post

রমজান পরবর্তী মাসসমূহে একজন মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য

ড. মুহা: রফিকুল ইসলাম

০৩ জুলাই ২০১৮
রমজান মাস রহমত বরকত এবং নাজাতের সওগাত নিয়ে আমাদের মাঝে এসেছিল। খুব দ্রুত আবার তা চলে গেলো। কিন্তু রেখে গেছে অনেক স্মৃতি। অনেক ভালোলাগার আবেশ। এখনও কিছু খেতে গেলে মন কেঁপে ওঠে, মনে হয় রোজা রেখেছি! আবার একটি বছরের অপেক্ষা! ভাগ্যে আছে কি না মহান আল্লাহ ভালো জানেন। তবে এ মাসে যারা সিয়াম পালন করেছে তারা অনেক ব্যাপারে সরাসরি মহান আল্লাহ এবং রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। আল্লাহ তাআলার সাথে সিয়াম পালনকারীদের সম্পর্কগুলো নিম্নরূপ: ক. মহান আল্লাহর প্রতি যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তাআলা সূরা আল বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে বলেন, হে ঈমানদাগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল।এ থেকে আশা করা যায়, তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলি সৃষ্টি হয়ে যাবে খ. এমন একটি মাসের সাথে আমরা সম্পৃক্ত ছিলাম যে মাসের মর্যাদা সকল মাসের থেকে বেশি এবং হাদিসে যাকে ‘সায়্যিদুস শুহুর’ বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ সে মাসেই আল কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। তিনি সূরা আল বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে বলেন, রমজানের মাস, এ মাসেই কুরআন নাজিল করা হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য পুরোপুরি হিদায়াত এবং এমন দ্ব্যর্থহীন শিক্ষা সংবলিত, যা সত্য-সঠিক পথদেখায় এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়।কাজেই এখন থেকে যে ব্যক্তি এ মাসের সাক্ষাৎ পাবে তার জন্য এই সম্পূর্ণ মাসটিতে রোজা রাখা অপরিহার্য। গ. এমন একটা মাসের সাথে যুক্ত ছিলাম যে মাসে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কিছু কাজ থেকে বিরত থাকলেও রাত্রে কোন কাজ থেকে বিরত থাকার দরকার ছিল না। যা নিম্নোক্ত আয়াতের মাধ্যমেই বলা হয়েছে, ঘ. আমরা এমন একটা মাস অতিক্রম করেছি যে মাসে ছিললাইলাতুল কদর, যা হাজার মাস থেকে উত্তম। সেটাও আল কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। মহান আল্লাহ বলেন, কদরের রাত হাজার মাসের চাইতেও বেশি ভালো, ফেরেশতারা ও রূহ এই রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে নাজিল হয়।এ রাতটি পুরোপুরি শান্তিময় ফজরের উদয় পর্যন্ত।(সূরা আল কদর) রমজান মাসে আমরা অসংখ্য হাদিসের মুখোমুখি হয়েছি। যে সব হাদিসের মাধ্যমে রাসূল সা. মানবতার সফলতার কথা, মানুষের পুরস্কারের কথা, তাদের নিরাপত্তার কথা এমনকি তাদের মুক্তির চূড়ান্ত বয়ান সেখানে বর্ণনা করেছেন। চলুন তার কিছু বর্ণনার সাথে আমরা পরিচিত হই। ক. আমরা এমন মাসের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম যে মাসে বদর যুদ্ধ হয়েছে। ঈমান এবং কুফরের মাঝে সরাসরি সংঘাত হয়েছে এবং চূড়ান্তভাবে ইসলাম বিজয়ী হয়েছে। এ বিষয়ে অনেক আয়াত হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যুদ্ধের কিছু পূর্বে রাসূল সা. এই ক্ষুদ্র কাফেলার বিজয়দানের জন্য অত্যন্ত আবেগঘন এক দোয়ায় বলেন, ইবন আব্বাস রা. বদরের ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, রাসূল সা. তার হাত উঁচু করে বললেন: ‘হে আল্লাহ তুমি যদি এই দলকে ধ্বংস করে দাও তাহলে এই পৃথিবীতে কখনও কেউ আর আর ইবাদত করবে না’।... খ. ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সঙ্গী-সাথীদের এ মর্মে সুসংবাদ শোনাতেন, ‘তোমাদের সমীপে রমজান মাস এসেছে। এটি এক মোবারক মাস। আল্লাহ তাআলা তোমাদের ওপর এ মাসের রোজা ফরজ করেছেন। এতে জান্নাতের দ্বার খোলা হয়। বন্ধ রাখা হয় জাহান্নামের দরোজা। শয়তানকে বাঁধা হয় শেকলে। এ মাসে একটি রজনী রয়েছে যা সহস্র মাস হতে উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো সে যেন যাবতীয় কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো’। নাসায়ী : ২৪২৭; মুসনাদ আহমাদ : ৮৯৭৯; শুআবুল ঈমান : ৩৩২৪ গ. যখন রমজান মাস আসে তখন জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়, শয়তানকে আটক করা হয়। রাসূল সা. বলেছেন, ‘যখন রমজানের প্রথম রাত্রি আগমন করে শয়তান এবং অবাধ্য জিনদের শৃঙ্খলিত করা হয়, জাহান্নামের সকল দরোজা বন্ধ করে দেয়া হয়; খোলা রাখা হয় না কোন দ্বার, জান্নাতের দুয়ারগুলো উন্মুক্ত করে দেয়া হয়; বদ্ধ রাখা হয় না কোন তোরণ। এদিকে একজন ঘোষক ঘোষণা করেন, ‘হে পুণ্যের অনুগামী, অগ্রসর হও। হে মন্দ-পথযাত্রী থেমে যাও’।আবার অনেক ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। আর এমনটি করা হয় রমজানের প্রতি রাতেই’। তিরমিযি : ৬৮২; ইবনমাজা : ১৬৪২; ইবনহিব্বান : ৩৪৩৫ ঘ. এ মাসে যারা সিয়াম সাধনা করছে এবং মহান রবের কাছে কিছু প্রত্যাশা করেছে তাদের দোয়া বিফলে যাবে না। এ সম্পর্কে হাদিসে এসেছে আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন: তিন ব্যক্তির দু‘আ রদ হয় না। ন্যায়বিচারক শাসক, রোজাদার যখন সে ইফতার করে এবং অত্যাচারিত ব্যক্তি যখন সে আল্লাহর কাছে দু‘আ করে..।(তিরমিজি) ঙ. এমন একটি মাসের সাথে আমরা ছিলাম যে মাসে কোন ব্যক্তি ঈমান সহকারে এবং সওয়াবের প্রত্যাশায় রোজা রেখেছে তার সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে নবী সা. বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসে সাওম পালন করবে তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করা হবে। (বুখারি ও মুসলিম) সম্মানীয় পাঠক, আমরা কি কখনও একটিবার হৃদয় দিয়ে ভেবেছি, আমাদের সিয়াম সাধনার পুরস্কার মহান আল্লাহ নিজে প্রদান করবেন! দুনিয়াতে কোন বড় মানুষের হাত থেকে সামান্য প্রাইজ পেলেই তা ছবি আকারে বাঁধাই করে রাখি, কেউ বেড়াতে এলে তাকে দেখাই, সবাই বাহবা প্রদান করে আরো কত কী!! চ. আমরা যারা সিয়াম পালন করেছি তাদের ব্যাপারে রাসূল সা. এর সুমহান ঘোষণা হচ্ছে- আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সা. বলেন “প্রত্যেক আদম সন্তানকে তার নেক আমল দশগুণ হতে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেয়া হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন: তা অবশ্য সিয়ামের প্রতিদান ছাড়া; কারণ সিয়াম আমার জন্য আর আমিই তার প্রতিদান দেবো। কেননা আমার কারণে সিয়াম পালনকারী তারযৌনকার্য ও আহার বর্জন করে থাকে। (বুখারি ও মুসলিম) ছ. বুখারি ও মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আদম সন্তানের প্রত্যেক আমল তার নিজের জন্য একমাত্র সিয়াম ছাড়া, কারণ তা কেবল আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দেবো। সিয়াম ঢাল স্বরূপ। যদি তোমাদের কেউ সিয়াম পালন করে, তাহলে সে যেন অশ্লীল কথা না বলে; যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়, তবে সে যেন বলে, আমি সিয়াম পালনকারী। ওই সত্তার শপথ! যার হাতে আমি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন, নিশ্চয়ই সিয়াম পালনকারীর মুখের না-খাওয়াজনিত গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের চেয়েও অধিক প্রিয়। রোজাদারের জন্য দু’টি আনন্দ রয়েছেÑ একটি যখন সে ইফতার করে, অন্যটি যখন সে তার রব আল্লাহর দিদার লাভ করবে তখন আনন্দ প্রকাশ করবে।” জ. রমজান মাসে যে রোজাদারকে ইফতার করাবে তার এ কাজ তার গুনাহ মাফ এবং জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার কারণ হবে। রাসূল সা. এ ব্যাপারে বলেন: হযরত যায়েদ বিন খালেদ জুহানি রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করালো তাকে রোজাদারের অনুরূপ সওয়াব দান করা হবে।কিন্তুরোজাদারের সওয়াবের কোন কমতি হবে না। (তিরমিজি) অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তিকোন রোজাদারকে ইফতার করাবে তার এ কাজ তার গুনাহ মাফ এবং জাহান্নামের আগুন থেকে তাকে বাঁচাবার কারণ হবে। ঝ. সিয়াম পালনকারীর জন্য কিয়ামতের দিন সিয়াম সুপারিশ করবে।আবদুল্লাহ ইবন ‘আমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘সিয়াম ও কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। সিয়াম বলবে, হে আল্লাহ! আমি তাকে পানাহার ও যৌনাচার হতে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। কুরআন বলবে, হে আল্লাহ! আমি রাতের ঘুম থেকে তাকে বিরত রেখেছি, সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। উভয়ের সুপারিশ কবুল করা হবে।’ (আলবানী, সহীহ আল জামি) আমরা প্রাগুক্ত সকল আয়াত ও হাদিসের সাথে একটি মাস অতিবাহিত করেছি। প্রতেকটা আমলের সাথে যুক্ত ছিলাম। মহান আল্লাহ নিজেই আমাদের পুরস্কার হবেন, এ আশা আমরা অবশ্যই লালন করি। সাওম এবং আল কুরআন আমাদের জন্য মহান আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে এ বিষয়টি সুনিশ্চিত। তাহলে আমাদের আর কোনো চিন্তা নেই। আমাদের কোন শঙ্কা নেই। ইনশাআল্লাহ আমরা নাজাত পেয়ে যাবো। কিন্তু রমজান মাস চলে গেলে আমাদের অবস্থাতো ভিন্ন হয়ে যায়। পরের মাসের প্রথম দিন থেকে আমাদের অধঃপতন শুরু হয়ে যায়। কেন হয়? কারণ, শয়তান আবার অবমুক্ত হয়ে যায়। তার যত বাহিনী আছে তাদের নিয়ে সে বনি আদমের পেছনে শতভাগ লেগে যায়। সে আল্লাহর গোলামদের বিপথগামী করার সকল জাল বিস্তার করে। আমরাও তার জালে আটকে যাই। তাহলে ব্যাপারটা কেমন হলো? মহান আল্লাহ এবং রাসূলের সরাসরি এতো আয়াত এবং হাদীস উপেক্ষিত হয়ে শয়তান জয়ী হয়ে যাবে? মহান আল্লাহর এতো এতো দয়া, রহমত ও মাগফিরাতের ঘোষণা সত্ত্বেও শয়তানের শয়তানিকিভাবে সিয়াম সাধনাকারী মুমিনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে? আমরা যদি প্রকৃত অর্থে রমজান পরবর্তী আবার রমজান পূর্ব মাসের মত হয়ে যাই তাহলে সিয়াম সাধনার শিক্ষা কোথায় গেলো? আমরা পুরো একটি মাস কী অর্জন করলাম? সাওমের মাসের সব প্র্যাকটিস যদি পরের মাস সমূহে বাদ হয়ে যায়, তাহলে আমরা হিপোক্রেট হয়ে গেলাম না? গোপাল ভাড়ের মত স্রষ্টাকে একটু ধোঁকা দেয়া হয়ে গেলনা ?সব নসিহত, সব বক্তব্য, সব মোনাজাত, সব কাকুতি-মিনতি নতুন মাসের পহেলা দিন থেকে বাদ গেল? তাহলে আমরা কি আসলেই রমজানের স্পিরিটে ছিলাম,না অভিনয় করেছিলাম? নাকি একমাস আমল করে সারা বছর আমলহীন থাকার লাইসেন্স পেয়ে গেলাম? নাকি মহান রবের সাথে তামাশা করেছি (নাউজুবিল্লাহ)। অথবা চূড়ান্তভাবে বলতে হবে রোজার মাসে এমন শক্তি অর্জন হয়নি যার মাধ্যমে পরবর্তী মাসগুলোতে শয়তানের সাথে ডিফেন্স করতে পারি। সম্মানীয় ভাই ও বোনেরা আসুন আমরা আবারও গভীর মনোনিবেশ সহকারে একবার ভেবে দেখি, মহান আল্লাহ এবং রাসূল সা. কতগুলোআয়াত আর হাদিস বলেছিলেন আমার আপনারমত রোজাদারের ব্যাপারে? তিনি তো সেই রব যিনি আসমান জমিনের মালিক, তিনি তো সেই যিনি আমাকে আপনাকে ইচ্ছা করলেই মৃত্যু দিতে পারেন, তিনি তো সেই আল্লাহ ইচ্ছা করলেই নিঃস্ব করতে পারেন, তিনি তো সেই রব ইচ্ছা করলে অসুস্থ করে দিতে পারেন, শরীরের শক্তি কেড়ে নিতে পারেন, তিনি সেই রব্বুল আলামিন যিনি ইচ্ছা করলে সন্তান কেড়ে নিতে পারেন, তিনি পারেন আমাদেরসন্তান না দিতে, তিনি পারেন দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিতে, পারেন সবার সামনে অপমান করতে,সুন্দর চেহারা কুৎসিত করে দিতে!! তাহলে কেন কোন জিনিস আমাদের সকলকে রমজান পরবর্তী তার স্মরণ থেকে বাধা দিল? আমরা সকলে পাগল দেখেছি নিশ্চয়? সকলেই কি আজন্ম পাগল ছিলো? সকলেকি আজন্ম বিকলাঙ্গ ছিলো? না বন্ধুরা না! তাহলে আমাদের কোন্ শক্তি আল্লাহ থেকে গাফিল করতে পারে? তিনি তাই আফসোস করে সূরা আল ইনফিতার এর ৬-৮ নম্বর আয়াতে বলেছেন “হে মানুষ! কোন জিনিস তোমাকে তোমার মহান রবের ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলে রেখেছে,যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাকে সুঠাম ও সুসামঞ্জস্য করে গড়েছেন এবং যে আকৃতিতে চেয়েছেন তোমাকে গঠন করেছেন”। অতএব, আমরা কোনভাবেই শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করব না। আমরা শয়তানকে বিজয়ী হতে দেবো না। মহান রবের নির্দেশ মেনে চলবো। রোজা পরবর্তী মাসসমূহে আল্লাহ এবং রাসূল সা. এর পক্ষ থেকে যা করতে বলা হয়েছে, সে সব কাজ করার মাধ্যমে এবং রোজার মাসে অর্জিত তাকওয়ার শক্তি দিয়ে পাপের সকল অন্ধকার দু’পায়ে মাড়িয়ে সিরাতুল মুস্তাকিমের মহাসড়কে উপনীত হবই ইনশাআল্লাহ। রোজার মাসে অর্জিত তাকওয়া পরবর্তী এগারোটি মাসে কার্যকর করার জন্য নিম্নোক্ত আমলসমূহ অত্যাবশ্যকভাবে পালন করার চেষ্টা করতে হবে। শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা আদায় করতে হবে সকল কাজ পূর্ণ এখলাস তথা একমাত্র মহান আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টির জন্য করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন: “আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদাত করে তাঁরই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে।” (সূরা আল-বাইয়্যেনাহ :৫) সময় মত সালাত আদায় করা সিয়াম পালনের সময় যেমন সালাতের গুরুত্ব ছিল, সিয়াম পরবর্তী কোনোভাবেই যেন জামাআতে সালাতের গুরুত্ব হ্রাস না পায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় সালাত মুমিনদের ওপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরয।’ (সূরা নিসা :১০৩) এ বিষয়ে হাদীসে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী! কোন আমল জান্নাতের অতি নিকটবর্তী? তিনি বললেন, সময় মত নামাজ আদায় করা। (সহীহ মুসলিম : ২৬৩ -রমজানের ন্যায় কুরআনুল কারিমের তেলাওয়াত ও তরজমা শিক্ষার কাজ অব্যাহত রাখা -রোজার মাসের ন্যায় কল্যাণকর কাজ বেশি বেশি করা -সালাতুত তাহাজ্জুদ পড়া। -রমাদান মাস ছাড়াও সালাতুত তাহাজ্জুদ পড়ার মধ্যে বিরাট সাওয়াব এবং মর্যাদা রয়েছে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন -ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হলো রাতের সালাত অর্থাৎ তাহাজ্জুদের সালাত’’ মুসলিম] বশি বেশি দান-সদাকাহ করা রমজান মাসের পর অন্যান্য মাসেও বেশি বেশি দান-সাদাকাহ করার জন্য চেষ্টা করতে হবে।বিশেষ করে ইয়াতিম, বিধবা ও গরিব মিসকিনদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ও বেশি বেশি দান খয়রাত করা। হাদীসে এসেছে আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল আর রমাদানে তাঁর এ দানশীলতা আরো বেড়ে যেত’’-আল-বুখারী। মানুষকে দ্বীনের কাজে আহবান করা। রমজানের শিক্ষার আলোকে এ কাজটি অব্যাহত রাখতে পারলে পরবর্তী মাসসমূহে আল্লাহর পথে চলা অত্যন্ত সহজ হয়। শয়তান কম ধোঁকা দিতে পারে। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে- ‘‘ঐ ব্যক্তির চাইতে উত্তম কথা আর কার হতে পারে যে আল্লাহর দিকে ডাকলো, নেক আমল করলো এবং ঘোষণা করলো, আমি একজন মুসলিম’’ (সূরা হা-মীম সাজদাহ :৩৩)। হাদিসে এসেছে, ‘‘ভাল কাজের পথ প্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারী অনুরূপ সাওয়াব পাবে’’ [সুনান আত-তিরমীযি) সর্বদা তাওবাহ ও ইস্তেগফার করা তাওবাহ শব্দের আভিধানিক অর্থ ফিরে আসা, গুনাহের কাজ আর না করার সিদ্ধান্ত নেয়া। এ সিদ্ধান্ত প্রতি মুহূর্তে প্রতি ক্ষণে গ্রহণ করতে হবে। কেননা তাওবাহ করলে মহান আল্লাহ খুশি হন। আল-কুরআনে এসেছে “হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর, খাঁটি তাওবা; আশা করা যায়,তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত।’’ (সূরা আত তাহরীম : ৮)] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “হে মানবসকল! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবাহ এবং ক্ষমা প্রার্থনা কর, আর আমি দিনে তাঁর নিকট একশত বারের বেশি তাওবাহ করে থাকি।” (সহীহ মুসলিম) তবে তাওবাহ ও ইস্তেগফারের জন্য উত্তম হচ্ছে, মন থেকে সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার পড়া, আর তা হচ্ছে, “হে আল্লাহ, তুমি আমার প্রতিপালক, তুমি ছাড়া প্রকৃত এবাদতের যোগ্য কেউ নাই। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ, আর আমি তোমার গোলাম আর আমি সাধ্যমত তোমার সাথে কৃত অঙ্গীকারের ওপর অবিচল রয়েছি। আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট থেকে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমাকে যত নেয়ামত দিয়েছে সেগুলোর স্বীকৃতি প্রদান করছি। যত অপরাধ করেছি সেগুলোও স্বীকার করছি। অতএব, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। কারণ, তুমি ছাড়া ক্ষমা করার কেউ নেই।’’ এর ফজিলত ও মর্যাদার ব্যাপারে বলা হয়েছে: “যে কেউ দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে দিনের বেলা এই দু‘আটি (সাইয়েদুল ইসতিগফার) পাঠ করবে ঐ দিন সন্ধ্যা হওয়ার আগে মৃত্যু বরণ করলে সে জান্নাতবাসী হবে এবং যে কেউ ইয়াকিনের সাথে রাত্রিতে পাঠ করবে ঐ রাত্রিতে মৃত্যুবরণ করলে সে জান্নাতবাসী হবে।’’ (সহীহ আল বুখারী) গরিব, মিসকিন ও অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের খাদ্য খাওয়ানো। মহান আল্লাহ আল কুরআনে বলেছেন: আর আল্লাহর মহব্বতে মিসকিন,ইয়াতিম এবং বন্দীকে খাবার দান করে । (সূরা আদ-দাহর: ৮) এ বিষয়ে হাদিসে বলা হয়েছে, ‘‘আবদুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, একজন লোক এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইসলামে উত্তম কাজ কোনটি? তিনি বললেন, অন্যদেরকে খাবার খাওয়ানো এবং পরিচিত ও অপরিচিত সকলকে সালাম দেয়া।’’ (আল-বুখারী ) আল্লাহর যিকর বা স্মরণ করা বেশি বেশি মহান আল্লাহকে স্মরণ করা ও তাসবিহ পাঠ করা। সময় পেলেই সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ,লা ইলাহা ইল্লাল্লা, আল্লাহু আকবার,পড়া।এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ‘‘আল্লাহ তা’আলা চারটি বাক্যকে বিশেষভাবে নির্বাচিত করেছেন, তাহলোসুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ,লা ইলাহা ইল্লাল্লা, আল্লাহু আকবার যে ব্যক্তি সুবহানাল্লাহ পড়বে, তার জন্য দশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর বিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহু আকবার পড়বে, তার জন্য বিশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর বিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়। যে ব্যক্তিলা ইলাহা ইল্লাল্লা পড়বে, তার জন্য বিশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর বিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবেআলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিনপড়বে, তার জন্য ত্রিশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর ত্রিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়’’। (মুসনাদ আহমাদ ) প্রত্যেক সপ্তাহর সোমবার এবং বৃহস্পতিবার রোজা রাখা। হাদিসে এসেছে এসব দিনে ব্যক্তির আমল মহান আল্লাহর কাছে পৌঁছানো হয়। -আইয়ামে বিজের রোজা রাখা। অর্থাৎ আরবি মাসের ১৩,১৪ এবং ১৫ তারিখ সিয়াম পালন করা। -কোন অন্যায় কাজ করার ইচ্ছা মনে আসলে আল্লাহ এবং রাসূল সা. এর সাথে প্রাগুক্ত সম্পর্কগুলো অবশ্যই স্মরণ করার চেষ্টা করা। মূলত যিনি সিদ্ধান্ত নিবেন রোজার মাসের শিক্ষা এবং তাকওয়া অবশ্যই বাকি এগারোটি মাস বহন করবেন, লালন এবং পালন করবেন মহান আল্লাহ অবশ্যই তার নিয়তকে পরিপূর্ণ করবেন। আর যিনি অবহেলা করবেন, তিনি অবশ্যই শয়তানের কাছে পরাজিত হবেন। রোজার তাকওয়া এবং শিক্ষা তাকে বাঁচাতে পারবে না। এজন্য আমরা মহান আল্লাহর ওপর দৃঢ় আস্থা রেখে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো যে, রোজার মাসে মহান আল্লাহর রহমতে যে সকল ব্যাপারে শয়তানকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছি, সে সকল ব্যাপারে কোনোভাবেই শয়তানকে আর বিজয়ী হতে দিব না। আল্লাহ তা‘আলা এ সিদ্ধান্তে অটল থাকার তৌফিক দান করুন। লেখক: বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির