post

হজ ও কুরবানির ইতিহাস ঐতিহ্য ও তাৎপর্য

০১ অক্টোবর ২০১২

অধ্যক্ষ মুহাম্মদ যাইনুল আবেদীন

হজ ইসলামী ঐতিহ্যের অন্যতম একটি। মানবজাতি সৃষ্টি করার আগেই আল্লাহতায়ালা এ পৃথিবী সৃষ্টি করেন এবং তাঁর দাসত্ব করার জন্য একটি স্থান নির্ধারণ করে দেন। সে স্থানটি ছিল বর্তমান মক্কা শরীফের কাবাঘর। পৃথিবীর প্রাচীনতম ঘর এ কাবা শরিফ। আল্লাহ বলেন, ان اول بيت وضع للناس للذى ببكة مباركا وهدا للعالمين নিশ্চয়ই প্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে, তাহলো বরকতময় বাক্কা (মক্কা) এবং এটা বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়েতের কেন্দ্রবিন্দু স্বরূপ (আলে ইমরান : ৯৬)। আল্লাহতায়ালা এ ঘরের তাওয়াফ করার ব্যাপারে ঘোষণা করেন। ولله على الناس حج البيت من استطاع اليه سبيلا- ومن كفر فان الله غنى عن العالمين আল্লাহর জন্য মানুষের উপর কাবাঘরের হজ আবশ্যক করে দেয়া হয়েছে যে সেখানে যেতে সামর্থ্য রাখে। আর যে অস্বীকার করবে তাহলে (সে জেনে রাখুক) নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বজগতের মুখাপেী নন। (সূরা আলে ইমরান : ৯৭) আল্লাহতায়ালা মানবজাতির উপর তিন ধরনের এবাদত ফরজ করেছেন। ১. শারীরিক ২. আর্থিক ৩. আর্থিক ও শারীরিক। হজ তন্মধ্যে তৃতীয় প্রকার। কুরবানি হজের মতো একটি বিধান। ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাতের সাথে হজ ও কুরবানি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নিম্নে হজ ও কুরবানি বিষয়ক আলোচনা করা হলো : হজের সংজ্ঞা হজ শব্দটি আরবি যার পঠনরীতি (হজ ও হিজ) কুরআন শরীফে দু’রকম ব্যবহার পাওয়া যায় যথা : الحج اشهر معلومات ও ولله على الناس حج البيت শাব্দিক অর্থে ইচ্ছা করা, সঙ্কল্প করা, মনোভাব পোষণ করা, নিয়ত করা ও সাাৎ করা ইত্যাদি। পরিভাষায় হজ বলা হয়, هو القصدالى زيارة البيت القديم مع افعال مخصو صة নির্দিষ্ট কিছু কাজের মাধ্যমে পুরাতন ঘরের জেয়ারত করার ইচ্ছা করা। অন্যত্র বলা হয়েছে, الحج هو الزيارة بافعال مخصوصة بنية مخصوصة নির্দিষ্ট নিয়ত ও কাজের সাথে জেয়ারত করার ইচ্ছাকে হজ বলে। احياء العلوم গ্রন্থকার বলেন, الحج هوا لقصد الى زيارة البيت الحرام على وجه التعظيم بافعال مخصوصة فى زمان مخصوصة মোট কথা হজের মাসে হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে বায়তুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ, আরাফার ময়দানে অবস্থানসহ নির্ধারিত কার্যাদি সম্পন্ন করাকে হজ বলে। মসজিদে হারাম ও কাবাঘর নির্মাণের প্রোপট বায়তুল মামুর বরাবর দুনিয়ার জমিনে প্রতিষ্ঠিত এ ঘর আল্লাহতায়ালা মানবজাতি প্রেরণের আগে ফেরেশতা দ্বারা তৈরি করেন। ঐতিহাসিক ও তাফসিরকারকদের মতানুযায়ী ঐ স্থানটি বর্তমান সৌদি আরবের মক্কা নগরীর কাবাঘর। মানবজাতির আদি পিতা-মাতা হজরত আদম ও হাওয়া (আ)কে এ ধরায় প্রেরণ করার পর আল্লাহরতায়ালার অনুগ্রহে তাদের সাাৎ হয় আরাফা ময়দানে। যেখানে অবস্থান করা হজের অন্যতম রুকন। কাবাঘর পুনঃবিনির্মাণে আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে আদম (আ) উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং হজরত আদম ও হাওয়াকে এ ঘর তাওয়াফ করার নির্দেশ দেন। তার রেখে যাওয়া ঘরখানা কালের আবর্তনে ও হজরত নূহ (আ)-এর সময়ের প্লাবনে মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। হজরত ইবরাহিম (আ)-এর সময়ে তার পুত্র প্রিয়নবী হজরত ইসমাইল (আ)কে সাথে নিয়ে জনমানবহীন ভূমি মক্কার বর্তমান কাবাঘরের স্থানটি আল্লাহপাক জিবরাইল (আ) দ্বারা চিহ্নিত করে দিলে তারা এ ঘরখানা পুনর্নির্মাণ করেন। এভাবেই ঐতিহাসিক এবং পৃথিবীর সবচেয়ে আদি ও পুরনো ঘরখানা মানবজাতির ইবাদতের স্থান ও কেবলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পরে আরবের ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধ গোত্র বনু জুরহাম কর্তৃক পুনর্নির্মাণ করা হয়। এভাবে কয়েকবার কুরাইশ কর্তৃক এ গৃহ পুনর্নির্মাণ করা হয়। সবশেষে হজরত মুহাম্মদ (সা)ও এ ঘরের পুনর্নির্মাণে শরিক ছিলেন। তিনিই হাজরে আসওয়াদকে কাবার দেয়ালে লটকিয়ে দেন। পরে আরো দুইবার এ ঘরখানা কিছুটা সম্প্রসারণ করা হয়। ঐতিহাসিকগণ বলে থাকেন, বর্তমান সময় পর্যন্ত কাবাঘর প্রায় ১০-১১ বার পুনর্নির্মাণ করা হয়। হজের ঐতিহাসিক পটভূমি হিজরি সনের ১২তম মাস হলো জিলহজ মাস। এই মাস হজরত ইবরাহিম (আ)-এর স্মৃতিবিজড়িত এক অনন্য মাস। যখন হজরত ইবরাহিম (আ)কে হজ ফরজ হওয়ার কথা ঘোষণা করার আদেশ দেয়া হয়, তখন তিনি আল্লাহর কাছে আরজ করলেন : এখানে তো জনমানবহীন প্রান্তর; ঘোষণা শোনার মতো কেউ নেই। যেখানে জনবসতি আছে সেখানে আমার আওয়াজ কিভাবে পৌঁছবে? আল্লাহতায়ালা বললেন, তোমার দায়িত্ব শুধু ঘোষণা করা। বিশ্বের কাছে তা পৌঁছানোর দায়িত্ব আমার। অতঃপর হজরত ইবরাহিম (আ) মাকামে ইবরাহিমে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলে আল্লাহতায়ালা তা উচ্চ করে দেন। কোনো কোনো বর্ণনায় আছে : তিনি আবু কোবাইস পাহাড়ে আরোহণ করত দুই কানে অঙ্গুলি রেখে ডানে-বামে এবং পূর্ব-পশ্চিমে মুখ ফিরিয়ে ঘোষণা করেছিলেন : ‘লোক সব, তোমাদের পালনকর্তা নিজের ঘর নির্মাণ করেছেন এবং তোমাদের ওপর এই ঘররে হজ ফরজ করেছেন। তোমরা সবাই পালনকর্তার আদেশ পালন করো।’ এ বর্ণনায় আরো বলা হয়েছে : ইবরাহিম (আ)-এর এই আওয়াজ আল্লাহতায়ালা বিশ্বের সবখানে পৌঁছে দেন এবং শুধু তখনকার জীবিত মানুষই নয়, বরং ভবিষ্যতে কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ আগমনকারী ছিল তাদের সবার কান পর্যন্ত এই আওয়াজ পৌঁছে দেয়া হয়, যার ভাগ্যে আল্লাহতায়ালা হজ লিখে দিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই এই আওয়াজের জবাবে ‘লাব্বায়িকা আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক’ বলেছে। হজরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, ইবরাহিম (আ)-এর আওয়াজের জবাবই হচ্ছে লাব্বায়িক বলার আসল ভিত্তি। হজের বিভিন্ন আচার-কায়দা আদি পয়গম্বর ইবরাহিম (আ)-এর সঙ্গে সম্পর্কিত। হজের সাথে জড়িত রয়েছে আল্লাহথর কাছে তাঁর আত্মসমপর্ণের ইতিহাস। ইবরাহিম (আ) আল্লাহর নির্দেশে তাঁর বিবি হাজেরাকে নির্জন মরুভূমিতে রেখে এসেছিলেন। সেখানে কাবা শরীফের অদূরে, বিবি হাজেরা নবজাত শিশু ইসমাইল (আ)কে নিয়ে মহাবিপদে পড়েছিলেন। সাহায্যের জন্য কাকেও না পেয়ে তিনি পানির তালাশে সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন। কোথাও পানি না পেয়ে সন্তানের কাছে ফিরে এসে দেখলেন, সেখানে নবজাত শিশুর পদাঘাতে এক পানির উৎসের সৃষ্টি হয়েছে। এটিই জমজম কূপ। আরাফাতের ময়দানে উপস্থিতি হজরত আদম (আ) ও হাওয়া (আ)-এর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বেহেশত থেকে আদম (আ) ও হাওয়া (আ) কে যখন দুনিয়াতে পাঠিয়ে দেয়া হয়, তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অতঃপর উভয়ে আরাফাত ময়দানে এসে মিলিত হন। তাঁদের দোয়া আল্লাহতায়ালা এখানে কবুল করেন। এ জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হজরত আদম (আ)-এর বংশধর দুনিয়ার সব মুসলিম আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হয়ে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হন। কাবাঘর নির্মাণ ও হজের ঐতিহাসিক সূচনা হজ বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের এক অপার নিদর্শন। জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মহান রবের সমুচ্চারিত ধ্বনিতে মুখরিত হয় রাসূল (সা)-এর স্মৃতিবিজড়িত মাতৃভূমি মক্কার আকাশ বাতাস। আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে কাবাঘরের চত্বর। হজরত ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ)-এর আহবানে সাড়া দিয়ে সমগ্র বিশ্বের মুসলমানগণ জমায়েত হয়ে আল্লাহর দাসত্ব করার নিমিত্তে পবিত্র কাবাঘর প্রদণি করে। আল্লাহ ঘোষণা করেছেন,- واذجعلنا البيت مثابة للناس وامنا واتخذ وامن مقام ابراهيم مصلى وعهدنا الى ابراهيم واسماعيل ان طهرا بيتى للطائفين والعاكفين والركع السجود- যখন আমি কাবাঘরকে মানুষের জন্য সম্মিলন ও শান্তির স্থল করলাম। তোমরা ইবরাহিমের দাঁড়ানোর স্থানকে নামাজের জায়গা বানাও এবং আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে নির্দেশ দিলাম যে তোমরা আমার ঘরকে তাওয়াফ, অবস্থান, রুকু ও সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো। (সূরা বাকারা : ১২৫) ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ)-এর দোয়া পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র নবী ইবরাহিম (আ) স্বীয় পুত্র ইসমাইল (আ)কে সাথে নিয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করে কাবাঘর নির্মাণ করে নজির স্থাপন করেন। কাবাঘর নির্মাণের পর মহান আল্লাহর দরবারে ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ) দোয়া করলেন, আল্লাহ যেন তাদের এ শ্রম ও ইখলাস কবুল করেন এবং নাজাতের উসিলা হিসেবে কবুল করেন। আরো দোয়া করলেন হে প্রভু কিভাবে এ ঘর তাওয়াফ করতে হবে এবং কিভাবে এ ঘরের রীতিনীতি সমাপ্ত করতে হবে তা বলে দাও। এ বিষয়ে আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে, واذيرفع ابراهيم القواعد من البيت واسماعيل ربنا تقبل منا انك انت السميع العليم- ربنا واجعلنا مسلمين لك ومن ذريتنا امة مسلمة لك وارنا منا سكنا وتب علينا انك انت التواب الرحيم স্মরণ করুন যখন ইবরাহিম ও ইসমাইল কাবাঘরের ভিত্তি স্থাপন করলেন। তারা দোয়া করলেন, ‘হে আমাদের প্রভু আপনি আমাদের প থেকে কবুল করুন। নিশ্চিয়ই আপনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ। হে আমাদের প্রভু আমাদেরকে তোমার আজ্ঞাবহ কর এবং আমার বংশধর থেকে একটি অনুগত দল সৃষ্টি কর এবং আমাদের হজের রীতিনীতি বলে দাও এবং আমাদের মা কর নিশ্চয়ই তুমি তওবা কবুলকারী ও দয়ালু। (সূরা বাকারা : ১২৮) বিশ্বনবীর আবির্ভাবের দোয়া হজরত ইব্রাহিম ও ইসমাইল (আ) দু’জনে কাবাঘর নির্মাণ করে আল্লাহর নিকট দোয়া করলেন যেন একজন রাসূল প্রেরণ করেন। যিনি আবির্ভাব হয়ে মহান আল্লাহর বাণী শিা দেবে এবং একটি জাতি তৈরি করবে যারা কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহতায়ালার মহান কালিমাকে সমুন্নত রাখবে। তারা আল্লাহর দ্বীন কায়েম করার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। মানবজাতিকে আত্মশুদ্ধি করবে ও প্রজ্ঞা শিা দেবে। যাতে মহান আল্লাহর কালিমা ও তার ঘর কাবা শরিফকে কেয়ামত পর্যন্ত এবাদত করার মতো যোগ্য লোক তৈরি হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে, ربنا وابعث فيهم رسولا منهم يتلو عليهم اياتك ويعلمهم الكتاب والحكمة ويزكيهم انك انت العزيز الحكيم- হে আমাদের প্রভু তাদের মধ্য থেকে আপনি প্রেরণ করুন একজন রাসূল যিনি তাদের মাঝে তোমার আয়াত পাঠ করে শুনাবে। তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিা দেবে আর তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবে। নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়। (সূরা বাকারা : ১২৯) হজের আহবান কাবাঘর নির্মাণের পর আল্লাহতায়ালা হজরত ইবরাহিম (আ)কে নির্দেশ দিলেন তুমি মানুষকে হজের দিকে আহবান কর। তিনি আহ্বান করলেন, ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তর থেকে মানুষ মক্কার চত্বরে সমবেত হওয়া শুরু করলো এবং তখন থেকেই বর্তমান হজের শুভসূচনা হয়। আল্লাহতায়ালার বাণী, واذن فى الناس بالحج يأتوك رجالا وعلى كل ضامر ياتين من كل فج عميق- আর মানুষের মাঝে হজের আহবান করুন তারা পায়ে ও সাওয়ার হয়ে সকল প্রান্ত থেকে আপনার নিকট আগমন করবে। (সূরা হজ : ২৮) এভাবেই হজরত ইবরাহিম (আ)-এর মাধ্যমে হজের সূচনা হয়। যদিও কালের আবর্তনে কাবাঘর কলুষিত হয় মূর্তিপূজারীদের কালো থাবায়। সে থাবাকে নিস্তব্ধ করতে এবং ইবরাহিম (আ)-এর দোয়ার পূর্ণ ররূপ দিতে প্রেরণ করেন হজরত মুহাম্মদ (সা)কে। তিনি এসে মানুষকে এক আল্লাহর দিকে আহবান করে সকল প্রকার শিরক ও পাপ পঙ্কিলতা হতে কাবা শরিফকে পূত-পবিত্র করেন। হজ ফরজ হওয়ার সময়কাল হজ ফরজ হওয়ার সময়কাল নিয়ে মুহাদ্দিসীন মুফাসসিরীন এবং ফক্বীহগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। মুহাক্বক্বেক্বীন ওলামাইকেরামের মধ্যে কেউ কেউ বলেন হজ হিজরি তৃতীয় সালে ফরজ হয় যে বছর ওহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। (তাফসীরে ইবনে কাসীর) আবার কোনো কোনো মুহাক্বক্বিক্ব বলেন, হজ হিজরি ষষ্ঠ সালে ফরজ হয়। তবে অধিকাংশ মুহাদ্দিসীন এবং ফক্বীহর মতে হজ হিজরি নবম সনে ফরয হয়। আল্লাহ ঘোষণা করেছেন-- واتمو الحج والعمرة لله এ আয়াত দ্বারা হজের নির্দেশ প্রদান করা হয়। রাসূল (সা) যদিও দশম হিজরিকালে হজ আদায় করেন। তিনি ষষ্ঠ হিজরিতে ওমরা পালন করতে গেলে হুদাইবিয়ার সন্ধি হয়। তিনি ওমরা না করে ফিরে আসেন। অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয় ও দশম হিজরিতে রাসূল (সা) লাধিক সাহাবী নিয়ে জীবনের প্রথম ও শেষ হজ পালন করেন যা ইসলামে বিদায় হজ নামে পরিচিত। হজের বিধান হজ ইসলামের অন্যতম একটি স্তম্ভ, যার সামর্থ্য রয়েছে (দৈহিক ও আর্থিক) তার ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ। এ েেত্র সুস্থ ও যৌবনকালে হজ করা উত্তম। হাদিসে বর্ণিত আছে, عن ابى هريرة (رض) قال خطبنا رسول الله فقال ايها الناس قد فرض الله عليكم الحج فحجوا فقال رجل اكل عام يارسول الله فسكت حتى قالها ثلاثا فقال رسول الله لو قلت نعم لوجبت (مسلم) আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূল (সা) ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি বললেন, হে মানব সকল! আল্লাহ তোমাদের ওপর হজ ফরজ করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা হজ আদায় কর। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলো, হজ কি প্রতি বছর আদায় করতে হবে? রাসূল (সা) চুপ রইলেন। লোকটি এ প্রশ্ন তিনবার করলে রাসূল (সা) বললেন, যদি আমি হ্যাঁ বলতাম তাহলে তা ফরজ হয়ে যেত। (মুসলিম) হজের প্রকার রাসূল (সা) কর্তৃক হজ মোট তিনভাবে আদায়ের কথা জানা যায় ১. হজে ইফরাদ অর্থাৎ শুধু হজ করা। ২. হজে তামাত্ত অর্থাৎ ওমরা ও হজের মাঝে হালাল হওয়া। ৩. হজে কিরান অর্থাৎ ওমরা ও হজের মাঝে হালাল না হওয়া। হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য দৈহিক ও আর্থিক সামর্থ্যবানের ওপর হজ করা ফরজ। সুতরাং এ বিষয়ে কোন কথা বা ওজর গ্রহণ যোগ্য নয়। হজ শুধু ফরজ তা-ই নয় এতে রয়েছে অফুরন্ত সাওয়াব ও পার্থিব উপকারিতা। যথা হাদিসে রয়েছে, عن ابى هريرة (رض) قال قال رسول الله من حج هذا البيت فلم يرفث ولم يفسق رجع كما ولدته امه আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন যে ব্যক্তি এ ঘরের হজ করলো এবং সে কোনো পাপাচারে লিপ্ত হলো না সে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে প্রত্যাবর্তন করলো। (বুখারী শরীফ) অপর এক হাদিসে রয়েছে, عن ابى هريرة (رض) قال قال رسول الله (صلى) العمرة الى العمرة كفارة لما بينها والحج المبرور ليس له جزاء الاالجنة হজরত আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন, এক ওমরা হতে অপর ওমরার মধ্যবর্তী সকল অপরাধ মা করা হয়। আর হজে মাবরুরের জন্য একমাত্র বিনিময় হচ্ছে জান্নাত। (বুখারী ও মুসলিম।) হজ দ্বারা মানুষ পূর্ণ তাকওয়ার অধিকারী হয়। কেননা হজ পালন করার দিনগুলো সে কোনো সামান্যতম পাপ কাজেও লিপ্ত হয় না। এ রকম দৃশ্য ও কাজ পৃথিবীতে আর একটিও নেই। মহান আল্লাহর ঘোষণা, الحج اشهر معلومات من فرض فهن الحج فلا رفث ولا فسوق ولا جدال فى الحج হজ নির্ধারিত মাসগুলোতে, যে ইচ্ছা করলো এ সময়ে হজ করার সে কোনো পাপ কার্যে লিপ্ত হবে না, বিবাদ করবে না। (সূরা বাকারা : ১৯৭) ঐতিহাসিক সাফা মারওয়াসহ বিভিন্ন স্থান দর্শনে ধন্য হওয়া যায়। এমনকি অগণিত নবী-রাসূলের পদচি‎হ্নের এ স্থান জিয়ারতে নিজের মাঝে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে, ان الصفاوالمروة من شعائر الله فمن حج البيت اواعتمر فلا جناح عليه ان يطوف بهما নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনের মধ্যে অন্যতম। যে হজ বা ওমরা করার উদ্দেশ্যে এ কাবাঘরে গেল তার জন্য ওই দু’টি তাওয়াফ করার মাঝে কোন অপরাধ নেই। বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্বের মিলনমেলার এক অপার নিদর্শন পাওয়া যায় এ হজের দ্বারা। পৃথিবীতে বিভিন্ন শ্রেণী, ভাষা ও বর্ণের মুসলমান বাস করে। তাদের খোঁজখবর নেয়ার মতো একটি মহান সৌভাগ্য এ হজের দ্বারাই সম্ভব। রাসূল (সা) বলেছেন, المسلمون كرجل واحد ان اشتكى عينه اشتكى كله وان اشتكى رائسه اشتكى كله মুসলমানগণ একটি দেহের ন্যায় তার মাথাব্যথা হলে সমস্ত দেহ ব্যথিত হয়। তার চোখ ব্যথিত হলে সমগ্র শরীর ব্যথিত হয়। হজের শিক্ষা শিরক বর্জনের ঘোষণা দেয়া হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মুসলমানের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। আল্লাহর প্রতি ঈমানী শক্তি সুদৃঢ় হয়। অতীত পাপ মোচন করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। পরকালীন ভয় ও আমলি চেতনা বৃদ্ধি পায়। মৃত্যুর কথা হৃদয়ে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। একে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসার প্রেরণা জোগায়। অসহায়ের জন্য স্বাবলম্বীদের হাত সম্প্রসারণ করার উৎসাহ জোগায়। তাওহিদবিরোধী শক্তির আগ্রাসন থেকে রা পেতে বিশ্ব মুসলিম ঐক্য গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ব্যক্তিপর্যায়ে সারা জীবনের ওপর এক বিস্ময়কর পরিবর্তন আনার প্রত্যয় সৃষ্টি হয়। তাকওয়া অর্জন, রাসূলের আনুগত্য ও সকল ধরনের অপরাধ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার এক ধরনের নৈতিক চেতনা সৃষ্টি হয়। কুরবানি কী? কুরবানি শব্দটি বাংলায় ব্যবহৃত আরবি ভাষার একটি শব্দ। কুরআনে এ ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে, واذتقربا قربانا শাব্দিক অর্থ নিকটবর্তী হওয়া- সান্নিধ্য লাভ করা। যেহেতু কুরবানির বাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে বিধায় এটাকে কুরবানি বলে। মূলত কুরবানির আরবি শব্দ হচ্ছে- اضحية বা نسك আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিমিত্তে কোন পার্থিব বস্তু উৎসর্গ করাকেই نسك বা কুরবানি বলে। এ কুরবানি যখন একমাত্র আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করার নিমিত্তে হবে তখন এ কুরবানি নাজাতের কারণ হবে। পান্তরে যদি উদ্দেশ্য ভিন্ন হয় যথা, লোক দেখানো কিংবা গোশত খাওয়া তখন তা দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের চিন্তা অবাস্তব। আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে- لن ينال الله لحومها ولادمائها ولكن يناله التقوى منكم অর্থাৎ আল্লাহর নিকট কুরবানির গোশত বা রক্ত পৌঁছে না কেবল তোমাদের আন্তরিকতা বা তাকওয়া পৌঁছে। (সূরা হজ : ৩৮) কুরবানির সূচনা ও ইতিহাস আমরা সকলেই এ বিষয়টি সম্পর্কে স্বল্প-বিস্তর জ্ঞাত আছি যে, কুরবানির প্রচলন হয় আদি পিতা হজরত আদম (আ)-এর সময় থেকে। তখনকার নিয়মানুযায়ী দু’টি করে সন্তান হতোÑ এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তান। বিবাহ দেয়ার েেত্র প্রথম পরে ছেলে দ্বিতীয় পরে কন্যার সাথে বিবাহ দেয়া হতো। বিবাহ নিয়ে আদম (আ)- এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের মাঝে দ্বন্দ্ব হলে আল্লাহর ফয়সালার ব্যাপারে আদম (আ) তার দুই সন্তানকে আহবান জানান। আল্লাহ তায়ালা দুই সন্তানকে কুরবানি করার নির্দেশ দিলে তারা দুই পাহাড়ের চূড়ায় হাবিল ও কাবিল কুরবানির বস্তু রেখে আসে। তখনকার নিয়মানুযায়ী যার কুরবানি কবুল হতো তার বস্তু আসমান থেকে আগুন এসে ঝলসিয়ে দিত ফলে তার কুরবানি কবুল হয়েছে বলে প্রমাণিত হতো। এভাবেই হাবিলের কুরবানি আগুন এসে ঝলসিয়ে দিলে তার কুরবানি আল্লাহ কবুল করেছেন বলে নির্ধারিত হয়। আল্লাহ পবিত্র কুরআনের দ্বারা ঘোষণা করেন, واتل عليهم نبأتنى أدم بالحق اذاقربا قربانا فتقبل من احد هما ولم يتقبل من الأخر আর আপনি পাঠ করুন তাদের নিকট আদমের দুই সন্তানের ঘটনা যখন তারা দু’জন কুরবানি উপস্থিত করলো তখন আল্লাহ তাদের একজনের কুরবানি গ্রহণ করলেন এবং অপরটা গ্রহণ করলেন না। (সূরা মাইদা : ৩৪) এটাই কুরবানির সূচনালগ্ন। পরে হজরত ইবরাহিম (আ)-এর সময়ে বর্তমান নিয়মে কুরবানির প্রচলন হয়। সেটাও ছিল কঠিন পরীার ঘটনা। সংপ্তি বিবরণ হচ্ছে এই যে, ইবরাহিম (আ) এর ঘরে তার বার্ধক্য বয়সে আল্লাহ একটি পুত্রসন্তান দান করেন, তার নাম ছিল ইসমাইল (আ)। একদা ইবরাহিম (আ) নির্দেশপ্রাপ্ত হন তিনি যেন প্রিয় বস্তু আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করেন। তিনি প্রথমে ১০টি উট আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানি করলে পরের রাতে একই স্বপ্ন পুনরায় দেখতে পেয়ে তিনি ১০০টি কুরবানি করেন। তৃতীয় রাতে একই স্বপ্ন দেখলে তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পারেন যে তার প্রিয় বস্তু পৃথিবীতে একমাত্র তার সন্তান ইসমাইল। হয়তো তাকেই কুরবানি করার জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন। এ প্রেেিত নিম্নের আয়াত নাজিল হয়, فبشرناه بغلام حليم- فلما بلغ معه السعى قال يابنى انى ارا فى المنام انى اذبحك فانظر ماذا تراى قال باابت افعل ماتؤمر ستجدنى انشاء الله من الصابرين- فلما اسلما وتله للجبين- وناديناه ان ياابراهيم- قد صدقت الرؤيا انا كذا الك نجزى المحسنين- ان هذا الهوا البلاء المبين وفديناه بذبح عظيم অতঃপর আমি তাকে একটি পুত্রসন্তানের সুসংবাদ দিলাম। সে যখন পিতার সাথে হাঁটা চলার উপযোগী হল। তিনি (ইবরাহিম) বললেন, হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখলাম আমি তোমাকে কুরবানি করছি। সুতরাং তোমার মতামত কী? সে (ইসমাইল) বললো, হে আমার পিতা! আপনি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন তা পালন করুন। আপনি আমাকে আল্লাহর ইচ্ছায় ধৈর্যশীল হিসেবে পাবেন। অতঃপর যখন তারা দু’জন একমত হলো তাকে আহবান করলাম, হে ইবরাহিম তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে রূপ দিয়েছ। আমি এভাবেই সৎপরায়ণ ব্যক্তিদের বিনিময় দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল স্পষ্ট একটি পরীা। অতঃপর আমি তাকে দান করলাম একটি মহা কুরবানির পশু। (সূরা সফ্ফাত : ১০১-১০৯) কুরবানির বিধান আমরা মুসলিম জাতি। আমাদের জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ) আমাদেরকে এ নামে ভূষিত করেন। আল কুরআনে বর্ণিত আছে- ملة ابيكم ابراهيم هوسما كم المسلمين এটা তোমাদের পিতা ইবরাহিমের জাতি, তিনি তোমাদের নামকরণ করেছেন মুসলিম। (সূরা হজ : ৭৮) মূলত ইবরাহিম (আ)-এর একটি মহান আদর্শ ছিল কুরবানি যা আজও আমরা শ্রদ্ধাভরে পালন করে থাকি। সুতরাং কুরবানি করা এটা সুন্নতে ইবরাহিমি। রাসূল (সা) সামর্থ্যবানদের জন্য কুরবানিকে আবশ্যক করে দিয়েছেন। আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে, فصل لربك وانحر (হে নবী!) আপনি আপনার প্রভুর উদ্দেশে সালাত আদায় করুন এবং কুরবানি করুন। (সূরা কাওসার) অন্যত্র বলা হয়েছে, ولكل امة جعلنا منسكا ليذكروا اسم الله على مارزقهم من بهيمة الانعام আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানির নিয়ম করে দিয়েছি যাতে তাদেরকে প্রদত্ত চতুষ্পদ জন্তুর ওপর তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করে। (সূরা হজ : ৩৪) কুরবানি বিষয়ে রাসূল (সা)কে প্রশ্ন করা হলে তিনি এভাবে উত্তর দিয়েছেন, قال اصحاب رسول الله صلى يارسول الله ماهذه الاضاحى- قال سنة ابيكم ابراهيم সাহাবায়ে কিরামগণ রাসূল (সা)কে জিজ্ঞাসা করলো কুরবানি কী? রাসূল (সা) বললেন, এটা তোমাদের পিতা ইবরাহিমের আদর্শ বা সুন্নাত। সাহাবাগণ বললেন, وما لنا فيه يارسوالله قال لكل شعرة حسنه হে রাসূল (সা) এ কুরবানি দ্বারা আমাদের লাভ কী? তিনি বললেন, প্রতিটি পশমের পরিবর্তে একটি করে নেকি। কুরবানি মূলত ওয়াজিব হলেও এটি সকলের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। যে সকল লোক জাকাত ও সাদকাতুল ফিতর দিয়ে থাকে কিংবা যার ওপর জাকাত ওয়াজিব একমাত্র তাদের ওপরই কুরবানি ওয়াজিব। এ েেত্র যদি এর বাইরে কেহ কুরবানি করতে চায় তা পারবে এবং নিয়তের ওপর ভিত্তি করে অগণিত সওয়াব পাবে। কুরবানির গুরুত্ব ও তাৎপর্য কুরবানি যেহেতু মুসলিম জাতির একটি ঐতিহ্য, তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। এ সম্পর্কে নিম্নে কিছু হাদিসের বাণী উদ্ধৃতি হিসেবে দেয়া হলো : عن زيد بن ارقم قال قال اصحاب رسول الله صلى يارسول الله ماهذه الاضاحى قال سنة ابيكم ابراهيم قالو فما لنا فيها يارسول الله قال لكل شعرة حسنة قالوا فالصوف يارسول الله قال لكل شعرة من الصوف حسنة যায়েদ ইবনে আরকাম হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলের কতিপয় সাহাবা রাসূলকে জিজ্ঞাসা করলো কুরবানি কী? তিনি বললেন, তোমাদের পিতা ইবরাহিমের সুন্নাত। তারা বললো, এতে আমাদের জন্য কী রয়েছে? তিনি বললেন, কুরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি। তারা বললো, ভেড়ারতো অসংখ্য পশম থাকে, রাসূল (সা) বললেন, ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি দেয়া হবে, যদি তা কুরবানি করে (ইবনে মাজাহ)। অপর একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, ان اعظم الايام عند الله يوم النحر আল্লাহর নিকট সবচেয়ে মর্যাদাবান দিন হচ্ছে কুরবানির দিন। (আবু দাউদ) তেমনি অন্য হাদিসে রয়েছে, عن عائشة قالت قال رسول الله( صلى) ماعمل ابن ادم من عمل يوم النحر احب الى الله من اهراق الدم وانه ليأتى يوم القيامة بقرونها واشعارها واظفارها وان الدم ليقع من الله بمكان قبل ان يقع بالارض فطيبوا بها نفسا হজরত আয়েশা (রা) বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন, কুরবানির দিনে মানবসন্তানের কোন নেক কাজই আল্লাহর নিকট তত প্রিয় নয় যত প্রিয় কুরবানি করা। কুরবানির পশুগুলোর শিং, পশম ও ুর কিয়ামতের দিন (আমলনামায়) এনে দেয়া হবে। কুরবানির পশুর রক্ত মাটিতে ঝরার আগেই আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা আনন্দচিত্তে কুরবানি কর। (তিরমিজি) কুরবানি আত্মত্যাগের পরীা যুগে যুগে আল্লাহতায়ালা মানুষকে রোগ, বিপদ-আপদ, বালা-মুসিবত দিয়ে তাদের ঈমানের পরীা নিয়েছেন। এ েেত্র সর্বাধিক পরীার সম্মুীণ হয়েছেন নবী ও রাসূলগণ। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ولنبو نكم بشئ من الخوف والجوع ونقص من الاموال والانفس والثمرات وبشر الصابرين আর অবশ্যই আমি তোমাদেরকে বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি, ুধা এবং ফসলাদি, জান ও মালের তি সাধন করার মাধ্যমে পরীা করবো। (এতে যারা ধৈর্যধারণ করবে) তাদেরকে সুসংবাদ দিন। রাসূল (সা)-এর একটি হাদিসে বর্ণিত আছে- اشد البلاء بلاء الانبياء ثم الامثل فالامثل সর্বাধিক কঠিন পরীার মুখে পতিত হয় নবীগণ অতঃপর তাদের মত যারা এবং এভাবে অন্যদের ওপরও। উপরের আয়াত ও হাদিস দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় আল্লাহর নিকট যারা বেশি প্রিয় তারাই অধিক বালা-মুসিবত দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ হজরত দাউদ (আ), হজরত ইউনুছ, হজরত জাকারিয়া, হজরত ইবরাহিম, হজরত মূসা (আ)সহ অগণিত নবী, ওলি, আউলিয়াগণ আল্লাহর পরীায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তারা ধৈর্য ও তাকওয়া দ্বারা উত্তীর্ণ হয়েছেন। এ েেত্র আত্মত্যাগের এ মহান শিা দেয় কুরবানি। আল্লাহ এ জন্যই ঘোষণা করেছেন, لن ينال الله لحومها ولادمائها ولكن يناله التقوى منكم আল্লাহর নিকট কুরবানির পশুর গোশত ও তার রক্ত পৌঁছে না। বরং এ েেত্র তাকওয়াই তোমাদের থেকে তার নিকট পৌঁছে (সূরা হজ : ৩৭) কুরবানির শিা মানুষ আল্লাহকে কতটুকু ভালবাসে তার একটি পরীা হয়ে যায় এ কুরবানি দ্বারা। কারণ কুরবানির সূচনাই হয়েছে তাকওয়ার ওপর ভিত্তি করে। হজরত ইবরাহিম (আ) তার সন্তানকে কুরবানি করতে আল্লাহ কোনো চাপ সৃষ্টি করেননি বরং স্বপ্নের মাধ্যমে জানিয়েছেন। তিনি তাকওয়ার চরম শিখরে পৌঁছেছেন বলেই স্বীয় পুত্রকে কুরবানি করতে কোন দ্বিধাবোধ করেননি। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, واذابتلى ابراهيم ربه بكلمات فأتمهن قال انى جاعلك للناس اماما আর যখন পরীা করলেন ইবরাহিমকে তার প্রভু কতিপয় বাণী দ্বারা তিনি তা পূর্ণ করলেন, তিনি বললেন, আমি তোমাকে মানুষের নেতা হিসেবে নির্ধারণ করলাম। ত্যাগের মানসিকতা সৃষ্টি পৃথিবীর সম্পদ সকলের জন্য আকর্ষণীয়। এ মোহ কিছুটা হলেও কমে যায় কুরবানি দ্বারা। কারণ কুরবানির পশু ক্রয় এবং এর যতœ নেয়াসহ গরিব, অসহায়কে গোশত দানের মাধ্যমে মানুষের মাঝে ভালবাসা তৈরি হয়। এর মাধ্যমে জাতিগত ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় হয়। ফলে মানুষ পরকালমুুখী হওয়াসহ যাবতীয় বিষয়ে আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করতে সামর্থ্য হয়। আল্লাহ বলেছেন, ياايها الذين امنوا لاتلهكم اموالكم واو لادكم عن ذكرالله ومن يفعل ذالك فاولئك هم الخاسرون হে ঈমানদারগণ তোমাদের সন্তানাদি ও সম্পদ যেন আল্লাহর স্মরণ হতে তোমাদেরকে গাফিল বা অবচেতন করে না রাখে। যারা এতে অবচেতন হবে তারাই মূলত তিগ্রস্ত। ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি আমরা মুহাম্মদ (সা)-এর উম্মত অথচ রাসূলকে না দেখেই তার দেখানো পথকে আমরা জীবনের চলার পথ বানিয়েছি। তার রেখে যাওয়া বিষয়ে আমরা ঈমান এনেছি। তেমনি হজরত ইবরাহিম (আ)-এর সুন্নাতকেও আমরা পরিপালনের মাধ্যমে আমাদের ঈমানী শক্তিই বৃদ্ধি করি। আল কুরআনের সূরা আনফালে বর্ণিত আছে, واذاتليت عليهم اياته زادتهم ايمانا وعلى ربهم يتوكلون আর যখন তাদের নিকট আল্লাহর আয়াত পাঠ করা হয় এতে তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের প্রভুর ওপর আত্মনির্ভরশীল হয়। (সূরা আনফাল) পরকালের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি কুরবানি করার ফলে মানুষে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। কেননা মানুষ তার প্রিয় বস্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কুরবানি করে থাকে। পরকালে এর সওয়াব পাবে এমন আশা থেকেই এ মহৎ কাজটি সম্পাদন করে থাকে। রাসূল (সা) একটি হাদিস দ্বারা জানা যায় যে, তিনি বলেছেন, হে মানুষ সকল তোমরা ভাল ও ত্রুটিমুক্ত প্রাণী কুরবানি কর কেননা জান্নাতে যাওয়ার বাহন হবে এগুলো। কুরবানির বিধান কুরবানি সাধারণত ৬টি প্রাণী দ্বারা দেয়া যায়Ñ ১. উট ২. মহিষ ৩. গরু ৪. দুম্বা ৫. ভেড়া ৬. বকরী। কুরবানির পশু বকরী বা দুম্বা হলে শুধু এক নামেই কুরবানি দেয়া যায় আর যদি কুরবানির পশু উট, মহিষ বা গরু হয় তাহলে ৭টি নামে পর্যন্ত দেয়া যায়। অংশীদার সকলের নিয়ত সহীহ থাকতে হবে। কারো মনে গোশত খাওয়া বা অন্য কোন ভাবনা থাকলে কারো কুরবানি কবুল হবে না। তাই অংশীদার নেয়ার েেত্র বাছাই করে নেয়া প্রয়োজন। ভাল ও শক্তিশালী কুরবানি বাছাই করা। অবশ্যই নামাজ শেষে কুরবানি দিতে হবে। নামাজ পড়ার পূর্বে কুরবানি দেয়া বৈধ নয়। কুরবানির পশু জবাই করার েেত্র যেন খুব বেশি কষ্ট না পায় সেদিকে ল্য রাখতে হবে। শ্রমিকদের পারিশ্রমিক চামড়া, গোশত বা হাড্ডি দ্বারা দেয়া যাবে না। তাদের গোশত দিলে তা কোন পারিশ্রমিক হিসেবে ধরা যাবে না। গোশত বণ্টনের েেত্র এক-তৃতীয়াংশ গরিব বা আত্মীয়দের জন্য বণ্টন করা উত্তম। অবশ্য না দিলেও কোনো তি নেই। এ েেত্র তার কুরবানি কি শুধু গোশত খাওয়ার জন্য কিনা সেটা প্রশ্ন থেকে যাবে। চামড়া বিক্রীত টাকা ইয়াতিম, গরিব বা মিসকিনদের কে দিতে হবে। নিজের কোন কাজে সে অর্থ ব্যবহার করা যাবে না এবং মসজিদে দেয়া যাবে না। পরিসমাপ্তি হজ ও কুরবানি এ দু’টি বিষয়ের সাথে সময় ও মনের একটি অন্যতম মিল পাওয়া যায়। একই মাসে দু’টি বিষয় সংঘটিত হয়। দুটো বিষয় আর্থিক সঙ্গতির সাথে সামঞ্জস্য। এ বিষয় দু’টি মানুষের পার্থিব লোভকে সামান্যতম হলেও সঙ্কোচন করতে সামর্থ্য হয়। পরকালীন ভালবাসা বৃদ্ধি পায় হজ ও কুরবানি দ্বারা। ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি ও রাসূলের আনুগত্য সৃষ্টি করার অন্যতম মাধ্যম। মোট কথা হজ ও কুরবানি মুসলিম ঐতিহ্যের এক অবিস্মরণীয় দু’টি বিষয়। আল্লাহ আমাদের এ বিষয় দু’টি সুন্দরভাবে পরিপালনের তাওফিক দান করুক। আমিন।

  • লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির