post

স্থাপত্যকলায় মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব

এম. মুহাম্মদ আব্দুল গাফ্ফার

১১ জুলাই ২০২০

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা মানুষকে সৃষ্টির সেরা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন ‘আদম সন্তানকে আমি শ্রেষ্ঠত্বের বৈশিষ্ট্য দান করেছি, তাদেরকে স্থল ও জলপথে যানবাহন দান করেছি এবং তাদেরকে পাক-সাফ জিনিস দ্বারা রিজিক দিয়েছি, আমার বহু সংখ্যক সৃষ্টির ওপর সুস্পষ্ট প্রাধান্য দান করেছি। এসব আমারই একান্ত দয়া ও অনুগ্রহ।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৭০)। মহান রাব্বুল আলামিনের এ ঘোষণা দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, মানুষকে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্ব দান করে পৃথিবীর অসংখ্য বিষয় ও জীব-জন্তুর ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ তার বুদ্ধি ও বাহুবল খাটিয়ে অবকাঠামো বিনির্মাণসহ পৃথিবীকে সুন্দর আঙ্গিকে সজ্জিত করবে এটাই তো স্বাভাবিক। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা হযরত দাউদ (আ) ও হযরত সোলাইমানের (আ) জামানার ইতিহাস ও জিনদের ওপর হযরত সোলাইমানের (আ) কর্তৃত্বের বিবরণ দানের সূত্র টেনে উল্লেখ করেন ‘তারা তাঁর জন্য তাই বানাতো যা সে চাইতো; উঁচু উঁচু ইমারত, ছবি প্রকৃতি, (প্রাণী তথা জীবজন্তুর ছবি ছাড়া) বড় বড় হাউজ থালার মতো.....।’ (সূরা সাবা : ১৩)। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রেরিত খলিফাদেরকে পৃথিবীতে মসজিদ, বাসগৃহ, দুর্গ, প্রাসাদ ও অট্টালিকা তৈরির কৌশল সম্পর্কিত ইলম দিয়েই পাঠিয়েছিলেন। আম্বিয়ায়ে কিরামগণের অনুগত উম্মতগণ নবী-রাসূলগণের শিক্ষাকে পুঁজি করে পার্থিব জীবনের যাবতীয় কার্যক্রমের আঞ্জাম দিতে সচেষ্ট ছিলেন। এ বিষয়ে সৈয়দ আমীর আলী লিখেন মুসলমানদের ধর্মকে চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্যের দিক দিয়ে অনুন্নত বলে অভিযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, চিত্র সম্পর্কে কুরআনের নিষেধাজ্ঞা বাইবেলের লেডিটিকাসের অনুশাসনের মতো। এটা মূসার বিধানের সম্প্রসারণ ছাড়া আর কিছুই নয়; লক্ষণীয় যে, মূসার বিধান ইহুদিদের মধ্যে খোদাই মূর্তিশিল্প কঠোরভাবে দমন করে, আর এর যৌক্তিকতার ভিত্তি হচ্ছে প্রাক-ইসলামী আরবদের ঘোর পৌত্তলিক স্বভাব। অতএব মুসলমানদের জন্য (প্রাণীর) চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্য ঘৃণিত ও নাযায়েজ। আর মূর্তির বিরোধিতা নিঃসন্দেহে ইসলামকে পৌত্তলিকতায় প্রত্যাবর্তনের বিপদ থেকে রক্ষা করেছে, যা অন্যান্য জাতির বেলায় রক্ষা পায়নি। (বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান, মুহাম্মদ রহুল আমীন)। মুসলিম স্থাপত্যগুলো দুটি ধারায় গড়ে উঠেছে। একটি ধারা হলো ধর্মীয় স্থাপত্য; যেমন- মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ দরগাহ ইত্যাদি। দ্বিতীয় ধারাটি হলো লৌকিক স্থাপত্য যেমন- শহর, নগরতোরণ, দুর্গ, দরবারকক্ষ, বাসগৃহ, প্রাসাদ, স্মৃতিস্তম্ভ, উদ্যান, সেতু, পানি নিষ্কাশনের নালা ইত্যাদি। এসমস্ত স্থাপত্য শিল্পকলার আবার সময় তথা কালভেদে পার্থক্য রয়েছে। যেমন- (১) প্রাচীন যুগের স্থাপত্যসমূহ, (২) মধ্যযুগের স্থাপত্যসমূহ ও (৩) আধুনিক যুগের স্থাপত্যসমূহ। মুসলিম স্থাপত্যকলাসমূহ আবার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের প্রভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের প্রথম ধাপই হলো মসজিদ। আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষ পাঠিয়ে মানুষকে তাঁর ইবাদত করার জন্য ইবাদতগৃহ বা মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ জারি করেছেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে, হযরত আদম (আ) প্রথম পৃথিবীতে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। হজরত নূহের (আ) সময়ের মহাপ্লাবনে সেটা বিধ্বস্ত হলে ঐ স্থানেই হযরত ইবরাহিম (আ) আল্লাহর নির্দেশে পুনরায় কাবাগৃহ নির্মাণ করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘স্মরণ কর ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ) যখন এ ঘরের প্রাচীর রচনা করছিল, তখন উভয়েই দোয়া করছিল- ‘হে আমাদের রব! আমাদের এ কাজকে তুমি কবুল করো; নিশ্চয়ই তুমি সবকিছু শুনতে পাও এবং সবকিছু জানো।’ (সূরা বাকারা : ১২৭)। পবিত্র কুরআনুল কারীমই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ) পৃথিবীতে আল্লাহর ঘর স্থাপনের মধ্য দিয়ে স্থাপত্যশিল্পের পিতা হিসেবেও মুসলিম জাহানে পরিচিতি লাভ করেন। এরপর হযরত সোলায়মান (আ) কর্তৃক মসজিদুল আকসা তথা বায়তুল মোকাদ্দাস নির্মাণ মুসলিম বিশ্বের একটি অমর কীর্তি। এ কথা পরিষ্কারভাবে বলা যায় যে, ইসলামের আবির্ভাবের প্রাক্কালে আরবে তেমন কোন স্থাপত্য ছিল না। উট ও ভেড়ার লোমের তৈরি তাঁবুতে তারা বাস করতো। মহানবীর (সা.) বিশ্বে পদার্পণের পূর্বে স্থাপত্য বলতে যা গৌরবোজ্জ্বল ছিলো তা হলো চুতষ্কোণাকৃতি কাবাঘর ও জেরুজালেমের বায়তুল মোকাদ্দাস। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত মদীনায় মহানবীর (সা.) মসজিদ আরব স্থাপত্যের প্রকৃত সূচনা করে। কাঁচা ইট, কাদামাটি ও খেজুর বৃক্ষ আচ্ছাদিত হয়ে এ মসজিদের যাত্রা শুরু হয় যা আজ বিশ্ব স্থাপত্যশিল্পের এক ঐতিহ্যমণ্ডিত অমূল্য সম্পদ। নির্মাণের প্রথম দিকে মোটামুটি ১০০ বর্গহাত আয়তন, ৭ হাত উচ্চতার চারিদিকে দেয়াল দুই সারিতে ১৮টি করে খেজুর গাছের স্তম্ভ, প্রথমে ছাদবিহীন ও পরে খেজুর পাতায় ছাউনিযুক্ত, যাতে ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ঝাউকাঠের তিন ধাপের একটি মিম্বর স্থাপন করা হয়। এ মসজিদ সম্পর্কে ঐতিহাসিক রিচমন্ড মন্তব্য করেন, It is an old still accepted idea that the mosque of Muhammad (sm) at Madina represents in an elementary from the prototype of the congregational Mosque of the first centuries of Islam. ৬২২ খ্রি. থেকে ৬৬১ খ্রি. পর্যন্ত মুসলিম স্থাপত্যের প্রাথমিক যুগ হিসেবে চিহ্নিত। এ সময় বিভিন্ন প্রাদেশিক গভর্নর যেমন আবু মুসা আশআরী, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, আমর ইবনুল আস যথাক্রমে বসরা, কুফা ও মিশরের ফুসতাতে মসজিদ নির্মাণ করেন। এসব স্থাপত্যশৈলীর প্রভাবে মুসলিম স্থাপত্যশিল্পী ও কারিগরগণ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সুরম্য প্রাসাদ, নগরী, বাগান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যরীতির অনুসরণে মসজিদ নির্মাণ করেন। ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ মসজিদ নির্মিত হয় দামেস্কের জামে মসজিদ। উমাইয়া খলিফা আল ওয়ালিদের বাইজেন্টাইন, কপটিক, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সহায়তায় এই জমকালো মসজিদটি নির্মিত হয়। আল্লামা মাসউদির মতে ৭০৬ খ্রি. এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। পূর্ব-পশ্চিমে ১২২.৫ মিটার, উত্তর দক্ষিণে ২৭ মিটার আয়তন বিশিষ্ট দামেস্ক মসজিদে সর্বপ্রথম ট্রান্সেপ্টে নির্মিত হয়। এ মসজিদে কিবলা প্রাচীরে চারটি মিহরাব এবং প্রধান মিহরাবের পাশে ১৩ ধাপবিশিষ্ট একটি মিম্বার রয়েছে। রিওয়াক, ওজুখানা, চারটি মিনার, সাহল মিলে এক পূর্ণাঙ্গ কাঠামো দেয়া হয়। মোজাইক চিত্রে বৃক্ষ, লতাপাতা, জ্যামিতিক নক্সা ও আরবি লিপিশৈলীর অপূর্ব অলঙ্কার একে অনন্য সৌন্দর্যের মর্যাদা দিয়েছে। আল মুকাদ্দেসির ভাষায় এটা বিশ্বের সুন্দরতম ইমারত হিসেবে গণ্য। ঐতিহাসিক হিট্টি একে মক্কা, মদীনা ও জেরুজালেমের পর চতুর্থ শ্রেষ্ঠ ইবাদতগাহ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মুসলমান শাসনামলে শহর, বন্দর, পান্থশালা, মিনার ও দরবারকক্ষ নির্মিত হওয়ার সাথে সাথে অনিন্দ্য সুন্দর মসজিদগুলো আজও পৃথিবীতে ইসলামী ঐতিহ্যের অতুলনীয় কীর্তি ঘোষণা করে যাচ্ছে। উমাইয়া শাসনামলে দামেস্ক, মিশর, আফিকা ও স্পেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সুউচ্চ ইমারত ও মসজিদসমূহ নির্মাণ করা হয়েছিল। আব্বাসীয় খলিফা আল মামুনের আমলে মিশরের শাসনকর্তা আহমদ ইবনে তুলুনের বহুবিদও কীর্তিসমূহের মধ্যে তাঁর নির্মিত মসজিদটি শ্রেষ্ঠ কীর্তি। আব্বাসীয় যুগের নির্মিত যে অল্পসংখ্যক স্থাপত্য নিদর্শন মূল কাঠামোসহ দণ্ডায়মান এটি তন্মধ্যে একটি। আবেষ্টনীসহ মোট দৈর্ঘ্য ৪৬০ ফুট এবং প্রস্থ ৪০১ ফুট। এ মসজিদের সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে কায়রোর আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান উৎ. ঔড়যহ. ঝ. ইধফবধহ মন্তব্য করেছেন: ইবনে তুলুনের মসজিদের যে মহিমা ও সহজ সরল রূপ, সে রকম একটি স্থানই আমার কামনার, যেখানে আমি প্রার্থনা করে ¯্রষ্টার নৈকট্য বোধ করতে পারতাম।’ (সূত্র : বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান গ্রন্থ, মুহাম্মদ রহুল আমীন)। আব্বাসীয় আমলের আরেকটি অমর কীর্তি বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদ সামারার জামে মসজিদ। তুর্কিদের উৎপাত থেকে রাজধানীকে নিরাপদ রাখার জন্য খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ বাগদাদের ষাট মাইল উত্তরে দজলা নদীর তীরে সামারা নগরী ও সেনানিবাস নির্মাণ করেন। সামারার জামে মসজিদ ছিলো বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদ। উত্তর দক্ষিণে ৭৮৪ ফুট এবং পূর্ব পশ্চিমে ৫১২ ফুট আয়তন বিশিষ্ট ৪০ একর অর্থাৎ ১২০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত এ মসজিদের স্থাপত্যকলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হচ্ছে উত্তর দিকে প্যাঁচ বিশিষ্ট মালবিয়া মিনার তৈরি। মূল ভবন থেকে ৮৯ ফুট দূরে অবস্থিত এটি ৮২ ফুট দীর্ঘ ৩৯.৫ ফুট প্রস্থ ও ১০ ফুট উঁচু অবস্থিত একটি সেতু দ্বারা মসজিদের সাথে সংযুক্ত ছিলো। এ ছাড়া ইস্পাহান জামে মসজিদ ছিলো মুসলিম জাহানের একটি অনন্য সৌন্দর্যমণ্ডিত দর্শনীয় কীর্তি। তামিনী আরবদের নবম শতকের প্রথম দিকে এটি শুরু হলেও সর্বশ্রেষ্ঠ সেলজুক শাসক মালিক শাহের আমলে এটার পরিপূর্ণ কাঠামো নির্মিত হয়। মালিক শাহের বিখ্যাত প্রধানমন্ত্রী ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব নিযামুল মুলকের পরিকল্পনায় এর বৈচিত্র্যময় কাঠামো নির্মিত হয়। এ মসজিদের জুল্লাহ গম্বুজ, খিলান মিহরাব ও বিভিন্ন গ্যালারি চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। এ মসজিদ সম্পর্কে আর্থার উপহাম পোপ উল্লেখ করেছেন, The power and nobility of Seljuk architecture is doubtless best ememplified by the Masjid-e-jame at Isfahan, of the greatest mosques in the world. ৭১২ খ্রি. তাবিক বিন জিয়াদ স্পেন অধিকার করে ইউরোপের মাটিতে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন করেন। মুসলমানগণ কর্তৃক কর্ডোভা নগরী প্রতিষ্ঠা ও তথায় স্পেনের রাজধানী স্থাপিত হলে উমাইয়া শাসক প্রথম আবদুর রহমান কর্ডোভা মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং পরপর কয়েকজন শাসক কর্তৃক মসজিদ সম্প্রসারণ ও পুনর্নির্মাণের পর দ্বিতীয় হিশামের আমলে সর্বশেষ সম্প্রসারণের পর ৯৮৮ খ্রি. মসজিদের পরিমিতি দাঁড়ায় উত্তর দক্ষিণে ৫৮৫ ফুট এবং পূর্ব পশ্চিমে ৪১০ ফুট। এটাই ছিলো পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মসজিদ। ১২৯৩টি স্তম্ভের ওপর বিশাল ছাদবিশিষ্ট উজ্জ্বল পিত্তল বিমণ্ডিত ২২টি দরজা, রৌপ্যে আবৃত মেঝে, ইহার সারি সারি স্তম্ভ স্বর্ণ ও ঘোর কৃষ্ণ বর্ণের প্রস্তরে মণ্ডিত ছিলো। মিম্বর গজদণ্ডও উৎকৃষ্ট কাষ্ঠে তৈরি ছিলো যাতে ৩৬০০০ (ছত্রিশ হাজার) পৃথক খোপ ছিলো, যার অনেকগুলোই মূল্যবান প্রস্তরে ও সোনার পেরেকে আবদ্ধ ছিলো। অজুখানাগুলোয় পাহাড় থেকে অহর্নিশ পানি এসে পরিপূর্ণ হতো। ষোড়শ শতাব্দীতে স¤্রাট পঞ্চম চার্লস এ মনোরম মসজিদের মধ্যাংশ ভেঙে গির্জা নির্মাণ করেন। শেষ জীবনে অবশ্য তিনি এ অনুপম শিল্পের অবমাননার জন্য আক্ষেপ করেছিলেন। ইতিহাসের বিচারে কর্ডোভায় এটাই সৌন্দর্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলো বলে অনেকের ধারণা। মিশরের বিখ্যাত আকর্ষণীয় স্থাপত্য হলো আল আজহার মসজিদ। এ মসজিদের জমকালো বৈশিষ্ট্যের কারণে এর নাম দেয়া হয় আজহার, কারো কারো মতে নবীনন্দিনী হযরত ফাতিমাতুজ্জাহরার (রা) নামানুসারে আল আজহার নাম রাখা হয়। এছাড়া মিশরে মাহদিয়া মসজিদ, আল হাকিমের মসজিদসহ বহু মসজিদ আজও মুসলমানদের স্থাপত্যকলার জৌলুস ঘোষণা করছে। ভারতের দিল্লি জামে মসজিদ, তুরস্কের ইস্তাম্বুলের মসজিদসহ সারা দুনিয়ায় মুসলমানগণ কর্তৃক নির্মিত অসংখ্য মসজিদ মুসলমান স্থপতিদের অতুলনীয় কৃতিত্বের মহিমা ঘোষণা করছে। মসজিদ ছাড়া মুসলমানদের অন্যান্য স্থাপত্যশিল্পের বর্ণনা এ স্বল্প পরিসরে বর্ণনা করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। বিখ্যাত উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারোয়ান ৬৯৯ খ্রি. জেরুসালেমে মহানবীর (সা.) মিরাজের স্মৃতি বিজড়িত স্থানে পাথরের ওপর নির্মিত গম্বুজ বিশিষ্ট ইমারত নির্মাণ করেন। আরবিতে যাকে বলা হয় কুব্বাত আস সাখরা (উড়সব ড়ভ ঃযব জড়পশ)। ভূমি নক্সার মাধ্যমে একটি গোলাকৃতি দুটি অষ্টভুজ দ্বারা পরিবেষ্টিত করা হয়েছে নিখুঁত জ্যামিতিক পদ্ধতিতে। প্রথম ৮টি স্তম্ভের মাঝে ২৫টি খিলান ছিলো। আর এর স্তম্ভ ছিলো মোট ১৬টি। এ মসজিদের অভ্যন্তরে মিরাজের স্মৃতি বিজড়িত ৬০ ঃ ৪৪ ফুট আকৃতির প্রস্তরখণ্ড স্থাপিত ছিলো। মর্মর পাথরে বিচিত্র রঙের সোনালি, নীল, সবুজ মোজাইক ও ঝিনুক কাজের চাকচিক্য একে দারুণ সুষমামণ্ডিত তথা সৌন্দর্যের শীর্ষ দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত করেছিল। এর সৌন্দর্য দর্শনে বিমুগ্ধ রিচমন্ড মন্তব্য করেন The Dome of the rock is the earliest existing monument of muslim architecture. ভারতে মুসলিম শাসনামলের মামলুক স্থাপত্যের মধ্যে ১১৯৭ খ্রি. কুতুবউদ্দীন আইবেক নির্মিত কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ ও তার অদূরে কুতুব মিনার ভারতের একটি অনন্য দর্শনীয় স্থাপত্য। এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হলো এর জুল্লার সামনে নির্মিত পাঁচটি খিলানের একটি স্ক্রিন। বিখ্যাত সাধক কুতুবউদ্দীন কাকির নামে এর নাম রাখা হয় কুতুব মিনার। স্যার জন মার্শাল তার Cambridge History of India MÖ‡š’ D‡jøL K‡i‡Qb Thanks to the strength of their binding properties is was possible for the Muslim builders to achieve effect of grandeur such as the Indians had never dreamt of. মুঘল আমলে নির্মিত ময়ূর সিংহাসন, দেওয়ানি আম, দেওয়ানি খান ও তাজমহল ভারতের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তি। মুসলমান শাসকগণের নগর ও প্রাসাদ নির্মাণ পরিকল্পনা ছিল অত্যন্ত সুন্দর পরিকাঠামো ও রুচিসম্মত স্থাপত্যশৈলীর দিকদর্শনের ওপর ভিত্তি করেই নির্মিত। মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় আগমন করে ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে মদীনায় মসজিদ নির্মাণের মাধ্যমে সুস্থ স্থাপত্য রীতির সূচনা করেন। আমর ইবনুল আস মিশর দখল করে ফুসতাত নগরী, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ও আবু মুসা আসয়ারীর যথাক্রমে কুফা ও বসরা শহর নির্মাণের কথা আগেই বলা হয়েছে। এ ছাড়া মিশরের স্থাপত্যরীতির গৌরব ফাতেমী সুলতানদের আমলে পূর্ণতা লাভ করে। আব্বাসীয় খলিফা মনসুর ফুরাতের তীরে বাগদাদ নগরী নির্মাণ করেন। যেখানে পূর্বে বাজার বসতো এবং অনতিদূরে রাক্কা শহর নির্মাণ করেন যা ঐ সময় সারা বিশ্বের মধ্যে অত্যন্ত জমকালো তথা সৌন্দর্যমণ্ডিত নগরী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয় পরবর্তীতে মোঙ্গল সেনাপতি নিষ্ঠুর হালাকু খাঁর ধ্বংসলীলায় সেই প্রাচীন বাগদাদ নগরীর আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। মুসলমানগণ ভারতে আগমনের সাথে সাথে এদেশে নগর বন্দরসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে থাকেন ভারতের বিখ্যাত বাণিজ্য বন্দর মাদ্রাজ মুসলিম বণিকগণ কর্তৃক গড়ে উঠেছিল যার নাম পরিবর্তন করে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকার রেখেছে চেন্নাই। এভাবে ঐতিহাসিক বোম্বাই নগরীর নাম করেছে মুম্বাই। উত্তর ভারতের এলাহাবাদ শহরের নামও পরিবর্তন করা হয়েছে। মুহম্মদ বিন তুগলকের পূর্ব নাম ছিল জনা খান, তার নামানুসারে জৌরপুর শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। মুঘল স¤্রাট আকবর দিল্লির পরিবর্তে ফতেহপুর সিক্রিতে নতুন রাজধানী স্থানান্তরকল্পে জমকালো একটি শহর গড়ে তুলেছিলেন। স¤্রাট শাহজাহান একটি সৌন্দর্যমণ্ডিত শহর শাহজাহানাবাদ নির্মাণ করেছিলেন। এভাবে ঢাকা তথা জাহাঙ্গীরাবাদ, রাজমহল, গৌড় গড়ে তুলেছিলেন। দিল্লি জামে মসজিদের সাবেক ইমাম সৈয়দ আবদুল্লাহ বোখারী যথার্থই বলেছেন যে, ভারতকে সজ্জিত করেছে মুসলমানেরাই। মুসলমানদের স্থাপত্যকলার এ কৃতিত্ব শুধু প্রাচ্যেই নয় পাশ্চাত্যেও এর কারুকার্য ও ভুবনমোহিনী নির্মাণশৈলী দর্শনে আজও সত্যানুসন্ধানকারী মানুষকে অতীতের সৌন্দর্য সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। প্রথম আবদুর রহমানের শুরু করা কর্ডোভা নগরী স্পেনের শেষ শক্তিমান শাসক তৃতীয় আবদুর রহমানের আমলে পূর্ণতা লাভ করে। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুযায়ী ২১টি শহরতলিসহ প্রায় ১৪ মাইল দীর্ঘ ও ৭ মাইল প্রস্থ কর্ডোভা নগরী তদানীন্তন পৃথিবীর স্বপ্নপুরী নগররাণী হিসেবে সবার কাছে পরিচিত ছিল। প্রায় ২ লক্ষাধিক বাসগৃহ, ৩ সহস্রাধিক মসজিদ, ৬০ হাজার অট্টালিকা তথা বিশালাকায় ইমারত ছিল কর্ডোভা নগরীর শ্রেষ্ঠত্বের মূল উপকরণ। যে যুগে লন্ডন, প্যারিস ও রোমের মত নগরীগুলোতে জ্বলতো রাতে টিপ টিপ করে কেরোসিনের বাতি, সে আমলে কর্ডোভা নগরীর উজ্জ্বল আলোয় ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরে রাত্রে বণিকেরা দিক নির্ণয় করতে পারতো। যখন বিদ্যুৎ আবিষ্কার হয়নি রাতে সরকারি আলোয় অধিবাসীরা দশ মাইল পথ অতিক্রম করতে পারতো। এমনকি কর্ডোভার রাস্তায় সুঁচ হারিয়ে গেলেও খুঁজে বের করা যেতো। এ সম্পর্কে Draper লিখেন, Cordova… boasted of more than 200,000 houses and more than a million of inhabitants, After sunset, a man might walk though it in a straight line for ten miles by the light of the public lamps. Seven hundred years after this time there was not so much as one public lamp in London. তৃতীয় আ: রহমান তার পত্নী রাণী জাহরার নামানুসারে ৮৪০ বিঘা জমির ওপর অতি মনোরম শহর নির্মাণ করেছিলেন যা ছিল অত্যন্ত্য সৌন্দর্যমণ্ডিত প্রাসাদের সমাহার। গ্রানাডার আল হামরার বর্ণনা দিয়ে প্রবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি করতে চাই না যেটা নেপোলিয়ানের সৈন্যদের ধ্বংসযজ্ঞের পরও পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থাপত্য। স্থাপত্যকলায় বর্তমান সময়েও মুসলিম কলাকৌশলীগণ যে একেবারে পিছিয়ে রয়েছে তা বললে ভুল হবে। কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন হিসেবে পরিগণিত Sears Tower এর স্থপতি ছিলেন বাংলাদেশের ডক্টর এফ আর খান। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে ১৪৫৪ ফিট উচ্চতার এ ভবন এক বিস্ময়কর প্রযুক্তিতে তৈরি। ডক্টর ফজলুর রহমান খান ১৯৬৫ সালে ১০০ তলাবিশিষ্ট Jhon Hancock Center এরও মূল স্থপতি ছিলেন তিনি। Engineering News Record তাঁকে যথাক্রমে ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে বিশ্বের সেরা স্থাপত্য মানব নির্বাচিত করে। তাছাড়া তিনি পৃথিবীর বৃহৎ বিমানবন্দর জেদ্দা এবং হজ্জটেস্ট নির্মাণে স্বীয় স্থাপত্য মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। আমেরিকানরা তাঁর কৃতিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবশত শিকাগোর কেন্দ্রস্থলে ৮ ফুট মঞ্চের ওপর ব্রোঞ্জ ও স্টেনলেস স্টিলের ১৫ ফুট দীর্ঘ এক আবক্ষ মূর্তি নির্মাণ করেছে যা ইসলামে সম্পূর্ণরূপে হারাম। তারা উক্ত ভাস্কর্যের পেছনে লিখেছে The Structural Engineers Association of Illionis recognized Fazlur Rahman khan one of the great Structural Engineers of our time. . (সূত্র : ইসলামের ইতিহাস, শিবলী নোমানী রচনাবলী, বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান, মুহাম্মদ রহুল আমীন ও ইসলামী বিশ্বকোষ)। লেখক : সদস্য, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, সিরাজগঞ্জ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির