখানি যত শিগগির সম্ভব সংবাদপত্রে প্রেরণ করা প্রয়োজন। আমি নিশ্চিত যে এ প্রস্তাবে আপনার কোন আপত্তি নেই। শ্রদ্ধান্তে আপনার বিশ্বস্ত স্বাক্ষর : ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান (সূত্র : জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫, অলি আহাদ) আলোচনার অনুকূল পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ মধ্যরাতে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ হতে সেনাবাহিনী ও ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হয়। গোলটেবিল বৈঠককে কেন্দ্র করে নওয়াবজাদা নাসরুল্লাহ খান, শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী ও ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটির নেতৃবৃন্দের নিজেদের মধ্যে আলোচনা রাজনৈতিক মহলে স্বস্তির আবহাওয়া সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক সমোঝতার পদক্ষেপ হিসেবে সরকার ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ দৈনিক ইত্তেফাকের ছাপাখানা নিউন্যাশান প্রিন্টিং প্রেসের বাজেয়াপ্তকরণ আদেশ প্রত্যাহার করে। এটি ছিল একটি স্বস্তিদায়ক পরিবেশ। ১৬ই ফেব্রুয়ারি রাত ১২টায় দেশ রক্ষা আইনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক সকল রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেয়া হয়। ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি ৮ দফা দাবির সমর্থনে ও জুলুমের প্রতিবাদে ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সমগ্র দেশব্যাপী সাধারণ হরতাল ঘোষণা করে। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা দাবির সমর্থনে ও জুলুমের প্রতিবাদে একই দিবসে সাধারণ হরতাল ঘোষণা দেয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ পল্টন ময়দানে ছাত্র-জনতার বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ জনসভা অনুষ্ঠিত হয় ৮ দলীয় ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটির ডাকে কিন্তু আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতৃবৃন্দ ছাড়া ডাক (DAC) এর অন্য ৬ দলীয় কোন নেতাকেই সেদিন বক্তব্য রাখতে দেয়া হয়নি। মূলত মঞ্চ দখল করার ও আন্দোলন নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার মানসিকতা আওয়ামী লীগ এর বহু পুরনো। যা ১৯৬৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি দেশের জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে। হরতালকে কেন্দ্র করে করাচিতে ২ জন ও লাহোরে ২ জন নিহত হয়। তখন এক ভয়ানক উত্তপ্ত পরিবেশ উঅঈ শান্তিপূর্ণ উপায়ে স্বৈরশাসন অবসান করে গণতন্ত্র বহাল করার উদ্দেশ্যে বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত নেয়। ডেমোক্রোটিক অ্যাকশন কমিটির নেতৃবৃন্দের অনুরোধের প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক ১৬ ফেব্রুয়ারি এর স্থলে ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। গোলটেবিল বৈঠকে DAC -এর প্রতিনিধি নির্ধারণের জন্য এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, ৮টি দলের প্রত্যেক দল থেকে দু’জন করে প্রতিনিধি বৈঠকে যোগদান করবেন। আরও সিদ্ধান্ত হয় যে, এ দু’জনের একজন পূর্ব পাকিস্তান এবং আর একজন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হতে হবে। আওয়ামী লীগের নিখিল পাকিস্তান সংগঠন আগেই ভেঙে গিয়েছিল। তাই পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান গোলটেবিলে যোগদান করেন। জামায়াতের কেন্দ্রীয় আমীর মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী এবং পূর্ব পাকিস্তানের আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম গোলটেবিল বৈঠকের জন্য মনোনীত হন। গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রিত ব্যক্তিগণ হলেন, -মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা (পাকিস্তান মুসলিম লীগ) -খাজা খায়ের উদ্দিন (পাকিস্তান মুসলিম লীগ) -মুফতি মাহুমুদ (পাকিস্তান জমিয়াতুল উলেমায়ে ইসলাম) -পীর মুহসেন উদ্দিন আহমদ দুদ মিয়া (পাকিস্তান জমিয়াতুল উলেমায়ে ইসলাম) -নওয়াবজাদা নাসরুল্লাহ খান (পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ৮ দফা) -আবদুস সালাম খান (পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ৮ দফা) -চৌধুরী মোহাম্মদ আলী (পাকিস্তান নেজামে-ই-ইসলাম পার্টি) -মৌলভী ফরিদ আহমদ (পাকিস্তান নেজামে-ই-ইসলাম পার্টি) -আবদুল ওয়ালী খান (পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) -মোজাফফর আহমদ (পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) -নুরুল আমিন (পাকিস্তান ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) -হামিদুল হক চৌধুরী (পাকিস্তান ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) -শেখ মুজিবুর রহমান (পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ৬ দফা) -সৈয়দ নজরুল ইসলাম (পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ৬ দফা) -মাওলানা আবুল আলা মওদুদী (পাকিস্তান জামায়াতে ইসলাম) -অধ্যাপক গোলাম আযম (পাকিস্তান জামায়াতে ইসলাম) ডাক-এর বৈঠকে সে আরো সিদ্ধান্ত হয় যে, ডাক-এর বাইরে যারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন তাদেরকেও গোলটেবিল বৈঠকে দাওয়াত দেয়ার জন্য সুপারিশ করা প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে নিম্ন লিখিত ব্যক্তিদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। -মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (ন্যাপ) -জুলফিকার আলী ভুট্টো (পিপলস পার্টি) -এয়ার মার্শাল আজগর খান -লে. জে. মোহাম্মদ আযম খান -সৈয়দ মাহবুব হোসেন (প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি, ঢাকা হাইকোর্ট) গোলটেবিল বৈঠক দু’দফা তারিখ পরিবর্তনের পর ১৯৬৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠক রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বসার পূর্বে DAC-এর প্রতিনিধিদের এক বৈঠক হয়। আইয়ুব খানের সাথে আলোচনার ব্যাপারে এ বৈঠকে বেশ কিছু পলিসিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। DAC এর আহ্বায়ক নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে মাওলানা মওদূদী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দান করেন। তিনি বলেন, “সামরিক প্রতি বিপ্লব, সশস্ত্র সংগ্রাম বা রক্তঝরা গণআন্দোলন ছাড়া মিলিটারি ডিকটেটর থেকে নাজাত পাওয়ার কোন নজির নেই। পাকিস্তানের উপর আল্লাহর রহমত যে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত আমাদের আন্দোলন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত। DAC-এর আটটি দলের সর্বসম্মত ৮-দফা দাবি মেনে নিয়েই আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠকে বসতে প্রস্তুত হয়েছেন। এ আট দফা কোন দলের একক নয়। এ দফাগুলো আমাদের সবার। “আমরা যদি গোলটেবিল বৈঠককে সফল করতে চাই তাহলে ৮-দফার বাইরের কোন বিষয় বৈঠকে উত্থাপন করতে দিতে পারি না। যদি কেউ নতুন কোন দাবি তুলেন তাহলে আমাদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হবে। তাছাড়া আইয়ুব খানও নতুন কোন দাবি মেনে নেবেন না। এ অবস্থায় সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসে গণতন্ত্র বহাল করতে ব্যর্থ হব এবং আবার নতুন করে সামরিক শাসনের খপ্পরে পড়ব।” এ বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে খোন্দকার মুশতাক আহমদ উপস্থিত ছিলেন। শেখ মুজিব তখনো আগরতলা মামলার কারণে জেলে ছিলেন। ঐ সময় ঢাকায় ঐ মামলার শুনানি চলছিল। প্রবল গণআন্দোলনের মুখে সরকার ঐ মামলা প্রত্যাহার করে নেয় এবং শেখ মুজিব ‘হিরো’ হিসাবে মুক্তি পান এবং যথাসময়ে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন। উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে যারা DAC-এর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না তাদের মধ্যে মওলানা ভাসানী, জনাব ভুট্টো, এয়ার মার্শাল আসগর খান ও বিচারপতি মুরশিদকে গোলটেবিলে দাওয়াত দেবার জন্য DAC-এর পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হলে আইয়ুব খান তা মেনে নিয়ে তাদেরকে দাওয়াত দেন। শেষোক্ত দুজন যথাসময়ে যোগদান করেন। কিন্তু প্রথমোক্ত দুজন বৈঠকে যোগদান না করে ময়দানে হৈ চৈ করতে থাকেন। গোলটেবিল বৈঠকে সমস্যা রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থিত প্রেসিডেন্ট গেস্টহাউজে ১৯৬৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠক বসে। সকাল ১০:৩০টায় শুরু হয়ে ৪০ মিনিট পর বৈঠক ঈদুল আযহা উপলক্ষে মুলতবি হয়ে যায়। প্রথম দিনের এ বৈঠকে DAC এর ১৬ জন প্রতিনিধি ও সরকারি দলের সমান সংখ্যক প্রতিনিধি যোগদান করেন। বৈঠকে ডাক-এর পক্ষ থেকে আহ্বায়ক আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্টের নিকট ৮ দফা দাবি সংবলিত প্রস্তাব বিবেচনার জন্য লিখিত আকারে হস্তান্তর করেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান দুর্বলকণ্ঠে সবাইকে তার দাওয়াতে সাড়া দিয়ে বৈঠকে হাজির হওয়ার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান। বৈঠকের প্রথম দিনে আনুষ্ঠানিক আর কোন আলোচনা হয়নি। ঈদের পর ১৯৬৯ সালের ১০ মার্চ রাওয়ালপিন্ডিতে মুলতবি গোলটেবিল বৈঠক শুরুর পূর্বে ৮ মার্চ লাহোরে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে উঅঈ এর বৈঠক বসে। সবাই নিশ্চিত যে, গোলটেবিল বৈঠকে আইয়ুব খান ডাক-এর ৮ দফা দাবি মেনে নিবেন। এরপর করণীয় সম্পর্কে গোলটেবিল বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হতে হবে। ৮ দফার ভিত্তিতে যথাসম্ভব দ্রুত নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচন পরিচালনার সময় কেন্দ্রীয় প্রদেশে ক্ষমতা যাদের হাতে থাকবে, কখন নির্বাচন হবে, নির্বাচন কমিশন গঠনের নীতি কি হবে ইত্যাদি বিষয়ে প্রেসিডেন্ট সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব পেশ করবেন বলে সকলের ধারণা। তাই এসব বিষয়ে গোলটেবিল বৈঠকে বসার পূর্বে ডাক-এর ঐকমত্যে পৌঁছা প্রয়োজন। সেখানে বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে ভিন্ন ভিন্ন মত পেশ করার সুযোগ দেয়া সম্ভব নয়। বৈঠকের একপক্ষ আইয়ুব সরকার অপরপক্ষ ডাক। তাই ডাক-এর অন্তর্ভুক্ত ৮ দলকে একমত হওয়া দরকার। DAC-এর কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান সভাপতি হিসেবে বৈঠকের শুরুতে কিছু বলবার আগেই শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম দাঁড়িয়ে বললেন, ‘DAC-এর নেতৃবৃন্দের নিকট আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আবেদন জানানো যাচ্ছে যে, গোলটেবিল বৈঠকে উঅঈ-এর পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবি পেশ করা হোক।’ এ কথায় সকলেই স্তম্ভিত ও হতবাক হয়ে যান। গোলটেবিল বৈঠক বানচাল হয়ে যাবার আশঙ্কায় সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ৮টি দলের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী DAC-এর ৮ দফা রচিত হয়েছে। এর ভিত্তিতে আন্দোলন হয়েছে। এ দাবি মেনে নিতে রাজি হয়েই প্রেসিডেন্ট আইয়ুব গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছেন। এ ৮ দফা প্রণয়নে শেখ মুজিবের দলও শরিক ছিলো। ৮ দফা দাবি মেনে নেবার পর যেসব বিষয় আলোচনা হতে পারে সে সম্পর্কে DAC-এর মতামত চূড়ান্ত করার জন্য ৮ দলের নেতৃবৃন্দ বৈঠকের সমবেত হন। এ পরিস্থিতিতে ৬ দফা দাবি পেশ করায় চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসে ব্যর্থ হয়ে যাবার আশঙ্কা দেখা দেয়। DAC-এর আহ্বায়ক বৈঠক মুলতবি ঘোষণা করেন। মাওলানা মওদূদীর সাথে শেখ মুজিবের বৈঠক DAC-এর বৈঠক থেকে বের হওয়ার পর গাড়িতে ওঠার অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় অধ্যাপক গোলাম আযমের সাথে শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীনের সাক্ষাৎ হয়। অধ্যাপক গোলাম আযম শেখ মুজিবকে বলেন, ‘আপনি কী করতে চান তা আমি বুঝতে চাই। এখনি চলুন মাওলানা মওদূদীর বৈঠকখানায়।’ শেখ মুজিব অধ্যাপক গোলামের এ প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান এবং জনাব তাজউদ্দীনকে সাথে নিয়ে অধ্যাপক গোলাম আযমের সাথে জামায়াতের গাড়িতেই রওনা হন। মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী একটু আগেই বৈঠক থেকে ফিরেছেন। শেখ সাহেবের আগমনে তিনি আগ্রহের সাথে বৈঠকখানায় এলেন। শেখ মুজিব উর্দু ও ইংরেজি উভয় ভাষা মিলিয়ে প্রায় দশ মিনিটের বক্তব্যে যা বললেন এর সারকথা নিম্নরূপ : ‘মাওলানা সাহেব, আমি ৬ দফা আন্দোলন শুরু করার পরই আমাকে গ্রেফতার করা হয়। আমি জেলে থাকা অবস্থায় আমার ৬ দফার সাথে ছাত্ররা আরো ৫ দফা যোগ করে ১১ দফার আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়। আযম সাহেব ৬ দফা সম্পর্কে শুরু থেকে এ পর্যন্ত একই ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু মওলানা ভাসানী আযব চিজ। তিনি প্রথমে ৬ দফা ডিসমিশ বলে ঘোষণা করলেন। অথচ আমার অনুপস্থিতিতে ১১ দফা নিয়ে মাতামাতি করছেন। ছাত্র ও শ্রমিক মহলে ১১ দফার ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। মওলানা ভাসানী গোলটেবিল বৈঠকেও যোগদান করলেন না। তার উদ্দেশ্য মোটেও ভাল নয়। তিনি জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন চালাচ্ছেন। আমি যদিও ৬ দফার বদলে DAC-এর ৮ দফা মেনে নেই তাহলে আমার বিরুদ্ধে মাওলানা, ছাত্র ও শ্রমিকদের খেপিয়ে তুলবেন। জনগণের মধ্যে ৬ দফাসহ ১১ দফা যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এর ফলে আমি বিরাট সমস্যায় পড়েছি। মওলানা ভাসানী বিরাট এক ফেতনা। তাকে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন।’ শেখ মুজিব অত্যন্ত আবেগময় কণ্ঠে বললেন, ‘মাওলানা সাহেব, মেহেরবানি করে ৬ দফাকে সমর্থন করে আমাকে সাহায্য করুন। দেখবেন আমি মওলানা ভাসানীকে দেশ থেকে তাড়াবো।’ সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘আপনি যদি আপনার দলীয় দাবিতে অনড় থাকেন তাহলে গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হবে এবং মওলানা ভাসানী আরো মজবুতভাবে কায়েম হবে। মওলানা চান যে গোলটেবিল বৈঠক বানচাল হয়ে যাক। আপনার এ পদক্ষেপ মওলানা ভাসানীর উদ্দেশ্যই পূরণ করবে। মনে রাখবেন ৭-৮ বছরের আন্দোলনের ফলে গণতন্ত্র এখন আমাদের দুয়ারে হাজির। গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হলে আবার সামরিক শাসন অনিবার্য হয়ে পড়বে। গোলটেবিল বৈঠককে সফল করুন এবং গণতন্ত্র বহাল হতে দিন। আগামী নির্বাচনে আশা করি আপনি ভালো করবেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ৮ দফা মেনে নিতে সম্মত হয়েই গোলটেবিল বৈঠক ডেকেছেন। আপনি কেমন করে আশা করতে পারেন যে DAC-এর অন্যান্য দল আপনার দাবি মেনে নিবে? গোলটেবিল বৈঠককে সফল করে গণতন্ত্রকে বহাল করার মহাসুযোগ নষ্ট করবেন না। দেশে অবিলম্বে নির্বাচন হতে দিন। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দলীয় মেনিফেস্টো অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করবেন। আমি বিষয়টা বিশেষভাবে বিবেচনা করার জন্য পরামর্শ দিচ্ছি।’ মাওলানার বক্তব্যের পর শেখ মুজিব নীরব রইলেন। মাওলানা মওদূদীর কথাগুলোর গুরুত্ব তিনি উপলব্ধি করলেন। তার চেহারায় চিন্তার ছাপ দৃশ্যমান হলো। গোলটেবিল বৈঠকের ব্যর্থতা DAC-এর যে বৈঠক ৮ মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করা হয় সে বৈঠক আর হতে পারেনি। শেখ মুজিবের ৬ দফা ও একগুঁয়েমির কারণে দেশে আবার সামরিক শাসনের আশঙ্কা দেখা দিল। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মাওলানা মওদূদীকে অনুরোধ করলেন শেখ মুজিবকে বোঝানোর চেষ্টা করার জন্য। মাওলানা মওদূদী বললেন, ‘যে ব্যক্তি পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানীর হুমকির হয়ে জাতির ভাগ্য সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়, এমন অদূরদর্শীর সাথে আলোচনা অর্থহীন।’ আইয়ুব খান জানতে পারেন যে, শেখ মুজিবের ৬ দফা দাবির কারণে DAC-এর মধ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। এক অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১০ মার্চ গোলটেবিল বৈঠক বসে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ আসন গ্রহণ করেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিক বৈঠকের কর্মসূচি শুরু হয়নি। DAC-এর প্রতিনিধিগণ নিজ নিজ আসন থেকে উঠে টেবিলের আশপাশে পরস্পরের সাথে কথা বলেন। আইয়ুব খান তার দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে নিজ নিজ আসনে স্থির বসে থাকেন। এক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন সকলেই। রাওয়ালপিন্ডিতে গোলটেবিল বৈঠক চলাকালে জোর গুজব চলছিল যে, গভীর রাতে শেখ মুজিবের সাথে সেনাপতি ইয়াহইয়া খান গোপনে সাক্ষাৎ করেছেন। সাংবাদিকদের মুখে মুখে আলোচনা চলতে থাকে। কার্যত গোলটেবিল বৈঠক অচল হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বৈঠক মুলতবি হয়ে যায়। DAC-এর নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবকে বুঝাবার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান। শেখ মুজিবের এক কথা ‘৬ দফা মুলতবি করার সাধ্য আমার নেই। জনগণ ৬ দফা গ্রহণ করেছে। আমি জনগণের সামনে কৈফিয়ত দিতে পারবো না। মওলানা ভাসানী ময়দান দখল করে ফেলবেন। আন্দোলনরত ছাত্র-শ্রমিক জনতা একমুখী হয়ে গেছে।’ সবাই বুঝতে সক্ষম হন গোলটেবিল বৈঠকের ফলাফল শূন্য। আনুষ্ঠানিকভাবে আইয়ুব খান ঘোষণা করলেন, ‘সকল রাজনৈতিক দল দুটো বিষয়ে একমত বলে প্রমাণিত হয়েছে: -প্রাপ্ত বয়স্কদের সরাসরি ভোটে জনগণের সকল প্রতিনিধি নির্বাচিত হতে হবে। -ফেডারেল পার্লামেন্টারি সরকারব্যবস্থা চালু করতে হবে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে এ দু’টো দাবি মেনে নেয়া হলো। আর কোন বিষয়ে ঐকমত্যে না পৌঁছার কারণে তা বিবেচনা করা সম্ভব হলো না। আমি গোলটেবিল বৈঠকের সমাপ্তি ঘোষণা করছি।’ ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি বিলুপ্ত ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটির বৈঠকের পর, কমিটি বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের (৬ দফা) সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বেই ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটির সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন । পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মস্কো) প্রতিনিধি ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটির সভায় যোগদান করেননি। এয়ার মার্শাল আজগর খান ১৩ মার্চ ১৯৬৯ রাওয়ালপিন্ডিতে সাংবাদিক সম্মেলন আহবান করে জাস্টিস পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গোলটেবিল বৈঠক শেষে শেখ মুজিব ১৪ মার্চ ১৯৬৯ ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করলে জনতা তাকে বিরোচিত সংবর্ধনা প্রদান করে। গোলটেবিল বৈঠকের ব্যর্থতাকে তিনি ৬ দফার বিজয় হিসেবে ধারণা করলেন। বিমানবন্দরে তিনি ঘোষণা করলেন যে, পূর্ব-পাকিস্তানি নেতারা ৬ দফা সমর্থন করলে আইয়ুব খান তা মেনে নিতে বাধ্য হবেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্যকালে শেখ মুজিব মন্তব্য করেন, জনাব হামিদুল হক চৌধুরী, মাহমুদ আলী, ফরিদ আহমদ ও আব্দুস সালাম খান ২২ বছর যাবৎ একই খেলায় মেতে আছেন। অসামঞ্জস্য ক্রিয়া-কলাপের প্রেক্ষিতে মওলানা ভাসানীর রাজনীতি হতে অবসর গ্রহণ করা উচিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন। মূলত শেখ মুজিব পূর্ব-পাকিস্তানি সকল নেতার বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলেন। এরপর DAC-এর এক দায়ছাড়া বৈঠক অনুষ্ঠিত হইল। সেখানে আহ্বায়ক ঘোষণা করেন যে,DAC-এর প্রধান দুটো দাবি সরকার মেনে নেয়ায় ৮ দলীয় জোটের আর প্রয়োজন রইল না। তাই DAC বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলো। ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি বিলুপ্ত হওয়ায় রাজনীতির ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান একচ্ছত্র নেতার মর্যাদা পান। আইয়ুবের পদত্যাগ গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর দেশের এবং সমাজজীবনের সর্বত্র জ্বালাওÑ পোড়াও-ঘেরাও আন্দোলন শুরু হয়ে যায় এবং হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, ধর্মঘট নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়। প্রশাসনে আইন-শৃঙ্খলা বলে কিছুই রইল না। ফলে উচ্ছৃঙ্খলতা সমাজজীবনের নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হয়। সর্বত্রই নেমে আসে অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, অশান্তি। দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও বিপক্ষীয় দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর অবাধে হামলা চলতে থাকে। ১৯৬৯ সালের ১৬ মার্চ মওলানা ভাসানীর ওপর হামলা চালানো হয়। এক চরম উচ্ছৃঙ্খল সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আইয়ুব খান দেশব্যাপী সামরিক শাসন জারির মনস্থ করেন। সেনাবাহিনীর প্রধান আইয়ুব খান তাকে স্পষ্ট ভাষায় জানান যে, সামরিক শাসন জারি করতে হলে তা করবে সেনাবাহিনী। তখন পূর্ব-পাকিস্তানের টলটলায়মান অবস্থা। ঠিক এই মুহূর্তে তদানীন্তন সেনাবাহিনীর প্রধান সুচতুর ইয়াহিয়া খান কৌশলে ক্ষমতা দখলের পদক্ষেপ নেন। তিনি ১৯৬৯ সালের ১৭ মার্চ একটি কাগজ আইয়ুব খানের সামনে উপস্থাপন করেন। ওটি ছিল একটি চিঠির ড্রাফ্ট। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের চাপের মুখে ঐ চিঠিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন আইয়ুব খান। সেই সাথে আইয়ুব খানের বক্তব্য রেকর্ড করা হয়। ঐ বক্তব্যটি ছিল ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ আইয়ুব খানের ক্ষমতা ত্যাগের ফরমান। পরদিন ২৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান আইয়ুব খানের নামে সমগ্র দেশে নতুন করে সামরিক শাসন জারি করেন। বাহ্যত আইয়ুব খান ইয়াহিয়া খানকে নিয়োগ দিলেও পর্দার আড়ালে ১৯৬৯ সালের ১৭ মার্চ আইয়ুবের ক্ষমতা হস্তান্তরের বক্তব্য রেকর্ড করা হয়। আর তা ২৫ মার্চ বাজিয়ে জনগণ ও সারা বিশ্বকে বুঝানো হয় যে, আইয়ুব খান স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। আইয়ুব খানের মুখ দিয়েই বলানো হয় তার ক্ষমতা ত্যাগের ঘোষণা। (সূত্র: রাজনীতির তিন কাল : মিজানুর রহমান চৌধুরী) যে চিঠিটি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে লিখে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করার অনুরোধ জানান তা হলো (সূত্র: জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫: অলি আহাদ): প্রেসিডেন্ট ভবন ২৪ মার্চ, ১৯৬৯ প্রিয় জেনারেল ইয়াহিয়া, গভীর বেদনার সাথে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, দেশে সমস্ত বেসামরিক প্রশাসন ও শাসনতান্ত্রিক কর্তৃত্ব কার্যকারিতা হারাইয়া ফেলিয়াছে। যদি বর্তমানের আশঙ্কাজনক গতিতে অবস্থার অবনতি ঘটিয়ে থাকে তাহা হইলে সভ্যভাবে জীবনধারণ অসম্ভব হইয়া পড়িবে। ক্ষমতা ত্যাগ করিয়া দেশরক্ষা বাহিনীর কাছে ক্ষমতা প্রত্যর্পণ করা ছাড়া আমার কোন বিকল্প নাই। বর্তমান সময়ে দেশের পূর্ণ কর্তৃত্ব গ্রহণের জন্য দেশরক্ষা বাহিনীই একমাত্র কার্যকর ও আইনানুগ প্রতিষ্ঠান। খোদা চাহেত অবস্থার পরিবর্তন সাধনপূর্বক পরিপূর্ণ বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংসের হাত হইতে দেশকে রক্ষা করিবার ক্ষমতা তাহাদের রহিয়াছে। একমাত্র তাহারাই দেশে সুস্থতা ফিরাইয়া আনিতে পারে এবং বেসামরিক ও শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশকে অগ্রগতির পথে ফিরাইয়া নিতে পারে। আমাদের বিশ্বাসের মৌলিক নীতিমালা এবং আমাদের জনগণের প্রয়োজন মোতাবেক পূর্ণ গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ইহা বজায় রাখাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। ইহার মধ্যেই আমাদের জনগণের মুক্তি নিহিত। আত্মোৎসর্গের শ্রেষ্ঠতম গুণাবলিসমূহ আমাদের জনগণের পৃথিবীতে একটি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালনের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রহিয়াছে। ইহা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, যখন আমরা সুখী ও সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যতের পথে অগ্রসর হইতেছিলাম তখনই আমরা কাণ্ডজ্ঞানহীন বিক্ষোভের শিকারে পরিণত হই। ইহাকে গৌরবান্বিত করিবার জন্য যে নামই ব্যবহার করা হইয়া থাকুক না কেন, সময়ে প্রমাণিত হইবে যে, এই বিক্ষোভ ইচ্ছাকৃতভাবে সেই সমস্ত ব্যক্তিদের দ্বারা সৃষ্ট হইয়াছে যাহাদিগকে বিপুলভাবে প্রণোদিত করা হইয়াছে এবং মদদ যোগান হইয়াছে। আইন ও শৃঙ্খলার ন্যূনতম চিহ্ন বজায় রাখা কিংবা নাগরিক স্বাধীনতা এবং জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ তাহারা অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছে। প্রশাসনের প্রতিটি অঙ্গ এবং সুস্থ জনমত প্রকাশের প্রতিটি মাধ্যমের উপর অমানবিক চাপ প্রয়োগ করা হয়। ত্যাগী মনোভাবাপন্ন অথচ নিরাপত্তাহীন সরকারি প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানসমূহ জনগণের ক্রুর সমালোচনা অথবা ব্ল্যাকমেইলের শিকারে পরিণত হয়। ফলে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলি বিনষ্ট হইয়া পড়ে এবং সরকারী যন্ত্র কার্যকারিতা হারাইয়া ফেলে। দেশের অর্থনৈতিক জীবন সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়া গিয়াছে। আইন-বহির্ভূক্ত এবং নৃশংস কাজ করিবার জন্য কর্মচারী ও শ্রমিকদিগকে উত্তেজিত করা হইতেছে। একদিকে সন্ত্রাসের হুমকির মুখে অধিক পারিশ্রমিক, বেতন ও সুযোগ সুবিধা আদায় করা হইতেছে অন্যদিকে উৎপাদন হ্রাস পাইতেছে। রফতানিক্ষেত্রে মারাত্মক অবনতি ঘটিয়াছে এবং আমার আশঙ্কা অতিসত্বরই দেশ মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতির কবলে নিপতিত হইবে। এইসব হইতেছে ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের নৈরাজ্যমূলক আচরণের ফলে যাহারা গত কয়েক মাস ধরিয়া গণআন্দোলনের নামে দেশে ভিত্তিমূলে একটির পর একটি আঘাত হানিতেছে। দুঃখের বিষয়, বিপুল সংখ্যক নির্দোষ লোক এই অসৎ পরিকল্পনার শিকারে পরিণত হইয়াছে। সকল অবস্থার মধ্যে আমি আমার ক্ষমতা অনুযায়ী দেশবাসীর খেদমত করিয়াছি। অবশ্য যথেষ্ট ভুলভ্রান্তি রহিয়াছে কিন্তু যাহা অর্জন করা হইয়াছে তাহাও নগণ্য নয়। এমন অনেকে আছেন যাহারা আমি যাহা করিয়াছি এমনকি পূর্বতন সরকার যাহা করিয়াছে তাহাকে ব্যর্থ করিয়া দিতে চাহিবে। কিন্তু সবচাইতে দুঃখজনক ও হৃদয়বিদারক চিন্তা হইল যে, এমন অনেকে এখন ক্রিয়াশীল রহিয়াছে যাহারা কায়েদে আযমের অবদান অর্থাৎ পাকিস্তান সৃষ্টিকেও ব্যর্থ করিয়া দিতে চাহিবে। বর্তমান সংকট নিরসনের জন্য আমি সকল বেসামরিক ও শাসনতান্ত্রিক পন্থা প্রয়োগ করিয়াছি। যাহারা জনগণের নেতা হিসেবে পরিচিত তাঁহাদের সহিত মিলিত হইবার প্রস্তাব দিয়াছি। সম্প্রতি তাঁহাদের অনেকে একটি কনফারেন্সে যোগ দিয়াছিলেন তখনই যখন আমি তাঁহাদের সকল পূর্বশর্ত পূরণ করিয়াছিলাম। কয়েকজন উক্ত কনফারেন্সে যোগ দিতে অস্বীকার করিয়াছেন; এই অস্বীকৃতির কারণ তাঁহাদেরই ভাল জানা। একটি সর্বস্বীকৃত ফর্মুলা উদ্ভাবন করিবার জন্য আমি তাঁহাদিগকে বলিয়াছিলাম। কয়েকদিনের আলোচনা সত্ত্বেও তাঁহারা উহা করিতে পারেন নাই। শেষ পর্যন্ত তাঁহারা দুইটি বিষয়ে একমত হইয়াছিলেন এবং আমি ঐ দুইটি বিষয়েই গ্রহণ করিয়ছিলাম। তারপরে আমি প্রস্তাব দিয়াছিলাম, যে সমস্ত বিষয়ে মতৈক্য হয় নাই সেইগুলি প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে যখন জনপ্রিতিনিধিরা নির্বাচিত হইয়া আসিবেন তখন তাঁহাদের বিবেচনার জন্য পেশ করা হইবে। আমার যুক্তি ছিল - এই কনফারেন্সে উপস্থিত প্রতিনিধিবৃন্দ যাঁহারা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন নাই তাঁহারা সকল বেসামরিক ও শাসনতান্ত্রিক বিষয় ও নিজেদের মধ্যে যে সমস্ত বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় নাই সেইগুলির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দাবি করিতে পারেন না। যে দুইটি বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে সেইগুলি বিবেচনার জন্য জাতীয় পরিষদ আহ্বান করিবার কথা আমি চিন্তা করিয়াছিলাম কিন্তু ইহা স্পষ্ট হইয়া উঠিল যে, ইহা নিরর্থক প্রচেষ্টা। পরিষদের সদস্যরা আর স্বাধীন প্রতিনিধি নন এবং যে দুইটি বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে সেইগুলি বিশ্বস্ততার সহিত গৃহীত হয় এমন কোন সম্ভবনা নাই। প্রকৃতপক্ষে পরিষদ সদস্যদেরকে এই মর্মে হুমকি প্রদানেও বাধ্য করা হইতেছে যাহাতে তাঁহারা হয় অধিবেশন বয়কট করেন অথবা এমন সংশোধনী প্রস্তাব আনয়ন করেন যাহাতে কেন্দ্রীয় সরকার বিপুপ্ত হইয়া যায়, সশস্ত্র বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ অসম্ভব হইয়া পড়ে, দেশের অর্থনীতি দ্বিধাবিভক্ত হইয়া পড়ে এবং পাকিস্তান ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত হইয়া পড়ে। এমন একটি বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে জাতীয় পরিষদ আহ্বান করিবার অর্থই হইতেছে পরিস্থিতিকে আরও সংকটাপন্ন করিয়া তোলা। শুধু বিদেশী আগ্রাসনই নয় বরং অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা হইতে দেশকে রক্ষা করিবার আইনগত ও শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব আপনার। জাতি আশা করে, দেশের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা বজায় রাখা এবং সামজিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আপনি এই দায়িত্ব পালন করিবেন। ১২ কোটি মানুষের এই বিক্ষুব্ধ দেশে শান্তি ও সুখ ফিরিয়া আসুক। আমি বিশ্বাস করি, দেশের বর্তমান কঠিন সমস্যা মোকাবেলা করিবার মত ক্ষমতা, দেশপ্রেম, ত্যাগী মনোভাব ও প্রজ্ঞা আপনার রহিয়াছে। আপনি এমন এক বাহিনীর নেতা যার সমগ্র বিশ্বে সম্মান রহিয়াছে। পাকিস্তান বিমান বাহিনী ও নৌ বাহিনীর আপনার সহকর্মীদের অনেকেই সম্মানিত ব্যক্তি এবং আমি জানি, আপনি সর্ব সময়েই তাঁহাদের সমর্থন পাইবেন। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীকে অবশ্যই বিচ্ছিন্নতার হাত হইতে পাকিস্তানকে রক্ষা করিতে হইবে। প্রতিটি সৈনিক, নাবিক ও বৈমানিকের নিকট আপনি এই কথা পৌঁছাইয়া দিবেন যে, তাহাদের সুপ্রিম কমান্ডার হিসেবে তাহাদের সহিত সম্পর্কিত হওয়াতে আমি গর্বিত; সেই জন্য আমি আপনার নিকট কৃতজ্ঞ থাকিব। তাহাদের জানা উচিত, বর্তমান সংকটাপন্ন মুহূর্তে তাহাদিগকে পাকিস্তানের রক্ষক হিসাবে কাজ করিতে হইবে। তাহাদের আচরণ ও কাজ ইসলামের নীতিমালা ও জনগণের স্বার্থ রক্ষার মনোবৃত্তি দ্বারা অনুপ্রাণিত হইতে হইবে। দীর্ঘকাল ধরিয়া পাকিস্তানের সাহসী ও অনুপ্রাণিত জনগণের খেদমত করিতে পারিয়া আমি পরম সম্মানিত বোধ করিতেছি। আল্লাহ তাঁহাদিগকে অধিকতর অগ্রগতি ও গৌরবের পথে পরিচালিত করুন। আপনার দ্বিধাহীন আনুগত্যের কথাও আমি পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করিতেছি। আমি জানি, আপনার সমগ্র জীবনে দেশপ্রেমই হইতেছে সর্বময় প্রেরণার উৎস। আমি আপনার সাফল্য এবং আমার দেশবাসীর কল্যাণ ও সুখের জন্য দোয়া করি। খোদা হাফেজ। আপনার বিশ্বস্ত স্বা/এম, এ, খান (চলবে)

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির