post

মিসরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণের ঐতিহাসিক রায়

৩০ জুন ২০১২
মীযানুল করীম মিসরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের বিজয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। সম্প্রতি পার্লামেন্টে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্র ও সরকারের সর্বোচ্চ পদটিতেও জনসমর্থনে তারা বিজয়ী হয়েছে। গত ১৬ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চূড়ান্ত পর্বে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী ড. মোহাম্মদ মুরসি প্রায় সাড়ে ৮ লাখ ভোটের ব্যবধানে প্রতিদ্বন্দ্বী আহমদ শফিককে পরাজিত করেন। মুরসি পেয়েছেন ১ কোটি ২৯ লাখ ১১ হাজার ৩৫০ ভোট যা মোট ভোটের শতকরা ৫২ ভাগ। শফিকের বাক্সে পড়েছে ১ কোটি ২০ লাখ ৬৬ হাজার ৩৭৬ ভোট। ব্রাদারহুড তাদের দেশব্যাপী বিস্তৃত নেটওয়ার্কে স্বল্প সময়ের মধ্যেই ফলাফল জানতে সক্ষম হয়। তখন শফিক এই ফল মেনে না নিয়ে বলেন, তিনি সরকারি ঘোষণার অপেক্ষায়। কয়েক দশক ধরে নিষিদ্ধ এবং অর্ধশতাব্দীর বেশি নির্যাতিত ছিল যে ইখওয়ানুল মুসলিমুন, সে দলই আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত মুসলিম ব্রাদারহুড (ভ্রাতৃসঙ্ঘ) নামে। দলের নেতা ড. মোহাম্মদ বাদী বলেছেন, মুরসির এ বিজয় অতীব গুরুত্ববহ, উম্মাহর স্বার্থেই। আর সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ড. মুরসি অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক দেশ গঠনের। তিনি বলেন, ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সব নাগরিককে আমার পরিবারের সদস্য মনে করবো। স্বৈরাচারপতন আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের পরিবার পরিজনের অধিকার আইনগতভাবে রক্ষা করার কথা তিনি ঘোষণা করেছেন। মিসরে ভোটার প্রায় ৫ কোটি। ভোটকেন্দ্র ছিল ১৩ হাজার। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন প্রথমে ১২ জন। পরিচিতির দিক দিয়ে তাদের মধ্যে সর্বপ্রধান ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আরব লিগের বিগত মহাসচিব আমর মুসা, প্রাক্তন প্রধান আহমদ শফিক এবং বৃহত্তম ইসলামী দল ব্রাদারহুড প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি। মে মাসের শেষ দিকের নির্বাচনে দেখা যায়, বহুলালোচিত মুসা ছিটকে পড়েছেন এবং ‘বাঘে মহিষে লড়াই’ মুরসি বনাম শফিক। এই দু’জনের কেউ-ই ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পাওয়ায় সংবিধানমাফিক দ্বিতীয় দফা ভোটাভুটির প্রয়োজন হয়। স্মর্তব্য, মোবারক-পরবর্তী সময়ে একজন শক্তিশালী সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিলেন মোহাম্মদ এল বারাদি। তিনি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রধান ছিলেন কিছুদিন আগে পর্যন্ত। ইরানইস্যুতে সাহসী নিরপেক্ষতা, আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ, অপর দিকে স্বদেশে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে একাত্মতা তাঁর বিশেষ ইমেজ তৈরি করেছিল। তবে শেষাবধি তিনি নির্বাচনে অবতীর্ণ হননি। যা হোক, এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসীরা এক হয়ে গিয়েছিলেন। পার্লামেন্টের বড় দুই দল ব্রাদারহুড ও আন নূর মুরসির পক্ষে ছিল। এর বিপরীতে, মোবারকের দোসর শফিক স্বৈরাচারের বেনিফিশিয়ারি ছাড়াও ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার পাশ্চাত্যপন্থী ও কথিত উদারতাবাদীদের সমর্থন না পেলে এত ভোট পেতেন বলে আশা করা যায় না। মিসরের বর্তমান সামরিক শাসকরা অন্তর্বর্তীকালীন হলেও তারা গত বছরের প্রচণ্ড গণ-অভ্যুত্থান থেকে শিক্ষা নেয়নি। তাঁদের গুরু মোবারকের তিন দশক স্থায়ী স্বৈরমসনদ উল্টে যাবার অভিজ্ঞতাও তাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনেনি বলেই প্রতীয়মান হয়। সাম্প্রতিক ঘটনাবলির নিরিখে এই সন্দেহ করা অমূলক নয় যে সাময়িকভাবে ক্ষমতাসীন সুপ্রিম কাউন্সিল স্থায়ীভাবে ক্ষমতা কব্জা করে রাখার স্বপ্ন দেখছে। পার্লামেন্ট নির্বাচনে টালবাহানা করে এক বছরেরও বেশি পার করে দিয়েছে উর্দিধারীদের সর্বোচ্চ ফোরামটি। সংবিধান নিয়ে তারা বিতর্ক বাধিয়ে জাতীয় অনৈক্য সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছে। কারণ সামরিক কর্তারা ভালোই জানেন, জনগণের ঐক্যই সাবেক সামরিক একনায়ক হোসনি মোবারকের পতন ঘটিয়েছে। এবার বহু প্রত্যাশিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঠিক আগের দিন ক্ষমতাসীন সামরিক সুপ্রিম কাউন্সিল নবনির্বাচিত পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার মতো চরম হঠকারী ও উসকানিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। এটা মিসরের ইসলামপন্থী ও গণতন্ত্রকামী জনগণের মতো বহির্বিশ্বে দেশটির সচেতন শুভাকাক্সক্ষীদের কাছেও বজ্রাঘাততুল্য। অন্তর্বর্তী সময়ের শাসকদের পরিষদ এসসিএএফ সংসদ ভেঙে দেয়ার যত কারণ দেখাক্ না কেন এসবই কানাখোঁড়া অজুহাত মাত্র। তারা নিজেদের গোষ্ঠীগত ক্ষমতা সুসংসহত করে মোবারক আমলে মিসরকে ফিরিয়ে নিতেই এভাবে গণতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত করলো। পার্লামেন্ট নির্বাচনে ইসলামন্থীদের সংখ্যাধিক্য ওদের বিশেষ গাত্রদাহের কারণ। এর মধ্য দিয়ে আবার প্রমাণিত হয়েছে, তারা মোবারকের মানসসন্তান এবং সে জন্য তার আমলের মতো স্বৈরতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনই তাদের লক্ষ্য। পার্লামেন্ট বাতিলের মধ্য দিয়ে গণরায়ই নস্যাৎ হলো যা গণতন্ত্রের ভিত্তি। জাতির মতামতের ওপর যারা নিজের খামখেয়ালকে প্রাধান্য দেয় নির্দ্বিধায়, তাদের পক্ষেই দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক পার্লামেন্ট বাতিল করার মতো নির্লজ্জ হওয়া সম্ভব। একই সাথে প্রথম গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সংকোচনের ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন জেনারেলরা। ১৬ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হলো। ১৫ তারিখে সামরিক শাসকরা পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে ভবনের প্রবেশপথে সৈন্য মোতায়েন করে। তারা খোদ এমপিদের জন্য এই ভবন নিষিদ্ধ করার মতো অবিশ্বাস্য পদক্ষেপ নিলেন। তদুপরি জানিয়ে দেয়া হয়েছে, নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও দেশের আইন জারির নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকবে সামরিক চক্রের হাতে। কী অদ্ভুত দেশ আর উদ্ভট আদেশ! সাথে সাথে তীব্র প্রতিবাদ ওঠে রাজনীতির অঙ্গনে। স্বতঃস্ফূর্ত গণবিক্ষোভে আবার জেগে ওঠে ঐতিহাসিক তাহরির স্কোয়ার। বাদ জুমা জনতা সেখানে শ্লোগানে-বক্তৃতায় ধিক্কার দেয় শাসকদের। মিসরের সার্বিক তাহরির বা মুক্তির পথে পদে পদে কুচক্রীদের ষড়যন্ত্রের দেশপ্রেমিক জনগণ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। পার্লামেন্ট অবৈধ ঘোষণার অভূতপূর্ব রায়কে তারা সেনা অভ্যুত্থানই মনে করছে। মানবাধিকার কর্মীরাও বলছেন, এভাবে গণ-অভ্যুত্থানের পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছে। ৬টি দল এবং মানবাধিকার সংগ্রামীদের মুক্ত বক্তব্যে বলা হয়, ‘মোবারকের পতনের পর এ পর্যন্ত সামরিক পরিষদের পদক্ষেপগুলো থেকে মনে হয়, তারা এতদিন এই পাল্টা অভ্যুত্থানের পথ সুগম করেছেন। পুরনো আমলে দেশকে ফিরিয়ে নিতেই তারা তৎপর। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আয়োজন লোকদেখানো পার্লামেন্টের বৃহত্তম দল এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা, সম্প্রতি গঠিত ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি। এর নেতা মোহাম্মদ আল বেলতাগি বলেছেন, (প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত) শফিক আর সামরিক পরিষদ এই সেনা-অভ্যুত্থানই চেয়েছেন। কিন্তু এটা বদলাতে আমরা যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। প্রেসিডেন্ট পদে বিজয়ীপ্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি বলেন, ‘বোঝা যায়Ñ জনগণের আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে কেউ তৎপর।’ মোবারকের মদদগার যুক্তরাষ্ট্রও উপলব্ধি করছে, পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া এবং সামরিক কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বাড়ানোকে কিছুতেই জনগণ মেনে নেবে না। আর তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে মিসরে মার্কিন প্রভাব ফেলা সম্ভব নয়। তাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি বললেন, নির্বাচিতদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য। তাঁর ভাষায়, পেছনে ফেরার কোনো উপায় নেই।’ মিসরের নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য : ১) সাম্প্রতিক পার্লামেন্ট নির্বাচন দেশটির ইতিহাসের সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন। তেমনি ব্রাদারহুডের ড. মুরসি নির্বাচিত হলেন মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট। ২) বিশ্বের দীর্ঘতম মেয়াদের একজন স্বৈরশাসককে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত করে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের জন্য এ নির্বাচন। ৩) সমৃদ্ধ ইতিহাস, ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব, মহাদেশের সর্বাধিক জনসংখ্যা, আরবজগতে বিশেষ অবস্থান, প্রভৃতি কারণে মিসরে নির্বাচিত সরকারের সাফল্য মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্বে প্রভাব ফেলতে পারে। মিসরে নির্বাচন নিয়ে সঙ্কট : ক) পার্লামেন্ট নির্বাচনে ইসলামপন্থীরা সম্মিলিতভাবে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেলেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রধান দুই প্রার্থীর ভোটের পার্থক্য বেশি নয়; মাত্র ৪ শতাংশ। খ) প্রেসিডেন্ট পদে পরাজিত প্রার্থী আহমদ শফিক সে ব্যক্তি যিনি স্বৈরশাসক মোবারকের নিযুক্ত শেষ প্রধানমন্ত্রী। একনায়ক হোসনি মোবারক নিশ্চয়ই কোনো গণতন্ত্রী ব্যক্তিকে এমন উঁচু পদে দেখতে চাইতেন না। সেই বশংবদ শফিক প্রেসিডেন্ট হলে মোবারকের কালো যুগ অনেকাংশে প্রত্যাবর্তনের সন্দেহ তাই ভিত্তিহীন নয়। গ) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাত্র অর্ধেক ভোটার অংশ নিয়েছেন। হতাশা থেকে অনেকেই ভোটকেন্দ্রে যাননি। ঘ) নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের আমলেও আইন প্রণয়নের একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করার ঘোষণা দিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ পরিষদ (এসসিএএফ) এই নির্বাচন, তথা গণতন্ত্রকে মারাত্মকভাবে অপমান করেছে। যারা বেশরমের মতো ভেঙে দিতে পারে সম্পূর্ণ সুষ্ঠুভাবে নির্বাচিত পার্লামেন্ট, তারা যে আগামী দিনে প্রেসিডেন্টকে বিতাড়নের মওকা খুঁজবে না, তার গ্যারান্টি নেই। মিসর দেশ হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পিরামিড, নীলনদ আর সর্বাৎকৃষ্ট তুলার জন্য বিশ্বখ্যাত দেশটি আফ্রিকার সর্বাধিক জনবহুল। তেমনি গণতন্ত্রহীনতা তথা স্বৈরাচারী শাসনও মিসরে সর্বাধিক সময় অতিক্রম করেছিল। ১৯৫২ সালে রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়েছিল যে বিপ্লব তা গণতন্ত্র না এনে সামরিক শাসকদের স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছিল। পরপর তিন একনায়ক নাসের, সাদাত ও মোবারকের দুঃশাসনে গ্রাস করেছে মিসরীয় জাতির প্রায় ৬টি দশক। আফ্রো-এশিয়া সংযোগকারী মিসর সুপ্রাচীন সভ্যতার পাদপীঠ হলেও ক্ষমতাপাগল স্বৈরশাসকদের অবাধ স্বেচ্ছাচার মিসরে কায়েম করেছিল অসভ্যদের অমানবিক রাজত্ব। এই দুঃসহ পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার ও উন্নয়নসমেত সার্বিক মুক্তি নিশ্চিত করতেই জনগণ ২০১১ এর প্রথম দিকে মিসরে ফুটিয়েছিল আরব বসন্তের ফুল। কিন্তু তা সত্ত্বেও একের পর এক প্রতিবন্ধকের দৌরাত্ম্যে গণতন্ত্রে উত্তরণ আজও সম্ভব হয়নি। যখনই গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠার আশার আলো কিরণ ছড়াতে শুরু করে, তখনই অপশক্তির কালো মেঘ ঢেকে দেয় সূর্যকে। এই অবস্থায় আরব বসন্তের ফুলটি অনেকটা বিবর্ণ ও বিশুষ্ক হয়ে পড়েছে। এখনো গণতন্ত্র বৃক্ষের যথার্থ পরিচর্যা ও নিরাপত্তা দ্বারা ফুলটিকে সতেজ ও সজীব করা যায়। কিন্তু মোবারকের উত্তরসূরিরা (বাম ও সেক্যুলারদের মদদে) সে সুযোগ জাতিকে দেবে কি না, তা এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির