post

মহাদুর্গতির সময়চিত্র সাধু সাবধান

০৫ অক্টোবর ২০১২

সাদেক খান ৯  সেপ্টেম্বর একটি গোলটেবিলে দেশের ছয়জন অর্থনৈতিক প্রশাসন বিশেষজ্ঞ গত মাসে ফাঁস হওয়া হাল আমলের সর্বশেষ আর্থিক কেলেঙ্কারিটি তথা সাধারণভাবে যাকে হলমার্ক কেলেঙ্কারি বলা হয় সেই ‘ভয়াবহ’ (অর্থমন্ত্রীর সংশোধিত স্বীকারোক্তি) ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে কথা বলছিলেন। মতলববাজ লুটেরা ধনপতি, কমিশনখোর কেনাকাটা ব্যবসায়ী, পুঁজি পাচারকারী আর কালো টাকাওয়ালা (কিংবা হলমার্কের মতো ব্যাংকের টাকায় তৈরি) ভূমিদস্যুদের বারবার দাঁও মারার সুযোগ করে দিয়ে ক্ষমতাসীন জোটের অভ্যন্তরে শক্তিশালী রাজনীতিবিদ ও পোষ্য আমলা-পুলিশ চক্র এ দেশের বিকাশমান অর্থনীতির সামষ্টিক শৃঙ্খলাকে ধাপে ধাপে ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে। সে সম্পর্কে ওই বিশেষজ্ঞদের গভীর উদ্বেগ ব্যক্ত হয়েছে ওই গোলটেবিলে। তাদের বক্তব্যের কিছু নমুনা উদ্ধৃত করছি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, ‘অর্থনীতির সুশাসন (নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা) ভেঙে পড়েছে। শেয়ারবাজার, ডেসটিনি, পদ্মা সেতুর পর হলমার্ক। এভাবে অর্থনীতির ন্যূনতম শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। হলমার্ক কেলেঙ্কারির সাথে যারাই জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কার্যকর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। (ফৌজদারি) দণ্ডবিধি, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, অর্থঋণ আদালত ও এনবিআর আইনÑ যে আইনেই হোক, (শাস্তি) প্রয়োগ করতে হবে।’ তার সাথে মতৈক্য পোষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান ও বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সংলাপ-বিশেষজ্ঞ এম এ তসলিম বলেন, ‘বৃহত্তম আঙ্গিকে বলতে পারি, ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ভেঙে পড়েছে। প্রথমে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি। এর সাথে ৩০ লাখ মানুষ জড়িত বলা হচ্ছে। কিন্তু এই কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটনে দায়িত্ব পালন করা তদন্ত কমিটির যিনি চেয়ারম্যান, তাকেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো। আর যারা এটি ঘটালেন, তারা নামী-দামি, তাদের মানহানি হবে বলে তাদের নাম প্রকাশ করাও যাবে না বলা হলো। একটা অপরাধ চাপা পড়ছে আরেক অপরাধ দিয়ে। সাবেক রেলমন্ত্রীর ঘটনা চাপা পড়ল একজন রাজনীতিবিদের গুম হওয়া দিয়ে। সেটি চাপা পড়ল সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি দিয়ে। এরপর কী আসবে কে জানে। প্রতিটি ক্ষেত্রে অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব জায়গাতেই এটা হচ্ছে। পুলিশের নেতৃত্বের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সব জায়গাতেই এ অবস্থা হচ্ছে।’ তিনি যুক্তরাষ্ট্রে শেয়ার কেলেঙ্কারিতে বার্নার্ড লরেঞ্জ ম্যাডফের ৯৯ বছরের জেল হওয়ার প্রসঙ্গ তুলে বলেন, ‘তার ঘড়ি থেকে শুরু করে সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও তা-ই করা উচিত।’ বিশ্বব্যাংকের সাবেক বিকল্প পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেন, ‘হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য রহস্যজনক। সোনালী ব্যাংকের এমডি বলছেন, এই টাকা না পেলে সমস্যা হবে। তারা ঋণ দিতে পারছেন না বলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। আর অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, অল্প টাকা এতে কোনো সমস্যা হবে না। তাহলে এমডি কি মিথ্যা বলছেন? ‘সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সুপারিশ করলে বলা হলো, এখতিয়ার নেই। অথচ গ্রামীণ ব্যাংক সরকারি আইন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত। ব্যাংক কোম্পানি আইনের একই ধারায় এর এমডিকে বাংলাদেশ ব্যাংক অব্যাহতি দিলো কী করে?’ এখন দেখা যাক, হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে কিংবা শেয়ার কেলেঙ্কারিতে জড়িত নন এমন রাজনীতিবিদেরা কী বলছেন। নমুনা : ৫ সেপ্টেম্বর সংসদ অধিবেশনে একটা অনির্ধারিত আলোচনায় সরকারদলীয় সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন (সংক্ষেপিত), ‘হলমার্কের অর্থ আত্মসাতের ঘটনার সাথে সরকার জড়িত নয়। (কিন্তু) সরকার এর দায়দায়িত্ব নিতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংক কী করেছে? ২০১০ সালে বিষয়টি তাদের নজরে এসেছে। খবর এবং প্রমাণপত্র পেয়ে দুই বছর তারা কী করেছে? তাদের এই নীরবতার পেছনে ব্যাংকের কোনো কোনো কর্মকর্তা জড়িত বলে আমার মনে হয়।...  সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা ও পরিচালনা পর্ষদ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও মন্ত্রণালয়ের কেউ কেউ এর সাথে জড়িত। চার হাজার কোটি টাকা দিতে হলে একটি ব্যাংকের পেইডআপ ক্যাপিটাল (পরিশোধিত মূলধন) কত থাকতে হয়? আমি যতটা জানি, সোনালী ব্যাংকের পেইডআপ ক্যাপিটাল ৯০০ কোটি টাকা। এই যে অরাজকতা, লুটপাট হলো, ধরা পড়ল অথচ এখনো জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ক্রিমিনাল কেস (ফৌজদারি মামলা) হয়নি।... অর্থমন্ত্রীর কথাবার্তায় জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তার বয়স হয়েছে, বুঝি। তার কথা কম বলা ভালো। এত বড় ঘটনা, তার কাছে চার হাজার কোটি টাকা বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু মানুষের কাছে বড় ব্যাপার। এক টাকা হোক, ১০ টাকা হোক, যে টাকা লুট হবে, তার বিচার করতে হবে।’ শেখ সেলিমের বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আমার মনে হয় এত বড় ঘটনা, একটি কোম্পানিকে দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা একজন ম্যানেজারের পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। এর সাথে আরো অনেকে জড়িত। রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালনা পর্ষদ করলে সব সময় যে ভালো হয় না, এ ঘটনা তার প্রমাণ। মিডিয়াকে দায়ী করে লাভ নেই। যাদের ব্যাংক পরিচালনার সামান্যতম অভিজ্ঞতা নেই, তাদের ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই কেলেঙ্কারির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা না নিলে এর দায় সরকারকে নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়ার সুপারিশ করলে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, তাদের এখতিয়ার নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, তাদের এখতিয়ার আছে। বিনয়ের সাথে বলব, ইচ্ছা থাকলেও অনেক কথা বলতে পারি না। এ ঘটনায় কয়েকজন উপদেষ্টার নাম এসেছে। সরকারে অনিয়ম হলে এর উত্তর আমাদের গ্রামগঞ্জে দিতে হয়।’ পরের দিনের অধিবেশনে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, প্রবীণ সংসদ সদস্য আবদুল জলিল বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী বলেছেন, চার হাজার কোটি টাকা কিছু নয়। কত টাকা হলে কিছু হবে? অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দুই হাজার কোটি টাকা পাওয়া যাবে। তাহলে বাকি টাকার কী হবে?’ সাবেক আইনমন্ত্রী, সরকারদলীয় বিশিষ্ট সংসদ সদস্য আবদুল মতিন খসরু বলেন, ‘এত বড় ঘটনার পর এখন পর্যন্ত কেন একজনও গ্রেফতার হলো না। চার হাজার কোটি টাকা কোথায় গেল, জাতি জানতে চায়।’ মহাজোটভুক্ত সিনিয়র সংসদ সদস্য (একটি পার্লামেন্টারি কমিটি প্রধান) রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘হলমার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ইতিহাস সবার জানা উচিত। আগারগাঁওয়ের একটি মুদি দোকান থেকে তার উত্থান। ব্যাংকের কেউ জড়িত না থাকলে সে এত দূর আসতে পারে না। সরকার জড়িত আছে কি না, খুঁজে দেখা উচিত।’ জবাব দিতে গিয়ে একরকম ক্ষমা চেয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পরিষদ ৬৫ কোটি টাকার ঋণ ছাড়া অন্য কিছুর সাথে সম্পৃক্ত ছিল না। সোনালী ব্যাংক (কর্মকর্তারা) অসত্য বিবরণ দিয়েছে। দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। দু’জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ১৯ জনকে সাময়িক বরখাস্ত ও দু’জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। ‘চার হাজার কোটি টাকা তেমন কিছু না’, সে দিন আমার এ কথাটা বলা ঠিক হয়নি। বলা হচ্ছে, এতে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এ জন্য আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন। পরবর্তীকালে সংসদের বাইরে হঠাৎ ডাকা এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে ৯ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী বলেন, হলমার্কের ঘটনা ‘ভয়াবহ’। এতে সোনালী ব্যাংকের লোকজনের পাশাপাশি বাইরের লোকও জড়িত। শোনা যাচ্ছে তারা দেশ থেকে পালানোর চেষ্টা করছে। তাই জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত মামলা করা হচ্ছে। পুরো ব্যাংকিং সেক্টরে জালিয়াতি। এক হাতে তালি বাজে না। এখানে সবারই দোষ আছে, অতিকথন আছে। সেটি আমিও করেছি। এর পরও কিছু বিষয়ে সাবধান হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। যদি বলা হয় ব্যাংকিং খাতে ধস নেমেছে, তবে এর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয় বিদেশ থেকে। ‘আমি এখনো মনে করি পদ্মাতে কোনো দুর্নীতি হয়নি, হবেও না। তারা (বিশ্বব্যাংক) বলছেন, দুর্নীতি হতে পারে। এ সম্ভাবনাকে রহিত করার জন্যই তাদের সব প্রচেষ্টা। সুতরাং এখানে ঐকমত্য হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।’ বিশ্বব্যাংকের শর্তানুসারে ড. মসিউর রহমান পদত্যাগ করবেন কি নাÑ এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওরা যা চেয়েছে, তার সমাধান হলো ছুটি। অর্থ উপদেষ্টাকে ছুটিতে পাঠানো যেতে পারে। পদত্যাগ নয়।’ ব্রিফিংয়ের বাইরে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অর্থমন্ত্রী মুহিত আরো বলেন, ‘সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আছেন আগুনের মধ্যে (হলমার্ক কেলেঙ্কারির কারণে), আমার মতোই। কিন্তু আগুন দেখে তো পালিয়ে গেলে হবে না। আগুন নেভানো দরকার। শারীরিক অবস্থার কারণে আমিও ৯ মাস ধরে পালিয়ে যেতে চাচ্ছি, সরকার থেকে বেরিয়ে যেতে চাচ্ছি।’ ‘বাজারে তো এটাই দাবি। ফখরুল ইসলাম সাহেব (বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব) আছেন, তার বক্তব্য শুরু ও শেষ হয় এটা দিয়েই। তবে তিনি প্রায় অসত্য বক্তব্য দেন। আমি তাকে খুব বেশি চিনি না। কিন্তু আমি দেখি তার স্টাইলটা এ রকম যে, অসত্যটা তিনি খুব ভালো করে সামনে তুলে ধরেন। তবে পদত্যাগের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত আমি নিইনি।’ একই দিনে ৯ সেপ্টেম্বর বিরোধী ১৮ দলীয় জোট নেতারা ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমস্বরে সরকারকে বলেছেন, দুর্নীতির দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করুন; নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিন। নইলে পালানোর সময় পাবেন না। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘গোটা সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও উপদেষ্টাসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে দেশের অর্থনীতিকে ভেঙে দেয়। এর পরই প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় ও মহাজোটের নেতাদের নামে ৯টি নতুন ব্যাংকের অনুমতি দেয়। প্রতিটি ব্যাংক খোলার জন্য ৪০০ কোটি টাকা লাগে। প্রথম ব্যাংকটি দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় ফজলে নূর তাপসকে, দ্বিতীয়টি দেয়া হয় মহিউদ্দীন খান আলমগীরকে, তৃতীয়টি দেয়া হয় সাবেক আমলা আশিকুর রহমান, চতুর্থটি দেয়া হয় মহাজোটের শরিক এরশাদকে, পঞ্চমটি দেয়া হয় জাহাঙ্গীর সত্তার টিংকুকে, ষষ্ঠটি দেয়া হয় ১-১১-এর হোতা মইনউদ্দিন আহমেদের ভাই ইফতেখার আহমেদকে। এসব ব্যাংকের মালিকের নাম দেখলেই বোঝা যায় আওয়ামী লীগ কী পরিমাণ দুর্নীতি করেছে।’ প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আপনাদের দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করেছে। এরপর বিশ্বব্যাংক অভিযুক্তদের নাম উল্লেখ করে চিঠি দিয়েছে, কিন্তু আপনারা তা প্রকাশ করেননি।’ ১০ সেপ্টেম্বর বিকল্প ধারার প্রেসিডেন্ট সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছেন, যে সরকারের অর্থমন্ত্রী ৯ মাস ধরে পালানোর চেষ্টা করছেন, সে দেশের অর্থনীতি চলে কিভাবে? সরকারই বা থাকে কিভাবে? তার আগে ৮ সেপ্টেম্বর একটি অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, ‘কিভাবে দুর্নীতি করে অর্থ পাচার করা যায়, সরকারের মন্ত্রী-এমপি-উপদেষ্টারা সেই কাজেই সর্বক্ষণ ব্যস্ত। ক্ষমতাসীনেরা জনগণের পকেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করেছেন। এখন কোনো সঙ্কটে পড়লে সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টারা দিল্লি দৌড় দেন।’ যে কথাটা তিনি উহ্য রেখেছেন সেটা এই যেÑ দিল্লি ঘুরে এলেই যেন আজকাল ‘সঙ্কটে-পড়া’ মন্ত্রী-এমপি-উপদেষ্টাদের বুকের পাটা একটু বেড়ে যায়, প্রধানমন্ত্রীর পদলেহনের অভ্যাসেও যেন একটু ছেদ পড়ে। প্রকাশ, দিল্লি থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা মসিউর রহমান সোজা বলে দিয়েছেন, বিশ্বব্যাংকের কথামতো দুর্নীতির অপবাদ নিয়ে পদত্যাগ করবেন না তিনি। বিশ্বব্যাংক যদি পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন করতে রাজি হয় কেবল সে ক্ষেত্রেই তিনি পদত্যাগ করবেন। তবে সরকার যদি তাকে অব্যাহতি দেয় সে ক্ষেত্রে তার কোনো আপত্তি থাকবে না। অবশ্য অনেক বিলম্বে তাকে ছুটিতে পাঠানোর একটা নাটক প্রত্যক্ষ করা গেল। দিল্লিতে গিয়ে সম্প্রতি আবার লালগালিচা সংবর্ধনা পেয়েছেন মহাজোটের এমপি ও মহাজোটের প্রধান শরিক সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ। দিল্লি থেকে ফিরে তিনি সদর্পে বলছেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলই ১৫০টি আসন পাবে না। বর্তমান সরকারি দলের আসন কমবেই। বিরোধী দলেরও ১০০ আসন পাওয়া দুরূহ হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টিই হবে ‘ফাস্ট পার্টি’। আমরা আর এখন তৃতীয় শক্তি নই। উই আর ফার্স্ট পার্টি ফর গভর্নমেন্ট ফর্ম (সরকার গঠনে সক্ষম প্রথম দল)। ক্ষমতায় থাকা যদি মানদণ্ড হয় তাহলেও জাতীয় পার্টি প্রথম শক্তি।’ শুধু সরকার পক্ষের এরশাদের নয়, সংসদীয় বিরোধী দলনেতারও ডাক পড়েছে দিল্লিতে। একাধিক সংবাদপত্রে প্রকাশ, আগামী অক্টোবরের মধ্যে ভারত ও চীন সফরে যেতে পারেন বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। দুই দেশই সফরের জন্য বিরোধীদলীয় নেতাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বিএনপির তরফে কেউ কেউ বলছেন, স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে সরকার পরিবর্তনে এ সফর ভূমিকা রাখতে পারে। খালেদা জিয়া সেপ্টেম্বর অথবা অক্টোবরে ভারত যাবেন। প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরের সময় খালেদা জিয়াকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ওই আমন্ত্রণকে কেন্দ্র করে খালেদা জিয়ার ভারত সফরের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। সফরে খালেদা জিয়া ভারতের নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এবং প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সাথে বৈঠক করবেন। বিরোধীদলীয় নেতা সুসমা সরাজের সাথেও বৈঠক করবেন বেগম জিয়া। এ ছাড়া আজমির শরিফ যাবেন তিনি। জোট সরকারের সময় সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারত সফরে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। ইতোমধ্যে বিরোধীদলীয় নেতা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও চীন সফর করেছেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ দু’জন ব্যক্তি মাসখানেক আগে ভারত সফর করেছেন। সেখানে তারা সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের সাথে সফরের তারিখসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে এসেছেন। বিএনপির কর্তাব্যক্তিদের কেউ কেউ বলছেন, ভারত সফরের ওপর নির্ভর করছে খালেদা জিয়ার চীন সফর। পূর্বমুখী কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে দুই বছরের মধ্যে আবারো চীন যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তার। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে ২০১০ সালের ১৮ ডিসেম্বর পাঁচ দিনের সফরে চীন যান খালেদা জিয়া। সে সময় চীনা প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার বৈঠক হয়নি। এবার চীন প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের শিডিউল পাওয়ার পরই সে দেশে যাবেন খালেদা জিয়া। বিরোধী দলনেতার ভারত ও চীন সফরে এভাবে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াস সত্ত্বেও পাবলিকের দুর্ভাবনা : দিল্লি থেকেই তো বাংলাদেশকে নতজানু ব্যর্থরাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে স্বল্পমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি সব রকম কারসাজি চালানো হচ্ছে। পার্বত্য বিদ্রোহের ইন্ধন, উগ্রবাদী চর, দুর্ধর্ষ পলাতক অপরাধী, অবৈধ অস্ত্র আর মাদকের চোরাচালানÑ এসবই তো আসছে কাঁটাতারের বেড়ার ওপার থেকে দিল্লি নিয়োজিত সীমান্তরক্ষীদের মুঠোর মধ্য দিয়ে; আর একই সাথে দিল্লি গড়ে তুলছে বাংলাদেশের চার পাশে নোম্যান্স ল্যান্ডে সীমান্ত সন্ত্রাসের মৃত্যুপুরী, মেঘনা অববাহিকার মরণফাঁদ টিপাইমুখ বাঁধ, উজানে গঙ্গা-তিস্তার পানি সমানে প্রত্যাহার করে চলেছে, সমুদ্রসীমার ভেতরে ঢুকে আমাদের জেলেদের তাড়াচ্ছে, জলদস্যুদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। বিরোধী দলনেতা দিল্লি দর্শন করে প্রচ্ছন্ন ও প্রত্যক্ষ এসব রাষ্ট্রনাশক কলকাঠির পুতুলনাচ ঠেকাতে পারবেন কি? সাধু সাবধান। লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির