post

যুগে যুগে মনীষীদের দৃষ্টিতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.

২৮ ডিসেম্বর ২০১৫
ছাত্র সংবাদ ডেস্ক যুগে যুগে মুহাম্মদ সা. এবং তাঁর আদর্শকে স্বীকতি দিয়েছেন এমন অনেক খাতিমান যারা ইসলাম বা তাঁর আনীত ধর্মের অনুসারী ছিলেন না। ইসলাম ও ইসলামের নবী মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে এখানে বিভিন্ন মনীষীর কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো : Sir George Bernard Shaw in ‘The Genuine Islam,’ Vol. 1, No. 8, 1936. মুহাম্মদের ধর্মের প্রতি আমি সবসময় সুউচ্চ ধারণা পোষণ করি, কারণ এর চমৎকার প্রাণবন্ততা। আমার কাছে মনে হয় এটাই একমাত্র ধর্ম যেটা সদা পরিবর্তনশীল জীবনযাত্রার সাথে অঙ্গীভূত হওয়ার ক্ষমতা রাখে যা প্রত্যেক যুগেই মানুষের হৃদয়ে আবেদন রাখতে সক্ষম। আমি তাঁর (মুহাম্মদ) সম্বন্ধে পড়াশোনা করেছি- চমৎকার একজন মানুষ এবং আমার মতে খ্রিস্টবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে অবশ্যই মানবতার ত্রাণকর্তা বলতে হবে। আমি বিশ্বাস করি তাঁর মতো ব্যক্তির নিকট যদি আধুনিক বিশ্বের একনায়কতন্ত্র অর্পণ করা হতো তবে এর সমস্যাগুলো তিনি এমনভাবে সফলতার সাথে সমাধান করতেন যা বহু প্রতীক্ষিত শান্তি ও সুখ আনয়ন করতো। আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি যে মুহাম্মদের ধর্মবিশ্বাস আগামীদিনের ইউরোপের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, যা ইতোমধ্যে বর্তমান ইউরোপে গ্রহণযোগ্যতা পেতে আরম্ভ করেছে। Thomas Carlyle in ‘Heroes and Hero Worship and the Heroic in History,’ 1840 এ লোকটিকে (মুহাম্মদ) ঘিরে যে মিথ্যাগুলো (পশ্চিমা অপবাদ) পুঞ্জীভূত হয়ে আছে- যার ভালো অর্থ হতে পারে ধর্মান্ধতা, তা আমাদের নিজেদের জন্যই লজ্জাজনক। Mahatma Gandhi, statement published in ‘Young India,’1924. আমি জীবনগুলোর মধ্যে সেরা একজনের জীবন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম যিনি আজ লক্ষ কোটি মানুষের হৃদয়ে অবিতর্কিতভাবে স্থান নিয়ে আছেন, যেকোন সময়ের চেয়ে আমি বেশি নিশ্চিত যে ইসলাম তরবারির মাধ্যমে সেইসব দিনগুলোতে মানুষের জীবন-ধারণ পদ্ধতিতে স্থান করে নেয়নি। ইসলামের প্রসারের কারণ হিসেবে কাজ করেছে নবীর দৃঢ় সরলতা, নিজেকে মূল্যহীন প্রতিভাত করা, ভবিষ্যতের ব্যাপারে সতর্ক ভাবনা, বন্ধু ও অনুসারীদের জন্য নিজেকে চরমভাবে উৎসর্গ করা, তাঁর অটল সাহস, ভয়হীনতা, ঈশ্বর এবং তাঁর (নবীর) ওপর অর্পিত দায়িত্বে অসীম বিশ্বাস। এ সব-ই মুসলমানদেরকে সকল বাধা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। যখন আমি মুহাম্মদের জীবনীর ২য় খন্ড বন্ধ করলাম তখন আমি খুব দুঃখিত ছিলাম যে এই মহান মানুষটি সম্পর্কে আমার পড়ার আর কিছু বাকি থাকলো না। Dr. William Draper in ‘History of Intellectual Development of Europe.’ জাস্টিনিয়ানের মৃত্যুর চার বছর পর, ৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে আরবে একজন মানুষ জন্মগ্রহণ করেন যিনি সকলের চাইতে মানবজাতির ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। অনেক সাম্রাজ্যের ধর্মীয় প্রধান হওয়া, মানবজাতির এক-তৃতীয়াংশের প্রাত্যহিক জীবনের পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করা- এসবকিছুই সৃষ্টিকর্তার দূত হিসেবে তাঁর উপাধির যথার্থতা প্রমাণ করে। Alphonse de LaMartaine in ‘Historie de la Turquie,’ Paris, 1854. উদ্দেশ্যের মহত্ত্ব, লক্ষ্য অর্জনের উপায়সমূহের ক্ষুদ্রতা এবং আশ্চর্যজনক ফলাফল যদি অসাধারণ মানুষের তিনটি বৈশিষ্ট্য হয় তবে কে মুহাম্মদের সাথে ইতিহাসের অন্য কোন মহামানবের তুলনা করতে সাহস করবে? বেশির ভাগ বিখ্যাত ব্যক্তি শুধুমাত্র সেনাবাহিনী, আইন এবং সাম্রাজ্য তৈরি করেছেন। তাঁরা যদি কিছু প্রতিষ্ঠা করে থাকেন সেটা কিছুতেই জাগতিক ক্ষমতার চাইতে বেশি কিছু নয় যা প্রায়ই তাদের চোখের সামনে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই মানুষটি শুধুমাত্র সেনাবাহিনী, আইন, সাম্রাজ্য, শাসক, লোকবলই পরিচালনা করেননি সেইসাথে তৎকালীন বিশ্বের লক্ষ-লক্ষ মানুষের জীবনকে আন্দোলিত করেছিলেন; সবচেয়ে বড় কথা হলো তিনি দেব-দেবী, ধর্মসমূহ, ধারণাগুলো, বিশ্বাসসমূহ এবং আত্মাগুলোকে আন্দোলিত করেছিলেন। দার্শনিক, বাগ্মী, বার্তাবাহক, আইনপ্রণেতা, নতুন ধারণার উদ্ভাবনকারী/ধারণাকে বাস্তবে রূপদানকারী, বাস্তব বিশ্বাসের পুনরুদ্ধারকারী...বিশটি জাগতিক এবং একটি আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা-এই হলো মুহাম্মদ। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব পরিমাপের যত মাপকাঠি আছে তার ভিত্তিতে বিবেচনা করলে আমরা নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে পারি- মুহাম্মদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কেউ আছে কি? Michael H. Hart in ‘The 100, A Ranking of the Most Influential Persons In History,’ New York, 1978. মুহাম্মদকে সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় শীর্ষস্থান দেয়াটা অনেক পাঠককে আশ্চর্যান্বিত করতে পারে এবং অন্যদের মনে প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে, কিন্তু ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সেকুলার এবং ধর্মীয় উভয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ পরিমাণ সফল ছিলেন। সম্ভবত ইসলামের ওপর মুহাম্মদের তুলনামূলক প্রভাব খ্রিস্টান ধর্মের ওপর যিশু ও সেইন্ট পলের সম্মিলিত প্রভাবের চেয়ে বেশি।... আমি মনে করি, ধর্মীয় ও সেকুলার উভয়ক্ষেত্রে প্রভাবের এই বিরল সমন্বয় যোগ্য ব্যক্তি হিসেবেই মুহাম্মদকে মানবেতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী একক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত করেছে। W. Montgomery Watt in ‘Muhammad at Mecca,’ Oxford, 1953. নিজ আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সকল প্রকার কষ্ট সহ্য করা, তাঁকে যারা বিশ্বাস করতো এবং নেতা হিসেবে অনুসরণ করতো তাদের সুউচ্চ চারিত্রিক গুণাবলি, এবং মুহাম্মদের অর্জনের বিশালত্ব- এ সবকিছুই তাঁর সততার সাক্ষ্য দেয়। মনে করুন মুহাম্মদ একজন অসাধু ব্যক্তি যিনি সমাধানের চেয়ে সমস্যাই বেশি সৃষ্টি করেছেন। অধিকন্তু, আর কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বই মুহাম্মদের মতো পাশ্চাত্যে এতবেশি অবমূল্যায়িত হয়নি শুধুমাত্র যা বর্ণিত হয়েছে তার ভিত্তিতে নয়, আমরা যদি মুহাম্মদকে সামান্য পরিমাণও বুঝতে চাই তবে অবশ্যই প্রয়োজনীয় সততা ও ন্যায়পরায়ণতা সহকারে তাঁকে বিচার করতে হবে। আমরা যদি আমাদের অতীত থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ভুলগুলো সংশোধন করতে চাই তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে চূড়ান্ত প্রমাণ আপাতদৃষ্টিতে যা সত্য বলে প্রতীয়মান হয় তারচেয়ে অনেক কঠিন শর্ত এবং এই ব্যাপারে প্রমাণ অর্জন সত্যিই দুঃসাধ্য হবে। D. G. Hogarth in ‘Arabia’ গুরুত্বপূর্ণ অথবা তুচ্ছ, তাঁর দৈনন্দিন প্রতিটি আচার-আচরণ একটি অনুশাসনের সৃষ্টি করেছে যা লক্ষ-কোটি মানুষ বর্তমানকালেও সচেতনতার সাথে মেনে চলে। মানবজাতির কোন অংশ কর্তৃক আদর্শ বলে বিবেচিত আর কোন মানুষকেই মুহাম্মদের মতো এতো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করা হয়নি। খ্রিস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতার আচার-আচরণ তাঁর অনুসারীদের জীবন-যাপনকে নিয়ন্ত্রণ করেনি। অধিকন্তু, কোন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতাই মুসলমানদের নবীর মতো এরকম অনুপম বৈশিষ্ট্য রেখে যায়নি। Gibbon in ‘The Decline and Fall of the Roman Empire’ 1823. মুহাম্মদের মহত্তের ধারণা আড়ম্বড়পূর্ণ রাজকীয়তার ধারণাকে অস্বীকার করেছে। স্রষ্টার বার্তাবাহক পারিবারিক গৃহকর্মে নিবেদিত ছিলেন; তিনি আগুন জ্বালাতেন; ঘর ঝাড়ু দিতেন; ভেড়ার দুধ দোয়াতেন; এবং নিজ হাতে নিজের জুতা ও পোশাক মেরামত করতেন। পাপের প্রায়শ্চিত্তের ধারণা ও বৈরাগ্যবাদকে তিনি অস্বীকার করেছেন। তাঁকে কখনো অযথা দম্ভ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি, একজন আরবের সাধারণ খাদ্যই ছিলো তাঁর আহার্য। Lane-Poole in ‘Speeches and Table Talk of the Prophet Muhammad.’ তিনি যাদেরকে আশ্রয় দিতেন তাদের জন্য ছিলেন সবচেয়ে বিশ্বস্ত রক্ষাকারী, কথাবার্তায় ছিলেন অত্যন্ত মিষ্টভাষী ও নম্র। তাঁকে যারা দেখত তারা শ্রদ্ধায় পূর্ণ হতো; যারাই তাঁর কাছে এসেছিল তাঁকে ভালোবেসেছিল; যারা তাঁর সম্বন্ধে বর্ণনা দিত তারা বলতো, “তাঁর মতো মানুষ আগে বা পরে আমি কখনো দেখিনি।” তিনি ছিলেন অতি স্বল্পভাষী, কিন্তু যখন তিনি কথা বলতেন জোরের সাথে এবং সুচিন্তিতভাবে কথা বলতেন। এবং তিনি যা বলতেন তা কেউ ভুলতে পারতো না। Edward Gibbon and Simon Oakley in ‘History of the Saracen Empire,’ London, 1870 প্রচার নয় মুহাম্মদের ধর্মের স্থায়িত্বই আমাদেরকে আশ্চর্যান্বিত করে। অকৃত্রিম এবং পূর্ণাঙ্গ সম্মোহনকারী শক্তি যেটা তিনি মক্কা এবং মদিনায় অর্জন করেছিলেন সেটা বারশত বছর পরও একই আছে কুরআনের মাধ্যমে ধর্মান্তরিত তাঁর ভারতীয়, আফ্রিকান ও তুর্কি অনুসারীদের মধ্যে। প্রলুব্ধ বা আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানরা তাদের মূল বিশ্বাস ক্ষয়প্রাপ্ত হতে দেয়নি। “আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর দূত”-এটাই হলো ইসলামের সহজ এবং অপরিবর্তনীয় বিশ্বাস। বুদ্ধিবৃত্তিক ঈশ্বরের চেতনা কোন দৃশ্যমান মূর্তি দ্বারা হ্রাস পায়নি; নবীর মর্যাদা কখনো মানবীয় গুণাবলির ব্যাপ্তি অতিক্রম করেনি। তাঁর জীবনধারণ পদ্ধতি শিষ্যদের কৃতজ্ঞতাবোধ ধরে রেখেছে যুক্তি ও ধর্মের সীমার মধ্যে। Jules Masserman in ‘Who Were Histories Great Leaders?’ in TIME Magazine, July 15, 1974 নেতাদের অবশ্যই তিন ধরনের কাজ সম্পাদন করতে হয়- অনুসারীদের মঙ্গলের ব্যবস্থা করা, এমন একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি করা যেটাতে সাধারণ লোকজন তুলনামূলকভাবে নিরাপত্তা বোধ করে, এবং অনুসারীদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাসের জোগান দেয়া। প্রথমটি বিবেচনায় নেতা হলেন লুই পাস্তুর এবং সাল্ক(Salk)। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় একদিকে গান্ধী ও কনফুসিয়াস এবং অন্য দিকে আলেকজান্ডার, সিজার ও হিটলার- এরা হলেন নেতা। যিশুখ্রিস্ট ও গৌতম বুদ্ধ তৃতীয়টি বিবেচনায় নেতা। সম্ভবত মুহাম্মদ হলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নেতা যিনি উপরোক্ত তিনটি কার্যাবলিই সম্পাদন করেছেন। স্বল্প পরিসরে হলেও মূসাও একই কাজ করেছিলেন। Annie Besant in ‘The Life and Teachings of Mohammad,’ Madras, 1932. যে কেউ আরবের মহান নবীর জীবন এবং চরিত্র অধ্যয়ন করেন তার হৃদয়ে মহান নবীর প্রতি শ্রদ্ধার উদ্রেক না হয়ে পারে না, যিনি জেনেছেন তিনি (নবী) কিভাবে শিক্ষা দিতেন এবং বসবাস করতেন; তিনি ছিলেন স্রষ্টার মহান বার্তাবাহকদের অন্যতম। যদিও আমি আপনাদেরকে এখন যা বলবো তা অনেকের কাছে সুপরিচিত মনে হতে পারে, তথাপি যখনই আমি মুহাম্মদের জীবনী পুনরায় পাঠ করি প্রতিবারই আরবের মহান শিক্ষকের প্রতি আমার মনে মুগ্ধতা ও শ্রদ্ধার নতুন ভাব জাগ্রত হয়। W.C. Taylor in ‘The History of Muhammadanism and its Sects’ দরিদ্র লোকদের প্রতি তাঁর সদয়তা এত বেশি ছিল যে প্রায়ই পরিবার-পরিজনকে উপবাস করতে হতো। তিনি শুধু তাদের অভাব মোচন করেই তৃপ্ত হতেন না, তাদের সাথে কথাবার্তা বলতেন এবং তাদের দুঃখ-দুর্দশার জন্য গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করতেন। তিনি ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং বিশ্বস্ত সহযোগী। Reverend Bosworth Smith in ‘Muhammad and Muhammadanism,’ London, 1874. রাষ্ট্রপ্রধান একইসাথে উপাসনাগৃহের প্রধান, তিনি ছিলেন একই সাথে সিজার এবং পোপ; তিনি পোপ ছিলেন কিন্তু পোপের দুরহঙ্কার ছাড়া, তিনি সিজার ছিলেন কিন্তু সিজারের মতো বিরাট সেনাবাহিনী ছাড়া, দেহরক্ষী ছাড়া, শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়া, স্থায়ী কোন ভাতা ছাড়া। যদি আজ পর্যন্ত কোন মানুষ ন্যায়বিচারপূর্ণ স্বর্গীয় শাসন করে থাকে, তবে সেটা ছিলেন মুহাম্মদ। Dr. Gustav Weil in ‘History of the Islamic Peoples.’ মুহাম্মদ ছিলেন তাঁর অনুসারীদের জন্য জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। তাঁর চরিত্র ছিল নিষ্কলুষ এবং দৃঢ়। তাঁর গৃহ, পোশাক, খাদ্য- সবই ছিল অতি সাধারণ। তিনি এতই নিরহঙ্কার ছিলেন যে তাঁর সঙ্গীদের কাছ থেকে বিশেষ কোন সম্মান গ্রহণ করতেন না কিংবা যে কাজ তিনি নিজে করতে পারতেন তাঁর জন্য অযথা ভৃত্যের সাহায্য নিতেন না। সবসময় সবার জন্য তাঁর দ্বার ছিল উন্মুক্ত ছিল। তিনি অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যেতেন এবং সবার প্রতি তাঁর অপরিসীম সহানুভূতি ছিল। তাঁর বদান্যতা ও মহানুভবতা ছিলো অসীম, সেইসাথে তিনি সবসময় অনুসরীদের মঙ্গলের কথা চিন্তা করতেন। J. W. H. Stab in ‘Islam and its Founder.’ তাঁর কাজের সীমা এবং স্থায়িত্ব বিবেচনা করলে শুধু মক্কার নবী হিসেবে নয় পৃথিবীর ইতিহাসে তিনি আরও দীপ্তিময়ভাবে জ্বলজ্বল করছেন। ...মানুষের বিখ্যাত হওয়ার মাপকাঠি অনুসারে বিচার করলে তাঁর সাথে অন্য কোন মরণশীলের খ্যাতি তুলনীয় হতে পারে কি? Washington Irving in ‘Life of Muhammad,’ New York,1920. মুহাম্মদের সামরিক বিজয় তাঁর মাঝে কোন গর্ব ও অযথা দম্ভ জাগায়নি। প্রতিকূল দিনগুলোতে তাঁর আচার-ব্যবহার ও পোশাক-আশাক যে রকম সাধারণ ছিলো সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পরও তা তিনি বজায় রেখেছিলে। রাজকীয় জাঁকজমক দূরে থাক, এমনকি কক্ষে ঢোকার পর তাঁর প্রতি কেউ বিশেষভাবে সম্মান প্রদর্শন করলে তিনি রেগে যেতেন। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের ভালোবাসার পাত্র কারণ সবাইকেই তিনি আতিথেয়তার সাথে গ্রহণ করতেন এবং মনোযোগসহকারে তাদের অভিযোগ শুনতেন। ব্যক্তিগত লেনদেনের ক্ষেত্রে ছিলেন ন্যায়পরায়ণ। বন্ধু-আগন্তুক, ধনী-দরিদ্র, সবল-দুর্বল সবার সাথে সমতার সাথে ব্যবহার করতেন। Arthur Glyn Leonard in ‘Islam, Her Moral and Spiritual Values.’ এটা ছিলো মুহাম্মদের মেধা, যে উদ্দীপনা তিনি ইসলামের মাধ্যমে আরবদের মাঝে সঞ্চারিত করেছিলেন তা তাদেরকে সুউচ্চ স্থানে আসন দিয়েছিল। যা তাদেরকে জড়তা ও গোত্রীয় সঙ্কীর্ণতা থেকে মুক্ত করে জাতীয় ঐক্যের সুমহান নিদর্শন গড়তে এবং সাম্রাজ্য গড়তে সাহায্য করেছিল। সেটা ছিলো মুহাম্মদের সমীহ উদ্রেককারী একত্ববাদ, সরলতা, মিথাচার এবং অকৃত্রিমতা যা আদর্শের প্রতি প্রতিষ্ঠাতার বিশ্বস্ততাকেই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়, যা তাদের নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে শাণিত করেছিল। James Michener in ‘Islam : The Misunderstood Religion,’ Reader’s Digest, May 1955, pp. 68-70. ইতিহাসে আর কোন ধর্মই ইসলামের মতো এত দ্রুত বিস্তার লাভ করেনি। পাশ্চাত্যে এ বিশ্বাস অত্যন্ত দৃঢ়মূল যে ইসলামের এই প্রসার তরবারির জোরেই সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আধুনিক কোন বিজ্ঞজনই এ ধারণাকে গ্রহণ করেননি এবং কুরআনেও বিবেকের/চিন্তার স্বাধীনতার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও মানবতার সুন্দরতম আদর্শ প্রতিষ্ঠায় মহানবী সা. সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এ সম্পর্কে জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা অধ্যাপক এডওয়ার্ড মুনন্ট বলেন, “চরিত্র গঠন ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে মুহাম্মদ সা. যে সাফল্য অর্জন করেছেন সেদিক থেকে তাঁকে বিশ্বমানবতার মহান দরদি নেতা বলে প্রতীয়মান হয়।” প্রিয়নবীর সা. মহানুভবতার কথা বলতে যেয়ে মক্কা বিজয়কালীন ইতিহাস তুলে ধরে ঐতিহাসিক গিবন বলেন, “হযরত মুহাম্মদ সা. তাঁর পদতলে দুশমনদের পেয়েও একে একে সব দুশমনকে মাফ করে দিয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন অনুরূপ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর সুদীর্ঘকালের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি আর নেই। সেই ঔদার্য ও ক্ষমাশীলতার দ্বিতীয় কোনো দৃষ্টান্ত আর দেখা যায় না।” ১৯৩৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সা. উপলক্ষে দেয়া এক শুভেচ্ছা বাণীতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘‘যিনি মহত্তমদের মধ্যে অন্যতম, সেই পবিত্র পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ সা. এর উদ্দেশ্যে আমি আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। মানুষের ইতিহাসে এক নতুন সম্ভাবনাময় জীবনশক্তির সঞ্চার করেছিলেন হযরত মুহাম্মদ সা.। তিনি এনেছিলেন নিখাদ, শুদ্ধ ধর্মাচরণের আদর্শ।” ইংরেজ কবি জন কিটস্ বলেন, ‘‘পৃথিবীর যা কিছু মঙ্গলময়, যা কিছু মহৎ ও সুন্দর সবই নবী মুহাম্মদ সা.। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই।’’ এভাবে আমরা দেখতে পাই জন ডেভেন পোর্ট, ডা: স্যামুয়েল জনসন, প্রফেসর স্টিফেন্স, জন উইলিয়াম ড্রেপার, ওয়াশিংটন আরভিং, এডওয়ার্ড মুনন্ট, রেভারেন্ড ডব্লিউ স্টিফেন, রেমন্ড এলিয়ন নিকলসন, পি.কে. হিট্টি, জেমস্ এ মিসেনার, আর্থার গিলমান, মরিস গড ফ্রে, টি ডব্লিউ আরনল্ড, স্টানলি লেনপুল, বসওয়ার্থ স্মিথ, মেজর আর্থার লিউনার্ড, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, জর্জ বার্নার্ড শ, বার্ট্রান্ড রাসেল, টমাস কার্লাইল, ড. গুস্তাভ উইল, এ্যানি বেসান্ত, স্যার গোকুল চন্দ্র, জোসেফ হেল, ড. গেসটাউলি, আলফ্রেড মার্টিন, রর্বাট বিফ্রো, এডমন্ড বার্ক, লা মার্টিন, ক্যাডফ্রে হেগেল, মানবেন্দ্রনাথ রায়, স্বামী বিবেকানন্দ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরুসহ পৃথিবীর অসংখ্য খ্যাতনামা ব্যক্তিগণ মহানবী সা. সম্পর্কে প্রশংসার বাণী উচ্চারণ করেছেন। এসব বিশ্ববরেণ্য মনীষীগণ মহানবী সা. এর আদর্শ এবং জীবনের নানাবিধ কর্মকান্ডের ব্যাপক বিচার-বিশ্লেষণ করে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সুন্দরতম চরিত্র, অনুপম আদর্শ, নির্ভীকতা ও সহনশীলতার মাধুর্য দেখে। তাঁর সততা, কর্তব্যপরায়ণতা, ন্যায়নীতি, ক্ষমা, দয়া এবং নিষ্ঠা দেখে তাঁরা অভিভূত হয়ে পড়েন। সর্বোপরি তাঁরা এটাও অকপটে স্বীকার করেছেন যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. এর আদর্শই মানবতার মুক্তির একমাত্র পথ যা বিশ্বশান্তিকে নিশ্চিত করতে পারে। ইতিহাসে মহামানব হযরত মুহাম্মদ সা. এর অবস্থান যে কতটা গৌরবদীপ্ত তা ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছিলেন যে, “মুহাম্মদের ধর্মই আমার নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয়। অতঃপর মহানবী সা. এর অনুপম চরিত্র ও বহুমুখী প্রতিভায় আকৃষ্ট এবং অভিভূত হয়ে তিনি এই মর্মেও আশা প্রকাশ করেন যে, “সে সময় খুব দূরে নয় যখন সকল দেশের বিজ্ঞ ও শিক্ষিত ব্যক্তিদের আমি একতাবদ্ধ করতে পারব এবং কুরআনের যে নীতিসমূহ একমাত্র সত্য এবং যে নীতিসমূহই মানুষকে সুখের পথে পরিচালিত করতে পারে সে সব নীতির ওপর ভিত্তি করে এক সমরূপ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবো।” মহানবী সা. সম্পর্কে আরো একটি বলিষ্ঠ স্বীকৃতি উচ্চারিত হয় বিখ্যাত মনীষী টমাস কার্লাইলের কণ্ঠে। ১৮৪০ সালে এডিনবার্গে আয়োজিত একটি সভায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি ঘোষণা করেন যে, “শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যেই নয়, ঈশ্বর প্রেরিত দূত বা নবীদের মধ্যেও নায়কের স্থান অধিকার করে রয়েছেন সুদূর আরবের হযরত মুহাম্মদ সা.।” অতঃপর তিনি তাঁর প্রাঞ্জল অনুপম ভাষায় আরো বলেন, “জগতের আদিকাল হতে আরবরা মরুভূমির মধ্যে বিচরণ করে বেড়াত এক অজ্ঞাত, অখ্যাত মেষপালকের জাতি হিসেবেই। অতঃপর তারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে এমন একটা বার্তাসহ সেখানে এক ধর্মবীর পয়গম্বর প্রেরিত হলেন, আর অমনি জাদুর মতো সেই অখ্যাত জাতি হয়ে উঠল জগদ্বিখ্যাত, দীনহীন জাতি হয়ে গেল জগতের শ্রেষ্ঠ জাতি। তারপর এক শতাব্দীর মধ্যে পশ্চিমে গ্রানাডা হতে পূর্বে দিল্লি পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হলো আরবদের আধিপত্য। সুদীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে পৃথিবীর এক বিশাল অংশের ওপর আরবদেশ মহাসমারোহে এবং বিক্রমের সাথে তার দ্যূতি বিকিরণ করেছে।” ফরাসি দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠতম পন্ডিত ও ইতিহাসবিদ প্রফেসর লা মার্টিন তার ‘তুরস্কের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “কার এমন ধৃষ্টতা আছে যে, ইতিহাসের অন্য কোন মহামানবের সাথে হযরত মুহাম্মদ সা. এর তুলনা করতে পারে? প্রায় সব বিখ্যাত মানুষ যদি কিছু অর্জন করেই থাকে তা তো জাগতিক শক্তি সামর্থ্য বৈ কিছুই নয়, যা প্রায় ক্ষেত্রে তাদের সম্মুখেই টুকরো টুকরো হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। এই মহামানব (হযরত মুহাম্মদ সা.) শুধুমাত্র সেনাবাহিনীই পরিচালনা করেননি, আইনই কেবল প্রণয়ন করেননি, রাজ্যই কেবল প্রতিষ্ঠা করেননি, জনসাধারণকেই কেবল সুসংগঠিত করেননি, কেবল খিলাফতের ধারাবাহিকতাই স্থাপন করেননি বরং তিনি সেই সময়কার জানা দুনিয়ার তিন ভাগের এক ভাগ অথবা ততোধিক জনপদের লাখ লাখ অধিবাসীর জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন। তাদেরকে উদ্ধার করেছেন কল্পিত দেব- দেবীর খপ্পর থেকে। ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাসে এনেছেন পরিবর্তন। বিকশিত করেছেন তাদের আত্মা ও মননকে। একটি মহাগ্রন্থের ভিত্তিতে নির্মাণ করেছেন এক অনন্য আধ্যাত্মিক জাতীয়তা যা প্রত্যেক ভাষার মানুষকে, প্রত্যেক গোত্রের মানুষকে এক অনন্য ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করে। সেই মহাগ্রন্থের প্রতিটা অক্ষর পরিণত হয়েছে আইনে। দার্শনিক, সুবক্তা, রাসূল, আইন প্রণয়নকারী, বীরযোদ্ধা, নিরাকারের ইবাদত আনয়নকারী, কুড়িটি জাগতিক সাম্রাজ্যের এবং একটি আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাকারী হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ সা.। মানুষের বিরাটত্ব ও মহত্ত্ব পরিমাপের তাবৎ মানদন্ড একত্র করে আমাদের শুধু একটিমাত্র প্রশ্ন : তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কোন মানুষ কি আর কোথাও আছেন? লা মার্টিন আরো বলেন, তিনি ছিলেন বিনম্র তবু নির্ভীক, শিষ্ট তবু সাহসী। তিনি ছিলেন সবচেয়ে সম্মানিত, সবচেয়ে উন্নত, বরাবর সৎ, সর্বদাই সত্যবাদী, শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসী এক প্রেমময় স্বামী, এক হিতৈষী পিতা, এক বাধ্য ও কৃতজ্ঞ পুত্র, বন্ধুত্বে অপরিবর্তনীয় এবং সহায়তায় ভ্রাতৃসুলভ, দয়ার্দ্র, অতিথিপরায়ণ, উদার এবং নিজের জন্য সর্বদাই মিতাচারী। কিন্তু তিনি কঠিন ছিলেন মিথ্যা শপথের বিরুদ্ধে, ব্যভিচারীর বিরুদ্ধে। খুনি, কুৎসাকারী, অর্থলোভী, মিথ্যা সাক্ষ্যদাতাÑ এ ধরনের লোকদের বিরুদ্ধে। ছিলেন ধৈর্যে, বদান্যতায়, দয়ায়, পরোপকারিতায়, কৃতজ্ঞতায়, পিতা-মাতা গুরুজনদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে এবং নিয়মিত আল্লাহর প্রার্থনা অনুষ্ঠানে এক মহান ধর্ম প্রচারক।” জার্মানির প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, পন্ডিত ড. গুস্তাভ উইল মহানবী সা.কে বিশ্বে আইনদাতা ও সমাজ সংস্কারের মূর্তপ্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অন্য একজন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ স্টানলি লেনপুল বলেছেন, ধর্ম ও সাধুতার প্রচারক হিসেবে মুহাম্মদ সা. যে রকম শ্রেষ্ঠ ছিলেন, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেও ছিলেন অনুরূপ শ্রেষ্ঠ। তিনি অদ্ভুত শক্তিতে, হৃদয়ের উষ্ণতায়, অনুভূতির মাধুর্য ও বিশুদ্ধতায় ছিলেন বিশিষ্ট। জীবনে কখনো কাউকে তিনি আঘাত করেননি। তিনি (মুহাম্মদ) বলেছিলেন, ‘কাউকে অভিশাপ দেয়ার জন্য আমি প্রেরিত হইনি, প্রেরিত হয়েছি বিশ্বজাহানের জন্য রহমত স্বরূপ”, প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড গিবন বলেন, ‘‘আশ্রয়প্রার্থীর জন্য বিশ্বস্ততম রক্ষাকারী ছিলেন মুহাম্মদ সা.। কথাবার্তায় সবচেয়ে মিষ্টভাষী, সবচেয়ে মনোজ্ঞ, তাকে যারা দেখেছেন তারা আবেগাপ্লুত হয়েছেন অপ্রত্যাশিতভাবে। যারা কাছে এসেছে তারা তাঁকে ভালোবেসেছেন। পরে তারা বিবরণ দিয়েছেন তাঁর মতো মহামানব আগে কখনো দেখিনি, পরেও না। মুহাম্মদ সা. এর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখরত গভীর, তাঁর রসিকতা ছিল শালীন। তাঁর কল্পনা ছিল উন্নত ও মহৎ। তাঁর বিচার বুদ্ধি ছিল তীক্ষè। জাগতিক শক্তির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেও মুহাম্মদ সা. নিজ গৃহের কাজগুলোও করতেন। তিনি আগুন জ্বালাতেন, ঘর ঝাড়ু দিতেন, দুগ্ধ দোহন করতেন এবং নিজ হাতে কাপড় সেলাই করতেন। তাঁর আনীত ধর্ম বিধান সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রযোজ্য।’’ লেবাননের হিট্টি বংশীয় প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও মার্কিন মুল্লুকে অধ্যাপনায় প্রশংসিত প্রফেসর ফিলিপ কে হিট্টি আরব জাতি ও দেশ নিয়ে অনেকগুলো তথ্যপূর্ণ ইতিহাস গ্রন্থ লিখেছেন। তিনি মহানবী সা. সম্পর্কে বলেছেন, “মুহাম্মদ সা. তাঁর স্বল্প পরিসর জীবনে অনুল্লেখযোগ্য জাতির মধ্য হতে এমন একটি জাতি ও ধর্মের গোড়াপত্তন করলেন যার ভৌগোলিক প্রভাব খ্রিস্টান ও ইহুদিদেরকেও অতিক্রম করলো। মানবজাতির বিপুল অংশ আজও তাঁর অনুসারী। অমায়িক ব্যবহার, অনুপম ভদ্রতা ও মহৎ শিক্ষার দ্বারা তিনি আরব জাতির অবস্থার পরিবর্তন ঘটান। মহত্ত্ব, সহানুভূতি ও বদান্যতার মাধ্যমে তিনি মানুষের হৃদয় জয় করেন। তিনি ন্যায়ের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কখনো ন্যায়নীতি ও পুণ্যতার পথ পরিহার করেননি। তিনি ওয়াদা খেলাফ করেননি বা কাউকে প্রতারিত করেননি। এমনকি তার আজীবন শত্রু, যারা তাকে দেশ হতে বের করে দিয়েছিল এবং সমগ্র আরব জাতিকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল চূড়ান্ত বিজয়ে তিনি প্রতিশোধ নেয়ার পরিবর্তে তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। ব্যক্তিগত আক্রোশে তিনি কখনো কাউকে শাস্তি দেন নাই। সমগ্র দেশের শাসনকর্তা হয়েও তিনি আগের মতই দারিদ্র্যপূর্ণ জীবন-যাপন করতেন। ফলে মৃত্যুকালে তাঁর উত্তরসূরিদের জন্য কিছুই রেখে যাননি।” মানবসভ্যতার ইতিহাসে নারীর মর্যাদা রক্ষার জন্য যিনি প্রথম সোচ্চার হয়ে ওঠেন, মানবজীবনে নারীর অধিকার পূর্ণভাবে যিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি হলেন মহানবী সা.। এ ব্যাপারে মনীষী পিয়েরে ক্রাবাইট বলেন, “মুহাম্মদ সা. সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে নারী অধিকারের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবক্তা ছিলেন।” অন্য একজন পন্ডিত গিব তাঁর ‘‘মুহাম্মদেনিজম” শীর্ষক ইংরেজি গ্রন্থে বলেছেন, ‘আজ এটা এক বিশ্বজনীন সত্য যে, মুহাম্মদ সা. নারীদেরকে উচ্চতর মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন।” ডব্লিউ ডব্লিউ কেশ লিখেছেন, “প্রথমবারের মত ইসলামই নারীদের মানবাধিকার দিয়েছে। দেহ ব্যবসার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। মদকে হারাম ও জুয়া খেলাকে মহাপাপ গণ্য করেছে।” মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও মানবতার সুন্দরতম আদর্শ প্রতিষ্ঠায় মহানবী সা. সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এ সম্পর্কে জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা অধ্যাপক এডওয়ার্ড মুনন্ট বলেন, “চরিত্র গঠন ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে মুহাম্মদ সা. যে সাফল্য অর্জন করেছেন সেদিক থেকে তাঁকে বিশ্বমানবতার মহান দরদি নেতা বলে প্রতীয়মান হয়।” প্রিয়নবীর সা. মহানুভবতার কথা বলতে যেয়ে মক্কা বিজয়কালীন ইতিহাস তুলে ধরে ঐতিহাসিক গিবন বলেন, “হযরত মুহাম্মদ সা. তাঁর পদতলে দুশমনদের পেয়েও একে একে সব দুশমনকে মাফ করে দিয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন অনুরূপ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর সুদীর্ঘকালের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি আর নেই। সেই ঔদার্য ও ক্ষমাশীলতার দ্বিতীয় কোনো দৃষ্টান্ত আর দেখা যায় না।” লিও টলস্টয় মহানবী সা. এর বিশাল কর্মজীবনে কতটা মুগ্ধ ছিলেন তা তাঁর মন্তব্য থেকে বোঝা যায়। তিনি বলেন, “আমি মুহাম্মদের নিকট হতে অনেক কিছু শিখেছি। তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে পৃথিবী অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। তিনি সেই অন্ধকারে দীপ্ত বহ্নির মতো প্রজ্বলিত হয়ে উঠেছিলেন। আমি দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি যে, মুহাম্মদের শিক্ষা ও দ্বীন ছিল যথার্থ।” খ্যাতনামা দার্শনিক ও হিন্দু ধর্মের নেতা স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, “হযরত মুহাম্মদ সা. ছিলেন সাম্যের, মানবতার ও সৌভ্রাতৃত্বের সুমহান দূত।” অধ্যাপক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী পিএইচডি বলেছেন, ‘যখন ইউরোপ কুরুচি ও মূর্খতার গভীরগহ্বরে নিমজ্জিত ছিল, যখন ইউরোপীয় রাজধানীতে ডাইনি সন্দেহ করে নারীদের জীবন্ত পোড়ান হতো, জ্ঞানার্জনকে ঘৃণার চোখে দেখা হতো, তখন মুসলমানেরা স্পেনের প্রতিটি গ্রামেস্কুল প্রতিষ্ঠা করে এবং শিল্প, বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন ও শিক্ষা বিলি করছিল।” স্যার উইলিয়াম মুর বলেছেন, ‘সর্বশ্রেণীর ঐতিহাসিকরা একবাক্যে হযরত মুহাম্মদের যৌবনকালীন স্বভাবের শিষ্টতা ও আচার ব্যবহারের পবিত্রতা স্বীকার করেছেন। এরকম গুণাবলি সে সময় মক্কাবাসীর মাঝে বিরল ছিল। এই সরল প্রকৃতির যুবকের সুন্দর চরিত্র, সদাচরণ তার স্বদেশবাসীর প্রশংসা অর্জন করে এবং তিনি সর্বসম্মতিক্রমে ‘আল-আমিন’ বা বিশ্বাসী উপাধি পান।” বাসওয়ার্থ স্মিথ বলেছেন, ‘হযরত মুহাম্মদ একাধারে সিজারের মত শাসনতন্ত্রের শীর্ষভাগে ছিলেন আবার পোপের মত ধর্ম মন্দিরের উচ্চ আসনেও সমাসীন ছিলেন। কিন্তু তাঁর পোপের মত জাঁকজমক ও সিজারের মতো সেনাবল ছিল না। বেতনভোগী সেনা, দেহরক্ষী সেনা, রাজকীয় প্রাসাদ ও নির্ধারিত রাজস্ব ছাড়া স্বর্গীয় অধিকারবলে রাজত্ব দাবি করার একমাত্র দাবিদার কেবল হযরত মুহাম্মদই। কারণ ক্ষমতার উপকরণ ও আশ্রয় ছাড়াই তিনি সব ধরনের ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।” জন ডেভেনপোর্ট বলেছেন, ‘ইসলাম কখনো অন্য কোন ধর্মমতে হস্তক্ষেপ করেনি। কখনো ধর্মের জন্য নির্যাতন, ধর্মমত বিরোধীদের দন্ডের ব্যবস্থা কিংবা দীক্ষা ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ করেনি। ইসলাম তার মত বা বক্তব্য জগতের সবার সামনে তুলে ধরেছে কিন্তু কখনো কাউকে তাঁর মত গ্রহণে বাধ্য করেনি। ইসলাম আশপাশ দেশগুলোতে তৎকালে প্রচলিত শিশুহত্যা ও আরবের দাসত্বপ্রথা তিরোহিত করেছে। ইসলাম কেবল এর অনুসারীদের ওপরই নয়, বাহুবলে বিজিত সবার ওপরই সমভাবে নিরপেক্ষ বিচার স্থাপন করেছে।’ এভাবে নিরপেক্ষ অমুসলিম বিশ্লেষক, বিশেষজ্ঞ ও পন্ডিতরাও একবাক্যে বিশ্বনবী সা. এর অতুল মহত্তের কথা দ্বিধাহীনভাবে ও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন যুগে যুগে। (সঙ্কলিত ও সংগৃহীত)

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির