post

মহানবী (সা.) মানবজাতির জন্য এক অনুপম আদর্শ

জাকারিয়া খান সৌরভ

২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

মাহে রবিউল আউয়াল আরবি মাসসমূহের অন্যতম একটি মাস। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের এ মাসের ১২ তারিখ (মতান্তরে ৯ তারিখ) সোমবার সুবহে সাদিকের সময় এ পৃথিবীতে তাশরিফ আনেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। আবার ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার দ্বিপ্রহরের পূর্বক্ষণে তাঁর উম্মতদেরকে শোকসাগরে ভাসিয়ে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এ পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। এক দিকে রাসূল (সা.) এর জন্মের কারণে এ মাসটি আনন্দের, অপর দিকে তাঁর মৃত্যুর কারণে এ মাসটি আবার বেদনারও বটে। বিশ্বের দিকে দিকে মুসলিম জনগোষ্ঠী মাহে রবিউল আউয়াল মাসকে বিভিন্নভাবে উদযাপন করে আসছে। কেউ এ মাসে সিম্পোজিয়াম ও সেমিনার করে রাসূল (সা.)-এর জীবনাদর্শ জাতির সামনে তুলে ধরছে। কেউ আয়োজন করছে সিরাত মাহফিল বা মিলাদ মাহফিলের। কেউ আবার জিকিরের আয়োজন করে রাসূল (সা.)-এর প্রতি ভক্তি প্রকাশের চেষ্টা করছে। আবার কেউ কেউ ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতার আয়োজনের মাধ্যমে এ মাসটি উদযাপন করে আসছে। বর্তমানে এ মাসে অনুষ্ঠানাদি নিয়ে আবার কোন কোন স্থানে বিতর্ক করতেও দেখা যায়। কেউ বলছে সিরাতুন্নবী (সা.) আবার কেউ বলছে মিলাদুন্নবী (সা.)। এ নিয়ে বিতর্ক আবার কোন কোন স্থানে সংঘর্ষেরও সৃষ্টি করেছে। তাই নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা পেশ করছি। সিরাত শব্দটি আরবি সারা-ইয়াসির শব্দের ক্রিয়ামূল। যার অর্থ সুন্নাহ, তারিকাহ, অবস্থা, আকৃতি, রওয়ানা হওয়া, মাজহাব ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায় সিরাত বলতে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে সংঘটিত যুদ্ধ-বিগ্রহসহ তাঁর পুরো জীবনের যাবতীয় ঘটনাবলির ধারাবাহিক বর্ণনাকেই বুঝানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ফাতহুল কাদিরের বর্ণনা হলো- বিশেষ করে কাফিরদের সাথে যুদ্ধ ও রীতিনীতির বর্ণনাই হলো সিরাত। Dictionary of Islam এ আছে Sizar means a historical work on the life Mohammad (sm) on any of his comparison. মিলাদ শব্দটি আরবি বুলিদা শব্দ থেকে নির্গত। যার অর্থ জন্মবৃত্তান্ত। রাসূল (সা.)-এর জন্ম সংক্রান্ত আলাপ আলোচনাকে মিলাদ বলা হয়। ইসলামী শরিয়তে মিলাদের এরচেয়ে বেশি কোনো সংজ্ঞা পাওয়া যায়নি। উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, মিলাদুন্নবী (সা.) শব্দটি একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে সীমাবদ্ধ, যা কেবল রাসূল (সা.-এর জন্ম সংক্রান্ত বিষয়কে বুঝায়। আর সিরাতুন্নবী (সা.) শব্দটি ব্যাপক, যা রাসূল (সা.)-এর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত গোটা জীবনকালকে বুঝায়। অতএব, মিলাদুন্নবী (সা.) না বলে সিরাতুন্নবী (সা.) বলাই শ্রেয়। কারণ, নবী করীম (সা.)-এর বাস্তব জীবনীতেই রয়েছে মানবজাতির জন্য উত্তম আদর্শ। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘লাকাদ কানা লাকুম ফি রাসূলিল্লাহি উসওয়াতুন হাসানা’ অর্থাৎ রাসূল (সা.)-এর জীবনেই রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। একদা উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা (রা)কে রাসূল (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, তোমরা কি কুরআন পড়নি! পুরো কুরআনই হলো রাসূল (সা.)-এর চরিত্র। মানুষ তার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, ধর্মীয় জীবন, অর্থনৈতিক জীবন সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় জীবন কিভাবে পরিচালনা করবে রাসূল (সা.) তার বাস্তব শিক্ষা দিয়ে গেছেন স্বীয় জিন্দেগিতে। একদা রাসূল (সা.)কে প্রশ্ন করা হয়েছিলো ইয়া রাসূল (সা.)! আপনি কেন পৃথিবীতে আগমন করেছেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন, মানবজাতির চারিত্রিক সংশোধন ও পরিপূর্ণতা বিধানের জন্য। আল্লাহ বলেন, তিনি সেই মহান সত্তা যিনি রাসূল (সা.)কে সত্য দীনসহ এ জন্য প্রেরণ করেছেন যে, এ পৃথিবী থেকে সমস্ত বাতিল মতাদর্শকে উৎখাত করে একমাত্র দীন ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করেন। রাসূল (সা.) ইসলামের প্রাথমিক যুগে দীর্ঘ তেরো বছর তাঁর সুমহান আদর্শ দিয়ে মানুষকে দীনের দাওয়াত দিয়ে মুষ্টিমেয় কিছু লোক তৈরি করেন এবং পরে তাদেরকে নিয়ে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে সেখানে ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর বদর, উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধের মাধ্যমে কাফিরদেরকে পরাজিত করে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা দেন। সে সময় আরব সাম্রাজ্যে নেমে এসেছিলো শান্তির ফল্গুধারা। মানুষ ভুলে গিয়েছিলো হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি, হত্যা ও ধর্ষণ। সেদিন এমন অবস্থা হয়েছিলো যে, একটি যুবতী মেয়ে রাতের অন্ধকারে ইয়েমেনের রাজধানী সানআ থেকে হাজরামাউত পর্যন্ত একাকী ভ্রমণ করতে পারতো। কেউ তার গতি রোধ করার সাহস করতো না। আর আজকে একটি মেয়ে ঘরে তার টেবিলে বসে পড়তে পারছে না। লম্পটরা এসিড নিক্ষেপে ঝলসে দিচ্ছে তার চেহারা। ধর্ষকদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না চার বছরের তানিয়া। আজকে মানুষে মানুষে চলছে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, খুন-খারাবি। মানুষের জান-মালের নেই কোন নিরাপত্তা। তার একমাত্র কারণ আমরা রাসূল (সা.)-এর আদর্শ থেকে আজ অনেক দূরে চলে গেছি। রাসূল (সা.)-এর নাম শুনলে আমরা হাতে মুখে চুমু খাই। মিলাদের আয়োজন করে মিষ্টি খাই। নিজেদেরকে আশেকে রাসূল হিসেবে পরিচয় দেই। অথচ তিনি যে মিশন নিয়ে এ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন তা ভুলে রই। যার কারণে সারাবিশ্বে মুসলমানেরা আজ লাঞ্ছিত-বঞ্চিত, নির্যাতিত-নিপীড়িত। সুতরাং শান্তি পেতে হলে রাসূল (সা.)-এর আদর্শের কোনো বিকল্প নেই। তাঁর আনীত জীবন-বিধান প্রতিষ্ঠাই মুক্তির একমাত্র উপায়। অতএব, আমাদের আচার-ব্যবহার, কথা-বার্তা ও পোশাক-পরিচ্ছদে রাসূল (সা.)-এর আদর্শের অনুসরণ করা উচিত। লেখক : কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির