post

রাজরাক্ষসদের কবলে অর্থনীতি

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

০৭ মার্চ ২০২২

দেশ থেকে বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। কিন্তু চলতি দশকে দেশ থেকে অর্থপাচারের মচ্ছব চলছে। কোনোভাবেই এর লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছে না বা রহস্যজনক কারণেই এসব অর্থনীতির রাজরাক্ষসদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জন্য রীতিমতো অশনিসঙ্কেত হলে সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি নিয়ে খুবই উদাসীন ও নির্বিকার। ফলে আমাদের ভঙ্গুর জাতীয় অর্থনীতি আরও হীনবল হতে শুরু করেছে। দেশ জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের এই অশুভবৃত্ত থেকে বেরিয়ে আশা উচিত।

বিষয়টি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের গোচরে আসার পর মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ঘটনার সাথে জড়িত গুরুতর অভিযুক্তদের নামের তালিকা মহামান্য আদালতে জমা দেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। মূলত, দেশে-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেশ থেকে অর্থপাচারের চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং আর সে প্রতিক্রিয়ার প্রতি সম্মান দেখিয়ে আদালত এই তালিকা তলব করেন, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করেছে।

সম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত ৬৯ বাংলাদেশির তথ্য হাইকোর্টে দাখিল করেছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (BFIU)। সুইস ব্যাংকসহ বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরানো তথ্যও দেয়া হয়েছে। হাইকোর্টের দেয়া অর্থপাচারকারীর তালিকায় যাদের নাম এসেছে তাদের অধিকাংশ সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। তবে বিরোধী রাজনীতির সাথে জড়িত কারো কারো নামও রয়েছে এই তালিকায়, যা বিষয়টিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।

এর আগে বাংলাদেশ থেকে বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংক বিশেষ করে সুইস ব্যাংকসহ সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, দুবাই ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১২ ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৩১০ কোটি ৮০ লাখ ১৪ হাজার ৭৪৮ টাকা পাচারের তথ্য দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (CID)। গত বছরের ১৭ অক্টোবর হাইকোর্টে এ প্রতিবেদন দেয় সিআইডি। অপরদিকে প্রতিবেদনে দাখিলের জন্য আরও সময় নেয় বিএফআইইউ এবং দুদক। এর পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি বিএফআইইউ তাদের প্রতিবেদন হাইকোর্টে জমা দিয়েছে, যা আমাদের দেশ থেকে অর্থপাচারের ভয়াবহতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।

মূলত, দেশ থেকে বিদেশে অর্থপাচার অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। অর্থপাচার রোধে দেশে প্রয়োজনীয় আইন ও বিভিন্ন সংস্থা ক্রিয়াশীল থাকলেও তা কোন কাজে আসছে না। ফলে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগকে এজন্য হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। বিদেশে অর্থপাচার রোধে সক্রিয় বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU) গত পাঁচ বছরে বিদেশে অর্থপাচারের এক হাজার ২৪টি ঘটনা চিহ্নিত করতে পেরেছে বলে দাবি করেছে। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরেই ঘটেছে অর্ধেকের বেশি ঘটনা। এসব ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চিঠি পাঠিয়েছে বিএফআইইউ। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১১৬টি অর্থপাচারের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫২টি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬৭৭টি, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১২১টি ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ঘটেছে ৫৮টি অর্থপাচারের ঘটনা। এর বাইরে গত পাঁচ অর্থবছরে দুই হাজার ২৯০টি অর্থপাচার ঘটনার তথ্য সরবরাহ করেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, বাংলাদেশ পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করেছে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো। কারণ, পাচারকারী এতই অর্থবিত্তের মালিক ও প্রভাবশালী যে আইনও তাদের কেশাগ্র পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারেনি। যা দার্শনিক সক্রেটিসের কথায় স্মরণ করিয়ে দেয়। তার ভাষায়, ‘যার টাকা আছে তার কাছে আইন খোলা আকাশের মত, আর যার টাকা নেই তার কাছে আইন মাকড়সার জালের মত’!

অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িতদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আমলা এবং রাজনীতিক বলেই মনে করা হয়। এর বাইরে রয়েছে সন্ত্রাস ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অশুভ চক্র। প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয় তা দেশে বিনিয়োগ করা গেলে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হতে পারতো। কিন্তু পাচারকারীরা দেশ ও জাতির কথা চিন্তা না হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য লাগামহীনভাবে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। আর রাষ্ট্র বা প্রশাসন কোন ভাবেই এদের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না।

বাংলাদেশ থেকে অনিয়ন্ত্রিত অর্থপাচারের বিষয়টি নিয়ে কোনো বিতর্কও নেই। তবে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে কিভাবে এবং কারা বেশি অর্থপাচার করেন এ নিয়ে। অনুসন্ধানে জানা যায়, কেউ অর্থপাচার করছেন আন্ডার-ইনভয়েসিং (দাম কম দেখিয়ে পণ্য রফতানি) এবং ওভার-ইনভয়েসিংয়ের (আমদানিতে দাম বেশি দেখিয়ে) নামে। কেউ পাচার করেন অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে, যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জন্য অশনিসঙ্কেত। সম্প্রতি দেশ থেকে অর্থপাচারকারীদের তালিকা প্রকাশের দাবি উঠেছে জাতীয় সংসদে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে-সে প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত। কারণ, ভূতটা যে সর্ষের মধ্যেই। ফলে বিষয়টি এখন রীতিমতো উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। যার প্রমাণ মিলেছে সুইস ব্যাংকের উপাখ্যান থেকে। সম্প্রতি সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশিদের পাঁচ হাজার ২৯১ কোটি টাকা জমা রয়েছে। যার সিংহভাগই দেশ থেকে পাচার হয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। তবে বাংলাদেশি কাদের অর্থ সুইস ব্যাংকে জমা রয়েছে, সেই তালিকা প্রতিবেদনে প্রকাশ করেনি সুইস ব্যাংক।

সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পাহাড় জমেছে। ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী সুইস ব্যাংকে জমা অর্থের পরিমাণ ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ফ্র্যাংক, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৫ হাজার ২৯১ কোটি টাকা। (প্রতি সুইস ফ্র্যাংক ৯৪ টাকা হিসাবে)। আগের বছরের চেয়ে এই আমানত ৩৭৭ কোটি টাকা কমেছে। অর্থাৎ ওই বছর ২০১৯ সালে ছিল ৫ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান, যা রীতিমতো উদ্বেগের। যদিও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সুইস ব্যাংক মূলত তাদের প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকা বিদেশিদের আমানতের তথ্য প্রকাশ করে। অবশ্য বাংলাদেশি আইনে কোনো নাগরিকের বিদেশি ব্যাংকে আমানত রাখার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত কাউকে বিদেশে অর্থ জমা রাখার বিশেষ অনুমোদনও দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া কোনো প্রবাসীও সরকারকে জানাননি যে তিনি সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রেখেছেন। ফলে সুইস ব্যাংকে জমা পুরো অর্থই দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে খোদ অর্থমন্ত্রীর আত্মস্বীকৃতি মিলেছে। তিনি মনে করেন, ‘দেশে একটি গ্রুপ আছে যারা লোভে পড়ে দেশ থেকে অর্থ পাচার করছে। এসব অপরাধীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। এজন্য বিদ্যমান আইনের কিছু ক্ষেত্রে সংশোধন করা হচ্ছে। কিছু নতুন আইনও করা হচ্ছে। এ উদ্যোগের ফলে পাচারকারীদের ধরা সহজ হবে এবং আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া যাবে।’ কিন্তু বিষয়টি এখন পর্যন্ত মন্ত্রীমহোদয়ের কথামালার ফুলঝুরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অবৈধভাবে উপার্জিত, আন্ডার-ইনভয়েসিং এবং ওভার-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার করা হচ্ছে দেদার। শুধু সুইস ব্যাংকই নয়, অন্য দেশেও অর্থপাচারের ঘটনাও নেহাত কম নয়। একথা কারো অজানা নয় যে, কানাডায় অর্থপাচারের মাধ্যমে বেগমপাড়া গড়ে তোলা হয়েছে। আর বিশে^র বিভিন্ন দেশে এ ধরনের বেগমপাড়ার সংখ্যা কত সে পরিসংখ্যান কারো জানা নেই।

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (PRI) বক্তব্য হচ্ছে, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মুদ্রা পাচার হয়। এ ছাড়া নিরাপত্তাহীনতা, বিনিয়োগ ঝুঁকির কারণেও অর্থপাচার হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত রাষ্ট্রে অর্থপাচার হয়ে থাকে। এগুলো সমাধান করলে টাকা পাচার বন্ধ হবে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে বিষয়টির ভিন্নতর ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, এই টাকার পুরোটা পাচার নয়। এর মধ্যে সুইজারল্যান্ডে যারা কাজ করছে তাদের আমানত রয়েছে। সে ক্ষেত্রে নতুন তথ্য প্রকাশের পর পরই বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য সংশ্লিষ্টদের অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়েছে। কিন্তু সার্বিক বিষয়গুলো এখন পর্যন্ত চর্বিত-চর্বণ বলেই মনে হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সুইস ব্যাংক এখন রীতিমত বাংলাদেশ ব্যাংকে পরিণত হয়েছে। বিদেশী ব্যাংকে আমানতের আঙ্গিক, ধরন ও প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বিশাল স্থিতি নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০২০ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানতের স্থিতি ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ফ্র্যাংক, আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে যা ছিল ৬০ কোটি ৩০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৮ সালে ৬১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৭ সালে ছিল ৪৮ কোটি ১৩ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৬ সালে ৬৬ কোটি ১৯ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৫ সালে ৫৫ কোটি ৮ লাখ ফ্র্যাংক, ২০১৪ সালে যা ছিল ৫০ কোটি ৬০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৩ সালে ৩৭ কোটি ২০ লাখ ফ্র্যাংক, স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। ২০১২ সালে ছিল ২২ কোটি ৯০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১১ সালে ছিল ১৫ কোটি ২০ ফ্র্যাংক। স্বর্ণালঙ্কার, শিল্পকর্ম এবং অন্য মূল্যবান জিনিসপত্র জমা রাখলে তার আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে আমানতে যোগ হয় না। তাই এই স্থিতি আরও বেশি হবে বলেই সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

অবশ্য প্রতিবেদন অনুসারে আলোচ্য সময়ে বিশ্বের সব দেশের আমানত বেড়েছে। আলোচ্য বছরে সুইজারল্যান্ডের ২৫৬টি ব্যাংকে আমানতের স্থিতি দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে ছিল এক লাখ ৩০ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। এ হিসাবে এক বছরে আমানত বেড়েছে ৬ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। এ ছাড়া ২০১৮ সালে যা ছিল এক লাখ ২৭ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। ২০১৭ সালে ছিল এক লাখ ৩৫ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। এ ছাড়া ২০১৬ সালে ছিল এক লাখ ৩২ হাজার কোটি। ২০১৫ সালে সুইস ব্যাংকে বিদেশিদের মোট আমানত ছিল এক লাখ ৩৩ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। ২০১৪ সালে ১ লাখ ৩৮ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। ২০১৩ সালে ছিল ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি, ২০১২ সালে ছিল ১ লাখ ২৯ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। এ ছাড়া ২০১১ সালে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি, ২০১০ সালে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি এবং ২০০৯ সালে ছিল ১ হাজার ৩৩ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোরও আমানত কমেছে। আলোচ্য সময়ে উন্নয়নশীল দেশের আমানতের স্থিতি ছিল ১৬ হাজার ৪৬০ কোটি ফ্র্যাংক, আগের বছর যা ছিল ১৬ হাজার ৯৮৬ কোটি ফ্র্যাংক। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের প্রায় সমান। একক বছর হিসাবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ১৫১ কোটি ডলার পাচার হয়, দেশীয় মুদ্রায় যা প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে চারটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।

জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চারটি প্রক্রিয়ায় এই অর্থপাচার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি মূল্য বেশি দেখানো (Over Invoicing), রফতানিতে মূল্য কম দেখানো (Under Invoicing), হুন্ডি ও অন্য মাধ্যমে বিদেশে লেনদেন এবং ভিওআইপি ব্যবসা। এ ছাড়া টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ২০ শতাংশই কোনো না কোনোভাবেই পাচার হচ্ছে। অর্থপাচারের তথ্য এসেছে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপির রিপোর্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজে প্রকাশিত পানামা ও প্যারাডাইস পেপারসে।

মূলত, দুর্নীতি ও চোরাচালানের মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। ওইসব টাকায় দুর্নীতিবাজরা বিদেশে সম্পদ গড়ে তুলছেন, জমা রাখছেন বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। এর বাইরে আরও অনেক ব্যাংকে বাংলাদেশের পাচারকারীদের অর্থ রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এর আগে মালয়েশিয়ার সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বিদেশির জন্য মালয়েশিয়ান সরকারের সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী। দেশ থেকে বিদেশে কোনো অর্থ নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু এ পর্যন্ত কাউকে ব্যাংক থেকে এই ধরনের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তার পরও বাংলাদেশ মালয়েশিয়ায় কিভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ হলো? কানাডায় রয়েছে বাংলাদেশি অধ্যুষিত অঞ্চল বেগমপাড়া। এ ছাড়া ব্রিটেনে, হংকং, সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন ব্যাংকেও বাংলাদেশিদের অর্থ রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

মূলত, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও ব্যর্থতা ও আইনের ভঙ্গুর প্রয়োগের কারণেই দেশ থেকে অর্থপাচার এখন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় রাষ্ট্র বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খুব একটা সাফল্যের পরিচয় দেয়নি। রাষ্ট্রের কার‌্যাবলি সম্পর্কে অধ্যাপক উইলোবি (Willoughby) বলেন, ‘এটি সর্বজনস্বীকৃত যে, রাষ্ট্রের আয়ত্তে প্রচুর ক্ষমতা থাকা উচিত, যার দ্বারা রাষ্ট্র বৈদেশিক হস্তক্ষেপ প্রতিহত করে স্বীয় অস্তিত্ব বাজায় রাখতে; জাতীয় জীবনের সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি করার সুযোগ দিতে পারে এবং জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি রক্ষাসহ অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বিধান করতে পারে।’

মূলত, লাগামহীন অর্থপাচার, দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রতিরোধে রাষ্ট্রের হাতে প্রচুর ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণেই এসব ক্ষমতা যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না। ক্ষেত্রবিশেষে অপপ্রয়োগ হওয়ার জোরালো অভিযোগ রয়েছে। ফলে অনেকটা অযাচিতভাবে বিষয়টি নিয়ে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। বস্তুত, আমাদের জাতীয় অর্থনীতি এখন রীতিমত রাজরাক্ষসদের কবলে পড়েছে। তাই দেশে লাগামহীন দুর্নীতি ও বেপরোয়া অর্থপাচার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বরং পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতিই হচ্ছে। এমতাবস্থায় দেশের অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলেও অবিলম্বে অর্থপাচারের লাগাম টেনে ধরতে হবে। বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগসহ প্রয়োজনমত নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করে পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় অর্থপাচারসহ রাজরাক্ষসদের দৌরাত্ম্য কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না। বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবেন ততই দেশ ও জাতির মঙ্গল।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির