post

স্বাস্থ্যসেবা: মুসলমানদের সোনালি অতীত

আলী আহমাদ মাবরুর

২০ জানুয়ারি ২০২০

আমাদের চারপাশে অনেককেই ইসলামের ব্যাপারে নানা ধরনের হীনমন্যতায় ভুগতে দেখি। যখনই ভালো কোনো জায়গায় যায়, কিংবা কোনো দামি অফিসে যায়, সুন্দর কোনো প্রতিষ্ঠানে যায়, দেশে-বিদেশে বেড়াতে যায়, তখন শুধু আফসোস করে। পরিহাস করে। নিজেদের জাতিকে অবহেলা করে। নিজেদের মানের সমালোচনা করে। অথচ নিজের দুর্বলতাগুলোকে সনাক্ত করে সেগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা অনেকের মাঝেই দেখা যায় না। কেউ কেউ তো নিজ ধর্ম ইসলামের মানবিক বৈশিষ্ট্যই অনুধাবন করতে পারে না। মুসলমানদের ইতিহাস নিয়ে একেবারেই অন্ধকারে ডুবে থাকার কারণে গৌরবময় সোনালি ঐতিহ্যের শক্তিও এরা ধারণ করতে পারে না। আমাদের দেশে যারা প্রতাপশালী, প্রভাবশালী ও অর্থশালী তারা দেশে চিকিৎসা নেয় না। বরং দেশের বাইরে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ করে। শুধু তাই নয়, ফিরে এসে নিজ দেশের চিকিৎসা খাতের অব্যবস্থাপনার তীব্র ভাষায় সমালোচনা করে। আর অন্ধের মতো ইউরোপ-আমেরিকা আর অন্যান্য উন্নত দেশের প্রশংসা করে যায়। অথচ, বাস্তবতা হলো, ইউরোপে চালু হওয়ারও কয়েক শতাব্দী আগে মুসলমানেরা উন্নত মানের হাসপাতাল চালু করেছিল। বর্তমানে পৃথিবীতে মেডিক্যাল বা চিকিৎসাশাস্ত্রে যে শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষাদানপদ্ধতি চলছে, তার নেপথ্যেও মুসলমানদের অবদানই মুখ্য। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে এসে স্যার উইলিয়াম অসলার কানাডা, ব্রিটিশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মেডিক্যাল স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেয়ার যে পদ্ধতি (ইন্টার্নশিপ) প্রচলন করেন, তারও বহু আগেই আরব মুসলমানেরা হাসপাতালগুলোর ওয়ার্ডে ছাত্রছাত্রীদেরকে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছিল। পশ্চিমা মেডিক্যাল স্কুলগুলোতে এখনো যে পদ্ধতিতে পড়ানো হয়, তারও শিকড় পাওয়া যায় আরবীয় শিক্ষাপদ্ধতিতেই। আমাদের হাসপাতালগুলোতে এখন নবীন অসংখ্য চিকিৎসক ইন্টার্নি হিসেবে কাজ করছেন। তারা একটি নির্দিষ্ট হারে সম্মানীও গ্রহণ করছেন। এগুলো কোনোটাই পশ্চিম আবিষ্কৃত বিষয় নয়। বরং সবটাই মুসলমানদের অবদান। মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিকেরা ইউরোপে এমন একটি সময়ে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানগুলোকে ছড়িয়ে দিয়েছেন যখন ইউরোপ একটি অন্ধকার সময় পার করছিল। সপ্তম শতক থেকে ১৫ শতক পর্যন্ত বিজ্ঞানের যে অগ্রযাত্রা ঘটেছিল তার ষোল আনা কৃতিত্বই মুসলমানদের। সেই সময়গুলোতে মুসলমানেরা যা করে গেছেন, তা মানব ইতিহাসে যুগান্তকারী প্রভাব স্থাপন করেছে। মুসলমানদের কর্মকাণ্ডের ওপর ভর করেই ইউরোপিয়ানরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রগতি অর্জন করেছিল। এটা বললেও অত্যুক্তি হবে না যে, মুসলমানদের নানা আবিষ্কার ও গৌরবময় কর্মকাণ্ডের কারণে মানব সভ্যতার বিবর্তন ঘটেছিল এবং সেই সাথে ইউরোপীয় রেনেসাঁরও সূতিকাগার রচিত হয়েছিল। ১৬ শতক অবধি ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলমান শিক্ষাবিদ ও দার্শনিকদের লেখা বই পড়ানো হতো। সে সময়ে আরবি ভাষায় লিখিত অসংখ্য রচনা, প্রবন্ধ ও পুস্তকও ল্যাটিন ও ইউরোপীয় নানা ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। ইরাক, সিরিয়া, মিসর, স্পেন, ইরান, কর্ডোভা কিংবা কায়রোতে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল, সেগুলোই ছিল গোটা পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে উন্নত ও প্রগতিশীল শিক্ষাকেন্দ্র। বিশ্বের নানা অঞ্চল থেকে ছাত্রছাত্রীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশুনা করার জন্য আসত। প্রখ্যাত মুসলিম চিকিৎসক আল রাজি ও ইবনে সিনা ঔষধশাস্ত্রের ওপর যে এনসাইক্লোপিডিয়াগুলো লিখেছেন সেগুলোও ১৬ শতক অবধি ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত পড়ানো হতো। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মোরাউইতজ তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘হিস্টোরিজ ব্ল্যাক হোলে’ এই প্রসঙ্গে বলেন, “বর্তমানে আমেরিকায় যে ইতিহাস পড়ানো হয় তাতে মধ্যযুগের অবস্থানটিতে বিশাল একটি গর্ত তথা ফাঁকা স্থান দৃশ্যমান হয়। এই শূন্যতাকে কেন্দ্র করে আবার ইতিহাসের বিকৃত এবং অনভিপ্রেত একটি ছবিও আঁকা হয়- যা মোটেও কাম্য নয়। নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত গোটা মুসলিম বিশ্বজুড়ে অসংখ্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই হাসপাতালগুলোকে তখন বলা হতো বিমারিস্তান। বিমার মানে হলো রোগ অর্থাৎ রোগে আক্রান্ত হলে যেখানে থাকতে হয় তাই হলো বিমারিস্তান। এই হাসপাতালগুলো মানবিক মর্যাদা, সম্মান এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা- এই তিনটি নীতির উপর ভিত্তি করে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হতো। ভালো মানের চিকিৎসকগণ এই হাসপাতালগুলোর পরিচালনায় থাকতেন। এর বাইরেও অসংখ্য চিকিৎসা শিক্ষা কেন্দ্র (বর্তমানের মেডিক্যাল কলেজের মত) এবং বেশ অনেকগুলো গবেষণা প্রতিষ্ঠানও তখন চালু ছিল। অনেক প্রসিদ্ধ মুসলিম চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ এই হাসপাতালগুলোর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ইসলামের প্রথম যুগে একটি হাসপাতালের নাম ছিল মুকতাদি যা বাগদাদে ৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রখ্যাত চিকিৎসাবিদ আল-রাজির তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই হাসপাতালে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিশেষজ্ঞ সার্জন এবং অর্থোপেডিক্স (হাড় সংযোজন ও প্রতিস্থাপন) বিশেষজ্ঞ কর্মরত ছিলেন। সার্বিকভাবে নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা, জীবন মানের উন্নয়ন ও চিকিৎসার অগ্রগতিতে মুসলমান চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতালের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। হাসপাতাল থেকে ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সকল নাগরিককে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হতো। নারী ও পুরুষ রোগীদের জন্য পৃথক ব্যবস্থাপনা ছিল। সেইসাথে সাধারণ রোগী, সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগী এবং মানসিকভাবে অসুস্থ রোগীদের জন্য পৃথক পৃথক ওয়ার্ড সুরক্ষিত ছিল। প্রতিটি চিকিৎসক এবং সেবকদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো যাতে তারা রোগীদেরকে মানসম্পন্ন সেবা দিতে পারে। হাসপাতালগুলোর সাথে গবেষণাগারও সংযুক্ত ছিল যেখানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র এবং শিক্ষকেরা নিয়মিতভাবে গবেষণা চালিয়ে যেতেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই হাসপাতালগুলো রীতিমতো প্রাসাদের মতো সজ্জিত ও গোছালো ছিল। প্রখ্যাত আরব পর্যটক ইবনে জুবায়ের বাগদাদের এই মুকতাদি হাসপাতালের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, “এই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেয়ার অনন্যসাধারণ ব্যবস্থা ছিল। রোগীদেরকে এখানে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও সহানুভূতির সাথে চিকিৎসা দেয়া হতো। প্রতিটি রোগীকে বিনামূল্যে খাবার ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হতো। রোগীরা যাতে নির্বিঘ্নে ওয়াশরুম ব্যবহার করতে পারেন সে জন্য টাইগ্রিস নদী থেকে ওয়াশরুমগুলোতে পানির পাইপ সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছিল। প্রতি সোম এবং বৃহস্পতিবার প্রখ্যাত চিকিৎসাবিদগণ হাসপাতালগুলো পরিদর্শন করতেন এবং সেখানে কর্মরত চিকিৎসক ও কর্মচারী-কর্মকর্তাদেরকে জটিল রোগগুলোর চিকিৎসায় সহায়তা করতেন। বিশেষ করে, ক্রনিক ধরনের রোগগুলোর চিকিৎসায় তারা নানা ধরনের পরামর্শ প্রদান করতেন। পাশাপাশি, হাসপাতালটিতে যারা রোগীর সাথে অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে থাকতেন তারাও হাসপাতালের অন্যান্য চিকিৎসক ও কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীদের জন্য পছন্দসই খাবার রান্না করা এবং ঔষধ তৈরিতে সহায়তা করার সুযোগ পেতেন।” (তথ্য সূত্র : মুসলিম কন্ট্রিবিউশন ট্যু সায়েন্স, সম্পাদনা- এম আর মির্জা এবং এম আই সিদ্দিকী) বাগদাদের মত বড় শহরগুলোতে মানসিক রোগীদেরকে পৃথক হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হতো। মানব ইতিহাসে মানসিক রোগীদের জন্য প্রথম হাসপাতালে সন্ধান পাওয়া যায়। বাগদাদে এবং পরবর্তী সময়ে দামেস্কে মানসিক রোগীদেরকে এসব হাসপাতালে অত্যন্ত সম্মানের সাথে চিকিৎসাসেবা দেয়া হতো। মানসিক রোগীদের অস্থিরতা ও নানা ধরনের বিড়ম্বনাকে মুসলমান চিকিৎসাবিদরাই সর্বপ্রথম মানসিক রোগ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। এর আগ পর্যন্ত এ ধরনের মানসিক রোগীদেরকে ডাইনি বা ভূতে ধরা রোগী হিসেবে গণ্য করা হতো। এমনকি ইউরোপেও মানসিক রোগীদেরকে ভূতে ধরা হিসেবে গণ্য করে তাদেরকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হতো। অথচ বাগদাদের মানসিক হাসপাতালগুলো তৎকালীন শাসকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে ঔষধ ও আর্থিক সহায়তা লাভ করতেন। ইউরোপে সর্বপ্রথম মানসিক হাসপাতাল তৈরি হয় ১৭৯৩ সালে। ফিলিপ্পো পিনেল ফ্রান্সে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর পরে পর্যায়ক্রমে ইউরোপের অন্যান্য শহরেও এই মানসিক হাসপাতালগুলো তৈরি হয়। অথচ এর প্রায় ৯০০ বছর আগেই মুসলিম সাম্রাজ্যে এই ধরনের মানসিক হাসপাতাল চালু করা হয়েছিল। মুসলিম চিকিৎসাবিদগণ সর্বপ্রথম স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত বিধি-বিধান প্রণয়ন করেন এবং তার আলোকে ডাক্তার ও ফার্মাসিস্ট লাইসেন্স প্রদান করেন। পরবর্তীতে ইউরোপের সিসিলিতে রাজা দ্বিতীয় রাজার এই ধরনের বিধান চালু করেন। এই বিধানটি চালু করার কারণে যারা রোগীদেরকে চিকিৎসা করতে আগ্রহী তাদেরকে চিকিৎসা করার আগে নির্দিষ্ট একটি পরীক্ষায় পাস করার প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে যায়। মুসলমানরা চালু করার বহুদিন পর ইউরোপের মধ্যে ইতালিতে প্রথম এই জাতীয় নিয়মগুলো চালু হয়। পরবর্তীতে স্পেন ও ফ্রান্সেও এর প্রচলন করা হয়। মুসলিম চিকিৎসাবিদগণই প্রথমবারের মতো মেডিক্যাল টেক্সটবুক (চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত পাঠ্যপুস্তক) রচনা করেন। এমনভাবে এই টেক্সটবইগুলো রচিত হয় যাতে মেডিক্যালের ছাত্ররা তাদের নিয়মিত পড়াশোনা এবং গবেষণায় এই বইগুলোকে ব্যবহার করতে পারেন। টেক্সট বইগুলোতে প্রাচীন গ্রিক এবং অন্যান্য সভ্যতার যেমন কিছু তথ্য সংযোজন করা হয়েছিল একইসাথে পরবর্তী সময়ে মুসলমান চিকিৎসাবিদগণ যে সকল তথ্য আবিষ্কার করেছিলেন সেগুলোকেও সন্নিবেশিত করা হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন আল রাজি, আল জাহরাভি এবং ইবনে সিনা। আল রাজি হলেন পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম চিকিৎসাবিজ্ঞানী যিনি হাম এবং গুটিবসন্তের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেইসাথে, খাদ্যাভাস এবং ডায়েটিং রুটিনের মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল নিয়েও তিনি পর্যালোচনা করে গিয়েছেন। তার মৃত্যুর কয়েক শ’ বছর পর বর্তমান সময়ে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ডায়বেটিস, হাইপারটেনশন এবং হৃদরোগসহ নানা রোগের চিকিৎসায় খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ এবং ডায়েটিংকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। আল রাজির লেখা বইগুলো প্রথমে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়েছিল এবং সেগুলো ১৬ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন মেডিক্যাল স্কুলে পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হতো। অন্য দিকে ইবনে সিনার এনসাইক্লোপিডিয়া মূলক কাজ ‘কানুন ফি-আল তিব্বে’ প্রাচীন সকল সভ্যতা এবং পরবর্তী সময়ে মুসলমানদের আমলে আবিষ্কৃত চিকিৎসা সংক্রান্ত সকল তথ্যকে একত্রে সন্নিবেশিত করা হয়েছিল। একই সাথে, তিনি মাটি ও পানির মাধ্যমে যক্ষ্মা এবং অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধির প্রসারণের বিষয়েও আলোচনা করে গেছেন। তার বইতে তৎকালীন সময়ে ব্যবহৃত ৭৬০টি ঔষধ সম্বন্ধেও বিস্তারিত তথ্য ছিল এবং তার এই লেখাগুলোকে পরবর্তীতে অনুবাদ করেই ইউরোপের মেডিক্যাল ছাত্রছাত্রীরা পরবর্তী কয়েক শ’ বছর পাঠ্য হিসেবে অধ্যয়ন করেছে। যদিও মুসলিম চিন্তাবিদদের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও বিজ্ঞান সমৃদ্ধ জ্ঞানের চর্চা উপরোক্ত কারণগুলোর প্রেক্ষাপটে অনেকটাই থেমে গিয়েছিল। তবে, মুসলিম বিজ্ঞানীরা যা আবিষ্কার করে গিয়েছিলেন, তার একটি ধারাবাহিক অগ্রগতি পরবর্তীতেও অব্যাহত ছিল। মুসলিম বিজ্ঞানীদের সকল সৃষ্টি ও অনবদ্য কর্মগুলো আরবি ভাষা থেকে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়। ফলত, ইউরোপের খ্রিষ্টানেরা চিকিৎসাশাস্ত্র, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, গণিত এবং দর্শনের মত বিজ্ঞানের নানা শাখা সম্বন্ধে জানার সুযোগ পায়। ইউরোপের অনেক ছাত্রছাত্রীরাই কর্ডোভা, টলেডো, বাগদাদ ও দামেস্কে এসে বিভিন্ন মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশুনা করে এবং ছাত্রজীবন শেষে ইউরোপে ফিরে গিয়ে নিজেদের দেশে একই ধারায় নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। ইউরোপিয়ান অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই গোড়ার দিকে আরবি ও ল্যাটিন ভাষাই ছিল পাঠদানের মূল মাধ্যম। ইউরোপে নতুন নতুন যেসব মেডিক্যাল স্কুল এবং কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় সেখানেও মুসলিম স্পেন এবং বাগদাদে রচিত পাঠ্যবই পড়ানো হতো। এইসব পাঠ্যবইয়ের সিংহভাগই মুসলিম চিকিৎসাবিদগণ লিখে গিয়েছিলেন যা আরবি থেকে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। এই সমস্ত বই-পুস্তকে ষোল শতক পর্যন্ত জ্ঞান অর্জনের মূল উৎস হিসেবেই বিরাজমান ছিল। তাই, চিকিৎসাশাস্ত্র ও স্বাস্থ্যসেবায় মুসলমানদের অবদান মানবতার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম বাস্তবতা। আমরা যদি নিজেদের মত করে বিশ্বের দরবারে আবারও সম্মানজনক একটি অবস্থান তৈরি করতে চাই, তাহলে হীনমন্যতায় ভোগার কোনো সুযোগ নেই। বরং ইতিহাসের গৌরবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে আবারও সেই সোনালি অতীত ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টায় আমাদের সচেষ্ট হবে। আমাদের আগের প্রজন্ম যদি কুরআন ও হাদীসের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাহলে সেই একই কুরআন ও হাদীস থাকার পর আমরা কেন লাঞ্ছিত হবো? সত্য প্রতিষ্ঠায় বলীয়ান হয়ে আমরা যদি নিজেদের কাজগুলোকে যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারি, নিজেদের দায়িত্বগুলোকে আঞ্জাম দিতে পারি, তাহলে আশা করা যায়, ইতিহাস আবারও মুসলমানদের হাতেই রচিত হবে ইনশাআল্লাহ।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও অনুবাদক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির