post

শহীদ মনসুর আলী যে স্মৃতি আজও প্রেরণা জোগায়

১৩ জুন ২০১২
মু: আনোয়ারুল ইসলাম মৃত্যু এক অনিবার্য মহাসত্য। মৃত্যুর হাত থেকে কেউ রেহাই পায়নি। মানুষের কীর্তিই মানুষকে চির ভাস্বর করে রাখে। মৃত্যুর পরও হয়ে থাকে অমর। পৃথিবীর বুকে তাকে রাখে চিরস্মরণীয় বরণীয়। তেমনি কীর্তিবান আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গকারী এক যুবক শহীদ মনসুর আলী। কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলাধীন সন্তোষপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৬৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ মনসুর আলী। তিনি রায়গঞ্জ এবতেদায়ী মাদ্রাসায় ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন, যার বর্তমান অস্তিত্ব নেই। এরপর সোনাইর খামার দাখিল মাদ্রাসায় ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। পরবর্তীতে নাগেশ্বরী সিনিয়র মাদ্রাসায় ৮ম শ্রেণী থেকে আলিম পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। ১৯৮৭-৮৮ শিক্ষাবর্ষে তিনি রংপুর কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ১ম বর্ষ বি.এ (সম্মান) ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ভর্তি হন। শাহাদাতের সময় তিনি ৩য় বর্ষ (সম্মান) ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। সম্মান শ্রেণীতে অধ্যয়নের পাশাপাশি নাগেশ্বরী সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ফাযিল এবং বড় কারামতিয়া আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কামিল পাস করেন। ছোটবেলা থেকেই ইসলামপ্রিয় শহীদ মনসুর আলী নাগেশ্বরী সিনিয়র মাদ্রাসায় অধ্যয়নের সময় ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত পান এবং শামিল হন। তখন সক্রিয়ভাবে ইসলামী আন্দোলনে নিজেকে স¤পৃক্ত করতে না পারলেও কারমাইকেল কলেজে ভর্তির পর থেকে তিনি সক্রিয়ভাবে ইসলামী আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন এবং ১৯৯০ সালে সাথী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল, সুঠাম দেহের অধিকারী, নম্র, ভদ্র ইসলামপ্রিয় এই যুবকটির মনে সব সময় একটিই চিন্তা ছিল কিভাবে মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করা যায়। তাই তিনি নিজ এলাকাতে কুরআন শিক্ষার জন্য মুরুব্বিদের সাথে নিয়ে মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন। বাড়ির আশপাশে মসজিদ না থাকায় তার উদ্যোগেই ঐ মক্তবেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতের সাথে আদায়ের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে ঐ মক্তব ও নামাজ ঘরকে জামে মসজিদে পরিণত করেন। বর্তমানে ঐ মসজিদের পাশাপাশি ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের আরবি শিক্ষার জন্য মক্তব চালু আছে। সত্যি শাহাদাত তার ভাগ্যেই জোটে যে নিজেকে ইসলামী আন্দোলনে খালিসভাবে স¤পৃক্ত করে আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা দেখাতে পারেন, যা আমি কয়েকটি ঘটনার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করেছি শহীদ মনসুর ভাইয়ের জীবনে। গ্রামের বাড়ি পাশাপাশি উপজেলা হলেও শহীদ মনসুর ভাইয়ের সাথে আমার সেই পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ছিল না। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ উপ-নির্বাচনে রংপুর-১ আসনের প্রার্থী আমাদের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব ইসলামী চিন্তাবিদ অধ্যক্ষ রুহুল ইসলাম পীর সাহেব চাচার নির্বাচনী কাজ করার জন্য রংপুর শহর শিবির-এর পক্ষ থেকে আমাকে দায়িত্বশীল করে ২৫-৩০ জনের একটি টিম গংগাচড়ায় পাঠানো হয়। সেই টিমে শহীদ মনসুর আলী ভাই ছিলেন। নির্বাচনী প্রচারণায় বিভিন্ন এলাকায় গ্র“প করে ভোটারদের কাছে পাঠানো। সেই সাথে পোস্টার, লিফলেট, মাইকিংসহ নির্বাচনী প্রচারণায় বিভিন্ন সামগ্রী বন্টনের দায়িত্ব আমার ছিল। নির্বাচনের ৫-৬ দিন আগের ঘটনা। বিভিন্ন এলাকায় গ্র“প ও মাইক পাঠিয়ে আমি নির্বাচনী অফিসে বসে আছি। এমন সময় এক ব্যক্তি অফিসে এলেন। আমার ধারণা ছিল কোনো এলাকার ভোটার হবেন। কিন্তু পরিচয় জানার জন্য জিজ্ঞেস করায় তিনি নাম ও বাড়ির ঠিকানা বললেন নাগেশ্বরীতে। আমি বললাম, এখানে কোথায় এসেছেন? বললেন, আমি মনসুরের বড় ভাই। বাড়ির জরুরি প্রয়োজনে ডাকার জন্য রংপুরে তার লজিং বাড়িতে এসে জানতে পারলাম গংগাচড়ায় গিয়েছে। এ জন্য তার খোঁজে এসেছি। আমি তাকে অফিসে বসতে দিলাম এবং বললাম জোহরের নামাজের সময় তারা খেতে আসবেন। জোহরের নামাজের পর পরই মনসুর ভাই এলেন। আমি তাকে বললাম বাড়ি থেকে আপনার ভাই এসেছেন। তিনি বড় ভাইয়ের সাথে আলাপ করে তাকে বিদায় দিলেন। আমি মনসুর ভাইকে বললাম, আপনাকে জরুরি  ভিত্তিতে ডাকার জন্যে এসেছেন কিন্তু আপনি গেলেন না। তিনি বললেন, নির্বাচনের পরদিন বাড়ি যাব ইনশাআল্লাহ। তিনি সংগঠনের যাবতীয় সিদ্ধান্ত হাসি মুখে মেনে নিতেন এবং যখন যে কাজে যেখানেই ডাকা হতো যথাসময়ে যথাস্থানে হাজির হতেন। ১৯৮৭ সালে কারমাইকেল কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে পূর্ণ প্যানেলে আমরা বিজয় লাভ করার পর থেকে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য আমাদের চরম বিরোধিতা শুরু করে। তারা কলেজ রোড, লালবাগ, ট্রাক স্ট্যান্ড, গ্রান্ড হোটেল মোড়, পায়রা চত্বর, কাচারি বাজারসহ শহরের বিভিন্ন মোড়ে শিবিরকে প্রতিহত করার জন্য মারমুখী অবস্থান নেয়। আমাদের ভূমিকা সব সময় উবভবহংরাব ছিল। শহরের যে কোন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য আমরা দলবদ্ধভাবে আসার চেষ্টা করতাম। ১৯৯২ সালে বিশ্বনন্দিত ইসলামী আন্দোলনের নেতা তৎকালীন আমীরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযমকে কেন্দ্র করে সারা দেশে আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। আসলে তাদের মূল উদ্দেশ্য অধ্যাপক গোলাম আযম ছিল না, তারা চেয়েছিল কিভাবে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনকে বাংলাদেশের জমিন থেকে সমূলে উৎখাত করা যায়। রংপুরে এই অশুভ শক্তি বিভিন্ন সময়ে আমাদের মিছিল, মিটিংসহ বিভিন্ন ব্যক্তির ওপরও ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়েনার মত। ইসলামবিদ্বেষী এই চক্রের অপতৎপরতাকে সহ্য করতে পারেনি এদেশের ছাত্র ও যুবসমাজ। তাই তারা একত্রিত হয়ে জাতীয় যুবকমান্ড নামক সংগঠন করে ইসলামবিদ্বেষী আওয়ামী অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সরকারের কাছে দেশদ্রোহীদের বিচার দাবি করে। এরই অংশ হিসেবে ১৯৯২ সালের ২০ জুন জাতীয় যুবকমান্ডের ডাকে দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করা হয়েছিল। দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচিকে সফল করার লক্ষ্যে রংপুরেও ছাত্র ও যুবসমাজ শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে পিকেটিং করছিল। কিন্তু এই কর্মসূচি পালনেও বাধা প্রদান করেছিল তথাকথিত গণতান্ত্রিক চেতনার দাবিদার আওয়ামী অপশক্তি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সেদিন গুলি ও ককটেল দ্বারা আহত হয়েছিলেন তৎকালীন জেলা সভাপতি জনাব তাজুল ইসলাম, ছাত্র নেতা কাওছার আলীসহ আরও বেশ কয়েকজন। ২১ জুন তথাকথিত ঘাদানি কমিটির ডাকে সারা দেশে সকাল সন্ধ্যা হরতাল ডাকা হয়েছিল। আমরা সকাল থেকে মেসেই অবস্থান করছি। এক সময় সংবাদ এলো শহর ও খামার এলাকা থেকে বেশ কিছু অছাত্র সন্ত্রাসী চকবাজারে বখাটে ছেলেদের সাথে একত্র হয়েছে এবং তারা বিউটি হাউজে হামলা করবে। সত্যি তাই হলো, তারা দুই গ্র“পে চকবাজার থেকে পশ্চিম দিকে মেসের পাশ দিয়ে এবং আর কে রোড দিয়ে বিউটি হাউজ আক্রমণ করার জন্য এলো, আমরা তা প্রতিহত করলাম কোনো রকমের হতাহত ছাড়াই। এভাবে দুই তিনবার তাদের সাথে আমাদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। এ অবস্থা বিকাল তিনটা পর্যন্ত চলছিল। কিন্তু তারা কখনো কল্লোল ছাত্রাবাসে হামলা করার জন্য অগ্রসর হয়নি। আমরা আর.কে রোড হয়ে বিউটি হাউজের দিকে মিছিল করতে করতে পার্কের মোড় পর্যন্ত না আসতেই আবারো তারা শ্লোগান দিয়ে আমাদের দিকে আসতে থাকায় আমরা পুনরায় মিছিল ঘুরিয়ে নিয়ে চকবাজারের দিকে এগিয়ে গেলাম। এমন সময় কল্লোল ছাত্রাবাসের ভাইয়েরা আমাদের দিকে আসছিল। তখন হায়েনারা তাদের ওপর চড়াও হয় এবং আমাদের অজ্ঞাতে মনসুর ভাইকে উপর্যুপরি আঘাত করলে তিনি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান এবং আর.কে রোডের দক্ষিণ পার্শ্বে তারা হাফিজুর ভাইকে আঘাত করতে থাকে। পরবর্তীতে আমরা তাকে উদ্ধার করি। এমতাবস্থায় ওদের বেশ কয়েকজন আহত হওয়ায় আমরা চকবাজার থেকে বিউটি হাউজের দিকে ফিরছিলাম। ফেরার পথে আমরা দেখতে পাই একটি লাশের মতো কে যেন পড়ে আছে। আমাদের এক ভাই খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেন মনসুর ভাই। পরে আমরা তাকে কয়েকজন তুলে নিয়ে এসে মেডিক্যালে পাঠালাম। মেডিক্যালে তাকে মৃত ঘোষণা করা হলো। তিনি চলে গেলেন আল্লাহর দরবারে শাহাদাতের অমিয় পেয়ালা পান করে। আমার ওপর দায়িত্ব অর্পিত হলো বাড়িতে সংবাদ দেয়ার। পরদিন সকালে মোটরসাইকেলে শিবিরের এক সাথী ভাইসহ রওনা হলাম। আমার মনে তখন বারবার নাড়া দিচ্ছিল কী জবাব দেবো শহীদ মনসুর ভাইয়ের বৃদ্ধ পিতা-মাতা ও ভাই-বোনদের কাছে। আমরা কুড়িগ্রাম গিয়ে বাজার মসজিদের খতীব রুকনে জামায়াত মাওলানা মোশাররফ সাহেবকে সাথে নিয়ে মনসুর ভাইদের বাড়িতে পৌঁছলাম। পৌঁছার সাথে সাথে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হলো। চতুর্দিক থেকে আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরা আসতে শুরু করলো। সকলের চোখে পানি আর মুখে একটি কথাÑ কী অপরাধ ছিল আমাদের প্রিয় মনসুরের যে, তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। আমরাও চোখে পানি সংবরণ করতে পারিনি। আমাদের শ্রদ্ধেয় মুন্সী স্যার ও আমিনুর রহমান ভাইয়ের হৃদয়গ্রাহী সান্ত্বনামূলক বক্তব্যে পরিবেশ কিছুটা শান্ত হলে শহীদের শেষ জানাযা তার বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় এবং পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। ঠিক এই ভাবে বাংলাদেশের এই জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েমেরে স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য বাতিলের কাছে মাথা নত না করে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়ে শত শত তরুণ-যুবক প্রমাণ করেছেন সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। মিথ্যার পতন হবেই। কিন্তু শহীদদের স্বপ্ন আজও বাস্তবায়ন হয়নি, বিচার হয়নি খুনিদের। তবে হ্যাঁ, দুনিয়ার আদালতে না হলেও আল্লাহর আদালতে ঠিকই হবে কেউ রেহাই পাবে না। শহীদেরা আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাদের কীর্তি অক্ষয় হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে, অনুপ্রাণিত হবে ইসলামপ্রিয় মানুষ। কাজেই আমরা যারা শহীদের উত্তরসূরি, আমাদের উচিত তাদের অসমাপ্ত কাজকে বাস্তবে রূপ দিয়ে একটি সফল ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। আর এর মাধ্যমেই সার্থক হবে শহীদের আত্মত্যাগ ও কুরবানি। আল্লাহ আমাদের সকলকে শহীদি প্রেরণা দিয়ে দ্বীন কায়েমের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার তৌফিক দিন। আমীন। লেখক : থানা আমীর, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, রংপুর সদর (পূর্ব) সাংগঠনিক থানা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির