post

রাষ্ট্রদ্রোহিতার মোকাবেলা এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই । হারুন ইবনে শাহাদাত

০১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

রাষ্ট্রদ্রোহিতার মোকাবেলা এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই । হারুন ইবনে শাহাদাতস্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন- এই অতি প্রাচীন সত্যটি কি বিগত ১০ বছরে জনগণ ভুলে গেছে? নাকি ঘুম পাড়ানি গান শুনিয়ে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। এই ভুলে যাওয়ার কারণ হয়তো এখন তাদেরই শাসন চলছে যারা নিজেদেরকে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলে দাবি করেন। দ্বিতীয় কারণ স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য সাধারণত প্রথম হুমকি মনে করা হয় প্রতিবেশী আগ্রাসী কোন বড় দেশকে। কিন্তু বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রতিবেশী সেই দেশটি। তৃতীয় কারণ সেই প্রতিবেশীরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মিত্রশক্তি। তাই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য কোনো দুশ্চিন্তার আর প্রয়োজন নেই। চতুর্থ কারণ যারা বিশ্বাস করতেন পিন্ডির শিকল থেকে দেশ মুক্ত হলেও দিল্লির শিকলে বন্দী হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাদের শীর্ষ নেতাদেরকে বিশেষ কায়দায় দুনিয়া থেকে বিদায় করা হয়েছে। যারা বেঁচে আছেন তাদের কেউ জেলখানায় বন্দী, নয় তো মামলার জালে দিশেহারা। তাই এখন আর কে জাতিকে বিভ্রান্ত করতে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন এই গুজব ছড়াবে? এমন ‘সুসময়ে’ দেশপ্রেমিক রাজনৈতিকগুলো তাদের সমর্থকদের নিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। এই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালেন প্রিয়া সাহা নামের একজন সচেতন মহিলা। তিনি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে বিশ্বমোড়ল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সামনে উপস্থিত হয়ে নালিশ করেছেন। এই ঘটনার পর কয়েক দিনের জন্য কিছুটা হলেও টনক নড়েছিল। রাজপথ গরম না হলেও সোস্যাল মিডিয়ায় বিতর্কের তুফান উঠেছিল। এই ঝড় থামলো দেশে শিশু নির্যাতনের প্রতিক্রিয়ায় কল্লাকাটা গুজব এবং গুজবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় গণপিটুনির চাপ এবং অতি উচ্চ জায়গা থেকে ধমক আসার পর। দেশ যখন নানান গুজবে ভাসছে তখন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সরকারের কাছে প্রশ্ন রাখলেন- কোনটা গুজব? ডেঙ্গু যে মহামারীতে পরিণত হয়েছে- এটা কি গুজব? নারীদের প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করা হচ্ছে, এটা কি গুজব? শিশু নির্যাতন কি গুজব? শেয়ারবাজার থেকে এক সপ্তাহে ২৭ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে, এটা কি গুজব? ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট, সেখান থেকে অর্থ লুটপাট করে খালি করে ফেলা হয়েছে, এটা কি গুজব? গুম খুন হত্যা মিথ্যা মামলা এটা কি গুজব? নির্বাচনের পূর্বে ভোট চুরি, এটা কি গুজব? সংবিধান লঙ্ঘন করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হজ পর্যবেক্ষণে সৌদি আরব গেছেন, কোনটি গুজব? তিনি নিজেই উত্তর দিলেন, সরকার তাদের সব ব্যর্থতাকে গুজব বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। কারণ তাদের কাছে গুজব বলে উড়িয়ে দেয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ নাই। আজকে সব কিছুতেই তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন এই ব্যর্থতার ফিরিস্তি এখন স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ধরে টান দিয়েছে বলে মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। ইতিহাস পর্যালেচনা করলে দেখা যায়, জনসমর্থনকে পাশ কাটিয়ে ভিন্ন-দেশী শক্তির মদদে যারাই ক্ষমতায় এসেছেন তারা কেউ স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারেননি। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাহকে যেসব বিশ্বাসঘাতক ক্ষমতাচ্যুত করেছিলো, তারা ক্ষমতার মসনদে বসলেও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেনি। তারা শুধু ক্ষমতাই হারাননি সাথে সাথে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সেই বিশ্বাসঘাতকদের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে শুধু বাংলা বিহার উড়িষ্যা নয় গোটা ভারতবর্ষ স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব হারিয়েছে। ক্ষমতার মোহে যারা ব্রিটিশ বেনিয়াদের সহযোগিতায় করেছেন, শেষ পর্যন্ত তারা পুতুল রাজা, বাদশা, নবাব,সম্রাট হয়েও ক্ষমতা রক্ষা দূরের কথা জীবন বাঁচাতেও ব্যর্থ হয়েছেন। তারপরও যুগে যুগে ক্ষমতালোভী শাসকরা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী শক্তির পা চাটা গোলামে পরিণত হয়, জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে ক্ষমতা দখল করে। কারণ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো কেউ ইতহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। স্প্যানিশ দার্শনিক জর্জ সান্তায়নার (১৮৬৩-১৯৫২) ভাষায়, "Those Who Do Not Learn History Are Doomed To Repeat It." Really?"অর্থাৎ যারা ইতিহাস থেকে শিখবে না তাদের নিয়তিও আগের ওদের মতোই হবে, এটাই বাস্তবতা। সম্প্রতি এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যার কারণে এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সেই সব ঘটনার প্রভাবে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার কথা উঠলেও অদৃশ্য কারো ধমক কিংবা ইশারায় তা হারিয়ে গেছে। উচ্চকণ্ঠগুলোকে থামিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এদেশে এরচেয়ে অনেক ছোটখাটো ঘটনায় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার মুখোমুখি হওয়ার উদাহরণ আছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ারও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা থেকে ছাড় পাননি। যদিও আইনজীবীরা মনে করেন তাঁর বিরুদ্ধে যে কারণে মামলা হয়েছে, সেই কারণে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হতে পারে না। বেগম খালেদা জিয়া ছাড়াও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, জামায়াত নেতা ডা: সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, বরিশাল মহানগর জামায়াতের আমির অ্যাডভোকেট মোয়াযযম হোসাইন হেলাল, নায়েবে আমির বজলুর রহমান বাচ্চু, সেক্রেটারি জহিরউদ্দিন বাবর, সহকারী সেক্রেটারি মতিউর রহমান, প্রচার সম্পাদক শাহ আলমসহ সাতক্ষীরা ও অন্যান্য কয়েকটি জেলার বিএনপি-জামায়াতের আঞ্চলিক নেতাদের বিরুদ্ধেও এমন মামলার একাধিক খবর মিডিয়ায় এসেছে। আওয়ামী লীগের সরকারের এক দশকের শাসনকালে বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে কয়েক ডজন রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়েছে। যদিও আইনজ্ঞদের দাবি সরকারের বিরোধিতা কিংবা সরকারের সমালোচনা রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে না। এ প্রসঙ্গে মিজানুর রহমান খান গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে দৈনিক প্রথম আলোতে লিখেছেন, ‘ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নতুন করে আবারও বলেছেন, সরকারের সমালোচনা করা আর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ করা এক নয়। সরকার পরিচালনায় কোনো এক বা একাধিক দল থাকে। নানা কারণে তাদের কাজের সমালোচনা করার দরকার পড়ে। কিন্তু সহনশীলতার ঘাটতি দেখা দিলে সরকারগুলো তা সহ্য করতে চায় না। তাই তারা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার প্রবণতা দেখিয়ে থাকে। তারা সরকার ও রাষ্ট্রের পার্থক্য রাখতে চায় না। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের মতো ভারতেও এই ক্ষতিকর প্রবণতা প্রকট রূপ নিয়েছে। ৬ সেপ্টেম্বর (২০১৬ সালের) ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, সরকারের সমালোচনা রাষ্ট্রদ্রোহ নয়। এ কথা এবারই প্রথম উচ্চারণ করেননি তাঁরা। ভারতে একটি বিষয় দেখা যায়, সর্বোচ্চ আদালত অত্যন্ত দরকারি কথা বারংবার বলেন। আদর্শ অবস্থান হলো, এক কথা তাঁরা একবারই বলবেন। সর্বোচ্চ আদালত যা বলে দেবেন, সেটাই আইন। কিন্তু বহু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দেখতে পাই, তাঁরা এক কথা বারংবার বলেন। এবং গণমাধ্যমগুলো সেসব খবর এমনভাবে প্রকাশ করে, যা দেখে বা শুনে আনকোরা কারও মনে হবে, এটা বুঝি তাঁরা এই প্রথম বললেন। অনুমান করি, প্রায় একই কথা বারংবার বলা এবং গণমাধ্যমে তা মোটা হরফে শিরোনাম হওয়ার কারণে সমাজে ও সরকারের ভেতরে সচেতনতা ও সংবেদনশীলতা তৈরি হয়। আর এটাই সব থেকে কার্যকর ও শক্তিশালী রক্ষাকবচ সৃষ্টি করে। উপমহাদেশের যেসব সমাজে এর যত বেশি ঘাটতি, সেখানে এ ধরনের কালাকানুনের নির্দয় ও বেপরোয়া প্রয়োগ কখনো কখনো ভয়াবহ রূপ নিতে দেখা যায়। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মোকাবেলা এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই । হারুন ইবনে শাহাদাতসরকারের সমালোচনা যে রাষ্ট্রদ্রোহ নয় এবং রাষ্ট্রদ্রোহ যে ঔপনিবেশিক প্রভুদের শোষণের হাতিয়ার ছিল, সেই সত্য ১৯৬২ সালে কেদারনাথ সিং বনাম বিহার মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পরিষ্কার করেছিলেন। এটা ভারতের গণতন্ত্র ও রাজনীতিকদের জন্য গৌরবের কথা নয় যে তাঁরা সেই রায়ের আলোকে আজ পর্যন্ত ১২৪ক ধারায় (রাষ্ট্রদ্রোহের শাস্তির বিধান) একটি প্রগতিশীল পরিবর্তন আনতে পারেননি। আবার একই সঙ্গে এটাও সত্য, ভারতের রাজনীতিবিদেরা অন্তত তাঁদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা দায়ের করার অধিকারকে স্বীকার করেছেন; সহনশীলতা দেখিয়েছেন। রাষ্ট্রদ্রোহের হাতিয়ার দিয়ে যখনই সরকার কারও মুখ বন্ধ করতে এবং নিপীড়ন চালাতে বড় বেশি রকমের মাত্রা অতিক্রম করতে চেয়েছে, তখনই নাগরিক সমাজ শিরদাঁড়া খাড়া করেছে। দরখাস্ত হাতে ছুটে গেছে সুপ্রিম কোর্টে এবং উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রে তারা অন্তত একটা প্রতিকার পেয়েছে।’ সরকারের সমালোচনা, কিংবা সরকার পরিবর্তনে জনমত গঠনকেও রাষ্ট্রদ্রোহ বলে গণ্য করা হয় না। কারণ বিরোধী রাজনৈতিক দল সরকারের সমালোচনা করবে, সরকার পরিবর্তন করে নিজেরা জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে গণতান্ত্রিক রাজনীতির এটাই রীতি। এক্ষেত্রে ভারতের আদালতের একটি রায় উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যায়, ‘রাম নন্দন নামের বিহারের এক লোক ‘জাতিকে বিভক্ত’ করার জন্য নেহরুকে বিশ্বাসঘাতক বলেছিলেন। হুমকি দিয়েছিলেন দিনমজুরদের চরম দারিদ্র্য নিরসনে ব্যর্থ সরকারের উৎখাতে দরকার হলে তিনি আর্মি গঠন করবেন। তিনি রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত হলেন। সুপ্রিম কোর্ট রাম নন্দনের দণ্ড মওকুফ করলেন। সেই ১৯৫৮ সালেই উচ্চ আদালতের রায়ে বাকস্বাধীনতার জয় হয়েছিল। (প্রথম আলো, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬) এর দ্বারা প্রমাণিত হলো সরকারের বিরুদ্ধে যত কঠিন কর্মসূচির কথা বলা হোক না কোন, তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে না। রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং যুদ্ধ ঘোষণা রাষ্ট্রদ্রোহিতা। যারা বাংলাদেশের সীমানা মুছে দিয়ে ১৯৪৭ সালের ভুলের সংশোধন করতে চায় ও অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে তাদের ব্যাপারে নীরব থাকলেও বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা থেমে নেই বলে অভিযোগ রাজনীতি বিশ্লেষকদের। তাদের এই অপতৎপরতা সম্পর্কে রাজনীতি বিশ্লেষক গৌতম দাস লিখেছেন, ‘গত ২০০৮ সালে ক্ষমতা নেয়ার সময় এ ব্যাপারে শেখ হাসিনা কিছু ভুল করেছিলেন। গত বছর নির্বাচনের আগে, বছরের শুরুর দিকে তিনি আরো কিছু মারাত্মক ভুল অনুমানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেসব ভুলের কি পুনরাবৃত্তি ঘটবে? এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে উঠে আসছে। তবে শেখ হাসিনা যদি তার বাবাকে ঠিক ঠিক পাঠ করেন তাহলে তিনি ভুল করবেন না, এই এক সরল ক্লু এখানে আছে। আগামী দিনের ইতিহাসে কি বাংলাদেশে হিন্দুত্বের রাজনীতি আনার ও একে তৎপর হতে দেয়ার দায় শেখ হাসিনার ওপর আসবে? নাকি এর আগেই তিনি পদক্ষেপ নিতে মাঠে নেমে যাবেন? আড়ালে এত দিন তৎপর থাকা এসব নানান প্রশ্ন এখন প্রিয়া সাহা ও তার বন্ধুদের হাতে পড়ে পুরো সমাজকে অস্থির চঞ্চল করে, সবাইকে কান খাড়া অ্যাটেনশন দিতে বাধ্য করে ফেলেছে। এতে আপাতত প্রিয়া সাহার সার্কেলের প্রায় সবাই সব ‘দায় প্রিয়ার’ বলে সব অস্বীকার করে আপাতত খামোশ হয়ে গেলেও হিন্দু মহাজোটের গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক আপাতত প্রধান প্রবক্তা, বীর হয়ে থাকতে চাইছেন। আর বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা আসলে অদৃশ্যপূর্ব ঘটনা যে, কোনো হিন্দু ব্যক্তিত্বের আচরণে অন্য হিন্দু ব্যক্তিত্ব বা সংগঠন ঘোষণা দিয়ে তার দায় নিতে অস্বীকার করছেন। ফ্যাক্টস হচ্ছে, বাংলাদেশে ট্র্যাডিশনাল হিন্দু রাজনীতি হলো পুরনো জমিদার হিন্দুর জমিদারি আর সামাজিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক হেজিমনি বা কর্তৃত্ব হারানোর দুঃখ থেকে জাত। এমন দুঃখ কমবে বা মিটবে কী করে, এর চিন্তার ওপর দাঁড়ানো। কিন্তু আজব ব্যাপারটা হচ্ছে, বাংলার সাধারণ আম-হিন্দুরা পুরনো জমিদারের জমিদারি হারানোর দুঃখকে নিজে বেখবরে থাকার কারণে এটা নিজেদেরই ‘দুঃখ’ মনে করে বসে আছে। এটাই আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার একটা দিক। যার অন্য দিকটা হলো, আমাদের উপমহাদেশের ভারত-বাংলাদেশ ও পাকিস্তান- এ তিন দেশে কোথাও নাগরিক বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়তে কেউ সক্ষমতা দেখাতে পারেনি। বৈষম্যহীন নাগরিক-সাম্য, মানুষের মর্যাদা আর ন্যায়বিচারে নিশ্চিত হয়নি। ধর্ম বা যেকোনো পরিচয় নির্বিশেষে সব নাগরিককে সমান চোখে দেখা হবে, বৈষম্য হতে দেবে না- এই নীতিতে রাষ্ট্র গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি, ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি আইডিয়াই রাজনীতিক বা অ্যাকাডেমিক সমাজেও স্পষ্ট হয়ে পৌঁছেনি। এ ছাড়া কী দেখলে একটা রিপাবলিক রাষ্ট্রকে চেনা যায়, এর প্রধান বৈশিষ্ট্য কী ইত্যাদি এসব ধারণা স্বচ্ছ না তো বটেই। ওই দিকে সেকুলারিজম বলে এক ধারণা এসে জায়গা নিয়েছিল। যদিও এই ইসলামবিদ্বেষী সেকুলারিজম বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠী নিজেদের জন্য এক রক্ষক ধারণা মনে করত, অনেকে করে এখনো। এর সাথে অবশ্যই ১৬৪৮ সালের প্রথম ‘ক্লাসিক সেকুলারিজম’ ধারণার কোনো সম্পর্কই নেই। তবুও ভারতে এই ইসলামবিদ্বেষী সেকুলারিজম ধারণার পপুলারিটি আরো বেশি। অথচ এই সেকুলারিজম ভারতের কনস্টিটিউশনে ঢুকানো হয়েছে ইন্দিরার হাতে ১৯৭৬ সালে, মানে ১৯৪৯ সালে ভারতে কনস্টিটিউশন গৃহীত হওয়ারও ২৭ বছর পরে। এখন আমরা প্রশ্ন করতে পারি, এর মানে কি প্রথম ২৭ বছর ভারত সেক্যুলার রাষ্ট্র ছিল না! ইন্দিরা গান্ধীসহ কারো কাছেই এর জবাব কী, কখনো শোনা যায়নি। আবার মোদির আমলে এসে ভারতের কনস্টিটিউশনে সেক্যুলারিজম লটকানো থাকলেও মোদির রাজত্বে কেউ ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে রাজি না হলে তার মাথায় কোপ দিতে মোদির কোনোই অসুবিধা হচ্ছে না। কারণ, এসব কাণ্ড দেখে বোঝার উপায় নেই যে, ভারতে কোনো সুপ্রিম কোর্ট অথবা কোনো নির্বাচন কমিশনার বলে কিছু আছে নাকি নেই। কারণ, এরা পুরোপুরি অ্যাকশনবিহীন। এর কারণ এরা সম্ভবত সমাজে থাকে না। অথবা না হয় তারা আরএসএসে যোগ দিয়েছে তাই, ‘জয় শ্রীরাম’ বলানোর ধ্বনি তাদের কানে পৌঁছাচ্ছে না। অথবা এ-ও হতে পারে তারা এটা অনুমোদন করেছে। এই হলো এখনকার ভারতে সেক্যুলারিজমের নমুনা। সেটি যাই হোক, বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠী নিজেদের এখন খুবই চালাক লোক বলে ভাবছে। তারা আর এখন তত সেক্যুলারিজম জপে না। তাদের এখনকার নেতা আর মণি সিংহ কমিউনিস্ট বা পঙ্কজ ভট্টাচার্যের ন্যাপ পার্টি না। তাদের নেতা এখন আরএসএস নেতা গোবিন্দ প্রামাণিক; যে নেতা বলছেন, হিন্দুরা এখন ‘ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশেরই নাগরিক’ থাকবে, আর এক ‘অখণ্ড ভারতের’ পক্ষে কাজ করে যাবে। এ ছাড়া অবস্থা এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যেন লীগ-বিএনপি কোনো দলের বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসতে গেলে ভারতের অ্যাপ্রুভাল লাগবে, এটা তারা মেনেই নিয়েছে। তাই সেই লোভে লীগ-বিএনপি কার আগে কে কত বেশি তাড়াতাড়ি হিন্দু মহাজোটকে খাতির করবে, ৬০ আসন দেবে ইত্যাদি নিয়ে প্রতিযোগিতা লেগে গেছে। আমরা এমন দেউলিয়া জায়গায় পৌঁছে গেয়েছি।’ (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২৭ জুলাই ২০১৯) এই ধারা অব্যাহত থাকলে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা কতটা সহজ হবে সেই বিবেচনার ভার পাঠকদের ওপরই থাকলো। রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সঙ্কটকালে সকল রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার সাথে সাথে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াইয়েও আপসহীন ভূমিকা পালন করতে হবে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির