post

মরণফাঁদ গজলডোবা

ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম

০৮ নভেম্বর ২০২০

বাংলাদেশের জন্য বড় মরণফাঁদ গজলডোবা বাঁধ। তিস্তা নদীর গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে ফারাক্কার মত মরণফাঁদ সৃষ্টি বাংলাদেশের প্রতি সম্প্রসারণবাদী আধিপত্যবাদী ব্রাক্ষণ্যবাদী উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতের অন্যায় আচরণের আরেক বেদনাদায়ক দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের পানিপ্রবাহের সকল উৎসই ভারতে। প্রায় শতকরা ৯৩ ভাগপানি আসে ভারত থেকে, কেননা ৫৪টি নদীর উৎস হলো ভারতে। ভারত তার দেশ দিয়ে আসা ৫৪টি নদীতে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের সমস্ত অংশকেই মরুভূমি বানাতে চাচ্ছে। ভূগোলের এই নির্যাতনে (Tyranny of geography) বাংলাদেশের মানুষ প্রয়োজনীয় ও ন্যায্য পানির হিস্যা পাচ্ছে না। গজলডোবা বাঁধ ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের পানি লুণ্ঠন ও সম্প্রসারণবাদী রাজনীতির প্রতীক প্রকল্প। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের সাথে দীর্ঘদিন যাবৎ আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এর কোন সমাধান হচ্ছে না। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি দীর্ঘদিন থেকে ভারত ঝুলিয়ে রেখেছে।১

তিস্তা নদী বাংলাদেশের উত্তরাংশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী তিস্তা নদী। এটি একটি আন্তর্জাতিক নদী। এই নদী উত্তরে হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে সিকিম দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে। এ নদীর পূর্ব নাম ছিল দিস্তাং, বর্তমান নাম তিস্তা যার সংস্কৃতকরণ হয়েছে ত্রিস্রােতা। জলপাইগুড়ি থেকে তিনটি স্রােতধারা তিন দিকে প্রবাহিত হয়। দক্ষিণবাহী পূর্বতম স্রােত ধারার নাম করতোয়া, মধ্যবর্তী স্রােতধারার নাম আত্রাই এবং পশ্চিমতর স্রােতধারার নাম পুনর্ভবা বা পুনরভবা। ইতিহাসে এমন উল্লেখ দেখা যায় যে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয় অভিযানকালে (১২০৩ খ্রিষ্টাব্দে) করতোয়া গঙ্গার প্রায় তিনগুণ ছিল। উত্তর নদীগুলো ওদের গতিপথ এবং যোগসূত্র পরিবর্তনের জন্য বিখ্যাত। এ আগুনের পানি নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে তিস্তার ভূমিকা সর্বাধিক; ১৭৮৭-র পূর্বে তিস্তা উত্তর সিকিমের বিভিন্ন হিমবাহ অঞ্চল হতে উদ্ভূত লাচেনচু, লাচুনচু এবং লোজাকচু-র সম্মিলিত ধারা রূপে দক্ষিণ দিকে তিস্তা নদী আত্রাই, করতোয়া, পুনর্ভবা নামে প্রাবহিত হয়ে এদের সম্মিলিত পাত্রিধারা মহান্দার সাথে মিলিত হওয়ার পর হুরসাগর নাম ধারণ করে জাফরগঞ্জ বর্তমান গোয়ালন্দ-এর নিকট পদ্মায় পতিত হয়। ১৭৮৭ সালের ২৭ আগস্ট তিস্তায় প্রবল বন্যা হয়েছিল। এরপর থেকে তিস্তা গতিপথ পরিবর্তন করে পূর্বদিকস্থ একটি পরিত্যক্ত গতিপথ দিয়ে প্রবাহিত হতে আরম্ভ করার ফলে এটি চিলমারীর দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হলো এবং গঙ্গার সঙ্গে কোন সম্পর্ক আর রইল না। আর সাবেক গতিধারা তিনটি করতোয়া আত্রাই পুনর্ভবা শীর্ষ স্রােতধারার পরিণত হয়ে গেল এবং শুষ্ক মৌসুম গতিপথের অনেক স্থান পানিশূন্য হয়ে পড়ে। তিস্তা নদী প্রায় ১৭৬ কিলোমিটার লম্বা। তিস্তা নদী পাড়ের প্রধান জেলাগুলো হচ্ছে নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও গাইবান্ধা।

গজলডোবা বাঁধ গজলডোবা বাঁধ বাংলাদেশের জন্য মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। এ বাঁধের কারণে তিস্তা নদীও পদ্মার ভাগ্যই বরণ করে নিতে বসেছে। পদ্মা যেমন শুষ্ক মৌসুমে ধু ধু বালুচর, কোথাও খালে পরিণত হয়েছে, তেমনি তিস্তাও। তিস্তার বুকজুড়ে শুধু বালু আর বালু। তিস্তা এখন দ্রুত মরে যাচ্ছে। তিস্তার পর্যাপ্ত পানির সংস্থান নেই। উজান থেকে বেপরোয়া পানি সরিয়ে নেয়ার কারণে শুকনো মৌসুমে তিস্তার পানি এমন তলানিতে এসে ঠেকেছে যে, এ পানিতে ক্ষেত্রে সেচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। প্রকৃতির কোলে সৃষ্টি এককালের স্রােতস্বিনী পাহাড়ি কন্যা তিস্তা, মানুষের হাতে মৃত্যুই যেন অমোঘ নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার উজানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি জেলার কালীগঞ্জের নাম স্থানে ভারত একটি বহুমুখী ব্যারেজ ভারত এই মরণফাঁদ নির্মাণ করেছে। ২২১ দার্শনিক ৫৩ মিটার দীর্ঘ ৪৪টি গেট সমেত গজলডোবা বাঁধের রয়েছে ৩টি পর্যায়। প্রবাস পর্যায় সেচ প্রকল্প, দ্বিতীয় পর্যায় বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং তৃতীয় পর্যায় গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সংযোগখাল খনন করে নৌপথ তৈরি। প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে আগেই। ১৯৮৭ সাল থেকে ৪৫টি স্লাইস গেটের মাধ্যমে সেচকার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে; বর্তমানে এ ব্যারাজের মাধ্যমে জলপাইগুড়ি জেলায় ৬১ হাজার, দার্জিলিং জেলায় ১৭ হাজার, মালদহ জেলায় ৩৮ হাজার, উত্তর দিনাজপুর জেলায় ২ লাখ ৪ হাজার একর জমিতে সেচ প্রদান করা হচ্ছে।২ গজলডোবা বাঁধের সাহায্যে একটি খালের মাধ্যমে ভারত একতরফা ভাবে শুকনো মৌসুমে তিস্তার প্রবাহ থেকে প্রায় ২ হাজার কিউসেক পানি আর মহানন্দার পানি যাচ্ছে ভারতে। এর মাধ্যমে ভারত তিস্তা নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করছে। মহানন্দায় নিয়ে যাচ্ছে।৩ এই মুহূর্তে ভারত ব্যারাজের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ করছে। ভারত ব্যারাজ নির্মাণ করে সেচ প্রকল্প ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এক তরফা পানি প্রত্যাহার করায় শুকনো মৌসুমে পানি সঙ্কটে মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে তিস্তা। শুধু তিস্তা কেন তিস্তার সংযোগ নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। যে স্থান দিয়ে তিস্তা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে সেই নীলফামারীর ডিমলার পশ্চিম চাতনাই ইউনিয়নের কালীগঞ্জ গ্রামের/ কালীগঞ্জে পয়েন্টে তিস্তা বালুচরে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় শুকনো মৌসুমে তিস্তায় আশা করা দুরাশা মাত্র। তিস্তার পানি প্রবাহের গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান দিলেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করা যাবে। ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে তিস্তার পানি প্রবাহ ছিল ১০৩৩ কিউসেক, ২০০০ সালে ৪৫৩০ কিউসেক, ২০০১ সালে ১৪০৬ কিউসেক, ২০০২ সালে ১০০০ কিউসেক, ২০০৩ সালে ১১০০ কিউসেক, ২০০৬ সালে ৯৫০ কিউসেক, ২০০৭ সালে ৫২৫ কিউসেক, ২০০৩ সালে ১১০০ কিউসেক, ২০০৬ সালে ৯৫০ কিউসেক , ২০০৭ সালে ৫২৫ কিউসেক, ২০০৮ সালে ১৫০০ কিউসেক . ২০০৯-২০২০ সালে শূন্য কিউসেক। এখন শুষ্ক মৌসুমে যেটুকু পানি আসছে তা বাঁধ চোয়ালো। পানি বিশেষজ্ঞরা বাঁধ চোয়ানো পানিকে কিউসেকের হিসাবে ধরেন না।৪ তিস্তার পানি এখন সম্পূর্ণ ভারতের নিয়ন্ত্রণে। তিস্তার পানি সরিয়ে নিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক আইনের সংঘন করছে। এতে তিস্তা পাড়ে প্রতি বছর বন্যা ও খরা দেখা দেয়। গজলডোবা বাঁধই শুধু নয়, গজল ডোবা বাঁধের মাধ্যমে পানি নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশে ভয়াবহ ভঙন ও নদীর গতিপথ পরিবর্তনের জন্য কর্তৃপক্ষ গজলডোবা বাঁধের ভাটিতে সীমান্ত জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত কিলোমিটারের মধ্যে ভরতীয় এলাকার তিস্তা নদীতে অবৈধভাবে সুপরিকল্পিতভাবে ৫টি স্পার নির্মাণ করেছে। বাংলাদেশের উজানে তিস্তা নদীতে গজলডোবাসহ মোট তিনটি বাঁধ দিয়েছে ভারত, আরেকটি বাঁধ দিতে পাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের সাথে চুক্তি না থাকলে আন্তর্জাতিক নদীতে বাঁধ নির্মাণ ও নদীর পানি কোন দেশ সরিয়ে নিতে পারে না। ভারতের এ অন্যায়ের প্রতিবাদও করছে না সরকার।৫ একটি আন্তর্জাতিক নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের ওপর ভারতের বাঁধ নির্মাণ ও পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন সংক্রান্ত সমস্যার সৃষ্টি করেছে।

গজলডোবা বাঁধের অশুভ প্রভাব গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে তিস্তার পানি ভারতের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে পাওয়ায় বাংলাদেশে তিস্তা সেচ প্রকল্প অচল হয়ে পড়েছে। তিস্তা সেচ প্রকল্পের অন্যতম প্রধান অংশ হচ্ছে তিস্তা বাঁধ। তিস্তা বাঁধ বাংলাদেশের বৃহত্তম বাঁধ। ১৯৯০ সালের ৫ আগস্টে এ বাঁধের উদ্বোধন করা হয়। তিস্তা বাঁধ প্রকল্পের মূল পরিকল্পনা নেয়া হয় ১৯৪৫ সালে। ১৯৫৯-৬০ সালে এ প্রকল্পের কাজ হাতে নেয়া হয়। কিন্তু ১৯৮০ সালে মূল কাজ শুরু হয়। ১৯৯৬ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি এর কাজ শেষ হয়। দেশের উত্তর-পশ্চিমাগুনের বৃহত্তর বগুড়া, রংপুর, দিনাজুরের ১২ জেলার ৩৫টি থানার ৫৪০৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ বাঁধ বিস্তৃত। এই বাঁধের সাথে প্রায় ৭৪৯ হাজার হেক্টর জমি সেচসুবিধা পেত। বিভিন্ন সেচখাল নিষ্কাশন খালের মাধ্যমে এ অঞ্চলে সেচ ও পানি নিষ্কাশন সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অথচ পানিশূন্য তিস্তা এখন ধু ধু বালুচর। তিস্তা বাঁধ এলাকায় তিস্তার করুণ দশা। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ বাংলাদেশ ভারত যৌথ নদী কমিশনের কর্মকর্তারা লালমনিরহাটে তিস্তা বাঁধ প্রকল্প ও তিস্তা নদীর দর্শনপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে এসেছেন। এ কমিশনের সফরকারী স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তিস্তায় এখন যে পানি পাওয়া যাচ্ছে তা কোনভাবেই কিউসেকের হিসাবে আসে না। এটাকে ভারতের দেয়া গজলডোবা বাঁধের চোয়ালো পানি বললেই চলে। তার মতে, তিস্তা বাঁধ প্রকল্পের আওতায় চলতিবরো মৌসুমে ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী পানিপ্রবাহের প্রয়োজন ৪ হাজার কিউসেক। কিন্তু তা পাওয়া না যাওয়ায় সেচকাজে তীব্র পানিসঙ্কট দেখা দিয়েছে।৬ দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দেশের বড় সেচ প্রকল্প তিস্তা বাঁধ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। গজলডোবা বাঁধের বিরুপ প্রভাবে উত্তরাঞ্চলের ৩টি প্রধান নদী আত্রাই, করতোয়া, পুনর্ভবা শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। তিস্তার দুটি শাখা নদী বাঙালী ও ঘাট ইতোমধ্যেই শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। নীলফামারীর ৩০টি ছোট-বড় নদী মরে যাচ্ছে। এ জেলার উহার দিয়ে প্রধানত ধলেশ্বরী, করালকাটা, শালকী, দেওনাই। মানস, ধাইজান, বুড়িখোড়া, ধুম, বুড়ি তিস্তাসহ অধিকাংশই আজ মৃত নদী, এ নদীগুলোকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল শহর, বন্দর, নগর। এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এ নদীগুলোর ছিল অসমান্য অবদান। নদী মরে যাওয়ায় খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় শুরু করে এখন আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে। পানি বিষেজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার উজানে বাঁধ নির্মাণ ও এক তরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে এ আগুনের পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব পড়েছে। পানির অভাবে হুমকির মুখে পড়েছে জীব বৈচিত্র্য। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি, নৌচলাচল ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ। হারিয়ে গেছে কয়েক শ’ মৎস্য প্রজাতি ও দেশীয় পাখি। নদীকে কেন্দ্র করে জনসাধারণের জীবন ও জীবিকার প্রশ্ন জড়িত। গজলডোবা বাঁধের প্রভাবে পানির অভাবে প্রধান নদী তিস্তা শুকিয়ে যাওয়ায় ৬০ হাজারের বেশি জেলে পরিবার মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। শিল্প-বাণিজ্য হুমকির মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। এ বাঁধ দিয়ে এক তরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে উত্তরাঞ্চলে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। নেমে গেছে ভূপৃষ্ঠের পানির স্তর। আগে এ অঞ্চলে ৪০-৬০ ফুট গভীর হতে নিউরনের ও অগভীর নলকূপে পানি উঠানো গেলও বর্তমানে তা ১৬০-২০০ ফুট গভীরে নেমে গেছে। নদী মরে যাওয়ায় ধীরে ধীরে এ অঞ্চল মরুকরণের দিকে এগিয়ে পাচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ সরাসরি গজলডোবা বাঁধের অশুভ প্রভাবের নির্মম শিকারে পরিণত হয়েছে। প্রকৃতি ও পরিবেশ হয়ে উঠছে চরম ভাবাপন্ন। গজলডোবা বাঁধের প্রতিক্রিয়ায় উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক কাঠামো বিপর্যায়ের সম্মুখীন। মরণফাঁদ গজলডোবা বাঁধের অশুভ প্রভাবে বিরান হচ্ছে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল।৭ দেখা দিয়েছে মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। গজলডোবা বাঁধ বর্ষায় খুলে দিলেই দু’কূল ছাপিয়ে ফুঁসে উঠে তিস্তা। আছড়ে পড়ে মানুষের ওপর। পর্যায় তিস্তার ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে পড়ে লাখো মানুষ। তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পেতে ভারতের সাথে বাংলাদেশের ৫০ বছর ধরে আলোচনা চলছে। ইতিবাচক ফল কিছুই হয়নি। মরণফাঁদ গজলডোবা বাঁধ দিয়ে তিস্তার পানি ভারত পশ্চিম বঙ্গের কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিংয়ের একাংশ, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ ও বিহার ও রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষি জমিতে নিয়ে যাচ্ছে। তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুতে যেন লুকোচুরি খেলা চলছে। অথচ তিস্তার পানিবণ্টন বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভারত তার নিজের স্বার্থ হাসিল করতে চায়। বিশেষজ্ঞরা মতপ্রকাশ করেছেন, ভারতের উদ্দেশ্য পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশ ফারাক্কা চুক্তির ন্যায় আবারো ভারতের ফাঁদে পড়তে পারে। তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুটি আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলতে হবে। কারণ তিস্তার পানি ভারত সরিয়ে নিচ্ছে। এখন যদি দ্বিপাক্ষিক চুক্তির কথা বলা হয় তবে বুঝতে হবে এটি ভারত ফাঁদ, ভারতের কূটকৌশল। ভারতের ফাঁদে পা দেয়া উচিত হবে না। এখনও বিশ্বে নদী আইন, অভিন্ন নদীর পানি একতরফা ব্যবহার না করার আইন বলবৎ আছে। ভারত তা মানছে না বলেই বাংলাদেশ অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং হচ্ছে। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র দেশ বলেও এদেশের ন্যায্য অধিকার ভোগ করে তার বাঁচার অধিকার রয়েছে। গৌতম দাস লিখেছেন, ভারত যে বাংলাদেশকে তিস্তার তেমন কোন কিছুই দেবে না সেটি ২০০৯ সালের আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। পানি টেনে নিয়ে গিয়ে যেখানে যা নেয়া তা করা হয়ে গিয়েছিল। সেখানে আর কোনদিন ভারতকে হাত লাগাতে হবে না। তবু প্রণব মুখার্জি তিস্তা চুক্তি করবেন বলে বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিস্তা একটা ডেড ইস্যু ভারতের কাছে, ২০০৯ সালের বহু আগে থেকেই। তিস্তা থেকে আসলে ভারতের কাউকে কিছু দেয়ার নেই। উৎস থেকে যা নেয়া সম্ভব এমন সব পানি আন্তর্জাতিক নদী আইন ভাঁজ করে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয় ২০০৯ সালের আগেই ভারতের এসব কাজ সম্পন্ন হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকারকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তিস্তা চুক্তি হবে। আজও তা বলে যাওয়া হচ্ছে।৮

তথ্যসূত্র ১. পঞ্চায়েত হাবিব, চীনের ৮২০০ কোটি টাকার প্রকল্প: ডিসেম্বরের মধ্যেই চুক্তি ও টেন্ডার তিস্তায় পাল্টে যাবে জীবন, দৈনিক ইনকিলাব, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, পৃ. ১। উল্লেখ্য এক সময় চীনের দুঃখ খ্যাত হোয়াংহো নদী নিয়ন্ত্রণ করে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের তিস্তাকে আশীর্বাদে রূপ দেয়ার জন্য চীন সরকার নিজ উদ্যোগে নিজ খরচে দুই বছর ধরে তিস্তা নদীর ওপর সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষা শেষে একটি প্রকল্প নির্মাণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রকৌশলগত ও আংশিক সহায়তা তারাই দেবে। ২. মুনশী আন্দুল মান্নান, তিস্তার পানিবণ্টন: প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ ও কল্যাণের প্রত্যাশা (উপ-সম্পাদকীয়) দৈনিক ইনকিলাব, ২৬ ডিসেম্বর ২০০৯, পৃ. ১১। ৩. সরকার মাজহারুল মান্নান প্রদত্ত তিস্তা নদীর উপর রিপোর্ট দৈনিক নয়া দিগন্ত; ২৭ আগস্ট ২০০৯, পৃ. ১৬। ৪. মুন্সী আব্দুল মান্নান, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১। ৫. এ. বি. সিদ্দিক, তিস্তার পানিবণ্টন ইস্যুতে লুকোচুরি খেলা, দৈনিক সংগ্রামের রিপোর্ট, ২৬ ডিসেম্বর ২০০৯, পৃ. ১। ৬. সাখাওয়াত হোসেন বাদশা, তিস্তা এখন ধু ধু বালুচর, দৈনিক ইনকিলাব, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃ.-১৬ ৭. বাংলাদেশের একটি বিশাল এলাকার কৃষিনির্ভর অর্থনীতির মেরুদ- সোজা করে দাঁড়ানোর মূল হাতিয়ার তিস্তা নদী গজলডোবা বাঁধের কারণে যে পানিশূন্য করুণ দশায় নিপতিত তা সরজমিনে দেখে এসেছেন ঢাকা সফররত ভারতের যৌথ নদী কমিশনের সদস্য এস. পি. কাকরান। তিনি সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ এ সফরে এসেছিলেন। ২১ শে ফেব্রুয়ারি ২০১০ ভারতীয় প্রতিনিধি দলটি স্বদেশে ফিরে গেছে। প্রতিনিধি দলের কথাবার্তায়যা মনে হয়েছে, গঙ্গার পানি নিয়ে ভারত যে গুলো বাংলাদেশের সাথে খেলেছে, তিস্তার পানি নিয়েও সে খেলারই পুনরাবৃত্তি হবে। ৮. গৌতম দাস, বাংলাদেশ কি এবার সচেতন হতে পারবে? দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২৩ আগস্ট ২০২০, পৃ. ৬

লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির