post

মানুষ হত্যার উৎসব

২৬ মে ২০১৪

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

Storyবাংলাদেশে এখন সবচেয়ে সহজ ও নির্বিঘœ হয়ে উঠেছে মানুষ হত্যা। মনে হচ্ছে, যেকোনো ব্যক্তি এখন যেকোনো সময়ে ইচ্ছা হলেই যে কাউকে নির্বিঘেœ খুন করতে পারেন। শুধু বলে দিতে হবে, এ খুনের জন্য দায়ী বিএনপি-জামায়াত। তাহলে আর সেই খুন নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য হবে না; বরং বিএনপি-জামায়াতের লোকদের গ্রেফতারবাণিজ্যের শিকার করা যাবে। এখন অবশ্য এটা একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে, যেকোনো জায়গায় যে কেউ খুন হলে সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের ছোট-বড় নেতারা একযোগে রা রা করে ওঠেন, এ হত্যাকাণ্ডের জন্য বিএনপি দায়ী। আর খুন এখন নিজেও করা যায়। র‌্যাব, পুলিশের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ ওঠে। এর বাইরে আছে ভারাটে খুনি বাহিনী। এখন মানুষ হত্যার বিচার আশা করা যায় না। ২০০৮ সালের একতরফা ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসে সরকার যেন একে একে হত্যার মাধ্যমে বিএনপি জোটকে নির্মূল করার পণ করে বসেছে। ইতোমধ্যে হাজার হাজার মানুষ খুন হয়েছে। বিচার হয়নি। প্রধানত খুনগুলো হয়েছে রাজনৈতিক। জোরালো সরাসরি অভিযোগ, র‌্যাব-পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে। জবাবদিহিতা বা বিচারের কোনো ব্যবস্থা হয়নি। কে খুন হয়েছে? বিএনপি বা জামায়াতের লোক। তাদের এই দেশে থাকারও অধিকার নেই। বেঁচে থাকারও অধিকার নেই। অতএব খুন হয়েছে, ভালোই হয়েছেÑ মনোভাবটা এই পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বহু ক্ষেত্রে গণমাধ্যম এমনটিই বলছেÑ এসব খুনে সরকার বা সরকারদলীয় লোকদের মদদ রয়েছে। কিন্তু ধরা পড়েনি কেউ। আমাদের মতো কিছু লোক অবিরাম চিৎকার করেছি, এই হত্যাকাণ্ড রোধ না করতে পারলে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানবেরা একসময় আরো প্রবল হয়ে উঠবে এবং সরকারেরই ঘাড় মটকে দেবে। সে চিৎকারে সাড়া দেয়নি কেউ। আমরা যা যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম, একে একে সব ফলতে শুরু করেছে। সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয়করণ ও উৎসাহদানের মাধ্যমে কার্যত জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে। বিরোধী দল দমনের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সরকারি দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের লোকদের নামানো হয়েছে। এরা কখনো কখনো পুলিশের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে প্রতিপক্ষের দিকে গুলি ছুড়েছে। এসবের সচিত্র প্রতিবেদন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করেছে ভিডিও ফুটেজ। কদাচিৎ কেউ হয়তো গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু কোনো ফাঁকে হয়তো জামিন নিয়ে বেরিয়েও গেছে। সরকার থেকেছে নির্বিকার। আমরা বলেছিলাম, যদি এই পরিস্থিতি চলতে থাকে, পরিণতি ভালো হবে না। এই ঘাতকেরা মানুষের জীবন নিয়ে নানা ধরনের ছিনিমিনি খেলতে থাকবে। সেই ছিনিমিনি শুরু হয়ে গেছে। এখন গ্রেফতারবাণিজ্য, মুক্তিপণ, গুম, অপহরণ নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। যার যেমন খুশি, যেভাবে খুশি মানুষ হত্যায় যোগ দিচ্ছে। র‌্যাব-পুলিশের পোশাক, টুপি, ব্যাজ, বেল্ট, জুতা, হাতকড়াÑ সব কিছুই বিক্রি হচ্ছে খোলাবাজারে। এগুলোর মাধ্যমে যে অপরাধ সংঘটন সম্ভব, সেটা পুলিশের না জানার কথা নয়। তারাও নির্বিকার। যত অপরাধী তত বাণিজ্য। এসব দোকান ও বাণিজ্য চলছে পুলিশের নাকের ডগায়ই। মিডিয়ার সচিত্র প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। পুলিশ বলছে, হতে পারে। ব্যস, তাদের দায়িত্ব শেষ। আবার পুলিশ কাল্পনিক অপরাধ সংঘটনের জন্য আজব সব মামলা করে। সে মামলায় আসামি হিসেবে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে। এরপর নিজে লিখে দেয় আরো পাঁচ শ’, হাজার, ১০ হাজার, ৩০ হাজার...। তারপর সাদা পোশাকে, অস্ত্র হাতে, প্রাইভেট-মাইক্রোবাস নিয়ে মধ্যরাতে গ্রামগঞ্জে আসামি ধরতে যায়। হাতের কাছে যাকে পায় তাকেই আটকে থানায় নিয়ে আসে। এরপর রাতভর চলে দেনদরবার ও গ্রেফতারবাণিজ্য। হাজার, লাখ। যার কাছে যা পায়, সেভাবে টাকা আদায় করে হয়তো ভোরবেলা ছেড়ে দেয় কিংবা চালান। কাউকে ভয় দেখায় দাবি করা অর্থ না দিতে পারলে দেয়া হবে ক্রসফায়ারে। তখন আটক ব্যক্তিদের স্বজনেরা মরিয়া হয়ে অর্থ সংগ্রহে নামে। এভাবেই চলছে। দেশের মানবাধিকার সংগঠন ও বিবেকবান মানুষেরা অবিরাম চিৎকার করেছেন, ‘বন্ধ করো এসব। নিরাপত্তা দাও মানুষের জানমালের।’ সরকারি মহল কেবলই অট্টহাসি হেসেছে। আমরা সতর্ক করার চেষ্টা করেছি যে, এ অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় সরকারের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা স্বার্থের দ্বন্দ্বে পরস্পরের ওপর হামলে পড়বে। এখন যে ক্রন্দনধ্বনি বিরোধী শিবিরে উঠেছে, তা একসময় সরকারি শিবিরের বুকও কাঁপিয়ে দেবে। ঘরে ঘরে এমন আহাজারির পরিণাম বড় ভয়াবহ হয়। আস্তে আস্তে পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এখন কাকেরা কাকের মাংস ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে। হায়েনারা হায়েনাদের। আর সম্ভবত এত দিন পরে এসে সরকারের টনক খানিকটা নড়তে শুরু করেছে। সম্প্রতি ঘটেছে এমনই কিছু খুনের ঘটনা। নারায়ণগঞ্জে সাত (১১) খুনের ঘটনা তার একটি। র‌্যাব সেখানকার সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় রাস্তায় রীতিমতো ব্যারিকেড দিয়ে দু’টি গাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন সম্প্রতি অপহরণ হন। প্রকাশ্য দিবালোকে অনেক লোকের সামনেই এমন ঘটনা ঘটে। এর প্রতিবাদ করার সাহস কারো নেই। তাতে প্রতিবাদীও যেকোনো সময় কিংবা হয়তো তখনই উধাও হয়ে যাবে। তবু প্রতিবাদ একজন করেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন কী হচ্ছে? অপহরণকারীরা তাকে ধমক দিয়ে বলেছিল, আগে বাড়ো। তারপর ৩০ এপ্রিল ওই সাতজনের হাত-পা বাঁধা লাশ একের পর এক ভেসে ওঠে শীতলক্ষ্যায়। লাশ ভেসে ওঠার পর খোদ প্রধানমন্ত্রী টঙ্গীর জনসভায় ঘোষণা করে বসলেন, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য বিএনপি দায়ী। কিন্তু এখন আস্তে আস্তে ঘটনা উদঘাটিত হচ্ছে। সবাই বলছে, এর জন্য র‌্যাবের কয়েকজনও দায়ী। এই সাতজন অপহরণের পরপরই নজরুলের স্ত্রী ও শ্বশুর গিয়েছিলেন র‌্যাব ও পুলিশের কাছে। তারা এদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রেখে দুর্ব্যবহার করে বের করে দিয়েছেন। নজরুলের স্ত্রী থানায় যে এজাহার দেন, তাতে তিনি র‌্যাবেরও নাম উল্লেখ করেন। সরকারি লোকদের নাম থাকলে এজাহার নেয়া হবে না। নজরুলের শ্বশুর বয়োবৃদ্ধ শহীদ চেয়ারম্যান র‌্যাবের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল তারেক সাঈদের পায়ে ধরে বলেছিলেন, অপর কাউন্সিলর নূর হোসেনের কাছ থেকে র‌্যাব যত টাকা খেয়েছে নজরুল ইসলামকে হত্যার জন্য, তিনি তার দ্বিগুণ টাকা দেবেন নজরুলকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। তাকেও দুর্ব্যবহার করে ফিরিয়ে দেন তারেক সাঈদ। এই সাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি কাউন্সিলর নূর হোসেন। নারায়ণগঞ্জ অপরাধ জগতের তিনি এক গডফাদার। পুলিশ-প্রশাসন সব কিছুই ছিল তার পোষা। তার ছিল ভোগবিলাসের রঙমহল। সেখানে যাতায়াত ছিল প্রশাসনের বড় চাঁইদের। অস্ত্র, মাদক, জুয়া থেকে ছিল তার বিপুল আয়। ভাগবঞ্চিত ছিল না কেউ। শহীদ চেয়ারম্যানের অভিযোগÑ নজরুলকে হত্যার জন্য র‌্যাবের সিও ছয় কোটি টাকা খেয়েছেন। এ টাকা সিও ও তার স্বজনদের অ্যাকাউন্টে কোথা থেকে গেছে, তিনি তারও আভাস দেন। এবং তাদের অ্যাকাউন্ট খতিয়ে দেখার আহ্বান জানান। কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও কাউন্সিলর নূর হোসেন দু’জনই আওয়ামী লীগের লোক। স্থানীয় এমপি শামীম ওসমানও আওয়ামী লীগের লোক। আর র‌্যাবের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা। মায়ার তদবিরেই এই তারেককে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনী প্রহসনের আগে নারায়ণগঞ্জের র‌্যাব ১১-এর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নিয়ে আসা হয়। তিনি যেখানেই কাজ করেছেন, সেখানেই ভয়ঙ্কর সব খুনের অভিযোগ। জনমত ও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ চাপেই সশস্ত্র বাহিনীর সংশ্লিষ্ট তিন কর্মকর্তাকে সেনাবাহিনী থেকে অকালীন অবসর ও বরখাস্ত করা হয়। আর জনমতের চাপেই ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। এর পরও মানুষের সংশয় কাটেনি। ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে তো? এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনার অবসান তখনো হয়নি। এরই মধ্যে গত ২০ মে ফেনীতে প্রকাশ্য দিবালোকে অত্যন্ত নৃশংস কায়দায় খুন করা হলো ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হককে। ৩০-৩৫ জনের একটি ঘাতক বাহিনী শহরের প্রধান সড়কে গাড়ির ভেতরে একরামুল হককে গুলি করে, কুপিয়ে হত্যা করে। তারপর পেট্রল বা গানপাউডার ঢেলে তার গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। প্রায় আধা ঘণ্টা পুড়ে ভস্ম হয়ে যায় গাড়ি। একরামুল পুড়ে এক টুকরো কয়লায় পরিণত হন। গুরুতর অপরাধে সাজা প্রতারণা করে মেয়াদের এক বছর কম জেল খেটে বেরিয়ে এসেছিলেন সেখানকার এবারের প্রহসনের এমপি নিজাম হাজারী। এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই তিনি ঘোষণা করে দেন যে, উপজেলা নির্বাচনে একরামের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী মিনার এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। কিন্তু একরামের ভাই বলেছেন, তিনি মিনারকে দায়ী করে কোনো এজাহার দেননি। কেউ একজন তার কাছে একটি কাগজ এনে সই করতে বলেন, তিনি সই করেছেন। অভিযোগ দায়ের হয়েছে রাজনৈতিক ভিত্তিতে। তারপর নিজাম হাজারী ঘোষণা দিলেন, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ফেনীর এককালের গডফাদার জয়নাল হাজারী দায়ী। জয়নাল হাজারী একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দিয়ে বললেনÑ তিনি নন, দায়ী নিজাম হাজারী নিজেই। অবস্থাদৃষ্টে স্পষ্ট হতে চলেছে যে, সম্ভবত রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও স্বার্থের সঙ্ঘাতে নিজাম হাজারী এই হত্যাকাণ্ডের আয়োজক। আর অভিযোগ, যাদের লোকে দেখেছে, যাদের চিনেছে, তাদের গ্রেফতারের কোনো উদ্যোগ প্রশাসনে নেই। জানি না শেষ পর্যন্ত এ খুনেরও কোনো কিনারা হবে কি না। আরেকটি খুনের ঘটনা দিয়ে শেষ করতে চাই। সেটি হলো, নাটোরের যুবদল নেতা জিয়াউল হক সেন্টু হত্যাকাণ্ড। সম্প্রতি হাতিরঝিলে সেন্টু খুন হয়েছেন। পত্রিকার রিপোর্টে দেখা গেল, সেন্টুর সাবেক প্রেমিকা এখনো ভালোবেসেই যাচ্ছেন। এই প্রেমিকার দাবি ছিল সেন্টু যেন তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ১০ বছর আগে বিয়ে করা পুরনো প্রেমিকাকেই আবার বিয়ে করেন। সেন্টু তাতে রাজি হননি। শেষে ২০ লাখ টাকা দিয়ে ভাড়াটে খুনিদের মাধ্যমে তিনি সেন্টুকে খুন করার পরিকল্পনা করেন। প্রেমিকা মোর্শেদা আক্তার প্রিয়া তাকে গভীর রাতে হাতিরঝিলে ডেকে আনেন। সেখানে ভাড়াটে খুনিরা অবিরাম ছুরিকাঘাত করে সেন্টুকে হত্যা করে হাতিরঝিলের সড়কে ফেলে দিয়ে তার ওপর দিয়ে মাইক্রোবাস চালিয়ে চলে যায়। অর্থাৎ সরকারি নিষ্ক্রিয়তায়, সরকারি মদদে খুন এখন এমনই এক সহজ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে যে, খোদ সরকারি দলের লোকেরাও এ খুনের শিকার হতে শুরু করেছে। এখনো কি সরকারের টনক নড়বে না? লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ৎবুধিহংরফফরয়ঁর@ুধযড়ড়.পড়স

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির