post

ভাষাভিত্তিক আগ্রাসন

মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান

৩০ জানুয়ারি ২০২২

মানুষের চিন্তা, আবেগ, অনুভূতি এবং মনের যত কথা- সব প্রকাশ পায় ভাষার মাধ্যমে। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ তার নিজের মত, চিন্তা-ভাবনা এবং ব্যক্ত-অব্যক্ত সকল পঙক্তিমালা নিজ ভাষাতে প্রকাশ করতে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। নিজের চিন্তাগুলোকে স্বীয় ভাষায় যত সুন্দরভাবে সাজিয়ে পেশ করা যায়, ভিনদেশী ভাষায় তা ততো সুন্দরভাবে পেশ করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর কোনো মানুষই ভাষাহীন কোনো পরিবার বা সমাজে আগমন করে না। ¯্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টি মানুষ। আশরাফুল মাখলুকাত বা শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষকে আল্লাহ ভাষার জ্ঞান দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন ‘আমি নিজের বাণী পৌঁছাবার জন্য যখনই কোনো রাসূল পাঠিয়েছি, সে তার নিজ সম্প্রদায়েরই ভাষায়ই বাণী পৌঁছিয়েছে। যাতে সে তাদেরকে খুব ভালোভাবে স্পষ্ট ভাষায় বোঝাতে পারে।’ (সূরা ইবরাহিম : ৪) তিনি অন্যত্র বলেছেন, ‘যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন।’ (সূরা আলাক : ৯৬) ভাষা মানুষের জন্য আল্লাহর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামত।

আমরা যারা বাংলায় কথা বলি, বাংলা যাদের মাতৃভাষা, এ ভাষাতেই আমরা মনের ভাব প্রকাশ করি। আমাদের হৃদয়ের যত কথা আর আবেগ সবইতো বাংলায় প্রকাশ করি। এমনকি যে কোনো ইবাদাতের শেষে আমরা মুনাজাতে আল্লাহর কাছে যে প্রার্থনা করি তাও বাংলায়-ই বলি। তাইতো তাদের নিয়েই কবির কবিতা ‘মাতৃভাষা বাংলা ভাষা খোদার সেরা দান’। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। এ জন্য আমাদের দেশের মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। ভাষার জন্য পৃথিবীর আরো বেশ কয়েকটি জাতির জীবন দেয়ার ইতিহাস থাকলেও আমাদের মতো রক্তাক্ত সংগ্রামী ইতিহাস তাদের কমই আছে। ভাষা এবং ভাষা আন্দোলন নিয়ে আলোচনা, বক্তব্য, লেখনী এবং ইতিহাসের আদ্যোপান্ত নিয়ে অসংখ্য বই নিত্য নতুন অবয়বে প্রকাশিত হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাস আসলে আমরা অতি বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে থাকি অনবরত। গান, কবিতা, সিম্পোজিয়াম, সেমিনার, প্রভাতফেরি আর শহীদ মিনারে ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসকে নতুন করে স্মরণ করা হয় বারে বারে। নতুন চেতনায়, নতুন শপথে জেগে ওঠে দেশের আপামর জনতা। মাতৃভাষা রক্ষায় দৃঢ় শপথ নেয়া হয়। মাতৃভাষার প্রতি সকল আবেগ এবং ভালোবাসা প্রকাশ করা হয়। ’৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন ’৫২-তে যে চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছিলো তাকে স্মরণ করে নবচেতনায় জেগে ওঠে বাংলাদেশের মানুষ। বাংলা ভাষার প্রতি হৃদয় মথিত ভালোবাসা আর আবেগ সত্যিই অতুলনীয়।

ভাষার প্রতি এতো ভালোবাসা আর আবেগের স্ফুরণ যে জাতির, তারাই যেন আবার নিজ ভাষার প্রতি সবচেয়ে বেশি উদাসীন। সচেতন কিংবা অবচেতন মনে নিজ ভাষা তাদের অনেকের কাছেই অবজ্ঞার পাত্র হয়। কারো কাছে অচ্ছুৎ মনে হয়। কেউ কেউ ভিনদেশী ভাষায় কথা বলতে পারাকে আভিজাত্য আর আধুনিকতার প্রতীক মনে করে। এ সমস্যা শুধু বাংলাদেশেই নয়। পৃথিবীর দেশে দেশে বিশেষ করে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ভাষাভিত্তিক এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চলছে জোর কদমে। মানুষের ভাষার ওপর এই আগ্রাসন কখনো সা¤্রাজ্যবাদী কখনো আধিপত্যবাদী। ভাষাভিত্তিক এবং সাংস্কৃতিক এই আগ্রাসনের ফলে মানুষের চিন্তায়-চেতনায়, আদর্শে, চলন-বলনে, পোশাকে, খাবারে সকল কিছুতে পরিবর্তন সাধিত হতে দেখা যায়। মানুষের চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ, জীবনমান, সাহিত্য, মূল্যবোধ, আদর্শ ও নৈতিকতা, এমনকি অভিবাদনের ভাষায় পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। দেশ, সমাজ, কাল আর জনপদের ভিন্নতার কারণে সা¤্রাজ্যবাদী এবং আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের রূপ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।

এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে আগ্রাসন বলতে আমরা কি বুঝি? কোনো দেশ, জাতি, সমাজ বা রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তা, দর্শন, আচার-আচরণ, ব্যবহারিক জীবন, স্বাভাবিক লেনদেন এবং নিত্যদিনের কার্যক্রমের ওপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেয়াকে আগ্রাসন বলা হয়। মৌলিক অর্থে দখল এবং আধিপত্য বিস্তারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কোনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দেয়া কিংবা শাসন বা কর্তৃত্ব করার মানসে অন্যায় দখল, অন্যায় লাভ করা অথবা অন্যায়ভাবে গ্রাস বা দখল করাকে আগ্রাসন বলে। অতীত ইতিহাসের সাথে দখল এবং আগ্রাসনের পদ্ধতির পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু চিন্তা এবং দখলি মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। শক্তিশালী রাজ্যগুলো দুর্বল রাজ্যগুলোকে বশ্যতা স্বীকারের জন্য আহ্বান জানাতো। এ আহ্বানে সাড়া দিলে ছোট রাজ্যগুলো বড় রাজ্যসমূহের কর্র্তৃত্বাধীনে পরিচালিত হতো। বিপরীতপক্ষে যুদ্ধ এবং আক্রমণের মাধ্যমে দেশসমূহ দখল করা হতো। সময়ের বিবর্তনে আগ্রাসী এবং আধিপত্যবাদী নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি, তাদের কৌশলে তারা পরিবর্তন এনেছে। বর্তমান সময়ে আগ্রাসী শক্তিসমূহের আক্রমণগুলো প্রাথমিকভাবে এমন সূক্ষ্মতার সাথে শুরু হয় যা বুঝতে বুঝতে একটি জাতির অনেক সময় চলে যায়। আধিপত্যবাদী এবং সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ এখন মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি এবং জীবনমানকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাদের প্রভুত্ব এবং কর্তৃত্ব বজায় রাখার নীতি গোটা দুনিয়ায় কায়েম রেখেছে। কর্তৃত্ববাদী গোষ্ঠীর এই আগ্রাসনই মূলত ভাষাভিত্তিক ও সাংস্কৃতিক সা¤্রাজ্যবাদ। ভাষা এবং সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন কোথাও হঠাৎ করে শুরু হয় না। আদর্শিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় নানা কারণ এখানে যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করলেও মূলত পুঁজিবাদ এবং সমাজবাদের নিগড়ে জন্ম নেয়া বস্তুবাদী মানসিকতাই আগ্রাসনের পেছনের দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। আগ্রাসনের চিন্তার উৎপত্তি ঘটে পুঁজিবাদের ধারণা থেকে। পুঁজিবাদ মানুষের চিন্তার ভিত্তিমূলে যে বিষয়টি গ্রোথিত করতে চায় তা হচ্ছে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি ব্যক্তিগত জীবনের উন্নয়নের জন্য পুঁজির মালিক হতে হবে। জীবনতো একটাই একে যথাযথভাবে ভোগ করতে হবে। পুঁজিবাদী দর্শনের এ ভুল চিন্তা হতে মানুষের মনে ভোগলিপ্সা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে সামনে এসে দাঁড়ায় পুঁজিবাদ যখন মানুষের মনে এ চিন্তার বীজ বপিত করতে পারলো, তারা পুঁজির বিকাশের জন্য তাদের সংস্কৃতিকে মানুষের সামনে নিয়ে আসলো। কারণ মানুষের আদর্শ এবং সংস্কৃত চিন্তায় পরিবর্তন আনতে না পারলে মানুষকে পুরোপুরি পুঁজিবাদের অন্ধ অনুসারী বানানো সম্ভব নয়। গোটা দুনিয়ার মানুষ তাদের মতো চিন্তা করবে, তাদের মতো জীবন যাপনে অভ্যস্ত হবে। জীবনের প্রয়োজন এবং চাহিদা বেড়ে যাবে। অনাহূত আয়োজনে মানুষ প্রচুর অর্থ ব্যয় করবে। অর্থের জন্য তাকে সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির পেছেনে ছুটতে হবে। এভাবে মানুষ আধিপত্যবাদী এবং সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির ভাষা এবং সংস্কৃতির অনুসারী হয়ে যাচ্ছে।

আগ্রাসী শক্তিগুলো নিত্যনতুন উৎসব এবং দিবস পালনের নামে নানান উপকরণ মানুষের সামনে হাজির করে। বাস্তবিকভাবে যে সকল দিবস পালন কিংবা পণ্যের আদৌ কোনো প্রয়োজন স্বাভাবিকভাবে মানুষের জীবনে নেই। তারা বিভিন্ন দিবস এবং উৎসব অনুষ্ঠানকে পণ্য বিপণনের মোক্ষম সুযোগ হিসেবে কাজে লাগায়। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, মা দিবস, বাবা দিবস, ধরিত্রী দিবস, কিটি ডে ইত্যাদি দিবসের অন্ত নেই। আবহমান কাল থেকে আমাদের সমাজে এবং পরিবারে কাউকে ভালোবাসার জন্য কিংবা কাউকে সম্মান দেখানোর জন্য কোনো দিবসের প্রয়োজন হয়নি। এ সকল দিবসকে ঘিরে নিত্যনতুন শব্দ এবং বাক্য আমাদের মুখে তারা তুলে দেয়। আমাদের শিশু, তরুণ এবং কিশোররা সেই সকল শব্দ, ভাষা এবং বাক্য ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। একইভাবে তারা তাদের বিভিন্ন পণ্য বিক্রির যে চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করে এতে করে আমাদের তরুণ-তরুণী এবং যুবকরা মনে করে দিবস পালন এবং উৎসবে যোগদান না করলে আমি হয়তো ব্যাকডেটেড হয়ে যাবো। উৎসব এবং দিবস পালনের জন্য তারা তাদের পণ্য এবং সংস্কৃতির খরিদ্দার হয়ে যায়। এভাবে তারা নিজস্ব সংস্কৃতিকে ঘৃণা করে পুঁজিবাদী ও সা¤্রাজ্যবাদীদের সংস্কৃতির অনুরাগী হয়ে যায়। সা¤্রাজ্যবাদের চাপিয়ে দেয়া এ সকল ভাষা এবং সংস্কৃতি চর্চার কারণে নিজেদের ভাষা এবং সংস্কৃতিকে তার কাছে অপাঙক্তেয় মনে হয়।

ভাষাভিত্তিক এবং সংস্কৃতির আগ্রাসনটা শুরু হয় গণমাধ্যম বিশেষ করে টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, ফ্যাশন, সাহিত্য, বই, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, সঙ্গীতকে ব্যবহার করে। বহুজাতিক কোম্পানি, বিদেশী এনজিও ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলো পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবস, ভাষা দিবসকে প্রমোট করার মাধ্যমে আজব কিছু অনুষ্ঠান হাজির করে। যার সাথে এ সকল দিবসের কোনো সম্পর্ক আদৌ খুঁজে পাওয়া যায় না। বিভিন্ন বিজ্ঞাপন, নাটক এবং কার্টুন চিত্রের মাধ্যমে তারা এমন সব ভাষা আর শব্দের অবতারণা করে যা কোনোভাবেই আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতির সাথে যায় না। তারা তাদের এ সকল কথা, বক্তব্য এবং শব্দমালা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তথ্যপ্রযুক্তির সকল মাধ্যমকে ব্যবহার করে। আধুনিক প্রযুক্তির উন্নয়নে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যে কোনো তথ্যপ্রবাহের সহজ সমাধান। যার পুরোটাই ব্যবহার করে আগ্রাসী শক্তিগুলো। আমাদের তরুণ এবং যুবসমাজ এগুলো সহজ ব্যবহারকারী হওয়ায় তারা সর্বাগ্রে এর সহজ শিকারে পরিণত হয়। উন্নয়নের ডুগডুগি আমাদের কানে অনবরত শোনানো হয়। জীবন ও অর্থনীতির উন্নয়নের নামে নানা ধরনের এনজিও, বহুজাতিক কোম্পানি এবং দাতাসংস্থাগুলোর কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা আমাদের ভাষা এবং সংস্কৃতির ওপর অনবরত আঘাত হানছে।

রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা বিভিন্ন দেশে ভাষাভিত্তিক এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সুযোগকে ত্বরাম্বিত করে। সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন একটি জাতিরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের জন্য বড় ধরনের হুমকি। একটি জাতিরাষ্ট্রে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন তার ভিতকে শক্ত করতে পারলে সে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-স্বকীয়তা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ভাষাভিত্তিক এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে একটি অনুগত শ্রেণি তৈরি হয়ে যায়। একই সাথে পুঁজিবাদী নীতি সম্প্রসারিত হয়, যার ফলে একটি ভোগবাদী গোষ্ঠী আধিপত্যবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দাসানুদাসে পরিণত হয়। এ ধরনের দুটি শ্রেণি যে রাষ্ট্র বা সমাজে তৈরি হয় সে জাতি বা রাষ্ট্র তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, স্বাধীনতা সব কিছু হারায়। তারা গর্ব করে নিজের স্বকীয়তাকে প্রচার করতে পারে না। নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যকে লালন করা ভুলে গিয়ে ভিনদেশী ভাষা, সভ্যতা আর সংস্কৃতির গোলামে পরিণত হয়। এই আগ্রাসন জাতীয় ঐক্যের ভিতকে চুরমার করে দেয়। শিক্ষা, সভ্যতায় বিভাজন তৈরি হয়। রাজনৈতিক ঐক্যের পরিবর্তে জাতি রাষ্ট্রের মাঝে বৈরিতা আর শত্রুতার বীজ বপন করে। এ সকল কারণে আদর্শিক, রাজনৈতিক, ভাষাভিত্তিক কোনো ইস্যুতেই আর জাতীয় ঐক্যকে ধরে রাখা যায় না। আগ্রাসী শক্তিগুলো শিক্ষা, সংস্কৃতি, জীবনমান, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সব জায়গায় এক ধরেনর পুঁজিবাদী স্বার্থ খুঁজে বের করে। মানুষের জীবনের যতগুলো অনুষঙ্গ আছে সব জায়গায় তারা ব্যবসার পসরা সাজিয়ে বসে। তারা তাদের ভাষা রপ্ত করার জন্য তাদের শব্দগুলো আমাদের মুখে তুলে দেয়। ভাষা এবং সংস্কৃতির আদান প্রদান না হয়ে শুধু এককেন্দ্রিক গ্রহণ করে। সা¤্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী শক্তির দেয়া সংস্কৃতি ভাবনা আর ভাষাকে দুর্বলরা গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে এক ধরনের গোলাম তৈরি হয়। যারা কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর কথা চিন্তা করতে পারে না। আমাদের চিরায়ত শব্দ মা-বাবার পরিবর্তে গঁস, উধফ, খালা ফুপুর পরিবর্তে অঁহঃ, অভিবাদন এবং কল্যাণ কামনার পবিত্র ভাষাকে পরিবর্তন করে ঐর, ণধয ইত্যাদি ব্যবহারে কেউ কেউ আত্মতৃপ্তি অনুভব করে।

পুঁজির পেছনে ছোটার কারণে ইতিহাস এবং কলার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র পাওয়া যায় না। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের কারণে ইংরেজি মাধ্যম প্রতিষ্ঠানের কদর বেশি। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে আবার ভিনদেশী বড় বিনিয়োগ রয়েছে। এর মাধ্যমে তারা তাদের মনস্ক মানুষ তৈরি করছে। এ সকল স্কুলগুলোতে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি যত গুরুত্ব দেয়া হয়, দেশীয় ভাষাকে তত বেশি অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা হয়। তারা স্বীয় পরিচয়, নিজ জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে একরূপ অন্ধকারেই থেকে যায়। দেশপ্রেম, নৈতিকতা, আদর্শ চরিত্র এবং স্বকীয়তা হারিয়ে তারা ভিনদেশী সংস্কৃতি চর্চায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এমনকি পোশাকি ঢঙেও তারা পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ করে থাকে। সামান্য ব্যতিক্রম বাদে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ সকল স্কুলে যা শিক্ষা দেয়া হয় তাকে একবাক্যে ভিনদেশী সংস্কৃতি বলা যায়। আমাদের দেশে এ চিত্র আমরা প্রত্যক্ষ করছি সর্বত্র-সব জায়গায়। অথচ সালাম জব্বার, রফিকের আত্মত্যাগের ইতিহাস নিয়ে আমরা গর্ব করি। তাদের নিয়ে আমরা গান, কবিতা আর সুরের মূর্ছনা তুলি। মঞ্চগুলোতে জ্বালাময়ী বক্তব্যে তাদের আত্মবলিদানের কথা উচ্চৈঃস্বরে আওয়াজ তোলা হয়। যেখানে দেশের কল্যাণ, জাতির কল্যাণ আর আত্মপরিচয়কে অবজ্ঞা করা হয় সেখানে আর যা-ই হোক ভাষার প্রতি কদর বাড়তে পারে না। একই অবস্থা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। বৈশ্বিক অভিযাত্রায় নিজেদের শামিল করার মানসে এ সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা যতটা পাশ্চাত্য সংস্কৃতি অনুসরণ করে তত বেশি দেশীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সময়ের প্রয়োজনে যদি দেশের কল্যাণে কোনো যুক্তিযুক্ত আন্দোলনের ডাক দেয়া হয় তবে পুঁজিতান্ত্রিক শিক্ষার নিগড়ে জন্ম নেয়া এ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কত সংখ্যক শিক্ষার্থীকে পাশে পাওয়া যাবে, তা একটি প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়।

দু’শ বছরের ইংরেজ শাসনের কারণে আমাদের এ জনপদের মানুষের মাঝে এক ধরনের গোলামির মানসিকতা ইংরেজরা তৈরি করতে পেরেছে। পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণকে অনেকেই আভিজাত্য বলে প্রচার করতে চায়। সকল সরকারি- বেসরকারি অফিসে এখনো ইংরেজিতেই অধিকাংশ কাজ সারতে হয়। উচ্চ আদালতে এখনো বাংলায় রায় লেখা শুরু হয়নি। হাইকোর্টের নির্দেশনা সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডগুলোতে ইংরেজির ব্যবহার বন্ধ হয়নি। শিশুতোষ কার্টুনগুলো আমাদের শিশুদের ভিনদেশী ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট করে তুলছে। ডোরেমন, বেনটেন, ছোটো ভিম, ডগি ইত্যাদি কার্টুন চিত্র দেখতে দেখতে অনেক শিশু নিজের ভাষায় কথা বলা পর্যন্ত ভুলে যায়। অনেক মা-বাবা গর্ব করে বলেন, তার সন্তান ইংরেজি-হিন্দিতে কথা বলতে পারে। ভাষা শেখা অবশ্যই একটি ভালো কাজ এবং এটির দরকারও আছে। তাই বলে নিজ ভাষা এবং সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে?

বারো শ’ শতকে সেন রাজবংশের লোকেরা এ অঞ্চলের সকল ভাষাভাষী মানুষকে একই ভাষায় কথা বলার আদেশ জারি করলেও তারা বাংলাভাষীদের ওপর তাদের জবরদস্তিমূলক নিবর্তনমূলক আইন কার্যকর করতে পারেনি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সেই ভুলে পা দিয়ে তাদের গোঁয়ার্তুমিকে কার্যকর করতে পারেনি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন আমাদের এই জনপদের মানুষদেরকে যে চেতনা এবং প্রেরণায় উদ্ধুদ্ধ করেছিলো আজ যেন তা শুধু কবিতা, গান আর র‌্যালির মাঝে আটকে আছে। সময়ের বিবর্তনে আমরা একুশ পালন করি। শোক র‌্যালি আর শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করি কিন্তু ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি যে আগ্রাসন চলছে সেই ফাঁদে পা দিয়েই উন্নতি অগ্রগতির স্বপ্ন দেখি। শুধু দিবস পালন আর পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে ভাষার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা সম্ভব নয়। ভাষাভিত্তিক যে আগ্রাসন চলছে তা আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকেও আক্রমণ করছে প্রতিটি পরতে পরতে। এ থেকে উত্তরণের জন্য জাতীয় চেতনার উদ্বোধন সর্বাগ্রে জরুরি। জাতীয় ঐক্য এবং সংহতির জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আদর্শ, চিন্তা এবং মূল্যবোধকে লালন করতে হবে যথার্থভাবে একইভাবে সংখ্যালঘুসহ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সকল শ্রেণির মানুষের মর্যাদা এবং স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারকে নিশ্চিত করতে হবে। তবেই আমাদের ভাষা আন্দোলন, ভাষা শহীদদের রক্তদান এবং একুশের আয়োজন সফল হবে।

লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির