post

যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি পেছনের রাজনীতি

২৯ জুন ২০১২
অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম বাবু শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের রাজনীতিতে যে বিপর্যয়ের সূচনা হয়েছে তার নেপথ্যে রয়েছেন বামপন্থী রাজনীতিবিদ ও তাদের পোষ্য বুদ্ধিজীবীরা। বেশ কিছুকাল থেকেই সেই বামরা ভর করেছে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে। সে জন্য দলটি এর আগে বহু বিতর্কিত বিষয় নিয়ে রাজনীতি করলেও ক্ষমতায় যাওয়ার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো মীমাংসিত বিষয়কে আগে কখনো ইস্যু করেনি। কারণ আওয়ামী লীগের নেতারা জানতেন, বিষয়টি তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে ৩০ মে সাধারণ ক্ষমা (general amnesty) ঘোষণার মাধ্যমে সমাপ্ত করেছেন। এ নিয়ে রাজনীতি করলে লোকে হাসাহাসি করবে। সেই হাসাহাসির কাজটি শেষ পর্যন্ত বামপন্থীদের উসকানিতে করছে আওয়ামী লীগ। বলা বাহুল্য, আমাদের দেশের অধিকাংশ লোকের ধারণা, আওয়ামী লীগের এই দাবির মধ্যে আদৌ কোনো সৎ উদ্দেশ্য নেই, আছে কেবল রাজনৈতিক ভণ্ডামি ও প্রতিহিংসা। এই পুরনো মীমাংসিত বিষয়কে নতুন করে বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে এসে এই দেশকে তাদের মিত্র শক্তিদের কাছে বিক্রি করার পাঁয়তারা করছে। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে সমস্ত বামপন্থী স্বাধীনতা যুদ্ধকে দুই কুকুরের কামড়া কামড়ি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন তারাই আজকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রক্ষকের ভান করছেন। কারণ একটিই, তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা সর্বোচ্চ সীমায় উপনীত হয়েছে। তাই নিজের দলীয় প্রতীক বিসর্জন দিয়ে নৌকাকে ধরে নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়ার পন্থা অবলম্বন করেছে। যুদ্ধাপরাধ অবশ্যই জঘন্য অপরাধ এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেখানেই যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেখানেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। সেটা হয়েছে যুদ্ধের পরপরই। যেমন জার্মানির নুরেমবার্গ ট্রায়াল। তার অব্যবহিত পরে জাপানের সামরিক আদালতে স্ব স্ব দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদাহরণ দেয়া যায়। সাম্প্রতিককালে বসনিয়ার গণতহ্যার জন্য যুগোস্লাভ প্রেসিডেন্ট স্লোবাধান মিলোসেভিচের যুদ্ধাপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনালে হয়েছে। এখন চলছে আরেক সার্ব নেতা রাদোভান কারাদজিচের বিচার। রুয়ান্ডার গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার চলছে। আমাদের দেশে বেশ কিছু দলীয় বুদ্ধিজীবী, তারা পেশাগত দায়িত্ব কতটুকু পালন করেন জানি না তবে ইতিহাসবহির্ভূত বিবৃতি দিয়ে শুধু নয়, টক শোতেও মিথ্যা তথ্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা ও উসকে দেবার কাজটি বেশ দক্ষতার সাথেই করছেন। যুদ্ধাপরাধ প্রসঙ্গে কথায় কথায় তারা জার্মানির নুরেমবার্গ ট্রায়ালের কথা তুলে ধরেন। অথচ তারা ভুলে যান এর পিঠেও কথা আছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অন্যতম পরাজিত শক্তি জার্মানির নাৎসী নেতাদের বিচারের জন্য যে আট সদস্যবিশিষ্ট ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল তার মধ্যে সোভিয়েত রাশিয়ার দু’জন সদস্য ছিলেন। এরা হলেন মেজর জেনারেল আইটি নিকেৎচেক্কো এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ ভলকাচ। নিরপেক্ষ ইতিহাসবিদরা বলেন, সোভিয়েত রাশিয়ার সৈন্যবাহিনী (রেড আর্মি) জার্মান সাধারণ নাগরিকদের ওপর ভয়াবহ অত্যাচার ও মহিলাদের বলাৎকার করেছিল, তার জন্য আরেক নুরেমবার্গ ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি। জাপানের সাধারণ নাগরিকদের ওপর অ্যাটম বোমা নিক্ষেপ করার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের বিরুদ্ধে সেটা মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ বলে বিবেচিত হয়নি। কারণ এই সমস্ত বিচার কিছুটা হলেও রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত ছিল। আমাদের দেশের বিষয়টিও তার ব্যতিক্রম নয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ সংবাদপত্র ও মিডিয়া মোটামুটিভাবে ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ লোকদের দ্বারাই পরিচালিত হয়ে থাকে। এদের অনেকেই রাজনীতিতাড়িত ব্যক্তি। পরমতসহিষ্ণুতা নেই বললেই চলে। এরা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করে। অথচ তাদের দল যখন একজন স্বৈরাচারের সঙ্গে ক্ষমতায় যাবার জন্য আঁতাত করে তখন তারা সেটাকে নীরবে হজম করে। তারা এমনকি এটাও ভুলে যাওয়ার ভান করে যে সেই স্বৈরাচারী ব্যক্তিটির অন্যতম অবদান হলো ইসলামকে একমাত্র রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এবং এবারের নির্বাচনে তার অন্যতম অঙ্গীকার ব্লাসফেমি আইন করা। অথচ জামায়াতে ইসলামী যখন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের অপমানের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ব্লাসফেমি আইনের কথা বলে তখন তারা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। এই একদেশদর্শিতা ও দ্বিচারিতা অবশ্য এদের স্বভাব। আসলে এদের একমাত্র উদ্দেশ্য দেশপ্রেমিক ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীকে চাপের মুখে রেখে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি দিয়ে দেশকে তাঁবেদার বানানো, সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে তুলে দেয়া। যাই হোক, এবার আসল বিষয়ে আসা যাক। স্বাধীনতার ৪১ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি কতটা যৌক্তিক? আন্তর্জাতিক আইনে এই বিচার এখনো সম্ভবপর কি না? দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টি অতীতে মীমাংসা হয়ে গেছে আবার সেই বিচার করা কতখানি আইন সঙ্গত? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সমাপ্তির অনেক আগেই জার্মানি ও জাপানের বিরুদ্ধে লড়াইরত দেশগুলো যাদের আমরা মিত্রশক্তি বলি, তারা একমত হয়েছিল এই ভয়াবহ যুদ্ধে সূচনাকারীদের বিচার করতে হবে। এই বিষয়ে যুদ্ধের সময় অর্থাৎ ৩০ মে ১৯৪৫ লন্ডনের রাজকীয় ন্যায় আদালতে হাউসটেড সেশনস ওয়ার কমিশনের চেয়ারম্যান লর্ড রাইটের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে একটি নতুন চুক্তিনামা হয়। ৭ আগস্ট ১৯৪৫ ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই চুক্তি অনুযায়ী পরবর্তীকালে জার্মানি ও জাপানের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়। তবে এই বিচার অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে বিজয়ী পক্ষের মধ্যে বিস্তর মতভেদ ছিল। কিন্তু একটি বিষয়ে ঐকমত্য ছিল যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দণ্ড প্রদান করতে হবে। আর তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেয়া হয়। এবার আসা যাক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। স্বাধীনতা যুদ্ধের অব্যবহিত পরই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব সরকার ১৯৭৩ সালে ১৭ এপ্রিল ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার করার ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণায় এই বিচারটা কিভাবে হবে তারও দিকনির্দেশনা দেয়া হয়। যেমন The trial shall be held in Dacca (Now Dhaka) before a Special Tribunal consisiting of Judge having status of Justice of the Supreme Court. এই স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের জন্য তখনকার আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলমাকে স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ দেয়া হয়। অথচ আদালত গঠন করা হয়নি। কেন করা হয়নি সেটা গবেষণার বিষয়। সম্ভবত এ ব্যাপারে স্বয়ং শেখ মুজিবের আগ্রহ ছিল না কারণ তিনি হয়তো forget and forget the past  নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। এর উত্তর আরো ভালোভাবে দিয়েছেন ভারতের বিখ্যাত রাজনৈতিক লেখক ও কূটনীতিক জেএন দীক্ষত। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে তিনি বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি তার বিখ্যাত liberation and Beyond গ্রন্থে বলেছেন : স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান জুন মাসেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ্যসচিব পিএস হাকসারের কাছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে অনাগ্রহ দেখান। কারণ তিনি জানতেন সাম্রাজ্যবাদী ভারতের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে পাকিস্তান ও মুসলিম বিশ্বের সহযোগিতা দরকার। ভারত যে নতুন বাংলাদেশের জন্য কাল হয়ে উঠবে তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। নুরেমবার্গ বিচারের আগে জার্মান বাহিনী মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। সেই কারণে মিত্রশক্তি তাদের ঘোষিত চুক্তি অনুযায়ী আদালত গঠন করেছিল। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটলো তার ব্যতিক্রম। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সেনাপতি আতাউল গণি ওসমানীর কাছে আত্মসমর্পণ করার পরিবর্তে করলো মিত্র বাহিনীর সেনাপতি জেনারেল অরোরার কাছে এবং আত্মসমর্পণকৃত ৯৫ হাজার পাকিস্তানি সেনা গিয়ে পড়লো ভারতের হাতে। ভারত সিমলা চুক্তির আগে  থেকেই পাকিস্তানকে বারবার আশ্বাস দিয়ে আসছিল বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার করা হবে না। কারণ পেশাদার ভারতীয় সেনাবাহিনী এ রকম বিচারের ঘোর বিরোধী ছিল। যেসব সেক্টর কমান্ডার আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ধুয়া তুলছেন তারা সবাই সেদিন ছিলেন ক্ষমতার ভাগীদার। সেই সময় তারা কোথায় ছিলেন? তখন কেন তারা প্রতিবাদী হলেন না? আজকে মুক্তিযুদ্ধে মহান সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল বেঁচে থাকলে তার কাছ থেকে অনেক তথ্য জানা যেত। মুল কথা হলো আওয়ামী লীগ এই বিচার প্রক্রিয়ার কোনো কিছুই শুরু করতে পারেনি। কারণ বাংলাদেশ ততদিনে পুরোপুরি ভারতের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমার ব্যাপারে বাংলাদেশের জনসাধারণের কোনো মতামত না নিয়েই ভারত-পাকিস্তানের সাথে ত্রিদেশীয় চুক্তি করল। সেই সময় মওলানা ভাসানীর ন্যাপ এই কাজের তীব্র সমালোচনা করেছিল। আন্তর্জাতিক আইন বলে, যদি মূল আসামিদের বিচার না হয় তাহলে তার সহযোগীদের বিচার না করাই ভালো। মূল যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনাকে বিনা বিচারে ছেড়ে দেয়ার পর তাদের সহযোগীদের বিচার করতে চাওয়ার নৈতিক অধিকার থাকে না। এই ১৯৫ জনকে যদি বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেত তাহলে তাদের কাছ থেকে তাদের প্রকৃত সহযোগীদের নাম, পরিচয় ও কর্মকাণ্ড জানা যেত। আর আইনের কথা হলো কেবল দলীয় সদস্য থাকলেই য্দ্ধুাপরাধ হয় না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হয়। অস্ট্রিয়ার অধিবাসী জাতিসংঘের মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ড হেইম ও বিশ্ববিখ্যাত জার্মান কথা সাহিত্যিক গুন্টারগ্রাস নাৎসী বাহিনীর সদস্য ছিলেন। তাই বলে তার জন্য তারা বিচারের মুখোমুখি হননি। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, জার্মানির নুরেমবার্গ বিচারের সময় ২০ গাড়ি ভর্তি দলিলপত্র, সেই সঙ্গে ব্রিটিশ, ফ্রান্স ও রাশিয়া থেকে ও ৩ হাজার দলিল বাছাই করা হয়েছিল। এগুলো সবই ছিল প্রমাণিত। এমনকি আসামিদের স্বীকারোক্তিও ছিল। বাংলাদেশে কতজন রাজাকার আলবদর ছিল কেউ বলতে পারবে না। সেক্টর কমান্ডাররাও সে সংখ্যা উল্লেখ করেননি। শেখ মুজিব মাত্র একবার ছাড়া কোনো সময় যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বলেননি। কেবল মাত্র ১৯৭৩ সালের দ্বিতীয় বিজয় দিবসেই তিনি দেশের কারাগারগুলো থেকে ৩০ হাজার বন্দীকে মুক্তি দেন। এদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল না। মিডিয়ার অনেক টক শোতে শুনেছি আওয়ামী লীগপন্থী অনেক বুদ্ধিজীবী দাবি করেন, দালাল আইন এখনো কার্যকর আছে। কিন্তু দালাল আইন আর যুদ্ধাপরাধের আইন এক নয়। বহু লোককে দালাল আইনে আটক রাখা হলেও আদালতে কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এটা লক্ষ্য করে দালাল আইন রহিত করেন। এটা তার দূরদর্শিতার পরিচয়। অথচ আওয়ামী লীগ কথায় কথায় শহীদ রাষ্ট্রপতিকে দায়ী করে বলেন, তিনিই নাকি যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসিত করেছেন। বরং তার উল্টোটাই সত্য। তিনি বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। তাই সেক্টর কমান্ডারদের কাছে বিনীত প্রশ্নÑ ১.    শেখ হাসিনা ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে এই সমস্ত যুদ্ধাপরাধীর বিচার করলেন না কেন? ২.    আওয়ামী লীগ যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য গোলাম আযমের আশীর্বাদ ও পদধূলি নিয়েছিলেন তখন কি গোলাম আযম যুদ্ধাপরাধী ছিলেন না? ৩.    বিচারপতি নূরুল ইসলামকে আওয়ামী লীগ যেদিন মনোনয়ন দিয়েছিল সেদিন শেখ হাসিনা কি জানতেন না স্বাধীনতা যুদ্ধে তার কী ভূমিকা ছিল? আসলে তারা সবই জানেন ও বোঝেন। কেবল রাজনৈতিক কুমতলবে জাতির স্থিতিশীলতা নষ্ট করার জন্য এরা আজ গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এক্ষেত্রে আমাদের পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশের ভূমিকাও অত্যন্ত আপত্তিকর। তারা আন্তর্জাতিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করে আমাদের দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করেছেন। একেই বলে ভূতের মুখে রাম নাম। কারণ, ১৯৭৪ সালে ৯ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশের যে ত্রিদেশী চুক্তিবলে ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী ও ৯৫ হাজার সৈন্যকে ছেড়ে দেয়া হয়, তার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি এবং সেই চুক্তিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনিই স্বাক্ষর করেছিলেন। সেই চুক্তিতে বলা হয়েছে : ‘The foreign minister of Bangladesh stated that the Government of Bangladesh had decided not to go proceed with the trials as an act of clemency. It was agreed that the 195 war prisoners may repatriated to Pakistan along with other prisoners of war now in the process of repatriation under the Delhi Agreement.' ধরে নিতে হবে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এই বিষয়টিকে মীমাংসা করার জন্যই এই চুক্তি করেছিল। যুদ্ধাপরাধের বিচার সেদিনই শেষ হয়ে গেছে। সত্যি বলতে কী তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সাংবিধানিকভাবে এই চুক্তি স্বাক্ষর করার অধিকারী ছিল না। বিষয়টি নির্ধারণ করার ক্ষমতা ছিল বাংলাদেশের তৎকালীন সংসদের। আজকে কেন সেক্টর কমান্ডাররা এর জন্য ড. কামাল হোসেন বা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের হর্তাকর্তাদের বিচার দাবি করছেন না? তিনি বা তারা তো আইনবিরোধী বলে এই চুক্তির বিরোধিতা করতে পারতেন। করেননি। এখন আবার তিনিই তাদের বিচার চাইছেন। জার্মান এক রণপণ্ডিত যুদ্ধ দেখে বলেছিলেন : অপর কোনো পন্থায় রাজনীতি পরিচালনার নামই যুদ্ধ। ভয় হয়, সেক্টর কমান্ডারদের এই গভীর ষড়যন্ত্র দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে কিনা। ফলত বাংলাদেশ এক অকার্যকর রাষ্ট্র বিদেশে এই প্রচারণা করা সহজসাধ্য হবে। যারা ট্রানজিট ও গ্যাস পাবার প্রত্যাশায় আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে আসছেন তাদের হবে পোয়া বারো। পরিশিষ্ট যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি একটি মহলের নগ্ন রাজনীতির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এই আন্দোলন করেছিল। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী ১৭টি আসনে জয়লাভ করে এবং বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে সরকার গঠন করে। তখন তারা চুপ হয়ে যায়। কারণ আওয়ামী লীগ সত্যিকারভাবে ঐ কমিটিকে আর সহযোগিতা করেনি। এই সত্য প্রকাশ করেছেন খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল। সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইনের এক স্মৃতিচারণমূলক লেখা থেকে জানা যায়, জামায়াতে ইসলামীর পরলোকগত নেতা আব্বাস আলী খান বলেছেন : সাইয়েদ কামরুল আহসান ও আমি একত্রে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলাম (১৯৬২-৬৫)। আমরা উভয়ে একমত ও ধ্যান ধারণার প্রবক্তা ছিলাম। বাংলাদেশ হওয়ার পর কলাবরেটর আইনে আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। তখন তিনি আমার আইনজীবী হিসেবে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন। পিটিশনটি গৃহীত হয়, ফলে কিছুদিন পর আমি মুক্তিলাভ করি। সুতরাং যুদ্ধাপরাধী হিসেবে এই ব্যক্তিকে আবার আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা যাবে কি? যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যা কেবলমাত্র একটি পক্ষের দ্বারা সংঘটিত হয় না। হিংসা প্রতিহিংসার মাধ্যমে এই অপরাধগুলো সংঘটিত হয়ে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত নিরপেক্ষ ইতিহাস এখনো লেখা হয়নি। আমরা বরাবর আওয়ামী লীগপন্থী বুদ্ধিজীবীদের লেখা রাজনীতি প্রভাবিত পক্ষপাতমূলক বক্তব্যই জানতে পারি। সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন তার একটি লেখায় বলেছেন : For over a week before Yahya Khan arrived for the negotiations that preceded the crackdown, men living in the cantonment and their families were denied to access to fresh food, vegetables, fish, meat and milk. The slogan heard of Awamin Leaguers lips we shall starve them to surrender by denying them food and drinks, if this was not act of war, one will need to redefine the term. It is in every sense comparable to the blockade of Britain by Germany and vice versa in the second world war (Bangladesh and Pakistan, the present and the future, a personal statement.  (সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন স্মারক গ্রন্থ, সম্পাদনা; মেসবাহউদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৯৩)। ১৯৭২ সালে ৯-১০ ডিসেম্বর সন্তোষে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির যে সম্মেলন হয় সেখানে মুজিব সরকারকে যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করার জন্য সমালোচনা করা হয়েছিল এই বলে তাহাদের অপরাধ ক্ষমা করিবার কোন এখতিয়ার বাংলাদেশ জনগণ সরকারকে দেয় নাই? আমাদের দেশের একশ্রেণীর পত্রপত্রিকা (মূলত বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা পরিচালিত) জামায়াতে ইসলামীকে নগ্নতার চরমপর্যায়ে এগিয়ে আনার সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন। কারণ তারা ভুলে যান আমাদের সংবিধান কোনো সময় ধর্মভিত্তিক দলকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করার জন্য হুকুম করেনি। এই জন্য তারা বারবার ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলেন। অথচ লক্ষণীয় এ সংবিধান চরমভাবে পরিবর্তিত হলো শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বারা বাকশাল গঠনের মাধ্যমে। এর জন্য কোন সময় তাদের মুখে শেখ মুজিবুর রহমানের সমালোচনা কিংবা বিরূপ মন্তব্য দেখতে পাওয়া যায় না। বর্তমান আওয়ামী লীগ যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার নাটক করছে তার আর একটি উদাহরণ হলো ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্টের পর মার্শাল ল অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে আগের অনেকগুলো আইন বাতিল করা হয়। বলা বাহুল্য, এগুলো বাতিলের বিরুদ্ধে ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম কেউই হাইকোর্টে কোনো ধরনের রিট পিটিশন দাখিল করেননি। এগুলো হলো যথাক্রমে : ক.    ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করা হয়। অর্ডিন্যান্স নং ৬৩, সাল ১৯৭৫। খ.    ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঝSecond Proclamation Order No-3 of 1976  জারি করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাদি তুলে দেয়া হয়। উল্লেখ্য, এই অর্ডিন্যান্সের বলে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চার পথ সুগমন হয়। জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী ও মুসলিম লীগ রাজনীতি করার সুযোগ পায়। অথচ লক্ষণীয় এদের অনেক নেতাই সেই সময় দেশে অবস্থান করছিলেন, কেউ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে এদের বিচার দাবি করেননি। খানে সবুর পাকিস্তানপন্থী ছিলেন কিন্তু তাই বলে দেশপ্রেমিক ছিলেন না এ কথা কেউ বলে না। এমনকি অনেকে সংসদ সদস্যও ছিলেন। গ.    Second Proclamation জারি করে সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে আওয়ামী লীগ কথিত দালালদের ভোটার হওয়ার সুযোগ করে দেয়। এই প্রজ্ঞাপন জারির পর অনেকেই নাগরিকত্ব ফিরে পান। ঘ.    Proclamation Order No-1 of 1977 দ্বারা সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ তুলে দেয়া হয়। এই প্রজ্ঞাপনগুলো এখনো বহাল আছে। অথচ আওয়ামী লীগ আগের টার্মে ক্ষমতায় থাকাকালে কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধুর হত্যকারীদের বিচার করা যাবে না মর্মে সংবিধানের অঙ্গীভূত ঘোষণাটি বাতিল করে। পরে কর্নেল ফারুকুর রহমান এই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করলে বিচারপতি মোজাম্মেল হক তার পক্ষে রায় প্রদান করেন। যার ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ইচ্ছে করলে এই সমস্ত Proclamation বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারতেন। কিন্তু তারা করেননি। আজকে বেশ জোরেশোরে দাবি করেছেন। তার অর্থই হলো নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য আর কোনো উপায় ছিলো না। এবার মিডিয়াকে খুব ভালোভাবে ব্যবহার করার ফলাফলও পেয়েছে। আসল কারণ যে রাজনৈতিক সেটা একজন সাধারণ নাগরিকের বুঝতে বাকি থাকে না। ২০০১ সালে বিএনপি এবং জামায়াত ঐক্যজোট হলো তখন থেকেই শুরু হলো জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে বিষোদগার। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে জামায়াতকে চিহ্নিত করার অপ্রপ্রয়াস শুরু করে। নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ১৭টি আসনে জয়লাভ করলে যুদ্ধাপরাধ বিচার আন্দোলন শেষ হয়ে যায়। ঙ.    ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার অনেক টকশোতে শাহরিয়া কবীরকে বলতে শুনেছি পাকিস্তান বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের জন্য কথিত ১৯৫ জনকে নেয়ার সময় কথা দিয়েছিল তারা নিজেদের আইন অনুযায়ী বিচার করবে। কিন্তু বিচার করেনি। মন্তব্য হিসেবে এটাকে একেবারে বেঠিক বলব না। কিন্তু তিনি কি ১৯৭৪ সালে ৯ এপ্রিল ত্রিপক্ষীয় চুক্তির ১৩ ধারাটি মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন? পড়েননি বলেই মনে হয়। কারণ এই ধারার একেবারে শেষ লাইনে লেখা ছিল। The state minister for defence and foreign affairs of the government of Pakistan said that his goverment condecmned and deeply regretted any crime that may have been committed. আইনের জগতে shall আর সধু-র ব্যবহার নিয়ে বেশ লড়াই চলে। এখন পাকিস্তান সরকার যদি বলে আমরা মনে করছি না কোন ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, তাহলে চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানকে বাধ্য করা যাবে না কথিত ১৯৫ জনের বিচারের জন্য। বলা বাহুল্য, সংসদে এই চুক্তিটি দাখিল করলে অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি ধরা পড়ত। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাচারবশত তা করেনি। চ.    স্বাধীনতা অর্জনের পর সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। সেই সঙ্গে মানুষের মূল্যবোধের ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। বিশেষত দালাল আইন প্রবর্তিত হওয়ার পর সাধারণ নাগরিকরাও এর অপব্যবহার শুরু করে। অনেক নিরপরাধ লোকজন ইচ্ছাকৃতভাবে জেলে যেতে বাধ্য হয়। দেখা যায়, সাধারণ ও তুচ্ছ কারণে একে অন্যকে দলাল পরিচিত করে প্রতিহিংসা বশত মামলা মোকদ্দমাতে জড়াতে থাকে। সেই সময় পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরেছেন কবি আবুল হোসেন তার একটি আত্মজীবনীমূলক রচনায়। কারণ ওখানে শুধুমাত্র ঘটনা নয়, জার্মান সাংবাদিকদের আসল উপলব্ধির কথা। শোনা যাক তৎকালীন সরকারি তথ্য বিভাগের বড় কর্মকর্তা কবি আবুল হোসেনের সেই ভাষ্য : ‘.... মনে হচ্ছিল এ দেশে বোধ হয় দালাল ছাড়া আর কিছু নেই।... একদিন পূর্ব জার্মানির কয়েকজন সাংবাদিক এলেন দেখা করতে। তাদের মধ্যে একজন হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা দেখছি কোলাবরেটর নিয়ে খুব বিপদে পড়েছেন।’ আমি বললাম, ‘ঠিকই ধরেছেন, এ আমাদের এক বিরাট সমস্যা।’ - আমরা কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি এর সমাধান করে ফেলেছিলাম। - তাই নাকি! কী রকম? - আমরা কিছু পালের গোদাকে ধরে নিয়ে এসে পটাপট সবগুলোকে খতম করে দিলাম। তারপর আর কোনো ধরপাকড় নয়, কারও গায়ে হাত দেইনি আমরা। আমাদের অতো সময় কোথায়? অত জেলখানা, বছরের পর বছর ধরে বিচার আচার, অত খোঁজাখুঁজি। দেশের পুনর্গঠনই ছিল তখন আমাদের সবচেয়ে জরুরি কাজ।’ উল্লেখ্য, এই সাপ্তাহিক পত্রিকাটি যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক মহোদয় এই আত্মজীবনীর আসল spirit বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, অ্যাডভোকেট, জজকোর্ট, রাজশাহী

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির