post

সব দলকে নিয়ে নির্বাচন

আশিকুল হামিদ

০৯ জানুয়ারি ২০১৮
২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরে আলোচনা হয়েছে। আলোচনার শেষ হয়নি এখনো। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি আলোচনায় অংশ নিয়েছে সচেতন সাধারণ মানুষও। সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফাই যে মেয়র পদে নির্বাচিত হবেন সে কথা জানা গিয়েছিল আগে থেকে। এর কারণ, রংপুরের পরিচিতি রয়েছে ‘এরশাদের ঘাঁটি’ হিসেবে। তা সত্ত্বেও ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ থাকায় চূড়ান্তভাবে হিসাব মেলানো খুব সহজ ছিল না। ভোটের ব্যবধান সম্পর্কেও সংশয় ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি ভোটে বিজয়ী হয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তফা। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী এবং মেয়র হিসেবে আগের বার নির্বাচিত সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু পেয়েছেন ৬২ হাজারের ঘরে। ওদিকে প্রচণ্ড দমন-নির্যাতনের মুখে দুর্বল হয়ে পড়া বিএনপিকেও একেবারে ঝেড়ে ফেলা সম্ভব হয়নি। দুপুরের দিকে নির্বাচন বর্জন এবং শেষ পর্যন্ত ফলাফল প্রত্যাখ্যান করলেও দলটির প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা ৩৫ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছেন। বিষয়টিকে বিএনপির জন্য বিরাট সাফল্য হিসেবেই দেখা হয়েছে। ওই দিকে আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও। বছর কয়েক আগে ‘কালো বিড়াল’ নামে কুখ্যাত হয়ে ওঠা প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর নেতৃত্বে পরিচালিত ছাঁটাই অভিযানের কারণে জামায়াতে ইসলামী একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও রসিক নির্বাচনের সময় ‘জামায়াতের ভোট’ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। জানা গেছে, রসিক এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর নাকি ৪০ হাজারের মতো ভোটার রয়েছে। এরই পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কথিত ‘ভোট ব্যাংক’-এর ৬৫ হাজার ভোটার ঠিক কোন দিকে বাঁক নিয়েছিল সে প্রশ্নের উত্তর নিয়েও আলোচনা জমে উঠেছিল। কারণ, দলটির প্রার্থী সব মিলিয়েও ৬৫ হাজার ভোট পাননিÑ যার অর্থ, ‘ভোট ব্যাংক’ নামে পরিচিতজনেরা সকলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দেয়নি। অথচ অন্য সব নির্বাচনেই তারা দলবেঁধে নৌকায় ভোট দিয়ে থাকে। একই কারণে তারা আওয়ামী লীগের ‘ভোট ব্যাংক’ হিসেবে পরিচিত। তাদের এই পরিচিতি রয়েছে সারাদেশেই। জামায়াত এবং কথিত ‘ভোট ব্যাংক’-এর সঙ্গে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সাফল্য নিয়েও আলোচনা কম হয়নি। কারণ, এর প্রার্থী ২৪ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছেন। এ পর্যন্ত পড়ার পর পাঠকদের মনে নিবন্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হতেই পারে। জবাবে সংক্ষেপে বলা দরকার, রসিক নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ নয়, উদ্দেশ্য আসলে একটি কথা জানানোÑ কোনো নির্বাচন যদি অংশগ্রহণমূলক হয় এবং সে নির্বাচনে যদি সব দল, অন্তত বেশির ভাগ দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তাহলে এ ধরনের প্রতিক্রিয়াই স্বাভাবিক। স্থানীয় সরকারের একটি নির্বাচন নিয়েই যখন এ অবস্থা সেখানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব না হলেও বেশির ভাগ বড় ও জনসমর্থিত দল যদি অংশ নেয় তাহলে পরিস্থিতি কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। রসিকের পর দু’মাসের মধ্যে অনুষ্ঠেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচনকে সামনে রেখে জনগণের মধ্যে সে আলোচনাই সম্প্রতি প্রাধান্যে এসেছে। সত্যি বলতে কি, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলে আসছে অনেক আগে থেকেই। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের নামে ক্ষমতাসীনদের একতরফা ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকান্ডের পরিপ্রেক্ষিতে। মাঝখানে বছর চারেক অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও জনগণ এখনো ভেবে উঠতে পারেনি, ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ জনই যেখানে বিনাভোটে ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন এবং বাকি আসনগুলোতেও যেখানে গণতন্ত্রসম্মত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি তেমন একটি সংসদকে কিভাবে ‘হালাল’ করা হয়েছে এবং ওই এমপিদের সমর্থনের আড়াল নিয়ে ‘গঠিত’ একটি সরকার কিভাবে এখনো ক্ষমতায় রয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় সংসদ যেমন নিয়মিত অধিবেশনে বসাসহ তার ‘কার্যক্রম’ চালিয়ে যাচ্ছে, ক্ষমতাসীনরাও তেমনি জনগণকে বুঝিয়ে চলেছেন, ফ্যাসিবাদ এবং ফ্যাসিবাদী সরকার কাকে বলে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে আলোচনা শুরুর পেছনেও রয়েছে বর্তমান ‘নির্বাচিত’ জাতীয় সংসদ। প্রসঙ্গক্রমে ইতিহাস স্মরণ করতেই হবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার গোপন উদ্দেশ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধান থেকে ‘ঝেঁটিয়ে’ বিদায় করেছিল, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে যে ব্যবস্থাটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনের ‘ফসল’ ছিল। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের উদ্যোগে সংসদে গৃহীত ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯৬ সালের মার্চে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। এতে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিয়েছিলেন ১৯৯৬ সালের ২৮ মার্চ। তারও আগে ১৯৯৪ সাল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে বিরোধী দলগুলো আন্দোলন করেছিল। সে আন্দোলনে প্রধান ভূমিকায় ছিল আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতে ইসলামী। উল্লেখ্য, তত্ত্বাবধায়ক বা কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থার দাবি মূলত ছিল জামায়াতে ইসলামীর। ব্যবস্থাটি প্রবর্তনের জন্য সংবিধানে সংশোধনী আনার দাবি তুলেছিল আওয়ামী লীগ ও জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো। আন্দোলনের পাশাপাশি দাবিটির যৌক্তিকতা নিয়ে সে সময় বিস্তর বিতর্ক ও আলোচনা হয়েছিল। হরতাল হয়েছিল দিনের পর দিন। শেষ পর্যন্ত বিএনপি সরকার দাবিটি মেনে নিয়েছিল। ১৯৯৬ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করেছিল বিএনপি সরকার। এর ভিত্তিতে গঠিত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১৯৯৬ সালের জুন মাসে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছিল। শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। নিজেরা উপকৃত হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের মনোভাব নিয়ে অবশ্য প্রথম থেকেই প্রশ্ন ও সংশয় ছিল। কারণ, শেখ হাসিনা শুধু একবারের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছিলেন। তখন বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার উদ্দেশ্য ছিল কোনোভাবে একবার ক্ষমতায় যাওয়া এবং তারপর ক্ষমতা স্থায়ী করা। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ব্যবস্থাটিকে স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছিল। নামসর্বস্ব বামপন্থী দলগুলোও জামায়াতের দাবির পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার সরকারও সে অনুযায়ী সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী উত্থাপন করেছিল। সেটা পাসও হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় গিয়েই আওয়ামী লীগ অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের জন্য প্রকাশ্যে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সে সময় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভবত ভাবতেই পারেননি যে, পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে তার দলের ভরাডুবি ঘটবে। ভাবতে না পারার কারণ, নির্বাচনের আগে তার সরকার এমনভাবেই প্রশাসনকে সাজিয়ে গিয়েছিল, যাতে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা না আসতে পারে। অন্যদিকে সেবার মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই শেখ হাসিনার সরকার জনগণকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। একই কারণে ২০০১ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জয়ী হয়েছিল। আওয়ামী লীগের ঘটেছিল লজ্জাকর পরাজয়। ওই নির্বাচনের পর বেগম খালেদা জিয়া আবারও প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। অন্যদিকে প্রথমবারের মতো জামায়াতে ইসলামী মন্ত্রিত্ব নিয়েছিল। দলটির আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং মহাসচিব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ মন্ত্রী হয়েছিলেন। শোচনীয় পরাজয়ের পাশাপাশি জামায়াত নেতারা মন্ত্রী হওয়ায় আওয়ামী লীগের ক্ষোভ সকল সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ওদিকে বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাও জনগণের স্বার্থে এমন কোনো ভূমিকা পালন করেননি, যার কারণে জনগণ আবারও তাকে ক্ষমতায় আনার কথা চিন্তা করবে। ২০০৬ সালের নির্ধারিত নির্বাচন এগিয়ে আসার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশি-বিদেশি প্রতিটি জরিপেই বরং আওয়ামী লীগের পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনার কথা জানানো হচ্ছিল। তখনই শুরু হয়েছিল ষড়যন্ত্র। সে ষড়যন্ত্রের ফলেই ২৮ অক্টোবরের লগি- বৈঠার ভয়াবহ হত্যা-সন্ত্রাস থেকে নির্বাচন বাতিল করাসহ তথাকথিত ওয়ান-ইলেভেন ঘটেছিল। সবই আসলে সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে ঘটানো হয়েছিল। জেনারেল মইন উ আহমেদ ও ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে সামনে রেখে বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্রকেই শুধু বিদায় করা হয়নি, সবশেষে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর যে নির্বাচন আয়োজন করা হয়েছিল তার মাধ্যমেও গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ আলোচনায় যাওয়ার পরিবর্তে এ প্রসঙ্গে সংক্ষেপে বলা যায়, মূলত আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার এবং বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী দলগুলোকে উৎখাত করার লক্ষ্যে ওই নির্বাচন ছিল বড় ধরনের একটি পদক্ষেপ। এর সঙ্গে বৃহৎ প্রতিবেশী এবং আরো কয়েকটি রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক শক্তি জড়িত ছিল বলে ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণিত হয়েছে। দশম সংসদের ওই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে পর্যালোচনা যথেষ্টই হয়েছে। এখনো প্রসঙ্গক্রমে পর্যালোচনা করা হয়। বড় দলগুলোর মধ্যে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীকে কতটা ন্যক্কারজনকভাবে হারিয়ে দেয়া হয়েছিল সে কথা স্মরণ করলে যে কাউকে বিস্মিত ও স্তম্ভিত হতে হয়। তা সত্ত্বেও মূলত বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের পাশাপাশি গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্য থেকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ চারদলীয় জোটকে নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে হয়েছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংসদে বিরোধী দলের নেত্রীর আসনও গ্রহণ করেছিলেন। অন্যদিকে প্রকৃত ফলাফল সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা ছিল বলেই আওয়ামী লীগ সরকার এগিয়েছিল বাঁকা পথেÑ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীনরা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ঘাড়ে ভর করেছিলেন। সরকারের পক্ষে একটি রিট আবেদন পেশ করা হয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গণতন্ত্রের মৌলিক চেতনার এবং সংবিধানেরও পরিপন্থী। কারণ, গণতন্ত্র ও সংবিধানের চেতনা হচ্ছে, দেশে সব সময় একটি নির্বাচিত সংসদ বহাল থাকবে। নির্বাচিত সরকারই দেশ পরিচালনা করবে। এই রিট আবেদনের শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলকারীরা আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করেছিলেন। সে আপিলের রায়ের মূলকথা নিয়ে এখনো বিতর্কের অবসান হয়নি। কারণ, অজুহাত হিসেবে যে রায়কে অবলম্বন করা হয়েছিল সে রায়টি একদিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, অন্যদিকে বিতর্কিত হয়েছে স্ববিরোধিতাপূর্ণ হিসেবে। কেননা, রায়ে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়নি, একথাও বলা হয়েছিল যে, ‘দেশের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে’ পরবর্তী দু’টি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তা ছাড়া এটা ছিল একটি বিভক্ত রায়। পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সাত সদস্যের মধ্যে কতজন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন এবং তারা ঠিক কি অভিমত দিয়েছিলেন সে কথাও এখনো অপ্রকাশিত রয়েছে। বড় কথা, রায়ের নামে যা ঘোষণা করা হয়েছিল তা আসলে ছিল একটি ‘সংক্ষিপ্ত আদেশ’, পূর্ণাঙ্গ রায় নয়। পূর্ণাঙ্গ রায় না দেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো সাংবিধানিক বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু সরকার সে পদক্ষেপই নিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময় বলেছিলেন, সর্বোচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার নাকি ‘আর কোনো সুযোগ নেই’! বলা দরকার, প্রধানমন্ত্রী কিন্তু সংক্ষিপ্ত আদেশের সঙ্গে জুড়ে দেয়া অভিমতটুকুর উল্লেখই করেননিÑ যেখানে বলা হয়েছিল, ‘দেশের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে’ পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। অমন একটি সংকীর্ণ এবং নিজেদের স্বার্থ পূরণকারী চিন্তার ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান যুক্ত করে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করিয়েছিলেন। রাজনৈতিক সংকটের শুরুও হয়েছিল সেখান থেকেই। বিএনপির নেতৃত্বে জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো প্রথম থেকেই ওই সংশোধনীর বিরোধিতা করেছে। উল্লেখ্য, ততদিনে ১৮ দলীয় জোট গঠিত হয়েছিল। কিছুদিন পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি জানালেও বেগম খালেদা জিয়া এক পর্যায়ে ছাড় দিয়ে বলেছিলেন, নির্বাচনকালীন সরকারকে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হতে হবে এবং শেখ হাসিনা ওই সরকারের প্রধান হতে পারবেন না। জাতিসংঘের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং গণচীনও সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহবান জানিয়েছিল। এজন্য প্রধান দু’টি দলকে সংলাপে বসার পরামর্শ দিয়েছিল। অন্যদিকে সংলাপের নামে একের পর এক নাটক সাজিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করলেও তার পেছনের কুটিল ও নোংরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রকাশিত হতে দেরি হয়নি (নভেম্বর, ২০১৩)। তা সত্ত্বেও ১৮ দলীয় জোটের নেতারা বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটকে মধ্যস্থতা করার এবং একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা থেকে সরকারকে নিবৃত্ত করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। জবাবে রাষ্ট্রপতি তার ‘সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার’ কথা শুনিয়ে বলেছিলেন, ১৮ দলীয় জোটের দাবি ও বক্তব্য তিনি সরকারের কাছে পৌঁছে দেবেন! এর পরপর প্রধানমন্ত্রী একদিকে হঠাৎ করে সংসদের চলমান অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটিয়ে সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে নতুন বিধান যুক্ত করার পথ বন্ধ করেছিলেন, অন্যদিকে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির কথিত অনুমতি পাওয়ার খবর জানিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিলেন। আরো কিছু পন্থায়ও রাষ্ট্রপতিকে বিতর্কিত করেছিলেন তারা। স্মরণ করা দরকার, ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটের নেতারা বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটকে রাষ্ট্রের প্রধান ‘অভিভাবক’ এবং ‘জাতীয় ঐক্যের প্রতীক’ হিসেবে সম্মানের সঙ্গে উল্লেখ করে সংকট কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে ভূমিকা পালনের জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। লিখিত বক্তব্যে তারা বলেছিলেন, মহামান্য রাাষ্ট্রপতি যাতে অবিলম্বে সংঘাত, হানাহানি ও হিংস্রতার পথ পরিহার করে সংলাপের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য সরকারকে তাগিদ দেন। সরকার যাতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ একটি সরকারের অধীনে এবং সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে সমঝোতার পথে অগ্রসর হয় তার জন্য উদ্যোগ নেয়ারও আহবান জানিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। তারা অভিযোগ করেছিলেন, ক্রমাগত উসকানি দেয়ার এবং আক্রমণাত্মক বক্তব্য রাখার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনরা সংলাপ অনুষ্ঠানের এবং সমঝোতা প্রতিষ্ঠার সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিচ্ছেন। ফলে সংঘাত ও সহিংসতা অনিবার্য হয়ে পড়ছে। জাতীয় জীবনের এমন এক ক্রান্তিলগ্নে মহামান্য রাষ্ট্রপতিই কেবল সরকারকে নিবৃত্ত করতে পারেন। তিনি চাইলে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার ব্যাপারেও ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি তেমন ভূমিকাই তিনি পালন করবেন বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন ১৮ দলীয় জোটের নেতারা। তারা রাষ্ট্রপতিকে বলেছিলেন, দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকা সহিংসতাকে প্রতিহত না করা গেলে এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাইরে রেখে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা চালানো হলে গণতন্ত্র ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। মারাত্মক সে পরিণতির কবল থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতির উচিত সচেষ্ট হওয়া। অন্যদিকে যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে স্বাগত জানালেও এবং গভীর মনোযোগের সঙ্গে তাদের বক্তব্য শুনলেও রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট নিজের ‘সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার’ কথা তুলে ধরে বলেছিলেন, সদিচ্ছা থাকলেও তার পক্ষে ১৮ দলীয় জোটের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভূমিকা পালন করা বা তাদের দাবি পূরণ করা সম্ভব নয়। তবে তাদের বক্তব্য ও দাবিগুলোকে তিনি সরকারের কাছে পৌঁছে দেবেন। ঘটনাপ্রবাহে ‘সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার’ পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটের সদিচ্ছার দিকটিই বেশি গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্যে এসেছিল। ‘কবর ও মাজার জিয়ারত ছাড়া রাষ্ট্রপতির কোনো কাজ বা ক্ষমতা নেই’ জাতীয় কথাবার্তা মানুষকে বহু বছর ধরেই শুনতে হয়েছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তদের সামনে রেখে পঞ্চদশ সংশোধনীর আড়ালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে প্রতিটি বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতা নিজের তথা প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত করেছিলেন তার ফলে রাষ্ট্রপতিকে নাকি কবর ও মাজার জিয়ারত করার জন্যও প্রধানমন্ত্রীর অনুমতির জন্য হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হয়! রাষ্ট্রপতির হাত-পাও নাকি বেঁধে ফেলা হয়েছে! এসব সত্ত্বেও সংবিধানে কিন্তু এ কথাও বলা আছে যে, রাষ্ট্রপতি যে কোনো বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভাকে ‘পরামর্শ’ দিতে পারবেন। বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি যেহেতু ‘মহামান্য’ সেহেতু তার ‘পরামর্শ’ই নৈতিক দিক থেকে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার তথা সরকারের জন্য ‘নির্দেশ’ হয়ে উঠতে পারে, ওঠা উচিতও। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে রাষ্ট্রপতি এমনকি নৈতিকভাবে চাপও সৃষ্টি করতে পারেন। উল্লেখ্য, মন্ত্রিসভার বা সংসদের যে কোনো সিদ্ধান্ত বা আইনে অনুমোদন দেয়ার আগে সেটা পুনর্বিবেচনার জন্য তিনবার পর্যন্ত ফেরত পাঠানোর ক্ষমতাও সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে রেখেছে। এর ব্যাখ্যায়ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার দিকটিই প্রাধান্যে এসেছিল। সুতরাং একথা ঢালাওভাবে বলার অবকাশ ছিল না যে, রাষ্ট্রপতির হাত-পা বাঁধা এবং কবর ও মাজার জিয়ারত ছাড়া রাষ্ট্রপতির আর কোনো কাজ বা ক্ষমতা নেই। ব্যাখ্যার আলোকে বরং বলা হয়েছিল, যা কিছুই লেখা থাকুক না কেন, সাংবিধানিকভাবেই তিনি ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি’। একই কারণে বেগম খালেদা জিয়া ও ১৮ দলীয় জোটের নেতারা রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তখন বলা হয়েছিল, এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রথম বিএনপি সরকারের রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের উদাহরণও অনুসরণ করতে পারতেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রশ্নে ১৯৯৫-৯৬ সালে যখন রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস তখন বিচারপতি ও সিনিয়র আইনজীবীসহ নাগরিক সমাজের অনেক বিশিষ্টজনের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। তাদের অভিমতের ভিত্তিতেই তিনি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ‘পরামর্শ’ দিয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রপতির সে ‘পরামর্শ’ অনুযায়ীই প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গঠিত ষষ্ঠ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধান যুক্ত করে সংবিধান সংশোধ করেছিলেন। এটাই ছিল সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী। এর পর ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন খালেদা জিয়া। অন্যদিকে সংঘাত ও হরতালসহ প্রচন্ড সংকটের মুখেও রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের উদাহরণ অনুসরণ করেননি। অথচ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেছিলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতিকে অনুসরণ করা হলে সংকট কাটিয়ে ওঠা সময়ের বিষয়ে পরিণত হতে পারতো। গণতন্ত্র রক্ষাসহ বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই রাষ্ট্রপতির উচিত ছিল প্রধানমন্ত্রীকে এমনভাবে ‘পরামর্শ’ দেয়া যাতে তিনিও বেগম খালেদা জিয়ার মতো প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং ১৮ দলীয় জোটের দাবি অনুযায়ী সংবিধানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের বিধান যুক্ত করেন। সংসদ তখনও বহাল থাকায় রাষ্ট্রপতি যে কোনো সময় অধিবেশনও আহবান করতে পারতেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তেমন কোনো উদ্যোগ নেননি। আর সে সুযোগ নিয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন। এর পরই আয়োজিত হয়েছিল এমন এক নির্বাচন, যে নির্বাচনে ১৫৪ জনই বিনা ভোটে ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন! ৫ জানুয়ারির সে নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাওয়ার সময়ও প্রধানমন্ত্রী যথেষ্টই মারপ্যাঁচ কষেছিলেন। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতির ‘সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা’ সম্পর্কে জানা থাকা সত্ত্বেও বঙ্গভবনে যাওয়ার এবং রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটের কাছে দাবি ও বক্তব্য তুলে ধরার মধ্য দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া শুধু সদিচ্ছারই প্রমাণ দেননি, দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেত্রীর ভূমিকাও পালন করেছিলেন। কারণ, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার হুবহু পুনর্বহালের দাবি পরিত্যাগ করার পাশাপাশি অনেক আগেই তিনি অন্য এমন সব বিষয়ে ছাড় দিয়েছিলেনÑ যেগুলোকে অজুহাত বানিয়ে ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক সংকটের সমাধানকে অসম্ভব করতে এবং বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপাতে পারতেন। খালেদা জিয়া শুধু একটি বিষয়ে অনড় থেকেছেন। সেটা নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার সম্পর্কিত। এ সরকারের রূপরেখায় তিনি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী বা সরকার প্রধানের পদে শেখ হাসিনাকে রাখা চলবে না। বিষয়টি নিয়ে সংসদের ভেতরে-বাইরে যে কোনো স্থানে সংলাপে বসার ব্যাপারেও সম্মতি জানিয়ে রেখেছিলেন তিনি। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগিয়েছিলেন তার একতরফা নির্বাচনের নীলনকশা অনুযায়ী। প্রধানমন্ত্রী এমনকি টেলিফোন সংলাপ নিয়েও নাটক সাজিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে সে সময় সর্বাত্মক উসকানি দেয়ার অভিযোগ উঠেছিল। বিদেশীদের পরামর্শ ও আহবানের জবাবেও প্রধানমন্ত্রী অনড় অবস্থানেই থেকেছেন। মুখে সংলাপ ও সমঝোতার কথা বললেও প্রধানমন্ত্রী সে সময় ‘সর্বদলীয়’ সরকারের নামে নিজের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মহাজোট সরকারের সম্প্রসারণ করেছিলেন। রাশেদ খান মেনন প্রমুখ মন্ত্রী রাতারাতি আওয়ামী মহাজোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার এবং আবারও মন্ত্রিত্ব গ্রহণের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যেন সত্যিই কোনো ‘সর্বদলীয়’ সরকার গঠন করেছেন প্রধানমন্ত্রী! এই চেষ্টা অবশ্য সফল হয়নি। কারণ, কথায় কথায় সংবিধানের দোহাই দিলেও ক্ষমতাসীনরা দেখাতে পারেননি, প্রধানমন্ত্রীর ওই ‘সর্বদলীয়’ সরকারের বিধান সংবিধানের ঠিক কোন অনুচ্ছেদ বা উপ-অনুচ্ছেদে রয়েছে। অর্থাৎ ‘সর্বদলীয়’ সরকারের ব্যাপারে তারা আসলে সংবিধান লংঘন করেছিলেন। তাদের উদ্দেশ্যও গোপন থাকেনি। সে উদ্দেশ্যের মধ্যে ছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংবিধানবহির্ভূত এমন একটি ‘সর্বদলীয়’ সরকার গঠন করা, যার মাধ্যমে লোক দেখানো নির্বাচন করে আবারও ক্ষমতায় আসা যাবে। বাস্তবেও সেভাবেই ক্ষমতায় এসেছিলেন তারা। অথচ উদ্দেশ্যে সততা এবং গণতন্ত্রের প্রশ্নে সদিচ্ছা থাকলে ক্ষমতাসীনদের উচিত ছিল অন্তত নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের ব্যাপারে সম্মত হওয়া। বলা দরকার, মূলত বৃহৎ একটি প্রতিবেশীর সহযোগিতায় এখনো ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারলেও আগামী সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ক্ষমতাসীনদের পাশাপাশি সমগ্র জাতিকেও নতুন পর্যায়ে প্রচন্ড সংকটের মুখে পড়তে হবে। প্রায় নিশ্চিত এই সংকট এড়াতে হলে ক্ষমতাসীনদের উচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে তাদের নীতি ও সিদ্ধান্তে পরিবর্তন ঘটানো। সর্বোচ্চ আদালতকে টেনে আনার এবং বিতর্কিত করার পরিবর্তে তারা যদি বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাব অনুযায়ী ‘সহায়ক’ সরকারের অধীনেও নির্বাচন করতে সম্মত হন তাহলেই সংকট কাটানো সম্ভব হতে পারে। দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ক্ষমতাসীনদের একগুঁয়েমি ও উসকানিমূলক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতেই রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। ‘সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার’ কথা তিনি স্মরণ করিয়ে দিতেই পারেন কিন্তু এ কথাও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দলগুলো এখনো তাকে রাষ্ট্রের প্রধান অভিভাবক এবং জাতীয় ঐক্যের প্রতীক মনে করে। আর একথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মানুষের জন্যই সংবিধান, সংবিধানের জন্য মানুষ নয়। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এই কথাটার তাৎপর্য অনুধাবন করে ক্ষমতাসীনদের বোঝানোর উদ্যোগ নিলেই তার পক্ষে জাতির স্বার্থে ‘ঐতিহাসিক দায়িত্ব’ পালন করা সম্ভব হবে। আর সে পথ ধরেই দেশে আবারও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এজন্য এমনকি সংবিধান সংশোধন করারও দরকার পড়বে না। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির