post

মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে শিক্ষা ব্যর্থ কেন?

ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম

০৪ মে ২০১৬
পর্ব-৪ পৃথিবীর আদি পিতা হযরত আদম (আ) আল্লাহপাকের প্রদত্ত জ্ঞানের মাধ্যমেই ফেরেশতাকুলের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করেন। উপস্থিত ফেরেশতাকুল জ্ঞানরাজ্যে আদম (আ)-এর অভূতপূর্ব সাফল্য লক্ষ্য করে তাকে শিক্ষক হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হন এবং আল্লাহর হুকুমে তাঁর নিকট চরম সম্মান প্রদর্শন করেন। একমাত্র শিক্ষার কারণেই আদম (আ) সকলের শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র হিসেবে বিবেচিত হন। তার ফলশ্রুতিতে আজ মানুষই সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে পরিগণিত ও স্বীকৃত। সেখান থেকেই শুরু হয় ‘নলেজ ইজ পাওয়ার’ জ্ঞানই শক্তি। এই শক্তির কাছে দুনিয়ার সব শক্তি তুচ্ছ। এই শক্তিই আলোর পথ দেখায়। এ জন্য চোখ না থাকলে তাকে অন্ধ বলা যাবে না। যদি তার জ্ঞানের চোখ প্রসন্ন থাকে। প্রকৃত অন্ধ সে যার জ্ঞানের আলো নেই। শিক্ষা মূল্যায়নের মানদন্ড, টিকে থাকা না থাকার মাপকাঠি। এগিয়ে যাওয়ার দুরন্ত সাহস। যে ব্যক্তি এবং জাতির মধ্যে এই শিক্ষার শক্তি যত সঞ্চারিত হবে সে তত বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। ‘‘Education’ শব্দটির মধ্যে সেই প্রত্যয় ফুটে উঠেছে। ‘Education’’ প্রত্যয়টির উদ্ভব ঘটেছে ল্যাটিন শব্দ ‌‌Educere’ থেকে, ইংরেজিতে এর ভাবার্থ হচ্ছে to lead out’ ev বা draw out। শিক্ষার আরবি প্রতিশব্দ ইলম বা জ্ঞান। আবার কেউ কেউ বলেছেন, ইংরেজি ‘Education’’ শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘‘Educere’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে যার ভাবার্থ হলো to bring up’ অথবা to train’ অথবা to mould’ অর্থাৎ ‘শিক্ষা’ বলতে বোঝায় শিক্ষার্থীকে ‘লালন করা’ অথবা ‘প্রশিক্ষণ দেয়া’ অথবা ‘কোন কিছুর আদলে তৈরি করা।’ শিক্ষা এমন একটি ধারবিহীন অস্ত্র যা দিয়ে চিন্তা জগতের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়ে থাকে। সৃষ্টির সূচনা হতেই শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়ে আসছে। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রথম বাণীটিই ছিল- “ইকরা বিইসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক।” “পড় তোমার রবের নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন”, পড় দিয়েই শুরু হয়েছে সর্বকালের সেরা মানুষ আমাদের প্রিয় নবী মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ সা:-এর মিশনের যাত্রা। আল্লাহ তায়ালা আদম থেকে শুরু করে সকল নবী এবং রাসূলকে শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত করেই তাদের পরিচয় তুলে ধরেছেন। মহানবী (সা) বলেছেন, ‘মানুষের প্রতি আল্লাহর শ্রেষ্ঠ দান হল উত্তম আখলাক।’ যার চরিত্র ভালো, ব্যবহার সুন্দর সে সবার প্রিয়। নবী করীম (সা) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় যার চরিত্র বা আখলাক সর্বোৎকৃষ্ট।’ আল্লাহ বলেন : ‘হে নবী! আপনাকে আমি এমন সব জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছি যা আপনিও জানতেন না এবং আপনার পূর্বপুরুষও জানতো না।’ (৬:৯২) আল্লাহপ্রদত্ত জ্ঞানদক্ষতায় রাসূল সা: এতই পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন যে, শিক্ষা সম্প্রসারণে বিশ্বমানবতার মহান শিক্ষকরূপে তার আবির্ভাব হয়েছিল। সে জন্য রাসূল সা: নিজেও এ পৃথিবীতে রাষ্ট্রপ্রধান, সেনাপতি কোন নামেই নিজের পরিচয় তুলে ধরেননি। বরং তিনি নিজেকে শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতে এভাবে গর্ববোধ করেছেন। রাসূল সা: বলেন : ‘বুয়িস্তু মোয়াল্লিমান’ ‘আমি মানবতার জন্য শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি।’ আল্লাহ্পাক রাসূলে করীম সা:-এর পরিচয় দেন এভাবে : “তিনি (আল্লাহ্) যিনি নিরক্ষর লোকদের মধ্য হতে তাদেরই একজনকে নবী হিসেবে উন্নীত করেছেন, যিনি (নবী সা:) তাদের কাছে আবৃত্তি বা পাঠ করেন তার (আল্লাহ) নিদর্শনসমূহ, তাদের পূত-পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও জ্ঞান; যদিও তারা পূর্বে মিথ্যা বিশ্বাসের অনুসারী ছিল।” (৬২:২) হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন উম্মি। মানবরচিত কিতাব বা গ্রন্থজ্ঞান তিনি আহরণ করেননি। মানবরচিত গ্রন্থের শিক্ষা অর্জন না করার ফলে তিনি কোনো লেখক বা গ্রন্থকারের মতবাদ দ্বারা পক্ষপাতদুষ্ট হওয়া থেকে ছিলেন পাক ও পবিত্র। কারণ সমগ্র বিশ্বের তথা বিশ্বমানবজাতির যিনি শিক্ষক, তিনি কী করে কোন মানুষবিশেষের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন? তাহলে বিশ্বকে সার্বজনীন শিক্ষা দেবে কে? আর এ কারণেই আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় রাসূল সা:- এর শিক্ষার ভার নিজেই গ্রহণ করেছেন। রাসূল সা: শিক্ষকসুলভ আচরণের মাধ্যমে আরবদের মাঝে লুক্কায়িত সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার কর্মসূচিতে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি মানবকুলের শ্রেষ্ঠসম্পদ হিসেবে জ্ঞানকেই আখ্যায়িত করলেন। আল্লাহ্ বলেন : “কুল, রাব্বি জ্বিদ্নি ইলমা”- ‘‘বল, হে রব আমার, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি কর।” কিন্তু আজকের সমাজের বাস্তব অবস্থা এই যে, মানুষের জ্ঞানগত পরিধি যতই বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার সমস্যা ততই জটিল হতে জটিলতর হয়ে যাচ্ছে। মানুষ বস্তুগত অগ্রগতি যত বেশি লাভ করছে, নিত্যনতুন কামনা-বাসনা, নতুন নতুন সমস্যা ও জটিলতা এবং নানারূপ নৈরাশ্য ও বঞ্চনার হাহাকার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। অধুনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতি ধ্বংস ও বিনাশের এমন সব হাতিয়ার উদ্ভাবনের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে, যার দরুন মানবতার অস্তিত্বই কঠিন হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। এ জন্য একজন দার্শনিকের অভিব্যক্তি ছিল এমন-our knowledge binges us near to ignorance. Our ignorance binges us near to death. এক দিকে মানুষ মানবীয় সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি বিধানের চেষ্টায় নিয়োজিত, অপর দিকে সে অত্যন্ত তীব্র গতিতে ভিত্তিহীন নাস্তিকতার ধারণা-বিশ্বাস ও কুসংস্কারের সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে। ফলে মানুষ এক স্থায়ী অশান্তি, দুঃখবোধ ও মানসিক যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে। মানুষ যত তীব্রতা ও আন্তরিকতার সাথে বিশ্ব-প্রকৃতিকে জয় করতে শুরু করেছে, তা আমাদেরকে প্রায় ততটাই ভুলিয়েই দিয়েছে যে, আসলে আমরা কেবল দৈহিক কামনা-বাসনারই অধিকারী নই, ‘আত্মা’ বলতেও একটি জিনিস আমাদের রয়েছে। দেহের জীবন এবং ক্রমবৃদ্ধির জন্য যেমন খাদ্য অপরিহার্য, মনের পরিশুদ্ধি ও পরিচ্ছন্নতা বিধানের জন্য যেমন প্রয়োজন শিক্ষার, তেমনি আত্মার উন্নতি সাধনের জন্য দরকার ঈমানের আর ঈমান হচ্ছে কতকগুলো মৌল সত্যের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত প্রত্যয়, যে প্রত্যয় শত প্রতিকূল ঝঞ্ছাবাত্যার আঘাতেও বিন্দুমাত্র নষ্ট বা দুর্বল হবে না। এবার খুঁজে দেখা যাক আমাদের দেহে আসল মানুষটি কে? অথবা কি? কোন উপাদান তাকে শ্রেষ্ঠত্বের আসন দিয়েছে? তারই বা মূল্য কত? আর এই মূল্য থেকেই কি তার এত মর্যাদা? সম্ভবত বর্তমান যুগে এই প্রশ্নগুলো আমাদের কাছে আর বিস্ময়কর বলে মনে হবে না। কারণ আজকের বিজ্ঞান আমাদের জানার পরিধিকে করেছে অনেক বিস্তৃৃত। প্রশ্নটি যদি কোনো শারীরতত্ত্ববিদ বা কোনো জীববিজ্ঞানীকে করা হয়, তাহলে তিনি হয়তো মানুষের দেহের গঠন, উপাদান, যে যে খনিজ-লবণ, ভিটামিন ইত্যাদি বস্তু দ্বারা গঠিত, তাদের পরিমাণ ও দাম হিসেব করে মানবদেহটির দাম হিসেব করবেন। বিখ্যাত চিকিৎসক ও দেহতত্ত্ববিদ মি. বিএ হাভার্ড জীবন-রহস্য উদঘাটনের মানসে একজন মানুষকে নিয়ে গভীর গবেষণার পর মতপ্রকাশ করেন- এতে দশ গ্যালন পানি, সাবানের সাতটি গোল্লা তৈরি করা যেতে পারে সেই পরিমাণ চর্বি, নয় হাজার পেন্সিল তৈরি করা যেতে পারে সেই পরিমাণ কার্বন, দিয়াশলাইয়ের দুই শতটি কাঠি তৈরি করা যেতে সেই পরিমাণ লোহা, মুরগির একটি ঘর লেপে দেয়া যেতে পারে সেই পরিমাণ চুন এবং সামান্য পরিমাণ গন্ধক ও ম্যাগনেশিয়াম রয়েছে। মানুষের চোখ, কিডনি এবং আরো অনেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করার রেওয়াজও বহুদিন থেকে প্রচলিত হয়ে আসছে। সেই হিসেবেও মানুষের একটি গড়মূল্য হিসাব করা সম্ভব। হয়তো এমন এক সময় আসবে যখন মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য বিশেষ বিশেষ পাইকারি আড়ত ও সুপারমার্কেট থাকবে। একজন চিকিৎসাবিদ এভাবেই মানুষের মূল্য নির্ধারণ করবেন। এখন বাজারে মানুষ বিক্রি হয়। নারী, শিশু, পুরুষ সব বয়সের, সব পেশার মানুষ বিক্রি হয়। ক্ষুধার জ্বালায় মা তার সন্তানকে ৫০ টাকায় বিক্রি করার ঘটনাও আমাদের সমাজে সংঘটিত হয়েছে। প্রশ্নটিকে যদি কোনো ভাড়াটে সন্ত্রাসীকে করা হয়, তাহলে সেও তার উপায়ে মানুষের দাম হিসেব করবে। সে ক্ষেত্রে সে হয়তো কারো জন্য দশ লক্ষ, কারো জন্য পাঁচ লক্ষ, কারো জন্য এক লক্ষ, কারো জন্য পঞ্চাশ হাজার- এভাবে মূল্য নির্ধারণ করবে। ইদানীং এও শোনা যায় যে, মাত্র দুই হাজার টাকার ঝামেলায় কিংবা দুইশত টাকার চাঁদা দিতে না পারায় কাউকে হত্যা করা হয়েছে। একজন অর্থনীতিবিদ যদি মানুষের মূল্য হিসাব করেন, তাহলে হয়তো তিনি এভাবেও ভাবতে পারেন যে, একজন মানুষ যোগ্যতাকে যদি ৫০-৬০ বছর ধরে প্রয়োগ করতে থাকে, তাহলে সেই যোগ্যতা অর্থনীতিতে কী পরিমাণvalue create  করে বা মূল্য সৃষ্টি করে, তার একটি গড় হিসাব। তা ছাড়া অন্যভাবেও হিসাব করা যেতে পারে। একজন মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার অস্তিত্বের প্রয়োজনে পৃথিবীর সম্পত্তি থেকে কতখানি ভোগ করে থাকে, তার গড় হিসাব। সে সারাজীবন wealth creation-এ কিভাবে অংশগ্রহণ করে, তার সঙ্গে তিনি তাকেও হয়তো হিসাবে আনবেন। কিন্তু এভাবে কি মানুষের মূল্য হিসাব করা সম্ভব?। এ ক্ষেত্রে অবশ্য মানুষ মানে যদি শুধু দেহটি হয়, তাহলে তখনই সে তার দেহ, মন, শক্তি, ইচ্ছা ও যোগ্যতার মানে মানুষের মূল্যের হিসাব দাঁড় করাতে পারেন। অথচ রাসূলে করীম (সা) বলেছেন, “আল্লাহ তোমাদের চেহারা এবং ধন সম্পদের প্রতি তাকাবেন না। বরং নজর দেবেন তোমাদের অন্তর ও কর্মের প্রতি।” তাহলে এর থেকে বুঝা যায় দেহ দিয়ে মানুষের মূল্যের হিসাব করা কঠিন। কারণ এ পৃথিবীতে সকল মানুষই দেহ নামক অবয়বটিকে যতটুকু মূল্য দেন তা হচ্ছে তার ভেতরের অংশ তথা আত্মার বা রূহের মূল্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, মানুষের মৃত্যুর পর কোন আপনজনই তার মৃতদেহটিকে বেশি সময় রাখতে রাজি হয় না। কারণ সবাই মনে করে আসল মানুষটি আর তার সাথে নেই। এতে তা যতই কষ্টকর হোক না কেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য মানুষ মানে যদি শুধু দেহটি হতো, তাহলে মানুষকে যতটা মূল্যহীন বা ছোট বলে আমরা মনে করেছি, ইবলিস কিন্তু তা করেনি। আল্লাহ মানবসৃষ্টির আগেই তাকে অত্যন্ত মূল্যবান করে প্রচার করেছিলেন, যার কারণে সৃষ্টির আগে তিনি যাবতীয় সৃষ্টিকুলের কাছে তার মূল্যকে তুলে ধরেছিলেন এবং যাবতীয় সৃষ্টিকুলকে মানুষের সামনে মাথা নত করতে বলেছিলেন। তিনি মানুষকে এতটা মূল্য দিচ্ছেন দেখে ইবলিসও বুঝে ফেলল মানুষ কতটা মূল্যবান। আর তখনই সে তার দেহ-মনের সমস্ত শক্তি, ইচ্ছা, যোগ্যতা সব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মানুষের অকল্যাণ ঘটানোর জন্য। এবার দেখা যাক, যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তিনি মানুষের মূল্যের ব্যাপারে কী বলেছেন? তিনি পবিত্র কুরআনে বলেছেনÑ “আমি কি তোমাদেরকে নিকৃষ্ট তরল থেকে সৃষ্টি করিনি? আমি কি মানুষকে পচা, গলা, কাদা, টনটনে মাটি থেকে সৃষ্টি করিনি?” (সূরা ইয়াসিন : ৭৭)। “মানুষ কি দেখে না, আমি তাকে শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছি? অথচ পরে সে প্রকাশ্যে তর্ক করে!” “আমি তো মানুষ সৃষ্টি করেছি, গন্ধযুক্ত শুকনো মাটি থেকে।” (সূরা হিজর : ২৬)। “তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন শুক্র থেকে, অথচ মানুষ প্রকাশ্যে ঝগড়াকারী হয়ে গেছে।” (সূরা নাহল : ৪) এবার আসা যাক যোগ্যতা এবং বৈশিষ্ট্যের মাপে মানুষ। মানুষ মানে যদি হয় তার যোগ্যতা, উদ্দেশ্য, গুণ, বৈশিষ্ট্য- তাহলে তার মূল্য কত? মানুষ মানে যদি হয় ব্যক্তিত্বটি, যোগ্যতাটি হয় (শুধু দেহটি নয়) তাহলে তার মূল্য নিশ্চয়ই আর একটু বেশি হবে। এখন তাহলে আমরা আর একটি প্রশ্নের উত্তর পেলাম, মানুষ মানে যদি হয় একটি ব্যক্তিত্ব বা মনুষ্যত্ব, তাহলে তার মূল্য কত? তাহলে মানুষের মূল্য কত? এই প্রশ্নের কোনো একক জবাব সম্ভব নয়। কারণ মানুষের বাজারমূল্য যা, তার উৎপাদনমূল্য বা ম্যানুফ্যাকচারিং কস্ট তা নাও হতে পারে। আসলে মানুষ নিজেকে কিভাবে চিহ্নিত করল তা দ্বারাই নির্ধারিত হয়ে গেল তার মূল্য কত। তাহলে আমরা পাচ্ছি ঠিক বিপরীত ধরনের কিছু মানুষ একেবারেই নিকৃষ্ট, মূল্যহীন পশুর মতো, কিংবা পশুর চেয়েও অধম; আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সে অত্যন্ত মূলবান। যাবতীয় সৃষ্টিকুলের চেয়েও তার মূল্য অনেক বেশি, যার কারণে যাবতীয় সৃষ্টিকুলের ওপর এটি বাধ্যতামূলক হয়ে গেল যে তারা যেন মানুষকে সিজদা করে। ইমাম তাবারানী ও ইমাম বায়হাকি (রহ) তাঁদের শু’আবুল ইমান অধ্যায়ে এবং আল্লামা খতিব বাগদাদী (রহ) স্বীয় তারিখ গ্রন্থে আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) এর বরাতে বর্ণনা করেছেন যে, নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নিকট মানবজাতি অপেক্ষা অন্য কোন সৃষ্টিই অধিক সম্মানের হবে না। প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ তা’য়ালার নিকটবর্তী ফেরেশতাগণের ক্ষেত্রে কি এটা প্রযোজ্য হবে? অর্থাৎ নিকটবর্তী ফেরেশতাদের চেয়েও কি মানুষের মর্যাদা বেশি? এর জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, নিকটবর্তী ফেরেশতাগণও (এক শ্রেণীর) মানুষের চেয়ে অধিক মর্যাদাবান হবে না। কেননা ফেরেশতাদের অবস্থান সূর্য ও চন্দ্রের মত। অর্থাৎ সূর্য ও চন্দ্র যেমন সর্বদা আল্লাহ তা’য়ালার হুকুম পালনে ব্যস্ত, তেমনি ফেরেশতাগণও আল্লাহর নির্দেশের সম্মুখে আত্মসমর্পিত। তাঁদের নিজস্ব কোন স্বাধীনতা নেই।” এই আপাত আত্মবিরোধ থেকে আমরা আর একটি প্রশ্ন আবিষ্কার করি, মানুষের মূল্য কত? মানুষ মানে শুধু দেহটি নয়; শুধু দেহের বিচারে- মানুষ না, না শুধু প্রাত্যহিক কাজ কর্মের বিচারে। তাই মানুষ, একজন নবীও যেমন হতে পারে, আবার একজন অবিশ্বাসীও। কোন জিনিস তার মূল্যের এত ব্যবধান সৃষ্টি করে? আল্লাহ বলছেন : ‘‘বলুন, আমি তো তোমাদের মতোই একজন মানুষ। আমার প্রতি ওহি প্রেরিত হয় যে, তোমাদের মা’বুদ তো একই মা’বুদ। অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার রবের সাক্ষাৎ লাভের আশা রাখে সে, যেন ভালো কাজ করে এবং তার রবের ইবাদতে অন্য কারো শরিক না করে।” (সূরা কাহাফ : ১১০) ইমাম আহমদ (রহ) বর্ণনা করেন যে, হযরত আনাস (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা পৃথিবী সৃষ্টি করার পর তা দুলতে শুরু করে। তাই তিনি পর্বতমালা সৃষ্টি করে তার উপর তা স্থাপন করেন। তাতে পৃথিবী স্থির হয়ে যায়। পর্বতমালা দেখে ফেরেশতাগণ অবাক হয়ে বললেন, হে আমাদের প্রতিপালক। আপনার সৃষ্টির মধ্যে পর্বত থেকে মজবুত আর কিছু আছে কি? আল্লাহ বললেন, হ্যাঁ, লোহা। ফেরেশতাগণ বললেন, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার সৃষ্টির মধ্যে লোহা থেকে মজবুত আর কিছু আছে কি? আল্লাহ বললেন, হ্যাঁ, আগুন। ফেরেশতাগণ বললেন, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার সৃষ্টির মধ্যে আগুনের চাইতে অধিকতর শক্তিশালী আর কিছু আছে কি? আল্লাহ বললেন, হ্যাঁ, বাতাস। ফেরেশতাগণ বললেন, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার সৃষ্টির মধ্যে বাতাসের চাইতে অধিকতর শক্তিশালী কিছু আছে কি? আল্লাহ বললেন, হ্যাঁ, আদম সন্তান, যে ডান হাতে দান করে আর বাম হাত থেকে তা গোপন রাখে।’ এ থেকেও কি বোঝা যায় না যে তার ক্ষেত্রে দেহবৃত্তি ছাড়াও অন্য সম্বন্ধে তাদের ধারণাটা খুব বেশি বড় ছিল না, যার কারণে অর্থ-সম্পদ, অহঙ্কার, ক্ষমতা এগুলোর মাধ্যমে তারা তাদের নিজেদেরকে বড় করে দেখার প্রয়াস পেত। কিন্তু ভেতরে তাদের এই বোধ বদ্ধমূল ছিল যে, মানুষ নেহাত রক্ত মাংসে গড়া এক জাতীয় জীব। মানুষের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব মহান আল্লাহ তা’য়ালার অগণিত সৃষ্টির মধ্যে মানুষের মর্যাদা সর্বাধিক। এ জন্য মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ‘সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ’- এই বক্তব্যের দ্বারা মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কুরআনের বাণী : ‘তিনি সে মহান সত্তা যিনি মানবজাতির কল্যাণে পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন।’ বস্তুত মহান আল্লাহর সমগ্র সৃষ্টিই মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত রয়েছে। মহানবী (সা) বিদায় হজের ভাষণে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে বলেন :‘তোমাদের এই পবিত্র শহরে এই পবিত্র মাসে আজকের এই দিনটি যেমন পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ তেমনি তোমাদের পরস্পরের রক্ত, তোমাদের পরস্পরের ধন-সম্পদ এবং পরস্পরের মান-সম্মানও পবিত্র এবং মর্যাদাপূর্ণ।’ মানুষের ধন-সম্পদ, রক্ত ও মান-সম্মানের নিশ্চয়তা দিয়ে বিদায় হজের ভাষণে তিনি যে ঘোষণা করেছেন, বস্তুত মানবজাতি ছাড়া কোন সৃষ্টি সম্পর্কে এরকম কথা বলা হয়নি। নিরপরাধ কোন মানুষকে হত্যা করা সকল মানুষকে হত্যা করার সমতুল্য। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘যে ব্যক্তি হত্যা বা সন্ত্রাস ব্যতীত কোন নিরপরাধ লোককে হত্যা করে, সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি এমন নিরপরাধ মানুষকে বাঁচাল সে যেন সকল মানুষকে বাঁচাল।’ অর্থাৎ একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যার অর্থ পৃথিবীর সকল মানুষকে হত্যার সমান অপরাধ করল। একইভাবে কোন নিরপরাধ মানুষ মৃত্যুর সম্মুখীন হলে (জালিম অত্যাচারীর হাতে পড়লে) তাকে রক্ষা করলে সে পৃথিবীর সকল মানুষকে রক্ষা করার সমান পুণ্য অর্জন করল। এর দ্বারা একজন মানুষের মর্যাদা তার জীবন ও সম্মানের প্রতি ইসলাম কতটুকু গুরুত্ব প্রদান করেছে, তা সহজেই অনুমেয়। পৃথিবীর অন্য কোন ধর্ম বা আইনে এত বড় নিশ্চয়তা দিয়েছে বলে নজির নেই। কিন্তু এত বড় মর্যাদা মানুষের দেহকে কেন্দ্র করে নয়। বরং ভেতরের মূল্যবান রতœটিই উদ্দেশ্য। আর সেই অমূল্য ধনটির নামই আত্মা। আর শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য অমূল্য ধনরতœ আত্মার বিকাশ সাধন করা।    (চলবে) লেখক : সহকারী সম্পাদক, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির