post

বিবর্তনবাদ মূল : হারুন ইয়াহিয়া

অনুবাদ : অধ্যাপক খোন্দকার রোকনুজ্জামান

২৩ জুলাই ২০১৬
গত সংখ্যার পর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডানিয়েল লিবারম্যান বলেন :“এটার (এই খুলির আবিষ্কার- অনুবাদক) প্রভাব হবে একটা ছোট আণবিক বোমার মত।”  (Parsell. 2002) এর কারণ হলো, আলোচিত জীবাশ্মটি যদিও-বা ৭ মিলিয়ন বছর বয়স্ক, তবুও মানুষের সাথে এর কাঠামোগত সাদৃশ্য (বিবর্তনবাদীরা এযাবৎ এই মানদন্ড ব্যবহার করে আসছেন) ৫ মিলিয়ন বছরের পুরাতন অস্ট্রালোপিথেকাস নর-বানরের চেয়ে বেশি, যে নর-বানরকে মানুষের আদিমতম পূর্বপুরুষ বলা হয়ে আসছে। এ থেকে এটাই দেখা যাচ্ছে যে, বিলুপ্ত বানর প্রজাতিগুলোর মধ্যে বিবর্তনগত যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত ব্যক্তিনিষ্ঠ এবং পূর্বধারণামূলক মানদন্ড তথা “মানুষের সাথে সাদৃশ্য” একেবারেই কাল্পনিক। ২০০২ সালের ১১ জুলাই “নেচার” সাময়িকীতে জন হুইটফিল্ডের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় যার শিরোনাম “মানবগোত্রের প্রাচীনতম সদস্য আবিষ্কার”। এই প্রবন্ধে তিনি আলোচিত দৃষ্টিভঙ্গিকে নিশ্চিত করেন জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনবাদী নৃতত্ত্ববিদ বার্নার্ড উডের উদ্ধৃতি দিয়ে : “যখন আমি ১৯৬৩ সালে মেডিক্যাল স্কুলে ভর্তি হই, তখন মানব বিবর্তনকে মইয়ের মত মনে হতো।” তিনি (বার্নার্ড উড) বলেন, “মইটা বানর থেকে মানুষের ধাপে উঠেছে মধ্যবর্তী কিছু পর্যায়ের মধ্য দিয়ে, যাদের প্রত্যেকে পূর্ববর্তীর তুলনায় কিছুটা কম বানরাকৃতির। এখন মানববিবর্তন ঝোপের মত দেখায়। আমাদের কাছে মানবাকার জীবাশ্মের এক সংগ্রহশালা রয়েছে .... তারা কিভাবে একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত এবং তাদের কোন্টা (যদি আদৌ থেকে থাকে) মানুষের পূর্বপুরুষ তা নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে। (Whitfield. 2002) নতুন আবিষ্কৃত বানরের জীবাশ্ম সম্পর্কে অন্যতম শ্রেষ্ঠ জীবাশ্ম-নৃবিজ্ঞানী এবং “নেচার” সাময়িকীর সিনিয়র সম্পাদক হেনরি গি-এর মন্তব্য খুবই উল্লেখযোগ্য। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে গি জীবাশ্মটি নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের উল্লেখ করে লিখেছেন : “পরিণতি যা-ই হোক, খুলিটি দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ‘হারানো সূত্র’ এর পুরাতন ধারণা পলায়নের পথ খুঁজছে ... এখন এটা খুব স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত যে, খোদ হারানো সূত্রের ধারণাটা (যা সব সময় নড়বড়ে ছিল) এখন একেবারেই বজায় রাখার অযোগ্য।” (The Guardian.2002.July.11) আমরা যেমনটি দেখলাম, ক্রমবর্ধমান আবিষ্কার বিবর্তনবাদের বিপরীত ফল প্রদান করছে, এটার পক্ষে নয়। যদি এ-রকম কোন বিবর্তনমূলক প্রক্রিয়া অতীতে ঘটে থাকত, তাহলে তার অনেক চিহ্ন পাওয়া যেত, এবং প্রতিটি নতুন আবিষ্কার এই মতবাদকে আরো জোরালো করত। বস্তুত “The Origin of Species” গ্রন্থে ডারউইন দাবি করেন যে, বিজ্ঞানের উন্নতি ঐ পথেই ঘটবে। তাঁর দৃষ্টিতে, তাঁর মতবাদের একমাত্র সমস্যা হলো জীবাশ্ম আবিষ্কারের ঘাটতি। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, ভবিষ্যতের গবেষণায় অসংখ্য জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হবে যা তাঁর মতবাদকে সমর্থন করবে। যাহোক, পরবর্তী কালের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার আসলে ডারউইনের স্বপ্নকে সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়েছে। মানব-সূত্রের  (human-link) গুরুত্ব মানুষ সম্পর্কিত আবিষ্কারের কিছু উদাহরণ এখানে আমরা দেখেছি। এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ সত্য প্রকাশ করে দিচ্ছে। বিশেষ করে, তারা আরো একবার দেখিয়ে দিয়েছে বিবর্তনবাদীরা বানরাকৃতির প্রাণীকে মানুষের পূর্বপুরুষ বলে যে দাবি করে, তা কি বিরাট কাল্পনিক ব্যাপার। এই কারণে এসব বানর প্রজাতিগুলো মানুষের পূর্বপুরুষ হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। পরিশেষে বলতে হয়, জীবাশ্ম রেকর্ড আমাদেরকে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, মানুষ লক্ষ লক্ষ বছর আগে অস্তিত্ব¡ লাভ করে ঠিক তেমনি আকার-আকৃতিতে, যেমনটি সে এখন রয়েছে। সে মোটেই কোন বিবর্তনমূলক উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় বর্তমান পর্যায়ে আসেনি। যদি বিবর্তনবাদীরা সত্যিই নিজেদেরকে বিজ্ঞানী এবং সৎ বলে দাবি করেন, তাহলে তাদের উচিত এই পর্যায়ে এসে বানর থেকে মানুষের কাল্পনিক ক্রমবিকাশের ধারণা আবর্জনার স্তূপে ছুড়ে ফেলা। তারা যে এই বানোয়াট গোত্র-বৃক্ষ (family tree) পরিত্যাগ করছেন না- সেটাই প্রকাশ করে দিচ্ছে যে, বিবর্তনবাদ কোন মতবাদ নয় যা বিজ্ঞানের নামে রক্ষা করে যাওয়া হচ্ছে। বরং এটা এক অন্ধবিশ্বাস যা তারা বৈজ্ঞানিক সত্যের মোকাবেলায় বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। বিবর্তনবাদীরা যে মিথ্যা দাবি বার বার পেশ করে তা হলো এই যে, বিবর্তনবাদই জীববিজ্ঞানের ভিত্তি। যারা এই দাবি পেশ করেন, তারা এই ধারণা দেন যে, বিবর্তনের এই মতবাদ ছাড়া জীববিজ্ঞানের বিকাশ ঘটত না, এমনকি অস্তিত্বও থাকত না। এই দাবি উদ্ভূত হয়েছে হতাশাজাত বক্তৃতাবাজি থেকে। তুর্কি বিজ্ঞানের জগতে অন্যতম প্রধান এক নাম দার্শনিক অধ্যাপক আর্দা ডেঙ্কেল; এই বিষয়ের ওপর তিনি নিম্নিলিখিত মন্তব্য করেন : “দৃষ্টান্তস্বরূপ, এই ধারণা দেয়া একেবারেই ভুল যে, বিবর্তনবাদকে প্রত্যাখ্যান করা মানেই জীববিজ্ঞান এবং ভূতত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করা, পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নের আবিষ্কারকে প্রত্যাখ্যান করা। কারণ, এরকম সিদ্ধান্তে আসার জন্য রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, ভূ-তত্ত্ব এবং জীববিজ্ঞানের আবিষ্কার সম্পর্কিত কিছু প্রস্তাবনা প্রয়োজন যা বিবর্তনবাদের ইঙ্গিত প্রদান করে। অথচ বাস্তবে কোনো আবিষ্কার এই মতবাদের প্রতি কোন ইঙ্গিত প্রদান করে না। অতএব, এটা প্রমাণিত হয় না।” (Denkel.1999) এটা উপলব্ধি করার জন্য বিজ্ঞানের ইতিহাস লক্ষ্য করাটাই যথেষ্ট। “বিবর্তনবাদ হলো জীববিজ্ঞানের মূল”- এই দাবি কতই না অকেজো এবং অযৌক্তিক! যদি এই দাবি সত্য হতো, তাহলে সেটার অর্থ এই দাঁড়াত যে, বিবর্তনবাদের উদ্ভবের আগে পৃথিবীতে জীববিজ্ঞানের কোনো বিকাশ ঘটেনি এবং এই মতবাদের পরেই সব কিছু আবিষ্কৃত হয়েছে। অথচ জীববিজ্ঞানের অনেক শাখা, যেমন- অ্যানাটমি, ফিজিওলজি এবং জীবাশ্ম-বিজ্ঞানের জন্ম এবং বিকাশ ঘটেছে বিবর্তনবাদের আগেই। পক্ষান্তরে, বিবর্তনবাদ হলো এক যুক্তিধারা যার জন্ম হয়েছে এই সব বিজ্ঞানের পরে। বিবর্তনবাদীরা জোরপূর্বক এটাকে বিজ্ঞানের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। বিবর্তনবাদীরা এই একই রকম পন্থা প্রয়োগ করেছিল স্ট্যালিনের সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে। সেই সময়, সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারি মতাদর্শ কমিউনিজম মনে করত, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের দর্শন হলো সকল বিজ্ঞানের ভিত্তি। স্ট্যালিনের নির্দেশ ছিল যে, সকল বৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ মেনেই করতে হবে। এইভাবে, জীববিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থ বিজ্ঞান, ইতিহাস, রাজনীতি এমনকি কলা শাখার পুস্তকাদির শুরুতে এমন পর্ব থাকত, যার ফলে ঐসব বিজ্ঞানকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এবং মার্কস, অ্যাঙ্গেলস ও লেনিনের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তিশীল করা হয়েছিল। যাহোক, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে  নেয়া হয় এবং পুস্তকাদি সাধারণ প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থে পরিণত হয় এবং তথ্যগুলি যথার্থ থাকে। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মতো অর্থহীন বিষয় পরিত্যাগ করাতে বিজ্ঞানের জগতে অন্ধকারের ছায়া নামেনি, বরং এটার ওপর থেকে চাপ ও বাধ্যবাধকতা অপসারিত হয়েছে। আমাদের যুগে বিজ্ঞানকে বিবর্তনবাদের সাথে বেঁধে রাখার কোনো যুক্তি নেই। বিজ্ঞানের ভিত্তি হলো পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষণ। পক্ষান্তরে, বিবর্তনবাদ হলো পর্যবেক্ষণ না করা অতীত নিয়ে এক যুক্তিধারা। তা ছাড়া, এই মতবাদের দাবি এবং প্রস্তাবনা বিজ্ঞান এবং যুক্তি-বিধি দ্বারা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বিজ্ঞান নিঃসন্দেহে কোন ক্ষতির সম্মুখীন হবে না যখন এই যুক্তিধারা পরিত্যাগ করা হবে। আমেরিকান জীববিজ্ঞানী জি, ডব্লিউ হারপার এই বিষয়ের ওপর যা বলেছেন তা হলো: “এটা সচরাচর দাবি করা হয় যে, ডারউইনবাদ আধুনিক জীববিজ্ঞানের প্রাণ। বাস্তবতা ঠিক বিপরীত; যদি ডারউইনবাদের সব তথ্য সহসা উধাও হয়ে যায়, তাহলে জীববিজ্ঞান বাস্তবিকই অপরিবর্তিত থেকে যাবে ...।” (Harper. 1979.p-26) আসলে, একেবারে বিপরীতক্রমে, বিজ্ঞান আরো দ্রুতগতিতে এবং সবলভাবে অগ্রসর হবে যখন এটা গোঁড়ামিপূর্ণ চিন্তা, কুসংস্কার, অর্থহীন এবং বানোয়াট বিষয়ের মতবাদ থেকে মুক্ত হবে। ৫.    বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর অস্তিত্ব কেন বিবর্তনবাদের পক্ষে যুক্তি নয়? কিছু বিবর্তনবাদী বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্বকে বিবর্তনবাদের প্রমাণ হিসাবে পেশ করার চেষ্টা করেন। আসলে এই দাবি তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যবহার করেন নবীন বিবর্তনবাদীরা। কারণ, তারা যে মতবাদকে রক্ষা করতে চাচ্ছেন, সে বিষয়ে প্রয়োজনের তুলনায় কম জ্ঞান রাখেন। যারা এই দাবি রক্ষা করতে চান, তাদের প্রস্তাবিত মতবাদের ভিত্তি হলো, “ঐশী উৎসের বক্তব্য অনুসারে যদি প্রাণের সূত্রপাত হয় একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে, তাহলে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মানুষের উদ্ভব কিভাবে ঘটতে পারল?” কথাটা এভাবেও বলা হয়, “যেহেতু আদম ও হাওয়ার উচ্চতা, গায়ের রঙ এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য ছিল কেবল দু’জন মানুষের, তাহলে কিভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের জাতি গোষ্ঠীর উদ্ভব হলো?” আসলে, এসব প্রশ্ন বা আপত্তির ক্ষেত্রে যে সমস্যা লুকিয়ে আছে তা হলো বংশগতি বিদ্যার সূত্রগুলি সম্পর্কে অপর্যাপ্ত জ্ঞান, কিংবা সেগুলি গ্রাহ্য না করা। আজকের বিশ্বে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে যে পার্থক্য, তার কারণ উপলব্ধি করার জন্য “বিভিন্নতা” বিষয়ক কিছু ধারণা থাকা প্রয়োজন যা এই প্রশ্নের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। বিভিন্নতা বংশগতি বিদ্যায় ব্যবহৃত এক পরিভাষা যা এক জিনগত ঘটনাকে নির্দেশ করে এবং কোন প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত সদস্য বা দলকে ভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করে। এই বিভিন্নতার উৎস হলো জিনগত তথ্য যা সেই প্রজাতির অন্তর্গত প্রতিটি সদস্যেও মধ্যে বিদ্যমান থাকে। ঐ সদস্যদের মধ্যে প্রজননের ফলে সেই জিনগত তথ্য পরবর্তী প্রজন্মে এসে ভিন্নভাবে সমন্বিত হয়। মাতা এবং পিতার ক্রোমোজমের মধ্যে জিনগত উপাদানের বিনিময় হয়। এভাবে জিনগুলি একে অন্যের সাথে মিশ্রিত হয়। এরই ফল বহুবিচিত্র বৈশিষ্ট্যের ব্যক্তির উদ্ভব। মানবজাতি-গোষ্ঠীগুলির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কারণ হলো মানবজাতির অভ্যন্তরীণ ভিন্নতা। ভূপৃষ্ঠের সব মানুষই মূলত একই জিনগত তথ্য বহন করে। তবুও কারো চোখ ট্যারা, কারো চুল লাল, কারো নাক লম্বা, আবার কারো দেহাকৃতি খাটোÑ সবকিছু নিভর্র করে এই জিনগত তথ্যের বিভিন্নতার সম্ভাবনার উপরে। বিভিন্নতার সম্ভাবনা বোঝার জন্য আসুন আমরা একটি সমাজের কথা বিবেচনা করি যেখানে বাদামি চুলের বাদামি চোখবিশিষ্ট মানুষের সংখ্যা ফর্সা ত্বকের নীল চোখ বিশিষ্ট মানুষের তুলনায় বেশি। এই দুই প্রকার মানুষের মধ্যে বিবাহ এবং সংমিশ্রণের ফলে নতুন প্রজন্মের আগমন ঘটবে, যাদের হয়ত চুল বাদামি হবে অথচ চোখ হবে নীল। অন্য কথায়, উভয় দলের শারীরিক বৈশিষ্ট্য একত্র হবে পরবর্তী প্রজন্মে এবং নতুন চেহারার জন্ম দেবে। একইভাবে মিশ্রিত অন্যান্য শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কথা কল্পনা করলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বিপুল বৈচিত্র্যের আবির্ভাব ঘটবে। এখানে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অবশ্যই বুঝে নিতে হবে, তা হলো : দু’টি জিন আছে যা প্রত্যেক শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ওপর আধিপত্য করে। একটি অপরটির চেয়ে প্রবল হতে পারে, কিংবা তারা উভয়েই সমমাত্রায় কোন বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, দুইটা জিন একজন ব্যক্তির চোখের রঙ নির্ধারণ করে। একটি আসে মাতা থেকে, অপরটি পিতা থেকে। যে জিনটা প্রবল, সেটা দ্বারা নির্ধারিত হবে সন্তানের চোখের রঙ। সাধারণভাবে বলতে গেলে, গাঢ় বর্ণ হালকার ওপরে প্রবল হয়। এভাবে যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে বাদামি এবং সবুজ চোখের জিন থাকে, তাহলে তার চোখের রঙ হবে বাদামি, কারণ, বাদামি চোখের জিন হলো প্রবল। যাহোক, দমিত সবুজ রঙ কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত বাহিত হবে এবং পরবর্তীতে কোন এক সময় আত্মপ্রকাশ করবে। অন্য কথায়, বাদামি চোখবিশিষ্ট মাতা-পিতা সবুজ চোখবিশিষ্ট সন্তান জন্ম দিতে পারে। কারণ, সেই রঙের জিন মাতা ও পিতা উভয়ের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল। এই সূত্র অন্য সব শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং যেসব জিন তা নিয়ন্ত্রণ করে তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। শত শত এমনকি হাজার হাজার শারীরিক বৈশিষ্ট্য, যেমন কান, নাক, মুখের আকৃতি, উচ্চতা, হাড়ের কাঠামো, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাঠামো, আকার এবং বৈশিষ্ট্য- সবকিছু একইভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। এই ব্যবস্থাপনাকে ধন্যবাদ, জিন-কাঠামোর অসংখ্য তথ্য বাহ্যিকভাবে দৃশ্যমান না হয়েই প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্থানান্তরিত হতে পারে। প্রথম মানব-মানবী আদম এবং হাওয়া এই বিপুল তথ্য-ভান্ডার পরবর্তী প্রজন্মসমূহে স্থানান্তর করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যদিও এর অতি সামান্য অংশই তাঁর শারীরিক গঠনে প্রতিফলিত হয়েছিল। মানবেতিহাসে যে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ঘটেছিল, তা এমন পরিবেশ তৈরি করেছিল যেখানে বিভিন্ন শারীরিক বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে একত্র হয়েছিল। দীর্ঘ সময়কালব্যাপী এটা মানুষকে দলবদ্ধ করেছিল হাড়ের কাঠামো, ত্বকের রঙ, উচ্চতা এবং মাথার খুলির আকারের ভিত্তিতে। ঘটনাক্রমে এটাই বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জন্ম দেয়। যাহোক, এই দীর্ঘ  সময়কাল একটা জিনিসের অবশ্যই কোন পরিবর্তন করতে পারেনি। তাদের উচ্চতা, ত্বকের রঙ বা মাথার খুলি যেমনই হোক, সব জাতি-গোষ্ঠীই মানব শ্রেণির অন্তর্গত। [চলবে]

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির