post

স্বজাতিপ্রীতি ও ইসলাম

রাহাত বিন সায়েফ চৌধুরী

০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২

জাতি, জাতীয়তা ও জাতীয়তাবাদ পরস্পর কাছাকাছি হলেও অর্থের দিক থেকে পরস্পরের মধ্যে রয়েছে সূক্ষ্ম পার্থক্য। যদিও অনেকেই এই তিনটি টার্মকে এক করে ফেলেন। জাতি একটি স্বকীয় সত্তা, জাতীয়তা মূলত একটা সাংস্কৃতিক অনুভূতি যার ভিত্তিতে একটা জাতি তৈরি হয় এবং জাতীয়তাবাদ হচ্ছে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি।

জাতিগঠনের মূল উৎস হচ্ছে সংস্কৃতি, সংস্কৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান হচ্ছে ভাষা। সাংস্কৃতিক জাতিগত চেতনা, যা গড়ে উঠতে বা ধ্বংস হতে শতশত বছর লেগে যায়। তাই এটাকে খুব ঠুনকো মনে করার সুযোগ নেই। বিশেষজ্ঞগণ ধর্মকেও সংস্কৃতির একটা উপাদান হিসেবে দেখেছেন। তবে সংস্কৃতির ছাত্র হিসেবে আমার মনে হয়, ধর্মও সংস্কৃতির মতোই শক্তিশালী আলাদা একটি শক্তি। ইসলামের সাথে জাতি ও জাতীয়তার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তাই জাতিগত স্বকীয়তা লালন করা, জাতির প্রতি ভালোবাসা ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো অপরাধ নয়। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই মানুষকে বিভিন্ন জাতি, গোত্র ও ভাষায় বিভক্ত করে সৃষ্টি করেছেন- “হে মানুষ! আমি তোমাদের একই স্ত্রী-পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করে দিয়েছি- শুধু এজন্য যে, যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো।” (সূরা হুজুরাত : ১৩)

আল্লাহ তায়ালা একই সময়ে আলাদা আলাদা জাতির কাছে, আলাদা নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন, দিয়েছেন আলাদা ধর্মগ্রন্থ। আমাদের রাসূল সা.কেও পাঠিয়েছেন আরবদের মধ্যে, আরবদের ভাষায়। রাসূল সা. নিজেকে আবদুল মুত্তালেবের বা কুরাইশ বংশের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতেন। একজন আরব হিসেবে তিনি তাঁর সংস্কৃতিরও যথাযথ চর্চা করেছেন। তাই আমাদেরও জাতিগত পরিচয়কে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ইসলাম জাতিগত বৈচিত্র্য বা নিজ জাতির প্রতি অনুরাগ মেনে নেয়, কিন্তু কারো জাতিগত অহমিকা (জার্মানদের রক্ত নীল) বা স্বার্থপরতা (White Man's Burden) মেনে নেয় না, আধুনিক পরিভাষায় যাকে জাতীয়তাবাদ বলা হয়। কারণ কোনো জাতিই সব দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, প্রত্যেক জাতিরই অন্য জাতির কাছ থেকে কিছুনা কিছু শেখার আছে। সর্বোপরি, আল্লাহ তায়ালার কাছে শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র মানদণ্ড হচ্ছে তাকওয়া। ইসলামের দৃষ্টিতে জাতি, জাতীয়তা ও জাতীয়তাবাদের পার্থক্য বুঝার ক্ষেত্রে মাওলানা মওদূদীর (রাহি.) কিছু মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি তাঁর বিখ্যাত বই ‘ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ’ এ বিষয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন।

তাঁর দৃষ্টিতে জাতিগত ভালোবাসা বা দেশপ্রেম নিন্দনীয় কিছু নয়, “শুধু নিজ জাতির প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা এবং তাকে স্বাধীন, সমৃদ্ধ এবং উন্নতশীল দেখার প্রত্যাশী হওয়াকেই জাতীয়তাবাদ বলা হয় না। কেননা মূলত এটা এক পবিত্র ভাবধারা সন্দেহ নেই। প্রকৃতপক্ষে নিজ জাতিকে ভালোবাসা নয়- বিজাতির প্রতি শত্রুতা, ঘৃণা, হিংসা-দ্বেষ ও প্রতিশোধ নেয়ার আক্রোশই এ জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি করে এটাই তা লালনপালন করে।” (- পৃ-৮৭) জাতিগত স্বাতন্ত্র্যও অপ্রত্যাশিত কিছু নয়, বরং প্রত্যাশিত, “এজন্যই প্রত্যেক মানব দল বা সমাজ ও তমদ্দুনিক পরিবেষ্টনীর কিছু না কিছু পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ হওয়া অপরিহার্য।... এর ফলে পরস্পরকে চিনতে পারে। পরস্পরের মধ্যে প্রীতি ভালোবাসার সৃষ্টি হতে পারে, পরস্পরকে অনুধাবন করতে পারে... নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারবে।... ঠিক এ কারণেই ইসলামে ‘তাশাব্বুহ’ (নিজেকে পরের সাথে পুরোপুরি মিলিয়ে দেয়া বা নিজেকে অপরের বাহ্যিক বেশে সজ্জিত করে) নিষেধ করা হয়েছে।” (পৃ-১১২)

স্বজাত্যবোধ ও জাতীয়তাবাদ কাছাকাছি হলেও এক নয়, “কিন্তু মনে রাখতে হবে, ইসলামের শত্রুতা হচ্ছে জাতীয়তাবাদ (Nationalism) বা জাতি পূজার বিরুদ্ধে- জাতীয়তার (ঘধঃরড়হধষরঃু) বিরুদ্ধে নয়। ইসলাম জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে জাতীয়তাকে রক্ষা করতে চায় এবং তাকে ধ্বংস করার ততদূরই বিরোধিতা করে, যতদূর বিরোধিতা করে তার স্বাভাবিক সীমালঙ্ঘন করে যাওয়া। এ জন্যই ইসলাম যে মধ্যমপন্থা গ্রহণ করেছে তা নিচের হাদিস থেকে অনুধাবন করা যায়- একজন সাহাবী রাসূল সা.কে জিজ্ঞেস করলেন, স্বজাতি পূজা বা জাতিবিদ্বেষ কাকে বলে? নিজ জাতিকে ভালোবাসাও কি জাতি বিদ্বেষ? উত্তরে নবী করিম সা. বললেন - ‘না, যুলুমের কাজেও নিজ জাতির সহযোগিতা করার নামই হচ্ছে স্বজাতি পূজা।’ (ইবনে মাজাহ, পৃ-১১৩) ইসলামে কোনো ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের স্থান নেই, শুধুমাত্র মুসলিম পরিবারে জন্ম নিলেই কেউ মুসলমান হয় না। ‘মুসলিম, শব্দটিই প্রমাণ করে যে, এটা কোনো জাতিবাচক শব্দ নয় - বরং এটা গুণবাচক নাম এবং মুসলমানের একমাত্র অর্থ- ইসলামের অনুসারী।’ (পৃ-১২৬)

ইসলাম মানুষের জাতিগত স্বাতন্ত্র্য বা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য মেনে নেয়, ইসলাম কারো সংস্কৃতির উপর খবরদারি করে না। ইসলাম একটা বিশ্বজনীন ধর্ম, যা পৃথিবীর সকল জাতি ও সংস্কৃতির মানুষ সমান ভাবে চর্চা করতে পারে। ইসলাম কোনো নতুন ধরনের জাতীয়তাবাদ তৈরি করতে চায় না, ইসলামের সাথে জাতীয়তাবাদের কোনো দূরতম সম্পর্ক নেই। মুসলিম হচ্ছে একটা দলের (পার্টি) নাম, পৃথিবীর যে কোনো জাতি, গোত্র বা ভাষার মানুষ চাইলেই এ দলের সদস্য হতে পারে। ইসলাম জাতিগত বা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য মেনে নেয়, এটাই ইসলামের সৌন্দর্য। এক্ষেত্রে অধ্যাপক তারিক রামাদানের একটা মন্তব্য উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছিলেন, ‘ইসলাম শুধুমাত্র কিছু সাংস্কৃতিক সীমানা তৈরি করে দেয়, যার মধ্যে যে কোনো সংস্কৃতি বিকশিত হতে পারে। যেমন, ইসলাম মহিলাদের বলেছে মাথা ঢেকে রাখতে, এখন এই মাথা ঢাকার জন্য একেক সংস্কৃতি একেক পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে- কেউ তার সংস্কৃতি অনুযায়ী স্কার্ফ পরে, কেউ হিজাব, কেউ ওড়না- এখানে ইসলাম কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করেনি।’ তবুও আমরা দেখি ধর্ম ও জাতিগত চেতনার দ্বন্দ্ব লাগে। কিছু ক্ষেত্রে ধর্ম জাতি চেতনার উপর জয়ী হয় (বাংলাদেশি জাতীয়তা, যার ভিত্তিতে বঙ্গভঙ্গ হয় এবং পরে দেশ ভাগ) আবার অনেক ক্ষেত্রে জাতি চেতনা ধর্মের ওপর জয়ী হয় (কুর্দি জাতীয়তা)। এক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা হচ্ছে- ধর্ম না জাতি এই প্রশ্নে- ধর্মকে জাতীয়তা বা সংস্কৃতির ওপর প্রাধান্য দেয়া।

চিকিৎসাশাস্ত্রের কোনো বিধান যদি সংস্কৃতির কোনো চর্চার সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে আমরা সুস্থ থাকার স্বার্থে অনায়াসে সংস্কৃতির সেই বিষয়কে বর্জন করি। ঠিক তেমনি, ধর্ম আসলে আমাদের আত্মা ও সমাজের চিকিৎসা করে, তাই ধর্মের কোনো কানুন যদি সংস্কৃতির কোনো চর্চার সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে সেটাও বর্জনীয়। এক্ষেত্রে চিকিৎসাবিজ্ঞান ভুলের ঊর্ধ্বে নয়, কিন্তু ওহি হচ্ছে নির্ভুল। তবে ধর্মের নামে জাতিগত পরিচয় অস্বীকার করা বা জাতীয়তার নামে ধর্মকে অস্বীকার করা, দুইটাই উগ্রতা। দুই ধরনের উগ্রতা থেকেই আমাদের দূরে থাকে দরকার। দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ না হলেও, দেশপ্রেম ইসলামে নিষিদ্ধ বা হারাম নয়। এ বিষয়ে ইসলামী উসুলের একটা ধারা উল্লেখ করা যায়, যেখানে বলা হয়েছে, ‘আশইয়া (বিষয়াদিতে, জিনিসপত্রে) তে মূলকথা হচ্ছে মুবাহ (বৈধ) হওয়া।’ এদিক দিয়েও দেশপ্রেম অবৈধ কিছু নয়। আমাদের রাসূল সা. তাঁর জন্মভূমি মক্কাকে ভালোবাসতেন, তাই জন্মভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়ে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘হে মক্কা! আমি তোমাকে ভালোবাসি। কাফেররা নির্যাতন করে যদি আমাকে বের করে না দিত, আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)

দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি দয়া ও ভালোবাসা না থাকলে, তাদের জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করা যায় না। তাই বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে দেশকে অন্তরে ধারণ করতে হবে। ভালোবাসতে হবে এ দেশের জনগণকে। মনে রাখবেন, আপনি যে জাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন, আপনাকে সে জাতির বিষয়ে সবার আগে জবাবদিহিতা করতে হবে। আপনার জাতি, আপনার দায়িত্ব। এক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে যাতে, দেশের প্রতি ভালোবাসা ইসলামের প্রতি আপনার ভালোবাসাকে অতিক্রম না করে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি তার নিকট তার পিতা, সন্তান এবং সকল মানুষ অপেক্ষা প্রিয়তম হয়েছি।” (বুখারি-১৫, মুসলিম-১৭৮)। লেখক : শিক্ষার্থী, শাবিপ্রবি

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির