post

মানবতার শান্তির দূত হজরত মুহাম্মদ সা.

মুহাম্মদ আবদুল জব্বার

২৬ জানুয়ারি ২০১৬
হজরত মুহাম্মদ সা. বিশ্বমানবতার জন্য আল্লাহর এক অনন্য রহমতস্বরূপ প্রেরিত। আল্লাহ তা’য়ালার ঘোষণা, “আমি তোমাকে প্রেরণ করেছি বিশ্বজগতের জন্য বিশেষ রহমতস্বরূপ।” (সূরা আম্বিয়া : ১০৭) তিনি ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো- সব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলেন। তিনি শুধু দার্শনিকই ছিলেন তা-ই নয়, বরং তিনি যা আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন তা নিজেই এর বাস্তব নমুনা হিসেবে মানবজাতির জন্য পেশ করেছেন। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন আঞ্জাম দিয়েছিলেন অত্যন্ত সুচারুরূপে। রাসূল সা. পৃথিবীর সবচেয়ে বর্বর একটি জাতিকে শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করে পৃথিবীতে অনাগতের জন্যও এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন রেখে গেছেন। রাসূল সা. বিশ্বজাহানে শান্তি প্রতিষ্ঠার এক অনন্য নজির স্থাপন করেন, সর্বক্ষেত্রে তিনি সফল ব্যক্তিত্ব। ঐতিহাসিক গিবনের ভাষায় বলা যায়,  If all the world was united under one leader, Muhammad would have been the best fitted man to lead the peoples of various creeds, dogmas and ideas to peace and happiness.সমগ্র দুনিয়াকে যদি একত্র করে একজনের নেতৃত্বে আনা যেত তাহলে নানা ধর্মমত, ধর্মবিশ্বাস ও চিন্তার মানুষকে শান্তি-সুখের পথে পরিচালনার জন্য হজরত মুহাম্মদ সা.-ই হবেন সর্বোত্তম যোগ্য নেতা। আজ অশান্ত বিশ্বে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, জাতি-গোত্রে হানাহানি সব কিছুর মূলোৎপাটন করে বিশ্বমানবতাকে শান্তির সুশীতল ছায়াতলে আচ্ছাদিত করতে নবী মুহাম্মদ সা.-এর আদর্শ অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই। ১. রাসূল সা. মানবজাতির জন্য শান্তির দূতস্বরূপ প্রেরিত আল্লাহ তা’য়ালা যুগে যুগে মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে বিভিন্ন গোত্রের নিকট মহানায়কদের পাঠিয়েছেন, যারা অহির মাধ্যমে মানবজাতির শান্তি নিশ্চিত করতে আমৃত্যু কাজ করেছেন। বিভিন্ন নবী ও রাসূলকে বিভিন্ন গোত্রের জন্য বা নির্দিষ্ট এলাকার জন্য প্রেরণ করলেও রাসূল সা.কে শেষ নবী হিসেবে সমগ্র বিশ্বমানবতার জন্য প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, “আমরা তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্যই সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী বানিয়ে পাঠিয়েছি।” (সূরা সাবা : ২৮) “হে লোক সকল! তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে এ নবী তোমাদের কাছে সত্যসহকারে এসেছেন, কাজেই তোমরা ঈমান পোষণ কর। এটা তোমাদের পক্ষে কল্যাণকর।” (সূরা নিসা : ১১০) “তিনি আল্লাহ যিনি তার রাসূলকে হিদায়েত ও সত্য জীবনব্যবস্থাসহ পাঠিয়েছেন, যেন তিনি এ দ্বীনকে সমস্ত বাতিল ব্যবস্থার ওপর বিজয়ী করেন।” (সূরা ফাতাহ : ২৮) ২. রাসূল সা. ব্যক্তিজীবনে ছিলেন শান্তির অনন্য দূত রাসূল সা. সেই শৈশব জীবন থেকেই সত্য, পরোপকারিতা, অন্যের অধিকারের ব্যাপারে ছিলেন সদাতৎপর। রাসূল সা. শৈশবে মা আমিনার কাছ থেকে লালিত পালিত হতে থাকলেন দুধমা হালিমা আস-সাদিয়ার কাছে। তিনি সবসময় মা হালিমার একটি স্তনের দুধ পান করতেন, অপরটির দুধ দুধভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন, কখনো চেষ্টা করেও অপরটির দুধ খাওয়ানো যায়নি। সুবহানাল্লাহ! রাসূল সা. কৈশোরে আরবের পাপাচার ও মিথ্যার প্রলেপে আবৃত নোংরা সমাজব্যবস্থায় সত্যবাদিতার এক অনন্য নজির ছিলেন, তাই তিনি যা বলতেন সবাই বিনাবাক্যে তা মেনে নিতেন। তাই তাকে সবাই আল-আমিন বা আস-সাদিক বলে ডাকতেন। যদিওবা তিনি যখন আল্লাহর নির্দেশে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর ঘোষণা দিলেন তখন মক্কার অধিপতিরা নড়ে চড়ে বসলেন। তাঁর উপস্থাপিত মতাদর্শকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে তার প্রতি জুলুম-নির্যাতন ও মিথ্যাচার চাপিয়ে দিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর বিশ্বাসের ওপর পাহাড়ের মতো অটল থাকলেন। তিনি বিশ্বাসীদের নিকট এক অনন্য দলিল। তাঁর আদর্শিক দৃঢ়তা দেখে পরবর্তী সময়ে হজরত বেলাল, খোবায়ের-খাব্বাব, আম্মার বিন ইয়াসির ইসলামের ছায়াতলে অংশগ্রহণ করে আত্মত্যাগের এক বিরল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেন। যাদের ত্যাগ কোরবানির ইতিহাস পৃথিবীর প্রতিটি অনাগত বিশ্বাসী মানুষের জন্য আল্লাহর পথে দৃঢ় পদে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রেরণা জোগাবে। রাসূল সা. নবুওয়াত প্রাপ্তির শুরুর দিকে গোপনে টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিলেন। এর মধ্যে এক বৃদ্ধা মহিলা রাসূল সা.-এর ইসলাম প্রচারের মিশনের কথা শুনে ক্ষুব্ধ হলেন। তাই তিনি মুহাম্মদ সা.কে কষ্ট দেয়ার পরিকল্পনা আঁটলেন। পরিকল্পনামাফিক প্রতিদিন রাসূলের হাঁটার পথে কাঁটা পুঁতে রাখতেন, আর রাসূল সা. কষ্ট করে তা সরিয়ে দিতেন। এভাবে বেশ ক’দিন চলল, একদিন দেখা গেল সেই রাস্তায় কাঁটা নেই। রাসূল সা. বুড়ি মা’র খোঁজ নিলেন, ভাবলেন তিনি কি অসুবিধায় পড়েছেন? খোঁজ দেখা গেল তিনি অসুস্থ। তাই তিনি তার খোঁজ নিতে তার শিয়রে গিয়ে হাজির হলেন! রাসূল সা. তার অসুবিধার (অসুস্থতার কথা শুনলেন, খোঁজখবর নিলেন) এতে বুড়ি-মা বিস্মিত হলেন! যে লোকটিকে কষ্ট দেয়ার জন্য চলার পথে প্রতিদিন কাঁটা পুঁতে রাখতাম সে-ই কিনা আমার খবর নিতে এসেছে? তিনি নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। রাসূল সা. নবুওয়াতপ্রাপ্তির পর ইসলামের দাওয়াত প্রচারে তায়েফে সফর করেন। তায়েফবাসীকে ইসলামের পতাকাতলে আসার আহবান জানালেন। তারা রাসূল সা.-এর দাওয়াত গ্রহণ না করে খারাপ আচরণ করলেন। তায়েফবাসীর (কাফেরদের) আক্রমণে তিনি মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন, শরীর থেকে রক্ত প্রবাহিত হয়ে পায়ের সাথে জুতো ও মোজায় জট বেঁধে যায়। এত কষ্টের পরও তিনি আল্লাহর দরবারে তায়েফের কাফেরদের জন্য লা’নত না করে দোয়া করলেন। এতে রাসূল সা. কত বেশি ধৈর্যশীল ও শান্তিকামী ছিলেন তার পরিচয় বহন করে! রাসূল সা. যা বলতেন তা বিশ^াস করতে ও কাজে পরিণত করতেন, যা সাহাবীরা স্বচক্ষে অবলোকন করেছেন। বার্নার্ড’শ তার দর্শনে লিখেছেন একজন ব্যক্তির জীবনে একটির বেশি বিয়ে করতে নেই। কিন্তু তিনি জীবনে তিনটি বিয়ে করেছিলেন। একদিন তার এক শিষ্য তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি আপনার দর্শনের সাথে মিলিয়ে আপনার জীবন পরিচালনা করেন না কেন? তিনি বলেছিলেন যে, দর্শন আর জীবন এক নয়। সে দিক দিয়ে আমরা রাসূল সা.-এর জীবনকে পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই তিনি ছিলেন মানবতার জন্য এক প্রজ্বলিত জীবনদর্শন। যখন খন্দকের যুদ্ধের জন্য পরিখা খননকাজ চলছিল তখন তিনি নিজেই মাটি খননের কাজ করছিলেন! সাহাবারা তাঁর কাজে দেখে তাদের কাজে আরো বেশি উদ্যমী হলেন। তাঁর ব্যক্তিজীবনে সারা জাহানের নেতৃত্বের জন্য আছে অতুলনীয় শিক্ষা। ৩. সর্বক্ষেত্রে শান্তির নায়ক রাসূল সা. ক. গোত্রে গোত্রে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান রাসূল সা. নবুওয়াতের আগে দীর্ঘদিন ধরে আওস ও খাজরাজ গোত্রের মাঝে বিদ্যমান যুদ্ধে মর্মাহত হলেন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধলিপ্ত এসব গোত্রকে যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে বিরত করে নিরীহ মানুষের নিরাপত্তার জন্য উদ্যমী শান্তিকামী যুবকদের নিয়ে “হিলফুল ফুজুল” নামে একটি শান্তিসংঘ প্রতিষ্ঠা করলেন। যে সংঘটি দুর্বলদের নিরাপত্তা বিধান ও গোত্রে গোত্রে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থেকে নিবৃত্ত করতে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিল। খ. মদিনা রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা সাম্যের এক অনন্য নজির মদিনায় হিজরত করে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা. ইসলাম প্রচারের উপযোগী পরিবেশ পেলেন। এখানে তিনি নিরাপদে ইসলাম প্রচার শুরু করলেন। তিনি মক্কা থেকে হিজরতকারী (মুহাজির) মুসলমানদের মদিনায় আশ্রয়দাতা (আনসার) মুসলমানদের সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেন। মহানবী সা. হিজরত করে মদিনাকে ইসলাম প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন। তিনি এখানে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর নিরাপত্তা ও কল্যাণের স্বার্থে কতগুলো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তার মধ্যে মদিনার সনদ অন্যতম। মহানবী সা. মদিনার মুসলমান, খ্রিস্টান, ইয়াহুদি ও পৌত্তলিক সম্প্রদায়ের লোকদের একত্রিত করে পরস্পরের মধ্যে শান্তি, সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য একটি সনদ সম্পাদন করেন। ইতিহাসে একে মদিনার সনদ নামে অভিহিত করা হয়। মদিনায় নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের এ সনদই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত চুক্তি বা সংবিধান। সনদে মোট ৪৭টি ধারা ছিল। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভিন্ন মত ও পথের মানুষদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে মদিনা ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। যে শর্তের ভিত্তিতে মদিনা রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল সে শর্তগুলো অবলোকন করলে বুঝা যায় রাসূল সা. শান্তিপ্রতিষ্ঠায় কত মহৎ ও উদার ছিলেন। গ. যুদ্ধক্ষেত্রে আগে আক্রমণ নয় রাসূল সা. কখনো নিজে থেকে শত্রুবাহিনীকে যুদ্ধের আমন্ত্রণ জানাননি, প্রথমেই নিজের পক্ষ থেকে আক্রমণ বা যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করেননি। সবসময় তিনি ধৈর্যের নীতি অবলম্বন করেছেন। রাসূলের সা. সব যুদ্ধ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে মুসলমানদের যুদ্ধের প্রস্তুতি স্বল্প থাকলেও আল্লাহর সাহায্য, ধৈর্য ও কৌশলে মোকাবেলা করেছেন। পৃথিবীর বুকে অনাগত যুদ্ধংদেহি নেতৃবৃন্দের জন্য এই নীতি শান্তিপ্রতিষ্ঠায় এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। ঘ. হুদায়বিয়ার সন্ধি রাসূল সা.-এর শান্তিকামিতার এক বিরল দৃষ্টান্ত ষষ্ঠ হিজরিতে রাসূল সা. হঠাৎ স্বপ্ন দেখলেন সাহাবীদের সাথে নিয়ে কাবা তাওয়াফ করছেন। সাহাবীদের কাছে তিনি তাঁর স্বপ্নের ঘটনা বর্ণনা করলেন এবং খুব শিগগিরই মুসলমানদের আশা পূরণে সক্ষম হবে বলে তিনি সুসংবাদ দেন। কয়েক দিনের মধ্যে মুসলমানদেরকে ওমরার প্রস্তুতি নিতে রাসূল সা. নির্দেশ দিলেন। উদ্দেশ্য ছিল রাসূল সা. এ সফরে কাবাঘর তাওয়াফ করবেন, মক্কায় অবস্থানকালীন সময়ে মক্কায় ইসলাম প্রচার করবেন এবং দীর্ঘ দিন ধরে মুহাজিররা স্বজনদের কাছ থেকে বিতাড়িত, তাই তাদের সাথে সাক্ষাতের একটি সুযোগ সৃষ্টি হবে। রাসূল সা. কাবার উদ্দেশে রওনা দিলেন, ইতোমধ্যে কুরাইশরা মুসলমানদের আগমনের খবর পেয়ে গেলো। এই সংবাদ জানার পরও হজরত সা. সামনে অগ্রসর হলেন এবং হুদাইবিয়া নামক স্থানে পৌঁছে যাত্রাবিরতি করলেন। এ জায়গাটি মক্কা থেকে এক মঞ্জিল দূরে অবস্থিত। এখানকার খোজায়া গোত্রের প্রধান হজরত সা.-এর খেদমতে হাজির হয়ে বললো : ‘কুরাইশরা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। তাঁরা আপনাকে মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না।’ হজরত সা. বললেন : ‘তাদেরকে গিয়ে বলো যে, আমরা শুধু হজের নিয়তে এসেছি, লড়াই করার জন্য নয়। কাজেই আমাদেরকে কাবা শরিফ তাওয়াফ ও জিয়ারত করার সুযোগ দেয়া উচিত।’ কুরাইশদের কাছে যখন এই পয়গাম গিয়ে পৌঁছলো, তখন কিছু দুষ্ট প্রকৃতির লোক বলে উঠলো : ‘মুহাম্মদের পয়গাম শোনার কোনো প্রয়োজন আমাদের নেই।’ কিন্তু চিন্তাশীল লোকদের ভেতর থেকে ওরওয়া নামক এক ব্যক্তি বললো : ‘না, তোমরা আমার ওপর নির্ভর করো; আমি গিয়ে মুহাম্মদ সা.-এর সঙ্গে কথা বলছি। ওরওয়া হজরত সা.-এর খেদমতে হাজির হলো বটে, কিন্তু কোনো বিষয়েই মীমাংসা হলো না। ইতোমধ্যে কুরাইশরা মুসলমানদের ওপর হামলা করার জন্য একটি ক্ষুদ্র বাহিনী প্রেরণ করলো এবং তারা মুসলমানদের হাতে বন্দীও হলো; কিন্তু হজরত সা. তাঁর স্বভাবসুলভ করুণার বলে তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন এবং তাদেরকে মুক্তি দেয়া হলো। এর পর সন্ধির আলোচনা চালানোর জন্য হজরত উসমান (রা) মক্কায় চলে গেলেন; কিন্তু কুরাইশরা মুসলমানদেরকে কাবা জিয়ারত করার সুযোগ দিতে কিছুতেই রাজি হলো না; বরঞ্চ তারা হজরত উসমান (রাা)-কে আটক করে রাখলো। বায়াতুর রিদোয়ান এই পর্যায়ে মুসলমানদের কাছে এই মর্মে সংবাদ পৌঁছলো যে, হজরত উসমান (রা) নিহত হয়েছেন। এই খবর মুসলমানদেরকে সাংঘাতিকভাবে অস্থির করে তুললো। হজরত সা. খবরটি শুনে বললেন : ‘আমাদেরকে অবশ্যই উসমান সা.-এর রক্তের বদলা নিতে হবে।’ এ কথা বলেই তিনি একটি বাবলা গাছের নিচে বসে পড়লেন। তিনি সাহাবীদের কাছ থেকে এই মর্মে শপথ গ্রহণ করলেন : ‘আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো, তবু লড়াই থেকে পিছু হটবো না। কুরাইশদের কাছ থেকে আমরা হজরত উসমান (রা)-এর রক্তের বদলা নেবোই।’ এই দৃঢ়প্রতিজ্ঞা মুসলমানদের মধ্যে এক আশ্চর্যজনক উদ্দীপনার সৃষ্টি করলো। তারা শাহাদাতের প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়ে কাফিরদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হলেন। এরই নাম হচ্ছে বায়াতুর রিদোয়ান বা ‘রিজওয়ানের শপথ’। কুরআন পাকে এই শপথের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেসব ভাগ্যবান ব্যক্তি এ সময় হজরত সা.-এর পবিত্র হাতে হাত রেখে শপথ গ্রহণ করেছিলেন, আল্লাহ তা’আলা তাঁদেরকে পুরস্কৃত করার কথা বলেছেন। মুসলমানদের এই উৎসাহ-উদ্দীপনার কথা কুরাইশদের কাছেও গিয়ে পৌঁছলো। সেই সঙ্গে এ-ও জানা গেলো যে, হজরত উসমান (রা)-এর হত্যার খবর সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। এই পরিস্থিতিতে কুরাইশরা সন্ধি করতে প্রস্তুত হলো এবং এ সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য সুহাইল বিন্ আমরকে দূত বানিয়ে পাঠালো। তার সঙ্গে দীর্ঘ সময়ব্যাপী আলোচনা হলো এবং শেষ পর্যন্ত সন্ধির শর্তাবলি স্থির হলো। সন্ধিপত্র লেখার জন্য হজরত আলী (রা)-কে ডাকা হলো। সন্ধিপত্রে যখন লেখা হলো ‘এই সন্ধি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সা.-এর তরফ থেকে তখন কুরাইশ প্রতিনিধি সুহাইল প্রতিবাদ জানিয়ে বললো : ‘আল্লাহর রাসূল’ কথাটি লেখা যাবে না; এ ব্যাপারে আমাদের আপত্তি আছে।’ এ কথায় সাহাবীদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হলো। সন্ধিপত্র লেখক হযরত আলী (রা) কিছুতেই এটা মানতে রাজি হলেন না। কিন্তু হজরত সা. নানাদিক বিবেচনা করে সুহাইলের দাবি মেনে নিলেন এবং নিজের পবিত্র হাতে ‘আল্লাহর রাসূল’ কথাটি কেটে দিয়ে বললেন : ‘তোমরা না মানো, তাতে কী? কিন্তু খোদার কসম, আমি তাঁর রাসূল।’ হুদায়বিয়ার সন্ধিসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে মুসলমানরা কুরাইশ কাফেরদের নিকট সাময়িক বশ্যতা স্বীকার করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছিল এই সন্ধিটি মুসলমানদের জন্য এক আত্মঘাতী চুক্তি। নিম্নোক্ত উল্লেখযোগ্য চুক্তির ধারাই প্রমাণ করে রাসূল সা. কত সহনশীল ও শান্তিকামী ছিলেন। সাময়িক কষ্টকে মেনে নিয়ে সংঘাতকে এড়িয়ে গিয়েছেন- ১.    মুসলমানরা এ বছর হজ না করেই ফিরে যাবে। ২.    তারা আগামী বছর আসবে এবং মাত্র তিন দিন থেকে চলে যাবে। ৩.    কেউ অস্ত্রপাতি নিয়ে আসবে না। শুধু তলোয়ার সঙ্গে রাখতে পারবে; কিন্তু তা-ও কোষবদ্ধ থাকবে, বাইরে বের করা যাবে না। ৪.    মক্কায় যেসব মুসলমান অবশিষ্ট রয়েছে, তাদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না। আর কোনো মুসলমান মক্কায় ফিরে আসতে চাইলে তাকেও বাধা দেয়া যাবে না। ৫.    কাফির বা মুসলমানদের মধ্য থেকে কেউ মদিনায় গেলে তাকে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু কোনো মুসলমান মক্কায় গেলে তাকে ফেরত দেয়া হবে না। ৬.    আরবের গোত্রগুলো মুসলমান বা কাফির যেকোনো পক্ষের সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করতে পারবে। ৭.    এ সন্ধি-চুক্তি দশ বছরকাল বহাল থাকবে। ঙ. সন্ধিকালে এক করুণ দৃশ্য, ধৈর্যের পরিচয় সন্ধিপত্র যখন লিখিত হচ্ছিলো, ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটনাচক্রে সুহাইলের পুত্র হজরত আবু জান্দাল (রা) মক্কা থেকে পালিয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি শৃঙ্খলিত অবস্থায় মুসলমানদের সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন এবং সবাইকে নিজের দুর্গতির কথা শোনালেন। তাঁকে ইসলাম গ্রহণের অপরাধে কী কী ধরনের শাস্তি দেয়া হয়েছে, তা-ও সবিস্তারে খুলে বললেন। অবশেষে তিনি হজরত সা.-এর কাছে আবেদন জানালেন : ‘হুজুর আমাকে কাফিরদের কবল থেকে মুক্ত করে আপনার সঙ্গে নিয়ে চলুন।’ এ কথা শুনে সুহাইল বলে উঠলো : ‘দেখুন, সন্ধির শর্ত মেনে নেয়ার পর আর তাকে নিয়ে যেতে পারেন না।’ এটা ছিলো বাস্তবিকই এক নাজুক সময়। কারণ, আবু জান্দাল ইসলাম গ্রহণ করে নির্যাতন ভোগ করছিলেন এবং বারবার ফরিয়াদ জানাচ্ছিলেন : ‘হে মুসলিম ভাইগণ! তোমরা কি আমাকে আবার কাফিরদের হাতে তুলে দিতে চাও?’ সব মুসলমান এই পরিস্থিতিতে অত্যন্ত অস্থির হয়ে উঠলো। হজরত উমর (রা) তো রাসূলুল্লাহ সা.-কে এ পর্যন্ত বললেন যে, ‘আপনি যখন আল্লাহর সত্য নবী, তখন আর আমরা এ অপমান কেন সইব? হজরত সা. তাকে বললেন : ‘আমি আল্লাহর পয়গাম্বর, তাঁর হুকুমের নাফরমানি আমি করতে পারি না। আল্লাহই আমায় সাহায্য করবেন।’ সন্ধি-চুক্তি সম্পাদিত হলো। সন্ধির শর্ত মোতাবেক আবু জান্দালকে ফিরে যেতে হলো। এভাবে ইসলামের পথে জীবন উৎসর্গকারীরা রাসূলের আনুগত্যের এক কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। একদিকে ছিলো দৃশ্যত ইসলামের অবমাননা ও হজরত আবু জান্দালের শোচনীয় দুর্গতি আর অন্য দিকে ছিলো রাসূল সা.-এর নিরঙ্কুশ আনুগত্যের প্রশ্ন। হজরত সা. আবু জান্দালকে বললেন : ‘আবু জান্দাল! ধৈর্য ও সংযমের সাথে কাজ করো। আল্লাহ তোমার এবং অন্যান্য মজলুমের জন্য কোনো রাস্তা বের করে দেবেনই। সন্ধি-চুক্তি সম্পন্ন হয়ে গেছে। কাজেই আমরা তাদের সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারি না।’ তাই আবু জান্দালকে সেই শৃঙ্খলিত অবস্থায়ই ফিরে যেতে হলো। চ. মক্কা বিজয়, রাসূল সা. শত্রুদের জন্য ক্ষমা ও শান্তির এক অনন্য নজির মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যের খবর সম্পূর্ণ গোপন রেখে মহানবী সা. অষ্টম হিজরির ১০ রমজান দশ হাজার সাহাবী নিয়ে মক্কার কুরাইশদের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য মদিনা ত্যাগ করেন। পথিমধ্যে তিনি শিবির সন্নিবেশ করলেন। এই বিশাল বাহিনী দেখে কুরাইশরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। প্রত্যেক তাঁবুতে আগুন জ্বালানোর জন্য মহানবী সা. নির্দেশ দিলেন। রাত্রে তা দেখে কুরাইশরা মুসলিম বাহিনীর প্রকৃত শক্তি থেকে অনেক বেশি বলে ধারণা করলো। এ সময় আবু সুফিয়ান ছদ্মবেশে শিবিরের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য এলে ইসলামের এই ঘোরতর শত্রু মুসলমানদের কাছে ধরা পড়ে যায়। তাকে মহানবী সা.-এর কাছে নিয়ে আসা হলে করুণার মূর্ত প্রতীক মহানবী সা. তাকে ক্ষমা করে দেন এবং ঘোষণা করেন যে, যারা আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করবে তারা নিরাপদ থাকবে। আবু সুফিয়ান মহানবী সা.-এর মহানুভবতায় এবং ইসলামের মহান উদারনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। আবু সুফিয়ান মক্কায় পৌঁছে মুসলমানদের আগমনের খবর ও তাদের বিরুদ্ধাচরণ করা যে নির্বুদ্ধিতা হবে, তা প্রচার করে দিলেন। পরদিন মহানবী সা. শান্তিপূর্ণভাবে মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং কোনোরূপ রক্তপাত থেকে বিরত থাকতে সকলকে নির্দেশ দিলেন। কাবাঘরে প্রবেশ করে মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। সব প্রতিমাগুলোকে সরিয়ে কাবাঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করলেন। অতঃপর এক ভাষণে সব মক্কাবাসীর প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করলেন। মহানবী সা. এইভাবে তাঁর শত্রুদের প্রতি এক দৃষ্টান্তমূলক ক্ষমা প্রদর্শনের স্বাক্ষর রাখলেন। সুদীর্ঘ তেরো বছর ধরে তিনি ও তাঁর সাহাবীগণ এই মক্কায় কুরাইশদের হাতে নিদারুণ নির্যাতন ভোগ করেছেন। তাদের নিষ্ঠুর, নির্যাতনে মুসলমানদের বাধ্য হয়ে মদিনায় হিজরত করতে হয়। হিন্দা ও আবু সুফিয়ানের মতো, ইসলামের ঘোরতর শত্রুকেও ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়। কোনো বিজয়ী তাঁর শত্রু বিজিতদের এভাবে ভালোবাসা ও দয়া প্রদর্শন করতে পারে, ইতিহাসে তেমন নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিক গিবনের ভাষায় বলা যায়, In the long lon history of he world there is no instance of magnamity and forgiveness which can approach those of muhammad (S.) when all his enemies lay at his feet and he forgave them one and all. হজরত মুহাম্মদ সা. তাঁর পায়ে অবনত অবস্থায় সকল শত্রুকে পেয়েও তাদেরকে ক্ষমা করে ঔদার্য ও ক্ষমাশীলতার যে অনুপম আদর্শ প্রদর্শন করেন তার দ্বিতীয় কোনো নজির দুনিয়ার সুদীর্ঘ ইতিহাসে নেই। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ স্বীকার করেছেন যে, “যুদ্ধ বিজয়ের সকল ঐতিহাসিক বিবরণীতে মহানবী সা.-এর বিজয়ীর বেশে মক্কা নগরীতে প্রবেশের মতো দৃশ্য আর দেখা যায় না।” বিশ্ব ইতিহাস মহানবী সা.-এর মতো ব্যক্তিত্ব এখন পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারেনি, যাঁর ছিল ক্ষমা করার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত। বস্তুত মক্কা বিজয় ছিল ইসলামের এক অনন্য বিজয়, মহানবী সা. এর দ্বীনের উদ্দেশ্যে অটল বিশ্বাসের বিজয়, শত্রুকে ক্ষমা ও শান্তিপ্রতিষ্ঠার অনন্য নজির উপস্থাপন। ৪. সোনার মানুষ তৈরি রাসূল সা. অসভ্য বর্বর জাতিকে সভ্য জাতিতে পরিণত করেছেন। পাপাচারে লিপ্ত মানুষগুলোকে সোনার মানুষে পরিণত করেছিলেন। যাদের নেতৃত্বে সুদীর্ঘকাল শান্তির আবেশে অর্ধজাহান শাসিত হয়েছিল। যাদের কাছে সমগ্র দুনিয়া পদানত হয়েছিল। সেই খোলাফায়ে রাশেদার যুগ যুগে যুগে ধরায় শান্তিপ্রতিষ্ঠায় ব্রত অনাগত সকল নেতৃত্বকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনুকরণ করতে অনুপ্রাণিত করবে। পৃথিবী আজ বড়ই অশান্ত। পৃথিবী শান্তির আশায় হন্যে হয়ে অথৈ মরীচিকায় সাঁতরাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী রক্তের হোলি খেলায় মত্ত মানবতা। কতটুকু মনুষ্যত্ববোধের অভাব হলে ক্ষমতান্ধ রাষ্ট্রনায়করা অগণিত নারী-শিশুসহ অসহায় নিরপরাধ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করতে পারে? কতটুকু মানবতা না থাকলে বছরের পর বছর জনপদের পর জনপদকে জিম্মি করে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করতে পারে? পৃথিবীটা মানুষের জন্যই। আর তা যদি বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায় তাহলে পৃথিবীর সব আয়োজন একেবারে বৃথা। পৃথিবীটাই মানুষের জন্য মূল কর্মযজ্ঞের স্থান। ব্যক্তি ও সামষ্টিক কর্মতৎপরতার ওপর ভিত্তি করে প্রতিটি জনপদে শান্তি-অশান্তি রচিত হয়। এমতাবস্থায় এই অশান্ত ধরাকে শান্তির ছায়াতলে আবদ্ধ করতে রাসূল সা. এর হেরার আলোয় উদ্ভাসিত আল কুরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বব্যাপী আজ যারা শান্তির ফেরি করে ফিরছেন তাদের অধিকাংশই ঠকবাজ মিথ্যুক ও প্রতারক। এরা যার যার আখের গোছাতে ব্যস্ত। তারা দুনিয়া-আখেরাতে তাদের কর্তব্যকর্মের কথা দিব্যি ভুলে গেছে। যেসব বিবেকবান নেতৃবৃন্দ বুঝেন তাদের উচিত বিশ্বমানবতার কষ্ট লাঘবের জন্য রাসূল সা.-এর শান্তি প্রতিষ্ঠার ফর্মুলা আল কুরআনের নির্দেশনাকে অনুসরণ করা। যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হবে কাক্সিক্ষত সমাজ, ঘুচাবে মানবতার অন্ধকার। লেখক : সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, বিআইসিএস

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির