post

বাংলাদেশ : সর্বগ্রাসী ফ্যাসিবাদের জাঁতাকলে সর্বত্র লঙ্ঘিত মানবাধিকার । মো: কামরুজ্জামান

১২ নভেম্বর ২০১৮

সব মানুষেরই একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হলো তিনি তার চারপাশের মানুষগুলোর সাথে নিজেকে তুলনা করেন। যাচাই করে দেখতে চান অন্যদের জীবনযাপনের সাথে তার নিজের জীবনের কতটা মিল আছে। আর এই তুলনামূলক পর্যালোচনার আলোকেই অনেকে নিজ জীবনের চাহিদা নিরূপণ করে থাকেন। আর এ কারণেই মানুষ নিজ সামর্থ্য ও যেখানে বসবাস করেন সেখানকার পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকেই নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন নিরূপণ করেন। সেই আদিকাল থেকেই মানবজীবনের এই সহজাত প্রবণতা বিদ্যমান। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এখানকার বেশির ভাগ মানুষের চিন্তা-ভাবনা এখন যার মধ্যে ঘোরপাক খায় তা হলো নিরাপদে নিজ ঘরে ফিরে আসতে পারবো কিনা, ফিরে এলেও নিরাপদে থাকতে পারবো কিনা। এমনকি কোনোমতে নিজ জীবনটা নিয়ে বেঁচে আছি সেইতো ঢের, এমন ভাবনাও এখানকার এক বিশাল জনগোষ্ঠীর। জীবনের চাওয়া-পাওয়াকে কেন এখানকার মানুষ এতোটা সংকীর্ণ গণ্ডির বেড়াজালে আবদ্ধ করে রেখেছে?


বাংলাদেশে বহুকাল ধরে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা ও বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক ঘটনাই আর গণমাধ্যমে আসে না। একদিকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে খর্ব করা হয়েছে, অপরদিকে, নানা কারণে গণমাধ্যমকর্মীরা সেলফ সেন্সরশিপ নীতি অবলম্বন করেছে। এ ছাড়া অপরাধীদের বড় অংশই ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভুক্তভোগী অনেকেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির ভয়ে শেষমেশ চুপ থাকার নীতি অবলম্বন করতে বাধ্য হন।


গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, খুন, নির্যাতন, পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন, দুর্নীতি, রাজনৈতিক হয়রানি এবং আরো বহুবিধ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বর্তমানে এদেশের মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গীতে পরিণত হয়েছে। যখনই কেউ ঘর থেকে কর্মস্থল কিংবা অন্য কোনো কাজে বের হন পরিবারের লোকজন গভীর শঙ্কার সাথে অপেক্ষা করেন কখন তিনি বাড়িতে ফিরবেন, পথে কোনো বিপদে পড়বেন নাতো, গুম-খুনের শিকার হবেন নাতো। বিশেষ করে বিরোধী রাজনীতির সাথে যারা জড়িত, কিংবা বিরোধী দলের প্রতি সমর্থন রয়েছে বা সরকারের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সরব এমনসব নাগরিকদের বেলায় এই আশঙ্কা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। দেশে বিদ্যমান এই ভয়াবহ পরিস্থিতির বিষয়টি বিভিন্ন গবেষণা ও প্রতিবেদনে এরই মধ্যে বার বার ফুটে উঠেছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসেক) প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত অর্থাৎ প্রথম ছয় মাসেই তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ার‘ এর নামে ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ২৭৫ ব্যক্তি নিহত হন। এদের মধ্যে ৬৬ জন নিহত হন র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‌্যাবের সঙ্গে ক্রসফায়ারে, ১৪১ জন পুলিশের ক্রসফায়ারে এবং ৩১ জন ডিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে। এমনকি নৌপুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধেও একজন নিহতের ঘটনা ঘটেছে যা একেবারেই ব্যতিক্রম। এ ছাড়া একই সময়ে ৪২৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তবে বিভিন্ন গ্রহণযোগ্য বাংলা ও ইংরেজি গণমাধ্যমের বরাতে তথ্য বিশ্লেষণ করে আসেকের দেয়া সেপ্টেম্বরের জরিপে বলা হয় চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারের নামে মোট ৩৭৭ জন নিহত হয়েছেন। এমন অমানবিক ও আইনবহির্ভূত হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দিতে গিয়ে এই মানবাধিকার সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘দল-মত-অপরাধী-নিরপরাধী-নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধান সরকারের একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য।’ এ দিকে, গত প্রায় দেড় দশক ধরে দেশে ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংস্কৃতি চালু হওয়ার পর চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের রেকর্ডই সর্বোচ্চ। দেশ-বিদেশী মানবাধিকার সংগঠন ও বিশ্লেষকরা এটাকে উদ্বেগজনক বলে আখ্যায়িত করেছেন। অপর মানবাধিকার সংগঠন অধিকার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানায়, ওই বছরে অন্তত ১৩৯ জন ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন। একই সময়ে ৮৬ জনকে গুম করা হয়েছিল এবং কারাগারে নিহত হয়েছেন আরো ৫৯ জন। ওই বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় আরো ৭৭ জন নিহত হন। এ ছাড়া একই বছরে ৭৮৩ নারী ধর্ষণের শিকার হন, যৌন হয়রানির শিকার হন ২৪২ জন, ২৫৬ নারী যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হন এবং এসিড হামলার শিকার হন ৫২ নারী।

প্রকৃত চিত্র আরো ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রকৃত চিত্র আরো ভয়াবহ। কারণ মানবাধিকার সংগঠনগুলো সাধারণত গ্রহণযোগ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক সংরক্ষিত বা প্রকাশিত তথ্যের আলোকেই এই জরিপ করে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশে বহুকাল ধরে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা ও বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক ঘটনাই আর গণমাধ্যমে আসে না। একদিকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে খর্ব করা হয়েছে, অপরদিকে, নানা কারণে গণমাধ্যমকর্মীরা সেলফ সেন্সরশিপ নীতি অবলম্বন করেছে। এ ছাড়া অপরাধীদের বড় অংশই ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভুক্তভোগী অনেকেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির ভয়ে শেষমেশ চুপ থাকার নীতি অবলম্বন করতে বাধ্য হন। নির্যাতনের নয়া-কৌশল মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে নতুন করে আবির্ভূত হয়েছে ফিলিপাইন স্টাইলের মাদকবিরোধী অভিযান। মানবাধিকার সংগঠন আসেকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি ২০১৮ সালের প্রথম ছয় মাসে সংঘটিত ২৭৫টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ১৭৬টি হত্যার ঘটনাই ১৫ মে থেকে ৩০ জুনের মধ্যে সংঘটিত হয়েছে যার প্রায় সবগুলোই মাদকবিরোধী অভিযানের সময় মাদকচক্রের সদস্যের সঙ্গে পুলিশের গুলি বিনিময়কালে ঘটেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, গত ৪ মে (২০১৮) থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দেশব্যাপী এই মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে।
পরিস্থিতি স্পষ্টতই জটিল। কিন্তু আশাহত হওয়ার কিছু নেই। সেদিন বেশি দূরে নয় যখন এদেশের তারুণ্যদীপ্ত নতুন প্রজন্ম সবকিছুর হাল ধরবে যারা কোনো ধরনের শঠতায় বিশ্বাসী নয়। নতুন এই শক্তি গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের দীপ্ত শপথ দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এমন আশাবাদী হওয়াই যায়। আর এদের হাতে রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিকড় গেড়ে থাকা ফ্যাসিবাদী শক্তির পতন হবে এবং সর্বত্র ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে
তবে, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও ভুক্তভোগীদের পরিবারের পক্ষ থেকে বার বার অভিযোগ করা হচ্ছে আগামী ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার অংশ হিসেবেই মাদকবিরোধী অভিযান চালানো হচ্ছে। আগামী ২৮ জানুয়ারির মধ্যে দেশের সংবিধান অনুযায়ী এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এদিকে, দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো মাদকবিরোধী অভিযানে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে সরকারের প্রতি বার বার আহবান জানিয়ে আসছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ও ইসলামী সম্মেলন সংস্থা- ওআইসিসহ প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার পক্ষ থেকে এই বেআইনি হত্যা বন্ধের আহবান জানানো হচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠনের ক্রমাগত উদ্বেগ নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) গত ৬ জুন (২০১৮) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারকে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের আহবান জানানো হয়। সংস্থাটির দেয়া বিবৃতিতে মাদকবিরোধী অভিযানের সময় সংঘটিত সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে একটি স্বাধীন তদন্তের উদ্যোগেরও পরামর্শ দেয়া হয়। সংস্থাটির এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস (Brad Adams) বলেন, প্রত্যেকেরই ন্যায়বিচার পাওয়া এবং দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিচারের আগেই নিহত না হওয়ার অধিকার রয়েছে। তিনি সরকারের সমালোচনা করে বলেন, বাংলাদেশ সরকার অনেক দিন আগ থেকেই বলে আসছে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করবে। অথচ প্রতিনিয়ত আইনবহির্ভূত হত্যার ঘটনা দেখা যাচ্ছে। কে মাদক ব্যবসায়ী আর কে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তা কখনোই বিচারবহির্ভূত হত্যার কারণ হতে পারে না। একই তারিখে (৬ জুন ২০১৮) জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ রাদ আল হুসেইন বাংলাদেশে সন্দেহভাজন মাদক অপরাধীদের বিচারবহির্ভূত হত্যার নিন্দা জানান। তিনি অচিরেই এই বেআইনি হত্যাযজ্ঞ বন্ধ এবং এ যাবৎ সংঘটিত এরূপ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের যত দ্রুত সম্ভব বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘আমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন যে এতগুলো মানুষকে হত্যা করা হলো এবং জনগণকে এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে সরকার শুধু এই ব্যাখ্যা দিলো যে যাদেরকে হত্যা করা হলো তারা কেউ নিরপরাধ ব্যক্তি নন।’ হাইকমিশনার হুসেইন এই ধরনের বক্তব্যকে ভয়াবহ আখ্যায়িত করে বলেন, এটা আইনের শাসনের প্রতি মারাত্মক অবজ্ঞার শামিল। ‘প্রত্যেক মানুষেরই জীবনে নিরাপত্তা পাবার অধিকার রয়েছে। একজন মানুষ মাদক সেবন কিংবা বিক্রি করছে এই অপরাধে তার মানবাধিকার থাকবে না এটা তো হতে পারে না। যে কোনো অপরাধের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে নিরপরাধীদের হয়রানি না করা এবং যথাযথ আইনি ব্যবস্থা অনুসরণ করা হচ্ছে কি না সেটিকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে।’ ভয়ানক খুনি বাহিনী সরকার বিশেষ করে ক্ষসতাসীন দল আওয়ামী লীগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার চেয়েও সরকার ও সরকারি দলকে রক্ষা এবং বিরোধী মতকে নিয়ন্ত্রণ করাই এই বাহিনীর এখন মূল দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে এই বাহিনীর প্রতি সরকারের কোনো নৈতিক শক্তি নেই এবং এই বাহিনীর জবাবদিহিতারও যেন কোনো বালাই নেই। ফলে ধীরে ধীরে দায়দায়িত্ববিহীন এক ভয়ানক খুনি দানবে পরিণত হয়েছে বর্তমান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। খুন, গুম এবং জেল-হাজতে নির্যাতন এই বাহিনীগুলোর এখন নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, র‌্যাবের হাতে সংঘটিত নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত হত্যা এখনো দেশের লাখো-কোটি মানুষের মধ্যে আতঙ্কের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতি সর্বত্র ক্রমবর্ধমান অনৈতিক চর্চা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও ক্ষমতার জোরে শত অপরাধ করেও পার পাওয়ার সংস্কৃতির ফলে দুর্নীতি দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই নয়, রাষ্ট্রের প্রায় সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানই আজ দুর্নীতির করালগ্রাসে নিমজ্জিত। চলতি বছরের ৩০ আগস্ট প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের খানা জরিপে বলা হয়েছে, দেশে বিদ্যমান সেবা খাতগুলোর মধ্যে ২০১৭ সালে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। জরিপে এরপরই রয়েছে পাসপোর্ট, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), বিচারিক সেবা, ভূমি, শিক্ষা এবং সরকারি স্বাস্থ্যসেবা। সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে ১৫টি খাতে দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে টিআইবির এই খানা জরিপে। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, এই জরিপে অংশগ্রহণকারীদের শতকরা ৭২.৫% পুলিশের হাতে কোন না কোন ধরনের দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। জরিপ অনুযায়ী, সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত বিভাগ হচ্ছে থানা পুলিশ, এরপর রয়েছে ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো জনগণের কাছ থেকে এই মেয়াদে ২১৬৬ কোটি টাকা ঘুষ হিসেবে আদায় করেছে বলে টিআইবির এক হিসাব বলছে। জরিপ অনুযায়ী ২০১৭ সালে মানুষকে যে পরিমাণ ঘুষ দিতে হয়েছে তা দেশের ২০১৬-১৭ অর্থবছরের মোট জিডিপির ০.৫ শতাংশ এবং একই অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের প্রায় ৩.৪ শতাংশ। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে টিআইবি সেই খানা জরিপ প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আমিও অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ গ্রহণ যেন প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়ে পড়েছে। ভয়ানক মানি লন্ডারিং বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১০ বছরে পাচার করা হয়েছে কমপক্ষে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা। ২০০৫ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে এই অর্থ পাচার হয়েছে বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন ভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই)। শুধু ২০১৪ সালেই বাংলাদেশ থেকে মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯ থেকে ১৩ শতাংশ পাচার হয়েছে টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৪৬ হাজার কোটি থেকে ৭২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭ থেকে ১১ শতাংশ বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আন্ডার-ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে। বাংলাদেশী টাকায় এ পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাকি অর্থ নগদ পাচার হয়েছে বলে জানিয়েছে মার্কিন সংস্থাটি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের কারণ মূলত তিনটি। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি বেড়েছে বলে অর্থ পাচারও বেড়েছে। এ ছাড়া দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অর্থ পাচার বাড়ছে। তাদের মতে, অর্থ পাচার রোধ করতে হলে দুর্নীতি কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। পাশাপাশি বিনিয়োগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। নাগরিক জীবনেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। এ ছাড়া শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করা হয়েছে। শেয়ারবাজারের দরবেশ খ্যাত সরকারি দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতার নাম সবারই জানা। এ ব্যাপারে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অর্থমন্ত্রীকে প্রতিবেদন দিলেও কারো নাম বলার সাহস পাননি। অপর দিকে, সিনেমার ভিলেনের মতো একটি কপট হাসি দিয়ে অর্থমন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানান, কারো নাম বলা যাবে না। তারা অনেক উচ্চ পর্যায়ের। অর্থমন্ত্রীর চেয়েও উচ্চ পর্যায়ের কারা হতে পারেন? কারাগারে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সয়লাব যখন দেশের সর্বত্র, লুটপাট ও দুর্নীতি যখন ক্ষমতাসীনদের নিত্য নৈমিত্তিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, তখন এক বিতর্কিত দুর্নীতির মামলায় দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক জোটের নেতা ও তিন বারের প্রধানমন্ত্রীকে জেলে দেয়া হলো। এর পর একের পর এক নতুন মামলায় তাকে আটক দেখানো হলো। উচ্চ আদালতে গিয়েও মামলার জট খুলতে পারছেন না। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট থেকে ২ কোটি ১০ লাখ টাকা তছরুপ করেছেন এমন অভিযোগে তাকে ৫ বছরের জেল দেয়া হলো। নানাবিধ পর্যালোচনায় উঠে এসেছে যে খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত ফাঁসানো হয়েছে। বিগত দুই বছরের জরুরি শাসনামলে যখন সেনাসমর্থন নিয়ে জেনারেল মঈন উদ্দিন ও ফখরুদ্দীন দেশ শাসন করছিলেন, তখন সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া- উভয়ের বিরুদ্ধেই অনেকগুলো মামলা দেয়া হয়েছিল। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সব মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে দ্রুততার সাথে এবং মামলাগুলো রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অথচ খালেদার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা সচল করা হয়েছে। রাজনৈতিক হয়রানি সারাদেশে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ও তার প্রধান রাজনৈতিক মিত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর হাজার হাজার নেতাকর্মীকে প্রতিনিয়ত রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। তারা তাদের ঘরে থাকতে পারছেন না পুলিশি হয়রানির ভয়ে। অনেকেই এরই মধ্যে আটক হয়ে কারাগারে কিংবা পলাতক হয়ে ফেরারি জীবন কাটাচ্ছেন। এমনকি বিএনপি ও জামায়াতের ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরাও ব্যাপক রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হচ্ছেন সারাদেশে। তারা গুম ও ক্রসফায়ারের নামে হত্যার শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। প্রিয় মাতৃভূমি আজ এই ছাত্র নেতাকর্মীদের নিকট এক কারাগারে পরিণত হয়েছে। অপর দিকে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজিসহ হেন কোনো অপরাধ নেই যা করছে না। অথচ এক অঘোষিত দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে এই ভয়াবহ দানবীয় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের। বিষয়টি এরই মধ্যে দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ফ্যাসিবাদের অপশাসন একটু নিরপেক্ষভাবে পর্যালোচনা করলে এটা খুবই পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করা যায় যে, গণতন্ত্রের লেবাসে বর্তমান বাংলাদেশে একটি ফ্যাসিবাদী শাসন চলছে। এখানে গণমাধ্যমের কণ্ঠ পুরোপুরিভাবে রোধ করা হয়েছে। এমনকি কেউ সামাজিক মাধ্যমেও সরকারের অপকর্ম নিয়ে বা স্বাভাবিক কোনো বিষয় নিয়ে ভিন্ন মত পোষণ করলেও তার আর রক্ষা নেই। আর এর সাথে সবশেষ যুক্ত হয়েছে বিতর্কিত তথ্যপ্রযুক্তি আইন। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন ফটোজার্নালিস্ট শহিদুল আলমকে যেভাবে আটক করে বন্দী রাখা হয়েছে এবং তার আগে কলামিস্ট ফরহাদ মজহারকে যে উপায়ে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হেনস্তা করা হলো তাতেই বোঝা যায় ফ্যাসিবাদী সরকার ভিন্ন মতকে কিভাবে দমন করতে চায়। এ ছাড়া সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর একনাগাড়ে অত্যাচারের যে স্টিমরোলার চালানো হচ্ছে তা বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে থাকবে। বিশ্ব গণমাধ্যমের সতর্ক বার্তা বাংলাদেশ যে দ্রুততার সাথে একটি স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে তা এরই মধ্যে বিশ্বের অনেকগুলো প্রভাবশালী গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বেশ গুরুত্বের সাথে ফুটে উঠেছে। শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের মোড়কে দেশে যে অনেকটাই স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার বিবরণ রয়েছে এসব প্রতিবেদনে। উদাহরণস্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুলের বরাত দিয়ে আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এটা এমনই এক সরকার এবং এমনই এক রাজনৈতিক দল যারা মনে করে থাকে যে তারা কারো নিকটই দায়বদ্ধ নয়। এটা গণতন্ত্রের জন্য এক ভয়াবহ আলামত।’ শুধু আসিফ নজরুলের উদ্ধৃতিই নয়, আলজাজিরার প্রতিবেদনেও বিষয়টির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। যেমন প্রতিবেদনের শুরুটাই ছিল অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও সাহসী। এখানে বলা হয়, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বিতর্কিত উপায়ে জেলে ঢোকানো এবং বিরোধী মতকে যেভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র নিষ্পেশিত করছে তাতে এমনই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে আগামী সংসদ নির্বাচনে মারাত্মক জালিয়াতি হবে।’ এই ঘোর অমানিশা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী? দেশের আমজনতার মধ্যে সত্যিকারের চেতনাবোধ জাগিয়ে তোলা সম্ভব হলেই এ দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। তবে, এক্ষেত্রে মূল চালকের আসনে বসতে হবে নতুন প্রজন্মকে। ঘুণেধরা সমাজে নতুন প্রজন্ম যে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে তার বাস্তব প্রমাণ পাওয়া গেল সড়ক নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের দাবিতে কোমলমতি স্কুলশিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক বাঁধভাঙা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পরিশেষে বলা যায় যে, পরিস্থিতি স্পষ্টতই জটিল। কিন্তু আশাহত হওয়ার কিছু নেই। সেদিন বেশি দূরে নয় যখন এদেশের তারুণ্যদীপ্ত নতুন প্রজন্ম সবকিছুর হাল ধরবে যারা কোনো ধরনের শঠতায় বিশ্বাসী নয়। নতুন এই শক্তি গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের দীপ্ত শপথ দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এমন আশাবাদী হওয়াই যায়। আর এদের হাতে রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিকড় গেড়ে থাকা ফ্যাসিবাদী শক্তির পতন হবে এবং সর্বত্র ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।

লেখক : সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির