post

লক্ষ্য অর্জনের পথে । মু. রাজিফুল হাসান

৩১ মার্চ ২০১৯

পর্ব :৭

খ্রিস্টান: আল্লাহর পক্ষ থেকে খ্রিস্টানদের ওপর দায়িত্ব ছিল ইঞ্জিলকে অনুসরণ করা এবং এর (ইঞ্জিলের) নিয়মের আলোকে সকল কিছুর ফায়সালা করা। খ্রিস্টানদের প্রতি আল্লাহর এই নির্দেশনার বিষয়ে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন-

وَلْيَحْكُمْ أَهْلُ الْإِنجِيلِ بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فِيهِ ۚ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ۞

ইঞ্জিলের অধিকারীদের উচিত, আল্লাহ তাতে যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুযায়ী ফয়সালা করা। যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না, তারাই পাপাচারী। (সূরা আল মায়িদাহ: ৪৭) আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইঞ্জিলের অনুসারীদের শুধুমাত্র এটি (ইঞ্জিল) বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়ে ছেড়ে দেননি। বরং এই দায়িত্ব পালনে যারা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে তাদেরকে জান্নাত প্রদানের ওয়াদা করেছিলেন। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে যে: “আল্লাহ ক্রয় করে নিয়েছেন মুসলমানদের থেকে তাদের জান ও মাল এই মূল্যে যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাহে, অতঃপর মারে ও মরে। তওরাত, ইঞ্জিল ও কোরআনে তিনি এ সত্য প্রতিশ্রুতিতে অবিচল। আর আল্লাহর চেয়ে কে বেশী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারে? সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেনদেনের ওপর, যা তোমরা করছ তাঁর সাথে। আর এ হলো মহান সাফল্য।” (সূরা আত তাওবাহ্: ১১১) আর আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার প্রদানের যে ঘোষণা ছিল এর সত্যতা মিলে ইঞ্জিলে বর্ণিত হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের বাণী থেকেও। এ বিষয়ে বর্ণনা হলো, “ধন্য যাহারা ধার্মিকতার জন্য তাড়িত হইয়াছে, কারণ স্বর্গরাজ্য তাহাদেরই।” (মথি ৫: ১০) “যে কেহ আপন প্রাণ রক্ষা করে, সে তাহা হারাইবে এবং যে কেহ আমার নিমিত্ত আপন প্রাণ হারায়, সে তাহা রক্ষা করিবে।”(মথি ১০: ৩৯) “আর যে কোন ব্যক্তি আমার নামের জন্য বাঢি হইতে কি ভ্রাতা, কি ভাগিনী কি পিতা ও মাতা, কি সন্তান কি ক্ষেত্র পরিত্যাগ করিয়াছে, সে তাহার শতগুণ পাইবে এবং অনন্ত জীবনের অধিকারী হইবে।” (মথি ১৯: ২৯) ইঞ্জিলের শিক্ষার আলোকে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ খ্রিস্টান সম্প্রদায় পথভ্রষ্টতার অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছিল বৈরাগ্যবাদ। খ্রিস্টানদের মাঝে বৈরাগ্যবাদের সূচনা হয়েছিল তৃতীয় শতকে। মিসরীয় এক খ্রিস্টান পাদ্রি এর প্রবর্তক, যার নাম সেন্ট এন্থনি। তিনি সর্বপ্রথম মিসরের পাসপির নামক স্থানে (যা বর্তমানে দাইর আলমাইমুন নামে পরিচিত) খানকা প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে লোহিত সাগরের তীরে প্রতিষ্ঠা করেন আরও একটি খানকা। খ্রিস্টান দরবেশ হিসেবে সর্বপ্রথম খ্যাতি পাওয়া সেন্ট এন্থনির লেখা ও নির্দেশনাসমূহ থেকেই গৃহীত হয়েছিল বৈরাগ্যবাদের মৌলিক নিয়ম কানুন, যা ব্যাপক হারে প্রচার প্রসার পায় সমগ্র মিসরজুড়ে। ফলে আবির্ভ‚ত হয় সংসার ত্যাগী অসংখ্য পুরুষ ও মহিলা দরবেশে ও সন্ন্যাসীর। যাদের জন্য তৈরি হয়েছিল স্বতন্ত্র খানকা। আর এসকল খানকার কোন কোনটিতে দুই থেকে তিন হাজার পর্যন্ত দরবেশ ও সন্ন্যাসী থাকতো। পরবর্তীতে খানকা তৈরির এ ধারা বিস্তার লাভ করে ফিলিস্তিন, সিরিয়া এবং ইউরোপ ও আফ্রিকার বহু দেশে। খ্রিস্টান গির্জাসমূহ প্রথমে বৈরাগ্যবাদের অনেক নিয়মের সাথে দ্বান্দিক অবস্থান থাকলেও পরবর্তীতে সেন্ট অগাস্টাইন, সেন্ট আথানিসিউস, সেন্টবাসেল এবং সেন্টগ্রেগরির মত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সক্রিয় ভ‚মিকার ফলে বৈরাগ্যবাদের অনেক নিয়মকানুন স্থান করে নেয় চার্চ ব্যবস্থাপনায়। খ্রিস্টানদের মাঝে বৈরাগ্যবাদের যে সকল উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল তা হলো,

প্রথমত: কত সাধনা ও নতুন নতুন পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে নিজেকে শাস্তি (কষ্ট) দেওয়া যায়। আর এ কাজটি দরবেশ ও সন্ন্যাসীদের মাঝে প্রতিযোগিতার রূপ নিয়েছিল যে, নিজের দেহকে কে কত বেশি কষ্ট দিতে পারে।

দ্বিতীয়ত: তারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা বর্জন করেছিল। নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন থাকতে পারাটাই ছিল তাদের দৃষ্টিতে পুণ্যের কাজ। তাদের দৃষ্টিতে গায়ে পানি লাগানো বা গোসল করাটা ছিল পাপ এবং খোদাভীরুতার পরিপন্থী।

তৃতীয়ত: দাম্পত্য জীবন ছিল বৈরাগ্যবাদের দৃষ্টিতে পুরোপুরি হারাম। চতুর্থ শতাব্দীতে রচিত তাদের সকল ধর্মীয় রচনাবলি অন্যতম দিক ছিল ‘নিঃসঙ্গ জীবন বা কৌমার্য’ সবচেয়ে বড় নৈতিক মূল্যবোধ। আর এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে বিশিষ্ট খ্রিস্টান পন্ডিত সেন্টজিরুম মত প্রকাশ করেন যে, “যে নারী যিশুখ্রিস্টের কারণে সন্ন্যাসিনী হয়ে সারাজীবন কুমারী থাকবে সে খ্রিস্টের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী আর সেই নারীর মা অর্থাৎ খ্রিস্টের তথা খোদার শাশুড়ি হবার মর্যাদা অর্জন করবে।” সেন্টজিরুম অন্যত্র বলেন, “পবিত্রতার কুঠার দিয়ে দাম্পত্য বন্ধনের কাষ্ঠখন্ড কেটে ফেলা-ই আধ্যাত্মিক পথের অনুসারীর সর্বপ্রথম কাজ।”

চতুর্থত: খ্রিস্টীয় বৈরাগ্যবাদের মাধ্যমে ব্যক্তি তার মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানাদিসহ সকল আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতো। যা ছিল মানবতার এক কঠিন বেদনাদায়ক রূপ। এই নীতি অবলম্বনের ফলে পারিবার সমূহে কলহ ও অশান্তি নেমে এসেছিল। প্রকৃত অর্থে বৈরাগ্যবাদের এ সকল মূলনীতি অল্পসংখ্যক দরবেশ ও সন্ন্যাসীরা কিছুকাল মেনে চলতে পারলেও সংখ্যাধিক্যের জীবনে ছিল তার বিপরীত চিত্র। পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন সন্ন্যাসীদের হৃদয় ছিল নির্দয় ও নিষ্ঠুরতায় ভরপুর। আর এর রূপ প্রত্যক্ষ করা যেত নিজেদের মাঝে ধর্মীয় বিরোধের সময়। চতুর্থ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত আশি থেকে নব্বইটি ফিরকা সৃষ্টি হয়েছিল খ্রিস্টানদের মাঝে। আর সেন্ট অগাস্টাইনের হিসাব অনুযায়ী এর সংখ্যা ছিল ৮৮টি। খ্রিস্টানদের এসকল ফিরকা নিয়ে নিজেদের মাঝে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্যবার। আর আলেকজান্দ্রিয়া ছিল এই সংঘাত সৃষ্টির প্রধান কেন্দ্রস্থল। আলেকজান্দ্রিয়ায় (প্রথমে) বিশপ আথানিসিউসের দলের ওপর হামলা করে এরিয়ান ফিরকা। আথানিসিউসের খানকা থেকে কুমারী সন্ন্যাসীদের বের করে আনা হয়। অতঃপর তাদেরকে উলঙ্গ করে প্রহার করা হয় কাঁটাযুক্ত ডালপালা দিয়ে এবং দাগ লাগানো হয় শরীরজুড়ে। তাওবার মাধ্যমে আকিদা-বিশ্বাস পরিবর্তন করাটাই ছিল এরিয়ানদের লক্ষ্য। পরবর্তীতে ক্যাথলিকরা মিসরে বিজয়ী হলে এরিয়ান ফিরকার সাথেও একই আচরণ করে। ৩৬৬ খ্রিস্টাব্দে রোমে পোপ লিবিরিয়াসের মৃত্যুর পর পোপ পদের জন্য দু’টি গোষ্ঠী প্রতিদ্বন্দিতা করে। গোষ্ঠীদ্বয়ের মাঝে ব্যাপক খুনাখুনি ও রক্তপাতের ঘটনা ঘটে। তখন একটি চার্চ থেকেই ১৩৭টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। কৃচ্ছ্রতা সাধন ও ভোগবিলাসের জীবন পরিহারের মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন করা খ্রিস্টান বৈরাগ্যবাদীদের অন্যতম লক্ষ্য থাকলেও প্রকৃত অর্থে তা করতে ব্যর্থ হয়েছিল তারা। বরং ছলনার আশ্রয় নিয়ে তারা হয়েছিল অঢেল ধন-সম্পদের মালিক। অনেক বিশপের জীবনমান ছিল রাজা বাদশাদের মতই এবং কারো কারো ক্ষেত্রে আরো বেশি জাঁকজমকপূর্ণ। চতুর্থ শতাব্দীর শেষ দিকে সেন্টজিরুম এ বিষয়ে অভিযোগ করে বলেন, “বহুসংখ্যক বিশপের খাওয়ার অনুষ্ঠানসমূহ জাঁকজমকের দিকে দিয়ে গভর্নরদের খাওয়া অনুষ্ঠানসমূহকে লজ্জা দিত।” সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত এই প্লাবন চলতে থাকে। এসময় মূলত সাধারণ খ্রিস্টানদের বোঝানো হয়েছিল যে, কেউ কোন অপরাধ (পাপের কাজ) করলে কোন খানকা অথবা চার্চকে ভোট ও উপঢৌকন দিলেই কেবল মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আবার বৈরাগ্যবাদের কৌমার্য নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে পূত-পবিত্র হবার পরিবর্তে তারা বিসর্জন দিয়েছিল তাদের সতীত্বকে। বৈরাগ্যবাদের এই নিয়ম প্রকৃতির বিরুদ্ধে পরাজিত হয়েছে বারবার। খানকাসমূহে প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ ছিল যে, একই জায়গায় সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীরা থাকতো। আর কঠিন অনুশীলনের অংশ হিসেবে মাঝে মাঝে সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীরা একই বিছানায় রাত কাটাত। কিন্তু প্রকৃত অর্থে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সন্ন্যাসীরা তাদের প্রবৃত্তিকে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল তা বোঝার জন্য তাদের ধর্মগুরুদের বক্তব্যই যথেষ্ট হবে। চতুর্থ শতকের শেষ দিকে সেন্টগ্রেগরি বলেন, “ফিলিস্তিন অসৎ ও দুশ্চরিত্রের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। যারা মানব প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে, মানব প্রকৃতি তাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ না করে ক্ষান্ত হয়নি।” দশম শতাব্দীর একজন ইতালিয়ান বিশপ বলেন, “চার্চে ধর্মীয় দায়িত্ব পালনকারীদের বিরুদ্ধে যদি লম্পট ও চরিত্রহীনতার শাস্তিমূলক আইন কার্যকর করা হয় তাহলে চার্চের কাজে নিয়োজিত লোকদের মধ্যে কেবল বালকরা ছাড়া আর কেউ তা থেকে রক্ষা পাবে না। আর যদি অবৈধ সন্তানদেরকেও ধর্মীয় কাজের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার নিয়ম চালু করা হয় তাহলে হয়তো চার্চের কাজে নিয়োজিত কোন বালকই সেখানে থাকতে পারবে না।” (সূরা হাদিদ এর ২৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় ৫৪ নং টীকা)

চতুর্থ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত আশি থেকে নব্বইটি ফিরকা সৃষ্টি হয়েছিল খ্রিস্টানদের মাঝে। আর সেন্ট অগাস্টাইনের হিসাব অনুযায়ী এর সংখ্যা ছিল ৮৮টি। খ্রিস্টানদের এসকল ফিরকা নিয়ে নিজেদের মাঝে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্যবার। আর আলেকজান্দ্রিয়া ছিল এই সংঘাত সৃষ্টির প্রধান কেন্দ্রস্থল।

খ্রিস্টানদের এই বৈরাগ্যবাদ গ্রহণ অতঃপর এর মূল ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে না পারার বিষয়ে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, “অতঃপর আমি তাদের পশ্চাতে প্রেরণ করেছি আমার রাসূলগণকে এবং তাদের অনুগামী করেছি মরিয়ম তনয় ঈসাকে ও তাকে দিয়েছি ইঞ্জিল। আমি তার অনুসারীদের অন্তরে স্থাপন করেছি নম্রতা ও দয়া। আর বৈরাগ্য, সে তো তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করেছে; আমি এটা তাদের ওপর ফরজ করিনি; কিন্তু তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য এটা অবলম্বন করেছে। অতঃপর তারা যথাযথভাবে তা পালন করেনি। তাদের মধ্যে যারা বিশ্বাসী ছিল, আমি তাদেরকে তাদের প্রাপ্য পুরস্কার দিয়েছি। আর তাদের অধিকাংশই পাপাচারী।” (সূরা আল হাদিদ: ২৭) এ বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নিজের প্রতি কঠোরতা অবলম্বন না করার। এ বিষয়ে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, “হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ বলতেন: নিজের প্রতি কঠোর হয়ো না তাহলে আল্লাহ তোমাদের প্রতি কঠোর হবেন। একটি কওম কঠোরতা অবলম্বন করলে আল্লাহ তাদেরকে কঠোরভাবে পাকড়াও করলেন। দেখে নাও, তারা এবং তাদের অবশিষ্ট উপাসনালয় বর্তমান।” (আবু দাউদ) এভাবেই কার্যকরভাবে খ্রিস্টানদের বিচ্যুতি ঘটে স্বধর্ম পালন হতে। হযরত মুহাম্মদ (সা)এর আবির্ভাবকালে খ্রিস্টধর্মের মৌলিক শিক্ষা বলতে তেমন কিছুই ছিল না, যার মাধ্যমে কোন একজন অনুসারী স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের দিকে এগিয়ে যাবে। আর এর স্বীকৃতি মিলে খ্রিস্টান ধর্মযাজকগণের মুখ (কথা) থেকেই। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে হযরত সালমান ফারসি রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন একজন অগ্নি-উপাসক। তবে অগ্নি-উপাসনার মাধ্যমে তিনি তার হৃদয়ের প্রশান্তি খুঁজে পাননি। তাই সত্যের সন্ধানে সালমান (রা) গ্রহণ করেন খ্রিস্টান ধর্ম। তিনি তার জীবনের দীর্ঘ সময় এই ধর্মের সাধনা করে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করেন। আর এই সময়ে মাঝে তিনি শাম (সিরিয়া) ও ইরাকের পাঁচজন (তৎকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ ধর্মযাজকদের) সান্নিধ্য পান। প্রথমে তিনি সিরিয়ার শ্রেষ্ঠ গির্জার পুরোহিত কানিসার সান্নিধ্যে ছিলেন, যেখানে কানিসাকে তিনি পেয়েছেন একজন (ধন-সম্পদ) আত্মসাৎকারী হিসেবে। যিনি গির্জায় দান করা জনগণের অর্থ-সম্পদ নিজের জন্য জমা করে রাখত। কানিসার মৃত্যুর পর তার (আত্মসাৎকৃত) জমা করা অর্থ-সম্পত্তিতে পরিপূর্ণ ৭টি মটকা (বড় কলস) পাওয়া গিয়েছিল। কানিসার মৃত্যুর পর ওই গির্জায় নিযুক্ত একজন নতুন পুরোহিতের সান্নিধ্য পান সালমান (রা)। যিনি কানিসার মতো লোভী ছিলেন না, তবে খ্রিস্টান ধর্মের প্রাত্যহিক এবাদত নামাজের ব্যাপারে তিনি ছিলেন বেখেয়াল। ওই পুরোহিত মৃত্যুর পর সালমান (রা) (পুরোহিতের পূর্ব পরামর্শের আলোকে) চলে যান ইরাকের মাউসেন এলাকার এক পুরোহিতের নিকট। আর মাউসেনের পুরোহিতের মৃত্যুর পর সালমান (রা) চলে যান ইরাকের নাসিবাইন নামক এলাকার অন্য একজন পুরোহিতের নিকট। যার সান্নিধ্যে যাবার পরামর্শ মাউসেনের পুরোহিত মৃত্যুর পূর্বেই সালমানকে (রা) দিয়েছিল। কিছুদিন পর নাসিবাইনের পুরোহিত মৃত্যুর পূর্বে সালমানকে পরামর্শ দেন তার মৃত্যুর পর সালমান (রা) যেন তুরস্কের আম্মুরিয়ায় অবস্থানকারী পুরোহিতের নিকট চলে যান। পরামর্শের আলোকে সালমান (রা) আম্মুরিয়ায় গিয়ে ওই পুরোহিতের সান্নিধ্যে ধর্মচর্চা চালিয়ে যান। পরবর্তীতে আম্মুরিয়ার পুরোহিতের মৃত্যুকালে সালমান প্রশ্ন করেন, “আপনার মৃত্যুর পর আমি কার নিকট থেকে ধর্মীয় জ্ঞান লাভ করবো।” জবাবে পুরোহিত বলেছিলেন, “হে প্রিয় বৎস শোনো, আমার দৃষ্টিতে আমাদের (খ্রিষ্টান) ধর্মে এমন কেউ নেই যে তোমাকে ধর্মীয় সঠিক জ্ঞান শিক্ষা দিতে পারে। বরং আমার কাছে দৃশ্যমান হচ্ছে যে, শেষ নবী (পৃথিবীতে) আসার সময় হয়েছে। যিনি ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের ধর্ম নিয়ে আসবেন এবং তা পুনরুজ্জীবিত করবেন। যিনি আসবেন আরবে এবং দু’টি কালো পাহাড়ের মাঝখানে খেজুর বাগানে ভরপুর এলাকায় দৃঢ়ভাবে (শক্ত) অবস্থান করবেন। তুমি বরং তার সন্ধানে ওই এলাকায় চলে যাও, তবে সঠিক ধর্ম পেয়ে যাবে। তাকে চেনার উপায় হলো, তিনি হাদিয়া খাবেন তবে সাদাকা খাবেন না এবং তার পিঠে দুই কাঁধের মাঝখানে নবুয়তের সিলমোহর থাকবে।” উপরের বর্ণনাই খ্রিস্টান পুরোহিতগণের যে চরিত্র ফুটে উঠেছে এবং পুরোহিতগণ ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী হযরত সালমান ফারসি রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জ্ঞানার্জনের জন্য নসিহত করতে গিয়ে এক পুরোহিত হতে অন্য পুরোহিতের নিকট গমনের যে নির্দেশনা দিয়েছিল ও সর্বশেষ আম্মুরিয়ার পুরোহিতের কথায় খ্রিস্টান ধর্মের সঠিক জ্ঞানসম্পন্ন ধর্মীয় গুরুপ্রাপ্তির বিষয়ে যে সঙ্কট প্রকাশিত হয়েছে, এর মাধ্যমে এ কথা স্পষ্ট হয় যে তখন খ্রিস্টান ধর্মের শিক্ষা প্রায় বিলুপ্তির পথে ছিল। আবার হযরত সালমান ফারসি রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নসিহত করতে গিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা)এর আগমনের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন আম্মুরিয়ার খ্রিস্টান পুরোহিত। অর্থাৎ শেষ নবী আগমনের খবর এবং তাঁকে অনুসরণের নির্দেশনা তারা (খ্রিস্টানরা) ধর্মীয়ভাবে পেয়েছিল। তা ছাড়া শেষ নবী আগমনের সম্পর্কে ঈসা আলাইহিস সালামের সহচর ইউহান্না কর্তৃক সঙ্কলিত ইঞ্জিলে বর্ণিত হয়েছে যে, “তোমাদের নিকটে থাকিতে থাকিতেই আমি এই সকল কথা কহিলাম। কিন্তু সেই সহায়, পবিত্র আত্মা, যাঁহাকে পিতা আমার নামে পাঠাইয়া দিবেন, তিনি সকল বিষয়ে তোমাদিগকে শিক্ষা দিবেন এবং আমি তোমাদিগকে যাহা যাহা বলিয়াছি, সে সকল স্মরণ করাইয়া দিবেন।” (যোহন ১৪: ২৫,২৬) “যাঁহাকে আমি পিতার নিকট হইতে তোমাদের কাছে পাঠাইয়া দিব, সত্যের সেই আত্মা, যিনি পিতার নিকট হইতে বাহির হইয়া আইসেন-যখন সেই সহায় আসিবেন-তিনিই আমার বিষয়ে সাক্ষ্য দিবেন ।” (যোহন ১৫: ২৬) “তথাপি আমি তোমাদিগকে সত্য বলিতেছি, আমার যাওয়া তোমাদের পক্ষে ভাল, কারণ আমি না গেলে সেই সহায় তোমাদের নিকটে আসিবেন না। কিন্তু আমি যদি যাই, তবে তোমাদের নিকটে তাঁহাকে পাঠাইয়া দিব ।” (যোহন ১৬: ৭) “তোমাদিগকে বলিবার আমার আরও অনেক কথা আছে, কিন্তু তোমরা এখন সে সকল সহ্য করিতে পারনা। পরন্তু তিনি, সত্যের আত্মা, যখন আসিবেন তখন পথ দেখাইয়া তোমাদিগকে সমস্ত সত্যে লইয়া যাইবেন; কারণ তিনি আপনা হইতে কিছু বলিবেন না কিন্তু যাহা শুনেন, তাহাই বলিবেন এবং আগামী ঘটনাও তোমাদিগকে জানাইবেন। তিনি আমাকে মহিমান্বিত করিবেন; কেননা যাহা আমার, তাহাই লইয়া তোমাদিগকে জানাইবেন। পিতার যাহা যাহা আছে সকলই আমার; এই জন্য বলিলাম, যাহা আমার, তিনি তাহাই লইয়া থাকেন ও তোমাদিগকে জানাইবেন।” (১৬: ১২-১৫ ) আর ইঞ্জিলে বার্নাবাসের রাসূল (সা)এর আগমন ও তার শিক্ষাসংক্রান্ত হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের যে সকল বাণী বর্ণিত হয়েছে এর সঙ্কলিত সমষ্টি দিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব হবে। উল্লেখযোগ্য কিছু বাণী হলো: বার্নাবাস লিখছেন, এক সময়ে হযরত ঈসা (আ) তাঁর শাগরিদদের সামনে বললেন: “আমার শাগরিদদেরই একজন (পরবর্তী সময়ে দেখা গেল ইয়াহুদি ইসকার ইউতি সেই শাগরিদ) ৩০টি মুদ্রার বিনিময়ে আমাকে শত্রুদের কাছে বিক্রি করে দেবে।” তারপরে বললেন, “আমার দৃঢ়বিশ্বাস, যে আমাকে বিক্রি করবে এরপর সে-ই আমার নামে মারা যাবে। কেননা, খোদা আমাকে পৃথিবী থেকে উপরে উঠিয়ে নেবেন এবং সেই বিশ্বাসঘাতকের চেহারা এমনভাবে পরিবর্তিত করে দেবেন যে, সবাই মনে করবে সে-ই আমি। তথাপি সে যখন জঘন্য মৃত্যুবরণ করবে তখন একটা সময়-কাল পর্যন্ত লাঞ্ছন আমারই হতে থাকবে। কিন্তু খোদার পবিত্র রাসূল মুহাম্মাদ যখন আসবেন তখন সেই বদনাম দ‚র করে দেয়া হবে। আল্লাহ তা’আলা তা এ জন্য করবেন যে, আমি সেই মাসিহর সত্যতা স্বীকার করেছি। সে জন্য তিনি আমাকে এই পুরস্কার দেবেন। লোকে জানতে পারবে আমি বেঁচে আছি এবং সেই লাঞ্ছনাকর মৃত্যুও সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।” (বার্নাবাস; অধ্যায়-১১৩) “(হযরত ঈসা (আ) শাগরিদদের বললেন,) আমি সন্দেহাতীতভাবে তোমাদের বলছি, যদি মূসার গ্রন্থের সত্যতা বিকৃত না হতো তাহলে খোদা আমাদের পিতা দাউদকে অন্য একখানি গ্রন্থ দিতেন না। আর দাউদের গ্রন্থের মধ্যে যদি বিকৃতি ঘটানো না হতো তাহলে খোদা আমাকে ইঞ্জিল দিতেন না। কারণ, মহাপ্রভু, আমাদের খোদা পরিবর্তিত হওয়ার নন। আর তিনি সব মানুষকে একই বাণী দিয়েছেন। তাই যখন আল্লাহর রাসূল আসবেন এসব জিনিসকে পরিষ্কার করে দেয়ার জন্যই আসবেন যা দিয়ে খোদাহীন লোকেরা আমার কিতাবকে কলুষিত করে ফেলেছে।” (অধ্যায়-১২৪) “আমি দৃঢ়বিশ্বাস নিয়ে তোমাদের বলেছি যেসব নবী এসেছেন তাঁরা সকলেই কেবল একটি মাত্র কওমের জন্য খোদার নির্দশন হিসেবে সৃষ্টি হয়েছিলেন। তাই যেসব লোকের জন্য তাঁদের পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যে ছাড়া সেইসব নবীর বাণী আর কোথাও প্রচারিত হয়নি। কিন্তু আল্লাহর রাসূল যখন আসবেন খোদা হয়তো তাঁকে নিজের হাতের মোহর দিয়ে পাঠাবেন এমনকি দুনিয়ার যে সব কওম তাঁর শিক্ষা লাভ করবে তাদেরকেই তিনি মুক্তি ও রহমত পৌঁছিয়ে দেবেন। তিনি খোদাহীন লোকদের ওপর কর্তৃত্ব নিয়ে আসবেন এবং এমনভাবে মূর্তি পূজার মূলোৎপাটন করবেন যে, শয়তান অস্থির হয়ে উঠবে। এরপর শাগরেদদের সাথে দীর্ঘ কথাবার্তার সময় হযরত ঈসা (আ) স্পষ্ট করে এ কথা বলেন যে, সেই নবী হবেন বনি ইসরাইল বংশের লোক।” (অধ্যায়-৪৩) “সমস্ত নবী-যাঁদেরকে আল্লাহ দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, যাঁদের সংখ্যা এক লাখ চুয়াল্লিশ হাজার-অস্পষ্ট ভঙ্গিতে কথা বলেছেন। কিন্তু আমার পরে সমস্ত নবী এবং পবিত্র সত্তাসমূহের জ্যোতি আসবেন যিনি নবীদের বলা কথার অন্ধকার দিকের ওপর আলোকপাত করবেন। কারণ তিনি খোদার রাসূল।” (অধ্যায়-১৭) “কিন্তু খোদা যখন আমাকে দুনিয়া থেকে নিয়ে যাবেন তখন শয়তান পুনরায় এভাবে বিদ্রোহ ছড়াবে যাতে খোদাকে যারা ভয় করে না তারা আমাকে খোদা এবং খোদার বেটা হিসেবে মেনে নেয়। তার কারণে আমার বাণী এবং শিক্ষা বিকৃত করে ফেলা হবে, এমনকি বড়জোর ত্রিশজন ঈমানদার লোক অবশিষ্ট থাকবে। সেই সময় খোদা দুনিয়ার প্রতি অনুগ্রহ করবেন এবং তাঁর সেই রাসূলকে পাঠাবেন যাঁর জন্য তিনি দুনিয়ার এইসব জিনিস সৃষ্টি করছেন। যিনি শক্তিতে বলীয়ান হয়ে দক্ষিণ থেকে আসবেন এবং মূর্তিসমূহকে মূর্তির পূজারিদেরসহ ধ্বংস করে ফেলবেন। শয়তান মানুষের ওপর যে কর্তৃত্ব লাভ করেছে তিনি তার থেকে সে কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেবেন। যারা তাঁর ওপর ঈমান আনবে তাদের মুক্তির জন্য তিনি খোদার রহমত নিয়ে আসবেন। আর বড়ই সৌভাগ্যের অধিকারী তারা যারা তাঁর কথা মানবে।” (অধ্যায়- ৯৬) হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্য ও শেষ নবী হিসেবে আগমনের বিষয়ে ইঞ্জিলে উল্লিখিত ও হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা বলতে গিয়ে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন-

وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُم مُّصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ َدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِن بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ ۖ فَلَمَّا جَاءَهُم بِالْبَيِّنَاتِ قَالُوا هَـٰذَا سِحْرٌ مُّبِينٌ۞

“স্মরণ কর, যখন মরিয়ম-তনয় ঈসা (আ) বলল, হে বনি ইসরাইল! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, আমার পূর্ববর্তী তাওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রাসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন। তাঁর নাম আহমদ। অতঃপর যখন সে স্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে আগমন করল, তখন তারা বলল, এ তো এক প্রকাশ্য জাদু।” (সূরা আস সাফ: ৬)

সেসব লোক, যারা আনুগত্য অবলম্বন করে এ রাসূলের, যিনি উম্মি নবী, যাঁর সম্পর্কে তারা নিজেদের কাছে রক্ষিত তাওরাত ও ইঞ্জিলে লেখা দেখতে পায়, তিনি তাদেরকে নির্দেশ দেন সৎকর্মের, বারণ করেন অসৎকর্ম থেকে; তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তু হালাল ঘোষণা করেন ও নিষিদ্ধ করেন হারাম বস্তুসমূহ এবং তাদের ওপর থেকে সে বোঝা নামিয়ে দেন এবং বন্দিত্ব অপসারণ করেন যা তাদের ওপর বিদ্যমান ছিল। সুতরাং যেসব লোক তাঁর ওপর ঈমান এনেছে, তাঁর সাহচর্য অবলম্বন করেছে, তাঁকে সাহায্য করেছে এবং সে নূরের অনুসরণ করেছে যা তার সাথে অবতীর্ণ করা হয়েছে, শুধুমাত্র তারাই নিজেদের উদ্দেশ্য সফলতা অর্জন করতে পেরেছে। (সূরা আল আরাফ: ১৫৭) শেষ নবী হিসেবে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনবার্তা এবং তাঁকে অনুসরণের যে নির্দেশনা ইঞ্জিলগুলোতে বর্ণিত হয়েছে, তা তৎকালীন সময়ের (হযরত মুহাম্মদ (সা)এর আবির্ভাবকাল) খ্রিস্টানরা জানতো। আর এর প্রমাণ মিলে নিম্নোক্ত ঘটনাসমূহ থেকে। চাচা আবু তালিবের সাথে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়ায় যাবার পথে বালক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখে চিনতে পেরেছিলেন খ্রিস্টান পাদ্রি বাহিরা। বাহিরা ছিলেন বুসরা এলাকায় অবস্থিত একটি খ্রিস্টান গির্জার পাদ্রি। খ্রিস্টান ধর্ম সম্পর্কে তিনি খুবই পারদর্শী ছিলেন। দীর্ঘকাল যাবৎ একখানা আসমানি কিতাব সংরক্ষিত হয়ে আসছিল ওই গির্জায়। আর পুরুষানুক্রমে ওই গির্জার পাদ্রিগণ কিতাবটির সংরক্ষণ ও জ্ঞানের উত্তরাধিকারী হয়ে আসছিল। কুরাইশগণ সিরিয়ায় যাত্রাপথে এই গির্জার পাশে বিশ্রাম নিত। ওই সফরে বাহিরা লক্ষ করলেন বালক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাথার ওপর একখন্ড মেঘ ছায়া দিয়ে চলেছে। এমনকি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন গাছের ছায়ায় অবস্থান করছিলেন তখনো গাছের ডালপালা এবং মেঘখন্ডটি তার ওপর ঝুঁকে ছায়া দিতে লাগলো। এ দৃশ্য দেখার পর বাহিরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট অনেক কিছু জানতে চাইলেন। প্রশ্নের জবাবে অনেক কিছু জানার পর বাহিরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিঠ দেখতে চাইলেন। তিনি দেখলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিঠে দুই স্কন্ধের মধ্যবর্তী স্থানে নবুয়তের মোহর অঙ্কিত আছে। ইতঃপূর্বে বাহিরা আসমানি কিতাবটিতে শেষ নবীর যে বর্ণনা পড়েছিলেন, প্রশ্নের জবাব শোনা এবং সিলমোহর দেখার মাধ্যমে সকল কিছুরই মিল পেলেন। তারপর বাহিরা আবু তালিবকে জিজ্ঞেস করলেন, “বালকটি আপনার কে? তিনি বললেন: আমার ছেলে। বাহিরা বললেন: সে আপনার ছেলে নয়। এ ছেলের পিতা জীবিত থাকতে পারে না। আবু তালিব বললেন: বালকটি আমার ভ্রাতুষ্পুত্র। বাহিরা বললেন: ওর পিতার কী হয়েছিল? আবু তালিব বললেন: এই ছেলে মায়ের পেটে থাকতেই তার পিতা মারা গেছে। বাহিরা বললেন: ঠিক এরকম হওয়ার কথা। আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রকে নিয়ে গৃহে ফিরে যান। খবরদার ইয়াহুদিদের থেকে ওকে সাবধানে রাখবেন। আল্লাহর কসম তারা যদি এই বালককে দেখতে পায় এবং আমি তার যে নিদর্শন দেখে চিনেছি তা যদি চিনতে পারে তাহলে তারা ওর ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করবে। কেননা আপনার এ ভ্রাতুষ্পুত্র অচিরেই এক মহামানব হিসেবে আবির্ভ‚ত হবেন।” অতঃপর আবু তালিব বালক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে তাড়াতাড়ি স্বদেশে ফিরে গেলেন। (উৎস: সিরাতে ইবনে হিশাম ৪৫ পৃষ্ঠা) ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন বর্ণনা করেন: “উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রা) তখনও রাসূলকে (সা) বিয়ে করেননি। একবার রাসূল (সা) খাদিজার পণ্যদ্রব্য নিয়ে সিরিয়া যান, সঙ্গে ছিলেন খাদিজার (রা) গোলাম মায়াসারা। যাবার সময় নাসতুরা নামক এক পাদ্রির নিকট দিয়ে তারা পথ অতিক্রম করলেন। তখন পাদ্রি নাসতুরা রাসূল (সা)এর চেহারায় নবুয়তের নিদর্শন লক্ষ্য করেন এবং মায়াসারাকে তা অবহিত করেন। মায়াসারা মক্কায় ফিরে পাদ্রির বর্ণনার আলোকে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়তের কথা খাদিজা (রা)কে জানান। আর এসব কথা জানার পর খাদিজা (রা) রাসূলকে (সা) বিয়ের প্রস্তাব দেন। (উৎস: সিরাতে সরওয়ারে আলম দ্বিতীয় খন্ড, ২৩০ পৃষ্ঠা) অতঃপর যখন হেরাগুহায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সর্বপ্রথম ফেরেশতার আগমন ঘটলো, তখন তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন এবং খাদিজাকে (রা) ঘটনা বললেন। খাদিজা (রা) রাসূলকে (সা) সান্তনা দেন এবং তার চাচাতো ভাই ওরাকা বিন নওফেলের নিকট নিয়ে যান। ওয়ারাকা বিন নওফেল জাহিলি যুগে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি আরবি ও ইবরানি ভাষায় ইঞ্জিল শরিফ লিখতেন। হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “ভাইজান আপনার ভাইপোর ঘটনা শুনুন।” ওরাকা রাসূল (সা)কে বললেন, “ভাইপো, কি দেখলেন বলুন দেখি? রাসূল (সা) যা কিছু দেখেছিলেন তা বলেন। ওরাকা বলেন, এ হচ্ছে সেই ‘নামূস’(ওহী আনয়নকারী ফেরেশতা) যাকে আল্লাহ তাআলা হযরত মুসা (আ) এর উপর নাযিল করেন। আহা, যদি আমি আপনার নবুওয়াতের যুগে শক্তিশালী হতাম এবং ঐ সময় পর্যন্ত জীবিত থাকতাম যখন আপনার জাতি আপনাকে বের করে দিবে।” রাসূল (সা) বলেন, “এসব লোক কি আমাকে বের করে দেবে?” ওরাকা বলেন: “নিশ্চয়ই এমন কখনো হয়নি যে, আপনি যা এনেছেন তা যখন কেউ এনেছে, তার সাথে শত্রুতা করা হয়নি। আমি যদি আপনার শেষ সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকি তাহলে আপনাকে সর্বশক্তি দিয়ে সাহায্য করবো।” উল্লেখ্য তখন ওরাকা ইবনে নওফেল ছিল অতিমাত্রায় বৃদ্ধ এবং অন্ধ। আর অল্প কিছুদিন পরেই তিনি মারা গিয়েছিলেন। (উৎস: সীরাতে সরওয়ারে আলম, ২৩০ পৃষ্ঠা) (চলবে)

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, প্রেরণা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির