post

রাসূল সা.

এর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দূরদর্শিতা মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন

০৭ অক্টোবর ২০২০
রাসূলুল্লাহ সা.-এর আবির্ভাবের পূর্বকালীন যুগে গোটা বিশ্বসহ আরবের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত নৈরাজ্যমূলক, বিশৃঙ্খলাপূর্ণ এবং ভয়াবহ। গোত্রতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জোর যার মুল্লুক তার এ সন্ত্রাসবাদী নীতিতেই তদানীন্তন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ হতো। গোত্রকলহ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মারামারি, হানাহানি লেগেই থাকত। কেন্দ্রীয় শাসন বা নিয়ন্ত্রণ বলে কিছু ছিল না। রাজনৈতিক এমনই শোচনীয় দুর্দিনে আবির্ভূত হলেন মানবতার মুক্তির দিশারি হযরত মুহাম্মাদ সা.। তিনি নৈরাজ্যপূর্ণ আরব ভূমিতে যে অবিস্মরণীয় রাজনৈতিক বিপ্লব সাধন করেছিলেন তা বিশ্বের ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। কোমের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর আলী বেহরুজী বলেছেন, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সা.-এর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর এই জীবন ছিল কল্যাণকামিতা ও মহৎ গুণাবলিকেন্দ্রিক। তাঁর শাসনপদ্ধতির লক্ষ্য ছিল মানুষের উন্নতি ও মানবীয় গুণাবলির বিকাশ সাধন। রাসূলে পাক সা. এর সমস্ত রাজনৈতিক আচরণ এ লক্ষ্যেই কেন্দ্রীভূত ছিল। তাঁর মানবীয় গুণাবলির মধ্যে দয়া, উদারতা, আন্তরিকতা, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা, বিভিন্ন বিষয় স্বচ্ছকরণ এবং সত্য ও ন্যায়বিচারকে সমুন্নত রাখার মত প্রভৃতি গুণ ছিল বিশ্বনন্দিত। মদিনায় হিজরতের পর পরই রাসূল সা. আনসার এবং মুহাজিরদের মধ্যে ঐক্যের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন। ভবিষ্যৎ ইসলামী রাষ্ট্র কাঠামোর জন্য এ ঐক্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান। রাসূল সা. একই সাথে সামাজিক বৈষম্য তথা ভেদাভেদ সম্পূর্ণ রহিত করাসহ ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সাম্য ও সমতার নীতি চালু করেন। ফলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করেও ইহুদি, খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিক আরবরা একই রাষ্ট্রের অভিন্ন অধিবাসীতে পরিণত হয়। ক্ষেত্র বিশেষে অমুসলমানগণ আরব, ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা ভিন্ন আচরণ লাভ করে। যাহোক, রাসূল সা. একদিকে অব্যাহত বিজয়াভিযান অন্য দিকে নয়া ইসলামী রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা কাঠামোর দিকে তার সদা সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিলেন। এ কারণেই আরবের গোত্রশাসিত এলাকার প্রচলিত প্রথা ভেঙে দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। এক সময় তা সমগ্র আরব উপদ্বীপে সম্প্রসারিত হয়ে কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থার আওতাধীনে স্থাপিত হয়ে এক নজিরবিহীন উদাহরণ সৃষ্টি করে। মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের অভিজ্ঞতা আরববাসীদের জীবনে সেই প্রথম। রাসূল সা. রাজনৈতিকভাবে একজন দূরদর্শী ব্যক্তি ছিলেন। নি¤েœ তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কিছু দিক উল্লেখ করা হলো- সকল ক্ষমতার উৎস আল্লাহ তায়ালা সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ নয় বরং আল্লাহ তায়ালা। তিনি সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। তিনি ছাড়া অন্য কোন মানবীয় ও অমানবীয় শক্তির পক্ষ থেকে নির্দেশ বা ফয়সালা দান করার কারোর অধিকার নেই। এই নীতিতে রাসূল সা. তাঁর রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। পৃথিবীতে তাঁর এ সার্বভৌমত্ব প্রয়োগের জন্য তিনি নিজেই মানুষকে খলিফা হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। আল-কুরআনে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: ‘‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনবে ও নেক আমল করবে, তাদের সাথে আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে, তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে প্রতিনিধি বানাবেন ঠিক যেভাবে তাদের পূর্বে অন্যদেরকে প্রতিনিধি বানিয়েছিলেন।’’ (সূরা আন নূর : ৫৫) রাসূলুল্লাহ সা. এই সার্বভৌমত্বের ওপর ভিত্তি করে মদিনায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনি এ রাষ্ট্রে আইন, শাসন, সমাজ, ব্যক্তি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিক ও বেসামরিক প্রভৃতি সেক্টরে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে দশ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এ সার্বভৌমত্বের বাইরে কোন নাগরিক অবস্থান করতে পারেনি। তিনি রাষ্ট্রের জনগণকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আল্লাহ রিযিকদাতা, সকল ক্ষমতার মূল উৎস। কেবলমাত্র তাঁর সার্বভৌমত্বেই নিহিত রয়েছে মানুষের মুক্তি, শান্তি ও প্রগতি। মানুষ মানুষের দাস হতে পারে না, কারো গোলামিও করতে পারে না। কেবল দাসত্ব ও গোলামি আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। আল্লাহ তাঁর সার্বভৌমত্ব প্রয়োগকারী হিসেবে তাঁর প্রতিনিধি বা খলিফা নিযুক্ত করেছেন। আর আল্লাহই হলেন এই প্রতিনিধির নিয়ামক শক্তি। তাই কোন ব্যক্তি বা রাষ্ট্রনায়ক নিজেদের খেয়াল-খুশিমত আইন প্রণয়ন করার অধিকার রাখে না। পরামর্শভিত্তিক রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা রাসূলে কারীম সা. রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে মজলিসুস শূরা বা পরামর্শ সভা গঠন করেন। মজলিসুস শূরা গঠনে রাসূল সা. একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তাহলো এ পরামর্শ সভাকে গতিশীল ও সার্বজনীন করার জন্য মদিনার বাইরে এমন কি আরবীয় গণ্ডির বাইরের কয়েকজনকে এর সদস্যভুক্ত করেন। মুহাজির ও আনসারী বিজ্ঞ সাহাবী ছিলেন এ সভার অন্যতম সদস্য। রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ, প্রশাসনিক কাঠামোর রূপরেখা দান, শাসন প্রণালী প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ শূরা নির্ণয় করত। তিনি মজলিসে শূরার সদস্যদের সাহাবীগণের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করতেন এবং তাদের পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। তবে কুরআন তাকে যে অলঙ্ঘনীয় ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছে তার প্রেক্ষিতে তিনি সেসব পরামর্শ গ্রহণ বা বর্জন করার এখতিয়ার রাখতেন। তিনি সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শ করার পর যে মতটি অধিক সঠিক ও কল্যাণকর মনে করেছেন সেটিই গ্রহণ করেছেন। সম্প্রদায়গত স্বার্থ, ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ক প্রশ্নে প্রতিনিয়ত পরামর্শ সভা চলত। সে পরামর্শের ভিত্তিতে তিনি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হযরত সালমান ফারসির পরামর্শক্রমে খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খনন এবং তায়েফে অভিযান চলাকালে অবরুদ্ধ শত্রুদের বিরুদ্ধে মিনজানিক ব্যবহার করা সংক্রান্ত পরামর্শ রাসূল সা. বিনাবাক্যে গ্রহণ করেন। রীতি পরামর্শনীতি অনুসরণ করেই মদিনায় মসজিদে নববীর স্থান নির্বাচন এবং মুয়াখাতের (ভ্রাতৃত্ববোধ) রীতি প্রচলিত হয়। রাসূল কারীম সা. কোন কোন সময় পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়ার পর সার্বিক কল্যাণের কথা চিন্তা করে কৌশলগত কারণে তা পরিবর্তন করতেন। যেমন ঐতিহাসিক তথ্যাবলী থেকে জানা যায় যে, খায়বার অভিযানকালে কয়েকটি নির্দিষ্ট ধরনের গাছ কেটে ফেলা সম্পর্কে আল-হুবাব ইবনুল মুনযিরের রা. পরামর্শ রাসূলে কারীম সা. মেনে নিলেও পরবর্তী পর্যায়ে হযরত আবু বকরের রা. ভিন্নতর পরামর্শে তিনি উক্ত সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেন। ঘটনাক্রমে কুরআন উভয় মতের যথার্থতা ও উপযোগিতার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করে। রাসূলে কারীম সা. কোন কোন ক্ষেত্রে পরামর্শদাতাদের পরামর্শ শুনেছেন কিন্তু সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনা ও সময়োপযোগী কৌশল অবলম্বন করে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করেননি। অমুসলিমদের সাথে সহাবস্থানের কৌশল রাসূলুল্লাহ সা. এর রাষ্ট্রব্যবস্থায় অমুসলিম সংখ্যালঘুদের সঙ্গে সম্পর্ক ও সহাবস্থানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। তিনি মদিনায় হিজরতের পর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতি স্থাপন করে এক তুলনাবিহীন রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি রাজনৈতিক ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এবং মুসলিম ও অমুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ভিত্তিতে সহনশীলতার মনোভাব গড়ে তোলার জন্য একটি সনদ প্রণয়ন করেন। এ প্রণীত এ সনদ পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সনদ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। তিনি এর মাধ্যমে তৎকালীন বিশ্বে ধর্ম ও রাজনীতির সমন্বয়ে যে ইসলামী উম্মাহ প্রতিষ্ঠা করেন, উত্তরকালে তা বিশাল ইসলামী সা¤্রাজ্যের মহীরুহে পরিণত হয়। তিনি এ সনদ প্রণয়নে যে কৌশল অবলম্বন করেন তাহলো মদিনার বিভিন্ন অমুসলিম সম্প্রদায়কে প্রাথমিকভাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সহায়ক শক্তিতে পরিণত করা এবং তাদের ও মুসলমানদের সহাবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করা। যাতে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। তিনি এ সনদের মাধ্যমে যে মহানুভবতা ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পরিচয় দেন তা বিশ্বের ইতিহাসে সত্যই বিরল। তিনি রাসূল সা. মুসলমানদের সাথে অমুসলিমদের সহাবস্থান এবং জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা এবং নিজ নিজ ধর্ম পালনে স্বাধীনতা দান করেন। তিনি ঘোষণা দেন, কারো ধর্ম মতে কোনরূপ অসম্মান করা যাবে না এবং সকলেই পরস্পর ভাই ভাই হিসেবে সহাবস্থান করবে। সংখ্যালঘু অমুসলিমদের অধিকারের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তিনি উদাত্তকণ্ঠে ঘোষণা দেন যে, ‘‘যে লোক কোন যিম্মিকে কষ্ট দিবে আমি তার প্রতিবাদকারী হব। আর আমি যার প্রতিবাদকারী হব, কিয়ামতের দিন তার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াব।’’ মদিনায় ঐক্যের বন্ধন গড়ার জন্য বিভিন্ন চুক্তি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সা. নবুওত লাভের পর বিশ্ববাসীর কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্যে প্রথমে তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন ও চারপাশের জনগণের কাছে এবং এরপর মক্কা নগরীর সবার কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেন। পরবর্তীকালে মদিনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তিনি তাওহিদ বা একত্ববাদের বাণী বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে দেয়ার পদক্ষেপ নেন। বিশ্বনবী সা. মুসলমানদের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন ও তাদের কল্যাণের জন্যে প্রথমে ইসলামী রাষ্ট্রের ভেতরে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ চুক্তি স্বাক্ষর করেন এবং মদিনার বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন গড়ে তোলেন। মদিনায় ইহুদিরা ছিল নানা দিক থেকে শক্তিশালী। ফলে মদিনাবাসী ও ইহুদিদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদন করা ছিল খুবই জরুরি। প্রথমবারের মতো তিনি একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এই গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিকে ‘মদিনার সনদ’ বলা হয়। এটি ছিল পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান। মদিনার সনদে স্পষ্টভাবে স্বীকার করা হয় যে সব রকমের বিবাদ মীমাংসার জন্য মহানবী সা.-এর শরণাপন্ন হতে হবে। রাসূলে পাক সা. মদিনা সনদে সরকারের সাথে জনগণের সম্পর্ক ও জনগণের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করেন এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতা সংহত করেন। মদিনা সনদের মাধ্যমে বুঝা যায় যে রাসূল সা. রাজনৈতিকভাবে কী রকম দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। মদিনাকে অভ্যন্তরীণ ও বাইরের হুমকি থেকে নিরাপদ রাখার কৌশল এরপর তিনি মদিনাকে অভ্যন্তরীণ ও বাইরের হুমকি থেকে নিরাপদ রাখার ওপর জোর দেন। মদিনার নতুন সরকার-কাঠামোয় রাসূল সা.-এর চিন্তাগত, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপগুলো মুসলিম উম্মাহর শক্তি ও ঐক্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে তাঁর প্রচেষ্টার নিদর্শন। তিনি সব সময় সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। আর এ বিষয়টি পররাষ্ট্রনীতি ও বিরোধীদের মোকাবেলার ক্ষেত্রে বিশ্বনবী সা. এর ডিপ্লোমেসি বা কৌশল ও গতিশীলতা বৃদ্ধি করতো। বিশ্বনবী সা. বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের জন্যে সে যুগের অন্যান্য দেশের সরকার ও সা¤্রাজ্যগুলো সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখতেন। আওস ও খাজরাজ গোত্র ছিল পরস্পরের ঘোর শত্রু। তিনি তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে অভ্যন্তরীণ সব সমস্যার সমাধান করেন। যাতে মদিনার ভিতর হতে কেউ কোন গোলযোগ সৃষ্টি করতে না পারে। প্রতিরক্ষা ও সমর কৌশল যে কোন নবগঠিত রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা চিরকাল একটি জটিল সমস্যা বলে চিহ্নিত হয়ে থাকে। রাসূল সা. এ সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অপূর্ব অসম সাহসিকতা, ও অপূর্ব দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। মদিনায় মাত্র দশ বছরের জীবনে তাকে ছোট বড় তিরাশিটি অভিযান পরিচালনা করতে হয়। এর মধ্যে সাতাশটিতে তিনি নিজেই সেনাপতির ভূমিকা পালন করেন। অবশ্য এর মধ্যে মাত্র নয়টি যুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাত ঘটে। এবং এর প্রত্যেকটিতেই এসব যুদ্ধে বিজয় অর্জন রাসূলের সা. অপূর্ব যুদ্ধকৌশলের বারতা বহন করে। রাসূলের জীবনে সংঘটিত এই যুদ্ধগুলো ছিল প্রতিরক্ষামূলক। কেননা তিনি যুদ্ধবাজ ছিলেন না। ছিলেন না সা¤্রাজ্যবাদী। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে হামলাও করেননি তিনি; বরং শত্রুপক্ষের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বাতিল শক্তির বহুবধি হুমকি ও বিপদের মুখে মদিনার শিশু ইসলামী রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্য তিনি রাসূল সা. একদিকে যেমন দক্ষ সামরিক সংগঠন ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলেন। অতি অল্প সময়ে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে এ সংগঠন যথারীতি এক উন্নত সেনাবাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অপরদিকে তেমনি এক অভিনব রণকৌশল অনুসরণ করেন। ফলে তিনি তার এ সেনা সংগঠনের সহযোগিতায় সমগ্র আরব উপদ্বীপ তাঁর পদানত হয়। রাসূল সা. রণক্ষেত্রে অভিনব কৌশল অনুসরণ করেন। মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের সামরিক সংগঠন রাসূলের সা. জীবনকালের এক দশক সময়কালের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে যথারীতি এক উন্নত সেনাবাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। রাসূল সা. কোন অভিযান প্রেরণকালে তিনি কমান্ডারদেরকে অভিযানের সহায়ক দিকনির্দেশনা এবং এর কৌশল ব্যাখ্যা করতেন। তিনি রণক্ষেত্রে যে সমস্ত কৌশল অবলম্বনের নির্দেশ দিতেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ১. চুক্তি সম্পাদন কৌশল : রাসূল সা. মদিনায় হিজরতের পর প্রথম যে সামরিক দক্ষতার পরিচয় দেন তা হলো মদিনায় নেতৃস্থানীয়দের সাথে সামরিক চুক্তি স্থাপন করেন। এ চুক্তির মাধ্যমে মদিনার চতুর্দিকে এক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি হয়। ২. উপযুক্ত স্থান নির্বাচন : হিজরতের পর প্রথম কাফিরদের সঙ্গে যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন তা ছিল বদর যুদ্ধ। রাসূল সা. স্থান নির্বাচনের জন্য মদিনার উত্তরে না গিয়ে দক্ষিণে মক্কার দিকে অগ্রসর হলেন এবং শত্রুদের পথ রোধ করে বদরকে নির্বাচন করলেন। যা পরবর্তীতে শত্রুদের ওপর অতর্কিত হামলা চালানোর কাজেকে সহজ করেছিলো। ৩. ইবাদতের রাত্রি জাগরণ : বদর যুদ্ধে রাতে দৃশ্য আমরা দেখি শত্রু শিবিরের সবাই নাচ-গান, মদে লিপ্ত থাকলেও, মুসলিম বাহিনীর সেনাপ্রধান ইবাদতের মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ করে আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করেন। ৪. পরিখা খনন : খন্দক যুদ্ধে রাসূল সা. পরিখাটি এতখানি চওড়া করে খনন করেন যে, একটি দ্রুতগামী ঘোড়াও লাফ দিয়ে তা অতিক্রম করতে পারবে না। আবার তা ৩-৪ ফুট গভীরে থাকায় কেউ পড়ে গেলেও সেখান থেকে উঠে আসা সম্ভব ছিল না। ৫. যুদ্ধের ময়দান পর্যবেক্ষণ : বদর যুদ্ধে পাহাড়ের চূড়ায় ছোট্ট একটি কুঁড়েঘর তৈরি করা হলো, যাতে নবী গোটা যুদ্ধের ময়দান পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। সেনাপ্রধানের দায়িত্ব তিনি এখান থেকে পালন করতেন এবং যা ছিল কাফেরদের দৃষ্টির বাইরে। ৬. মুক্তিপণ ধার্য : যুদ্ধ-পরবর্তী সময় যুদ্ধবন্দীদের কাছে মুক্তিপণের ব্যবস্থা করা হলো, যাতে মুসলমানদের আর্থিক ভিত্তি মজবুত হয়। ৭. যুদ্ধ-পরবর্তী কাফেরদের গতিবিধি লক্ষ্য : যুদ্ধ শেষে কাফিরদের গতিবিধি সম্পর্কে খোঁজ নেয়ার জন্য কয়েকজন সৈন্য পাঠালেন। তিনি বলে দিলেন যদি তারা উটের পিঠে সাওয়ার হয় তাহলে ওরা ফিরে যাবে মক্কায় আর যদি ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে গেলে বুঝতে হবে ওদের গন্তব্যস্থল হবে মদিনা। ৮. বন্দী বিনিময় : যুদ্ধপরবর্তী সময়ে মুসলিম বন্দীদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য বন্দী বিনিময় করেন। হুদায়বিয়ার সন্ধি : রাজনৈতিক বিজয় রাসূল সা. পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে হুদায়বিয়ার সন্ধি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত হয়। এই ঘটনার ফলে ইসলামী আন্দোলন এক লাফে সার্বজনীনতার পর্যায়ে সম্প্রসারিত হবার সুযোগ পায়। এই ঘটনা দ্বারা রাসূল সা.-এর সর্বোচ্চ রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার প্রমাণ। নিকৃষ্টতম ও নিষ্ঠুরতম যুদ্ধরত শত্রুকে তিনি কত সহজে সমঝোতা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং কয়েক বছরের জন্য তাদের হাত বেঁধে দিয়েছেন, হুদায়বিয়ার চুক্তি তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। ঐতিহাসিক ড. গ্রেফটাউলি “অংরন ঈরারষরুধঃরড়হ” গ্রন্থে লিখেছেন, “ইসলামের যে উম্মি নবীর ইতিবৃত্ত বহু আশাজনক। তৎকালের কোন বৃহৎ শক্তি যে জাতিকে নিজের আওতায় আনতে পারেনি, সে উচ্ছৃঙ্খল জাতিকে তিনি তাঁর আওতায় বশীভূত করেছেন।” রাসূল সা. এই চুক্তির মাধ্যমে সকলের মধ্যে একটি সেতুবন্ধ তৈরি করলেন। তিনি এই চুক্তির মাধ্যমে এ আদর্শের সত্যতা, মানবপ্রেম, ধৈর্য ও প্রজ্ঞার এক ঐতিহাসিক উপমা, মানব সমাজের কাছে হাজির করলেন। সুতরাং ইসলামের দাওয়াত সর্বমহলে ছড়িয়ে দিতে হুদায়বিয়ার সন্ধি এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। মূলত এই সন্ধির মাধ্যমে ইসলামের রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। রাজনৈতিক গুরুত্বের দিক থেকেও এর রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব। রয়েছে অনাগত মুসলিম উম্মাহর করণীয় নির্ধারণে করণীয় নির্দেশনা। এই সফর একদিকে ধর্মীয় সফর ছিল। অপর দিকে এতে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দিকও ছিল অন্তর্ভুক্ত। এ যেন পর্যায়ক্রমে ফুলের কলি থেকে প্রস্ফুটিত হয়েছে ফুলের মত। সকল মানব পেয়েছে এর সুগন্ধি। কিন্তু এর আগ থেকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ব্যতীত কারো জ্ঞানই যেন তা উপলব্ধি করতে পারেনি। হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তসমূহ যখন নির্ধারিত হচ্ছিলো তখন মুসলমানদের পুরা বাহিনী অত্যন্ত বিচলিত বোধ করেছিলেন। এ সন্ধির ফলে যে বিরাট কল্যাণ অর্জিত হতে যাচ্ছিলো তা দেখতে পাওয়ার মত দূরদৃষ্টি কারোরই ছিল না। কিন্তু মুহাম্মাদ সা.-এর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মের মাধ্যমে হুদাইবিয়ার সন্ধির মাত্র তিন মাস পরেই ইহুদিদের সবচেয়ে বড় দুর্গ খায়বার বিজিত হয় এবং তারপর ফাদাক, ওয়াদিউল কুরা, তায়ামা ও তাবুকের মত ইহুদি জনপদেও একের পর এক মুসলমানদের কর্তৃত্বাধীনে চলে আসে। হুদাইবিয়ার সন্ধি এভাবে মাত্র দু’বছরের মধ্যে আরবে শক্তির ভারসাম্য এতটা পাল্টে দেয় যে, কুরাইশ এবং মুশরিকদের শক্তি অবদমিত হয়ে পড়ে এবং ইসলামের বিজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। জবাবদিহিতামূলক রাজনৈতিক তৎপরতা রাসূলুল্লাহর সা. রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ছিল, শাসন, কর্তৃত্ব এবং তাঁর ক্ষমতা ইখতিয়ার ও এবং অর্থ-সম্পদ আল্লাহ এবং মুসলমানদের আমানত। আল্লাহর ভীরু, ঈমানদার এবং ন্যায়পরায়ণ লোকদের হাতে তা ন্যস্ত থাকবে। কেউ ইচ্ছামত বা স্বার্থবুদ্ধি প্রণোদিত হয়ে এ আমানতের খিয়ানত করার অধিকার রাখে না। এ আমানত যাদের হাতে সোপর্দ করা হবে তারা এর দায়িত্ব পালন সম্পর্কে জবাবদিহি করতে বাধ্য। রাসূলুল্লাহর সা. সরকার কাঠামোতে ও প্রশাসনিক পরিমণ্ডলে সরকারি যাবতীয় কার্যক্রমের জবাবদিহির প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি দায়িত্বশীলদেরকে জবাবদিহিতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সাবধান তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় নেতা যিনি সকলের উপর শাসক হন তিনিও দায়িত্বশীল। তাঁকেও তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।’’ (বুখারী) রাসূল সা.-এর কূটনৈতিক দূরদর্শিতা ইসলামের আগমনের আগে আরবসহ গোটা বিশ্ব নৈতিক অবক্ষয়ের তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছিল। মহানবী সা.-এর বিদেশি রাজদরবারে সাময়িকভাবে দূত প্রেরণের দৃষ্টান্ত স্মরণাতীতকাল থেকেই প্রচলিত আছে। সুতরাং রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নবী করিম সা. বিভিন্ন সময় দেশে দেশে দূত বা কূটনৈতিক প্রতিনিধি প্রেরণ করতেন। আল্লাহর নবী সা.-এর অনুমতি পেয়ে মুসলমানরা আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। মুসলমানদের দলকে ফিরিয়ে আনার জন্য কুরাইশরা উদ্যোগ নেয়। তারা আবিসিনিয়ায় গিয়ে সেখানকার বাদশাহ নাজ্জাশিকে প্ররোচিত করেছিল। কুরাইশদের এ দুরভিসন্ধি বানচাল করার উদ্দেশ্যে নবী করিম সা. পদক্ষেপ নিলেন। দ্বিতীয় হিজরিতে তিনি আমর বিন উমাইয়া আদ-দামরিকে আবিসিনিয়ায় দূত হিসেবে (বর্তমান ইথিওপিয়া) প্রেরণ করেন। রাসূলের সা. রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং তা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপকতা লাভ করে। তার যে দল এ ইসলামী আন্দোলন পরিচালনার সৌভাগ্য লাভ করেছিল তা শ্রেষ্ঠ দল হিসেবে সারা পৃথিবীর ও সর্বকালীন মানবজাতির কল্যাণার্থে আবির্ভূত হয়েছিল। সমগ্র মানবজাতিকে সত্য, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, ইনসাফ ও সৌভ্রাতৃত্বের বিধান বাস্তবায়নের পথপ্রদর্শক বানানো হয়েছিল। শুধু আরবদের সংস্কার সংশোধন এবং তাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংঘবদ্ধ করাই তাঁর চূড়ান্ত ও সর্বশেষ লক্ষ্য ছিল না; বরং তার লক্ষ্য ছিল একটি ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করা এবং যাবতীয় উপায় উপকরণকে কাজে লাগিয়ে সারা পৃথিবীর সকল জাতি ও দেশকে ইসলামী বিধান বাস্তবায়নের আহবান জানানো। ঐ রাজতান্ত্রিক যুগে আল্লাহর যে কোটি কোটি বান্দা ছোট ছোট শ্রেণী ও পরিবারের গোলামির যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিল, যাদের না ছিল বিচার স্বাধীনতা, না ছিল অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এবং না ছিল কোন রাজনৈতিক অধিকার। তাদের নির্যাতিত নিষ্পেষিত অবস্থা সম্পর্কে কোন সংস্কারমূলক আন্দোলন কিভাবে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে। পারস্য স¤্রাটের কাছে লেখা চিঠিতে রাসূল সা. নিজেই স্বীয় দাওয়াতের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলকে এই বলে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন যে, ‘‘আমি সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে আল্লাহর প্রেরিত দূত বা রাসূল।’’ রাসূল সা. সমকালীন রাজা বাদশাহদেরকে চিঠি লিখতে গিয়ে একদিকে তিনি যেমন প্রচলিত রীতিনীতি মেনে চলতেন, অর্থাৎ সিল মারার জন্য আংটি তৈরি করান এবং তাতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ শব্দটা খোদাই করান। অপরদিকে তেমনি নিজের একটা স্বতন্ত্র রীতি ও পদ্ধতি চালু করেন। প্রত্যেক চিঠি বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম দিয়ে শুরু করতেন। অতএব প্রেরক হিসেবে নিজের নাম এবং যাকে চিঠি পাঠান তার নাম লেখাতেন। অতঃপর ন্যূনতম, অত্যন্ত মাপাজোখা ও সতর্ক ভাষায় বক্তব্য তুলে ধরতেন। সেই যুগের প্রেক্ষাপটে যে কূটনৈতিক ভাষা তিনি চিঠির জন্য অবলম্বন করেন তা রাসূলের সা. মানসিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ বহন করে। যেমন তিনি এ সব চিঠিতে অতি সংক্ষেপে এ বাক্যটি ব্যবহার করেন যে, ‘‘ইসলাম গ্রহণ করুন শান্তি পাবেন।’’ এর আরো একটি অর্থ এও হতে পারে হয় যে, আনুগত্য করুন শান্তি পাবেন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সা.-এর সমস্ত রাজনৈতিক চিঠিতে শান্তিকামিতা, নৈতিক শিক্ষা ও ন্যায়বিচারের শিক্ষা এবং ইসলামী দয়াশীলতার ছাপ ছিল অত্যন্ত জোরালো। রাসূল সা.-এর চিঠি নিয়ে যেসব সাহাবায়ে কেরাম দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন: আমর বিন উমাইয়া যামরীর হাবশার স¤্রাট নাজ্জাশির কাছে, হাতেব বিন আবু বালতা মিশরের স¤্রাট মোকাওকিসের কাছে, আব্দুল্লাহ বিন হোযাফা সাহমী পারস্য স¤্রাট খসরু পারভেজের নিকট, দেহইয়াহ কালবী রোমের স¤্রাট কায়সারের নিকট, আলা ইবনে হায্রামী বাহরাইনের গভর্নর মুনযির বিন সাভীর নিকট, সালিত বিন আমর আমেরী ইয়ামামার গভর্নর হাওযা বিন আলীর নিকট, শোজা বিন অহাব দামেশকের গভর্নর হারেস বিন আবি শামর গাসসানীর নিকট, আমর বিন আস আম্মানের স¤্রাট জাইফার এবং তাঁর ভাই আবদের নিকট চিঠি নিয়ে গিয়েছিলেন। স্কটিশ ইতিহাসবিদ (এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ইসলামী স্টাডিজের অধ্যাপক) মন্টোগোমারি ওয়াট (১৯০৯-২০০৬) যথার্থই বলেছেন, ‘বিবাদ মীমাংসার জন্য মহানবী সা.-এর শরণাপন্ন হওয়ার শর্ত থাকার কারণে তাঁর শক্তি বৃদ্ধি পায়নি। কিন্তু সব বিবাদের মীমাংসা তিনি এমন নিখুঁত ও কূটনৈতিকভাবে সমাধান করতেন, যা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় এবং এ কারণে তাঁর ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়।’ এ কথা সত্য যে মহানবী সা. মদিনায় হিজরতের মাধ্যমে মক্কার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তবে মক্কায় তখনো ছিল অনেক মুসলমান। মক্কায় ইসলাম প্রচারের কাজ ধীরে হলেও গোপনে চলছিল। আর মক্কায় দ্বীনের প্রচার সম্প্রসারণ করাও ছিল নবীজির অন্যতম লক্ষ্য। এ জন্য দ্বীন প্রচারের স্বার্থে কুরাইশদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা ছিল খুবই জরুরি। কুরাইশদের সঙ্গে আলোচনায় মহানবী সা. সবচেয়ে বেশি কূটনৈতিক সফলতা অর্জন করেন হুদায়বিয়ার চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে। একজন আদর্শ কূটনীতিকের পরিচয় আমরা পাই আল্লাহর নবীর চরিত্রে। আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি, মহানবী সা. তাঁর কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অবস্থাভেদে কখনো দৃঢ়তা অবলম্বন করেছেন, কখনো বা ন¤্রতা প্রদর্শন করেছেন। অর্থাৎ মহানবী সা. প্রয়োজনবোধে সময়োচিত ব্যবহার করতে সক্ষম ছিলেন। দার্শনিক ও বাস্তববাদী ব্যক্তির গুণের এক অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। নিজের অনুসারীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার-বিশ্লেষণ করে দ্রুত তথা আড়ম্বরহীন পদ্ধতিতে আলোচনা চালিয়ে তিনি এমন এক চুক্তি সম্পাদন করেন, যা দূরদৃষ্টি, ধৈর্য, বিশ্বাস, কৌশল ও ন্যায়বিচারের আদর্শ হিসেবে বিবেচ্য। হুদায়বিয়ার সন্ধিতে মহানবী সা. কুরাইশদের অনেক ছাড় দেন। ফলে এই চুক্তি নিয়ে অনেক মুসলমান নানা ধরনের প্রশ্ন তোলেন। তারপরও এই চুক্তি ছিল মুসলমানদের জন্য বিরাট সাফল্য। আল্লাহ তায়ালা হুদায়বিয়ার সন্ধিকে ঐতিহাসিক বিজয় বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। পৃথিবীর বুকে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অন্যতম মূল কারণ হচ্ছে, মানবজাতির মধ্যে শ্রেণী, বর্ণবৈষম্য এবং যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত প্রিয়নবী সা.-এর আগমনের পূর্বে গোটা পৃথিবী রাজনৈতিক অস্থিরতার অতল তলে নিমজ্জিত ছিলো। এর ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ছিলো চরম অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্র পর্যায়ে যুদ্ধংদেহী মনোভাব, এমনকি এর ফলে সামান্য কোনো তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে প্রতিহিংসার কারণে বছরের পর বছর ধরে চালিয়ে যেত ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ। রাসূল সা. তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দিয়ে সমাজ থেকে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা দূর করে মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। অধুনা বিশ্বে এই অশান্ত ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে রাসূল সা.-এর অনুসরণ ও আনুগত্য। লেখক : প্রভাষক, সিটি মডেল কলেজ, ঢাকা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির