post

বিবর্তনবাদ

মূল : হারুন ইয়াহিয়া অনুবাদ : অধ্যাপক খোন্দকার রোকনুজ্জামান

০৯ অক্টোবর ২০১৬
[গত সংখ্যার পর] সকল প্রাণীর ভ্রুণ মাতৃগর্ভে বিভিন্ন পর্যায় অতিল্ডম করে। বিবর্তনবাদ প্রমাণ করতে এটাকে এক বিশেষ তত্ত্ব হিসেবে গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এটা এক ভিত্তিহীন দাবি। এর কারণ হলো, বিবর্তনবাদী সাহিত্যে ‘পুনরাবৃত্তি’ নামে পরিচিত এই তত্ত্ব বৈজ্ঞানিক প্রতারণার চেয়েও বেশি; এটা বৈজ্ঞানিক জালিয়াতি। হিকেলের ‘পুনরাবৃত্তি’ কুসংস্কার ‘পুনরাবৃত্তি’ পরিভাষাটি এক বাণীর ঘনীভূত রূপ: ‘অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ল্ডমবিকাশে বিবর্তনের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে।’ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী আর্নস্ট হিকেল এটা উপস্থাপন করেন। হিকেলের এই তত্ত্ব যুক্তি দেখায় যে, প্রাণীর ভ্রুণ বিবর্তনপ্রল্ডিয়ার অভিজ্ঞতা পুনরায় লাভ করে, যেটা তাদের ছদ্ম পূর্বপুরুষেরা লাভ করেছিল। তিনি তত্ত্ব প্রদান করেন যে, মাতৃগর্ভে বিকাশের সময়কালে মানবভ্রুণ প্রথমে একটা মাছের বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে, তারপর সরীসৃপের এবং পরিশেষে মানুষের। বিকাশকালে ভ্রুণের ফুলকা থাকে- এই দাবির উৎস হলো উল্লিখিত তত্ত্ব। যাহোক, এটা নিখাদ কুসংস্কার। ‘পুনরাবৃত্তি’ এর সময় থেকে বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে এটার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে গবেষণা করা সম্ভব হয়েছে। এসব গবেষণায় দেখা গেছে, বিবর্তনবাদীদের কল্পনাশক্তি এবং উদ্দেশ্যমূলক বিকৃতি ছাড়া ‘পুনরাবৃত্তি’ তত্ত্বের আর কোনো ভিত্তি নেই। এখন এটা জানা গেছে যে, মানবভ্রুণের প্রাথমিক পর্যায়ে ফুলকা বলে যেটাকে অনুমান করা হয়েছে, সেগুলো আসলে মধ্য কর্ণকুহর, প্যারাথাইরয়েড ও থাইমাসের প্রাথমিক পর্যায়। ভ্রুণের যে অংশটিকে ডিম্ব-কুসুম থলির সাথে তুলনা করা হতো, সেটা আসলে শিশুর জন্য রক্ত উৎপন্নকারী থলি। যে অংশটাকে হিকেল ও তাঁর অনুসারীরা লেজ হিসেবে চিহ্নিত করতেন, তা আসলে মেরুদন্ড। এটা লেজের মত দেখতে হয় কেবল এই কারণে যে, এটা পায়ের আগে আকার লাভ করে। এগুলো বিজ্ঞানের জগতে সর্বজনস্বীকৃত বাস্তবতা। এমনকি বিবর্তনবাদীরা নিজেরাও এগুলো মেনে নিয়েছেন। নব্য ডারউইনবাদেও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জর্জ গেইলর্ড সিম্পসন লিখেছেন : ‘হিকেল বিবর্তনবাদের সংশ্লিষ্ট নীতি সম্পর্কে ভুল বিবৃতি দিয়েছেন। এটি এখন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিকাশ বিবর্তনবাদের ইতিহাসকে পুনরাবৃত্তি করে না।’ (Simpson.1965.p-241) ‘নিউ সায়েন্টিস্ট’ ম্যাগাজিনের অক্টোবর ১৬, ১৯৯৯ সংখ্যায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখিত হয় : ‘এটাকে বলা হয় বায়োজেনেটিক সূত্র (হিকেল বলেন- অনুবাদক), এবং ধারণাটি ‘পুনরাবৃত্তি’ নামে জনপ্রিয় হয়। আসলে হিকেলের বিধিটায় খুব অল্পকালেই ভুল পাওয়া গেল। উদাহরণস্বরূপ, প্রাথমিক মানবভ্রুণে কখনোই মাছের মতো কার্যকর ফুলকা থাকে না। এটা এমন কোনো পর্যায়ও অতিল্ডম করে না, যখন এটাকে সরীসৃপ বা বানরের মতো দেখায়। (কেন ম্যাকনামারা, New Scientist.1999) American Scientistনামক সাময়িকীতে আমরা দেখতে পাচ্ছি : ‘কোন সন্দেহ নেই, জৈববংশগতির সূত্র (biogenetic law))গজালের মত প্রাণহীন। এটাকে অবশেষে জীববিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক থেকে ৫০-এর দশকে বিদায় করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বীয় তদন্তের বিষয়বস্তু হিসেবে এটা বিশের দশকে অনুপস্থিত ছিল।’ (American Scientist. v-76.1988.p-273) আমরা যেমনটি দেখলাম, ‘পুনরাবৃত্তি’ এর ধারণা প্রথম পেশ করার পর থেকে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি আমাদেরকে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, এর আদৌ কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। যাহোক, ঐ একই অগ্রগতি (বিজ্ঞানের) এটাও পরিষ্কার করে দিচ্ছে যে, এটা কেবল বৈজ্ঞানিক প্রতারণা ছিল না, বরং এটার উৎপত্তি ঘটে সম্পূর্ণ ‘জালিয়াতি’ থেকে। হিকেলের জালিয়াতিপূর্ণ অঙ্কন ‘পুনরাবৃত্তি’ তত্ত্বের প্রথম উপস্থাপনকারী আর্নস্ট হিকেল তার তত্ত্বের সমর্থনে বেশ কিছু চিত্র প্রকাশ করেন। মানবভ্রুণ এবং মাছের ভ্রুণের সাদৃশ্য দেখানোর জন্য তিনি কিছু জালচিত্র প্রকাশ করেন। যখন তিনি ধরা পড়ে যান, তখন আত্মরক্ষার একমাত্র উপায় হিসেবে বলেন যে, অন্যান্য বিবর্তনবাদীরাও একই রকম অপরাধ করেছেন : “জালিয়াতির এই আপসমূলক স্বীকারোক্তির পর আমার বাধ্য হওয়া উচিত নিজেকে দোষী বিবেচনা করা; আমি শেষ হয়ে গেছি। সান্ত্বনা এই যে, বন্দিশালায় আমার আশপাশে আমারই মত শত শত অপরাধী দেখতে পাচ্ছি। এদের মধ্যে অনেকেই আবার খুব বিশ্বস্ত গবেষক এবং অত্যন্ত সম্মানিত জীববিজ্ঞানী। সবচেয়ে ভালো জীববিজ্ঞানের পাঠ্যবই, নিবন্ধ এবং সাময়িকীর বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ চিত্র একই মাত্রার ‘জালিয়াতি’র দোষে দুষ্ট। কারণ, এগুলো সবই ত্রুটিযুক্ত এবং কমবেশি ইচ্ছাকৃত পরিবর্তন, রূপান্তর ও গঠননির্মাণের শিকার।”  (Hitching.1982.p-204) ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ‘সায়েন্স’ নামক বিখ্যাত সাময়িকীতে এক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে প্রকাশ করে দেয়া হয় যে, হিকেলের প্রকাশ করা ভ্রুণের চিত্রগুলো ছিল প্রতারণার ফসল। ““Haeckel’s Embryos : Fraud Rediscovered”  শিরোনামের নিবন্ধে বলা হয়েছে : “(হিকেলের চিত্রাবলি থেকে) যেসব ধারণা পাওয়া যায় তা হলো, ভ্রুণগুলো একেবারে একই রকম। এটা ভুল”, বলেছেন লন্ডনের সেইন্ট জর্জ মেডিক্যাল স্কুলের ভ্রুণতত্ত্ববিদ মাইকেল রিচার্ডসন ... অতএব, তিনি এবং তার সহকর্মীগণ তাদের নিজস্ব তুলনামূলক গবেষণা শুরু করেন। তারা হিকেলের আঁকা মোটামুটি একই রকম দেখতে ভ্রুণের প্রজাতি এবং বয়সভিত্তিক আলোকচিত্র গ্রহণ করেন। আর দেখুন, ভ্রুণগুলো “প্রায়শ দেখতে বিস্ময়কর রকমের ভিন্ন”, রিচার্ডসন উল্লেখ করেন ‘‘Anatomy and Embryology’ নামক সাময়িকীর আগস্ট সংখ্যায়।” (Science, September 5, 1997) পরে ঐ একই নিবন্ধে নিম্নলিখিত তথ্য প্রকাশ করা হয়: “রিচার্ডসন ও তাঁর সহযোগীরা জানান, হিকেল কেবল বৈশিষ্ট্য যোগ-বিয়োগই করেননি, বরং তিনি মাপকাঠিতে গোঁজামিল দেন; আকারের দিক থেকে দশ গুণ পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে সাদৃশ্যের ব্যাপারে অতিরঞ্জন করেন। হিকেল এই পার্থক্যগুলোকে অবজ্ঞা করেন এবং অস্পষ্ট করে তোলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি এটা করেন প্রজাতির নামকরণের উদ্দেশ্যে, যেন একটি সমগ্র শ্রেণীর সকল প্রাণীর জন্য একটি প্রতিনিধি যথার্থ। বাস্তবতা হলো, রিচার্ডসন ও তাঁর সহযোগীরা উল্লেখ করেন, এমনকি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত ভ্রুণও, যেমন মাছের ভ্রুণ, তাদের আকার ও বিকাশের পথে বেশ ভিন্ন হয়ে থাকে। রিচার্ডসন উপসংহারে বলেন, (হিকেলের আঁকা ছবি থেকে) মনে হয়, এটা জীববিজ্ঞানের অন্যতম জালিয়াতি। (Science. September 5, 1997) লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, হিকেল জালিয়াতি করেন ১৯০১ সালে; বিষয়টা প্রায় এক শতাব্দীকাল অনেক বিবর্তনবাদী প্রকাশনায় স্থান পেয়েছে, যেন এটা এক প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক সূত্র। যারা বৈজ্ঞানিক বিশ্বাস লালন করতেন অসাবধানভাবে, তাঁরা তাঁদের আদর্শকে বিজ্ঞানের ওপর প্রাধান্য দিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ এক বাণী দিয়েছেন : বিবর্তনবাদ বিজ্ঞান নয়, এটা এক যুক্তিহীন বিশ্বাস যা তারা বৈজ্ঞানিক সত্যের বিপরীতে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। বিবর্তনবাদের প্রমাণ হিসেবে ক্লোনিং চিত্র অঙ্কন করা কেন প্রতারণামূলক? ক্লোনিংয়ের মতো বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ‘বিবর্তনবাদকে সমর্থন কওে’ কি না- এরকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়। এই ব্যাপারটি খুব গুরুত্বপূর্ণ এক সত্যকে প্রকাশ করে দেয়। এটা হলো, মানুষকে তাদের মতবাদ গ্রহণ করানোর জন্য তারা যে প্রচারণা চালান তার মূল্যহীনতা। যেহেতু ক্লোনিং বিষয়টির সাথে বিবর্তনবাদের কোনো সম্পর্ক নেই, সেহেতু এটি কোনো পেশাদার বিবর্তনবাদীর বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। যাহোক, যারা অন্ধভাবে যে কোন মূল্যে বিবর্তনবাদ সমর্থন করে, তাদের কেউ কেউ, বিশেষ করে প্রচারমাধ্যমের কিছু চল্ড, এমনকি ক্লোনিংয়ের মত সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন বিষয়কেও বিবর্তনের স্বপক্ষে প্রচারণায় আনতে চেষ্টা করেছে। প্রাণীর ক্লোনিং বলতে কী বুঝায়? ক্লোনিং প্রল্ডিয়ায় যে প্রাণী থেকে অন্য প্রাণী তৈরি করা হবে, তার ডিএনএ ব্যবহার করা হয়। উল্লিখিত প্রাণীর যে কোন কোষ থেকে ডিএনএ বের করে একই প্রজাতির অন্য প্রাণীর ডিম্বকোষের মধ্যে রোপণ করা হয়। এর ঠিক পর পরই এক শক্ দেয়া হয় যা ডিম্বকোষকে বিভাজিত করে দেয়। এর পরে ভ্রুণটিকে কোনো জীবিত প্রাণীর জরায়ুতে রোপণ করা হয়। সেখানে এটার বিভাজন চলতে থাকে। বিজ্ঞানীরা এরপর অপেক্ষা করতে থাকেন এটার বিকাশ ও জন্মের জন্য। বিবর্তনের সাথে ক্লোনিংয়ের কোনো সম্পর্ক নেই ক্লোনিং এবং বিবর্তনের ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিবর্তনবাদ এই দাবির ওপর প্রতিষ্ঠিত যে, জড়বস্তু দৈবল্ডমে জীবন লাভ করে (এমনটি ঘটতে পারার স্বপক্ষে সামান্যতম প্রমাণও নেই)। পক্ষান্তরে, ক্লোনিং হলো কোন প্রাণীকোষের জেনেটিক উপাদান ব্যবহার করে আরেকটি নকল (একই রকম আরেকটি প্রাণী- অনুবাদক) তৈরি করা। নতুন প্রাণীটি একক কোষ থেকে যাত্রা শুরু করে এবং একটি জৈব প্রল্ডিয়ায় গবেষণাগারে স্থানান্তর করা হয় এবং সেখানে পুনরাবৃত্তি করা হয়। অন্য কথায়, বিবর্তনবাদীদের দাবি মোতাবেক এরকম প্রল্ডিয়া ‘দৈবল্ডমে’ ঘটার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, আর না ক্লোনিংয়ে “প্রাণহীন বস্তু প্রাণ লাভ করে”। ক্লোনিং প্রল্ডিয়া কোনোভাবেই বিবর্তনের পক্ষে কোনো প্রমাণ নয়। বরং এটা হলো জীববিজ্ঞানের একটি সূত্রের সুস্পষ্ট প্রমাণ যা বিবর্তনবাদের ভিত্তি সম্পূর্ণ নড়বড়ে করে দেয়। জীব-বিজ্ঞানের এই বিখ্যাত মূলনীতিটি হলো : “প্রাণ কেবল প্রাণ থেকেই আসতে পারে”। এই নীতিটি পেশ করেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। এই প্রকাশ্য সত্যের বিপরীতে ক্লোনিং-কে বিবর্তনবাদের প্রমাণ বলাটা এক প্রতারণা, যা প্রচারমাধ্যম অবলম্বন করেছে। বিগত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অগ্রগতি এটাই নির্দেশ করছে যে, প্রাণের উদ্ভব ‘আকস্মিকতা’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। বিবর্তনবাদীদের বৈজ্ঞানিক ভ্রান্তি এবং একপেশে মন্তব্যের যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। বিজ্ঞানের রাজ্যে বিবর্তনবাদ অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। এই বাস্তবতা কিছু বিবর্তনবাদীকে অন্যান্য ক্ষেত্রে নজর দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এই কারণেই ‘ক্লোনিং’ বা ‘টেস্টটিউব বেবি’ এর মতো বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে সাম্প্রতিক অতীতে এত অন্ধের মত বিবর্তনবাদের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বিজ্ঞানের নামে সমাজকে বলার মতো বিবর্তনবাদীদের আর কিছু নেই। এ-জন্য তারা মানুষের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের যে শূন্যতা, তার আশ্রয় গ্রহণ করে। এভাবে তারা মতবাদটার জীবন দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এতে অবশ্য মতবাদটাকে করুণ অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে। অন্যসব বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির মতো ক্লোনিং খুব গুরুত্বপূর্ণ; এটি এক সত্য প্রকাশকারী বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি। ক্লোনিং এই সত্যের ওপর আলোকপাত করে যে, প্রাণ সৃজিত হয়েছিল। ক্লোনিংয়ের অন্য কিছু অপব্যাখ্যা ক্লোনিং সম্পর্কে মানুষ আরেকটা ভুল বুঝেছে; সেটা হলো, ক্লোনিং ‘মানুষ সৃষ্টি করতে পারে’। অথচ, ক্লোনিং এমন কোনো ব্যাখ্যা দাবি করে না। ক্লোনিং করা হয় বংশগতির তথ্য সংযোগের মাধ্যমে, যা আগে থেকেই প্রাণীর প্রজনন পদ্ধতিতে বিদ্যমান। এই প্রল্ডিয়ায় কোনো নতুন পদ্ধতি বা বংশগতির তথ্য সৃষ্টি করা হয় না। বংশগতির তথ্য এমন কারো নিকট থেকে গ্রহণ করা হয়, যার অস্তিত্ব আগে থেকেই আছে। এটা (এই তথ্য ঐ একই প্রজাতির) স্ত্রীগর্ভে রোপণ করা হয়। এটার সাহায্যে শিশুটি অবশেষে সেই প্রাণীর ‘অভিন্ন যমজ’ হিসেবে জন্মলাভ করে, যার থেকে বংশগতির তথ্য গ্রহণ করা হয়েছিল। অনেক লোক, যারা ক্লোনিং কি তা ভালোভাবে বোঝে না, তারা এ-সম্পর্কে যত রকম অদ্ভুত ধারণা পোষণ করে। উদাহরণস্বরূপ, তারা কল্পনা করে যে, ৩০ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তি থেকে একটি কোষ নেয়া হয় এবং সে-দিনই আরেকজন ৩০ বছর বয়স্ক মানুষ সৃষ্টি করা যায়। ক্লোনিংয়ের এরকম উদাহরণ কেবল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে পাওয়া যেতে পারে, বাস্তবে নয়, আর কখনো সম্ভব হবেও না। মূলত ক্লোনিং হলো প্রকৃতিক পদ্ধতিতে (অন্য কথায় মাতৃগর্ভে- অনুবাদক) একজন ব্যক্তির ‘অভিন্ন যমজ’ তৈরি করা। বিবর্তনবাদ কিংবা ‘মানুষ সৃষ্টি’-র সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষ কিংবা অন্য কোনো জীব সৃষ্টি করা- অন্য কথায়, শূন্য থেকে কোনো কিছুকে অস্তিত্বে নিয়ে আসা- এমন এক ক্ষমতা, যা কেবল স্রষ্টার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। এই সৃষ্টি মানুষের দ্বারা হতে পারে না- এটা দেখানোর মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ঠিক এই বিষয়টি নিশ্চিত করে। বিষয়টি এক আয়াতে এভাবে বর্ণিত হয়েছে : “(তিনি) আসমান ও জমিনের স্রষ্টা। যখন তিনি কিছু সৃষ্টি করতে চান, তখন কেবল বলেন ‘হও’ এবং তা হয়ে যায়।” (আল করআন- ২:১১৭) জীবন কি পৃথিবীর বাইরে থেকে আসতে পারে? ডারউইন যখন ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে তার মতবাদ পেশ করেন, তখন তিনি মোটেই উল্লেখ করেননি কিভাবে প্রাণ তথা প্রথম জীবন্ত কোষের উদ্ভব হলো। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বিজ্ঞানীরা প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে উপলব্ধি করা শুরু করেন যে, মতবাদটি অগ্রহণযোগ্য। প্রাণের জটিল এবং নিখুঁত কাঠামো অনেক গবেষকের জন্য বিশেষ সত্যকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। গাণিতিক হিসাব-নিকাশ এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ নির্দেশ করছে যে, প্রাণ ‘আকস্মিকতার ফসল’ হতে পারে না, যেমনটি বিবর্তনবাদীরা দাবি করে। আকস্মিকতার দাবির অসারতা এবং প্রাণের ‘পরিকল্পিত’ হওয়ার বিষয়টি উপলব্ধির পর কিছু বিজ্ঞানী পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্যে প্রাণের অস্তিত্বের কথা ভাবতে থাকেন। যেসব বিজ্ঞানী এরকম দাবি করেন, তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত হলেন ফ্রেড হোয়েল এবং চন্দ্রবিল্ডম সিংঘে। এঁরা দু’জন একটি দৃশ্যকল্পকে একত্রে জুড়ে দেন; তাঁরা ধারণা দেন যে, কোনো এক শক্তি মহাশূন্যে প্রাণের ‘বীজ বপন করে’। এই দৃশ্যকল্পের মতে, এসব বীজ মহাশূন্যে বাহিত হয় গ্যাস বা ধূলিমেঘের দ্বারা, কিংবা কোনো উল্কাপিন্ডের দ্বারা। পরিশেষে এটা পৃথিবীতে এসে পড়ে। এভাবে এখানে প্রাণের সূত্রপাত হয়। নোবেল পুরস্কার জয়ী বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ল্ডিক, যিনি জেমস ওয়াটসনের সাথে ডিএনএ-এর ডাবল হেলিক্স কাঠামো আবিষ্কার করেন, তিনি হলেন তাঁদের অন্যতম যাঁরা মহাশূন্যে প্রাণের উৎপত্তির সন্ধান করেছেন। ল্ডিক এই উপলব্ধিতে আসেন যে, আকস্মিকভাবে প্রাণের উৎপত্তির বিষয়টা আশা করা একেবারেই অযৌক্তিক। কিন্তু তিনি এর পরিবর্তে দাবি করেন যে, ভূপৃষ্ঠে জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল ‘পৃথিবীর বাইরের’ কোনো বুদ্ধিমান শক্তি দ্বারা। আমরা যেমনটি দেখেছি, মহাশূন্য থেকে প্রাণের আগমনের ধারণা বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদেরকে প্রভাবিত করেছে। এই বিষয়টি এখন এমনকি প্রাণের উৎপত্তি সম্পকির্ত লেখালেখি এবং বিতর্কে আলোচিত হচ্ছে। মহাশূন্যে প্রাণের উৎপত্তির ধারণাটি দু’টি মৌলিক প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে। বৈজ্ঞানিক অসঙ্গতি ‘প্রাণের শুরু পৃথিবীর বাইরে’- মতবাদ মূল্যায়নের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে পৃথিবীপৃষ্ঠে পতিত উল্কাপিন্ডের গবেষণা এবং মহাশূন্যে বিদ্যমান গ্যাস ও ধূলিমেঘের মধ্যে। এই দাবির সমর্থনে এখনো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে, মহাশূন্যের কোনো গ্রহ-উপগ্রহে অপার্থিব কোনো প্রাণী রয়েছে যা পরিশেষে পৃথিবীর বুকে প্রাণের বীজ ছড়িয়েছে। এযাবৎ যত গবেষণা পরিচালিত হয়েছে তার কোনোটাতেই জীব-কাঠামোয় অতি বৃহৎ কোনো জৈব অণুর (যেমন প্রোটিন, নিউক্লিয়িক এসিড ইত্যাদি- অনুবাদক) উপস্থিতি প্রকাশ পায়নি। তাছাড়া, উল্কাপিন্ডে যে উপাদানগুলো আছে, তাতে একটি বিশেষ ধরনের অপ্রতিসমতা নেই যা জীবন গঠনকারী অতি-অণুতে (যেমন, প্রোটিন, নিউক্লিয়িক এসিড ইত্যাদি- অনুবাদক) পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, প্রোটিন গঠনকারী এ্যামিনো এসিডগুলো নিজেরা জীবন-প্রাসাদের ইটের মতো। এই এসিড তত্ত্বীয়ভাবে বাম এবং ডান উভয় হাতি কাঠামোয় (অপটিক্যাল আইসোমার) মোটামুটি সমান সংখ্যায় থাকা উচিত। তবে কেবল বাম হাতি এ্যামিনো এসিড প্রোটিনে পাওয়া যায়, অথচ এই অপ্রতিসম বণ্টন ছোট জৈব অণুতে ঘটে না (কার্বনভিত্তিক অণু জীবদেহে পাওয়া যায়) যা উল্কাপিন্ডে আবিষ্কৃত হয়েছে। পরবর্তীটা বিদ্যমান বাম ও ডান উভয় হাতি কাঠামোয়। (Pigliucci, October.1998) পৃথিবীর বাইরের কোনো প্রাণী বা উপাদান পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব ঘটায়- এই মতবাদের এটাই শেষ প্রতিবন্ধকতা নয়। যারা এ রকম ধারণা পোষণ করেন, তাদের ব্যাখ্যা করার সামর্থ্য থাকা উচিত, কেন এ-রকম প্রল্ডিয়া এখন ঘটছে না, অথচ এখনো পৃথিবীর বুকে উল্কাপিন্ড আঘাত হানছে। যাহোক, এসব উল্কাপিন্ড নিয়ে গবেষণা ‘প্রাণের বীজ’ মতবাদকে কোনোভাবে নিশ্চিত করার মতো প্রমাণ পেশ করেনি। এই মতবাদের সমর্থকরা আরেকটি প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। প্রশ্নটি হলো : কিভাবে পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ প্রজাতি এলো (যদি ধরেও নেয়া হয় যে, প্রাণ গঠিত হয়েছিল মহাশূন্যের কোনো সচেতনতা দ্বারা এবং কোনোভাবে এটি পৃথিবীতে পৌঁছেছিল)? এটা তাদের জন্য এক বড় উভয় সঙ্কট যারা ধারণা দেন যে, প্রাণের শুরু মহাশূন্যে। এসব প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও মহাশূন্যে প্রাণের বা সভ্যতার এমন কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি যা পৃথিবীতে প্রাণের শুরু করতে পারত। বিগত ৩০ বছরে বিরাট অগ্রগতি অর্জন করেছে যে জ্যোতির্বিদ্যা, তার কোনো পর্যবেক্ষণ এ রকম কোনো সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করতে পারেনি। [চলবে]'

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির