post

হোলোডোমর এক কমিউনিজম ক্রাইম

গোলাপ মুনীর

০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

Holodomor, সোভিয়েত ইউক্রেনের বড় ধরনের এক দুর্ভিক্ষের নাম। এটি ‘টেরর-ফ্যামিন’ নামেও পরিচিত। কেউ কেউ এর ব্যাপকতা বিবেচনায় এটিকে ‘গ্রেট ফ্যামিন’ নামেও অভিহিত করেন। ১৯৩২-৩৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেনে এই দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। এই দুর্ভিক্ষে ইউক্রেনীয় জাতিগোষ্ঠীর লাখ লাখ লোক মারা যায়। এটি ইতিহাসে চিহ্নিত একটি ‘কমিউনিজম ক্রাইম’ হিসেবে। এর নামটি নেয়া হয়েছে moryty holodom শব্দ থেকে, যার অর্থ to kill by starvation'। এটি একটি মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, যা ইচ্ছে করেই সৃষ্টি করা হয় কমিউনিজম বিরোধী জনগোষ্ঠী নিধনের লক্ষ্যে। ওই দুর্ভিক্ষের সময় সোভিয়েত কমিউনিস্ট সরকার বাইরের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে, ঘরে ঘরে অভিযান চালিয়ে খাদ্যশস্য বাজেয়াপ্ত করে এবং জনগণের চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে।

হোলোডোমর চলার সময়েই সোভিয়েত ইউনিয়নের শস্য-উৎপাদন অঞ্চলগুলোতেও বৃহত্তর পরিসরের দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, যা ‘সোভিয়েত ফ্যামিন’ নামে পরিচিত। এই ফ্যামিন ছড়িয়ে পড়েছিল ইউক্রেন, উত্তর ককেশাস, ভলগা অঞ্চল, কাজাখস্তান, দক্ষিণ উরাল ও পশ্চিম সাইবেরিয়ায়। যুদ্ধবিগ্রহহীন শান্তিপূর্ণ এক সময়ে দেখা দিয়েছিল এই দুর্ভিক্ষ। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ও কবি রাবার্ট কনকুয়েস্টের মতে- তখন শুধু কাজাখস্তানে দুর্ভিক্ষেই মারা যায় ১০ লাখ লোক। তখন অনেক যাযাবর কাজাখ সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে চলে যায়; বিশেষত, চীন ও মঙ্গোলিয়ায়। এই হোলোডোমর বৃহত্তর সোভিয়েত দুর্ভিক্ষেরই (১৯৩২-৩৩) একটি অংশ। হোলোডোমর বলতে শুধু ইউক্রেন অংশে দেখা দেয়া দুর্ভিক্ষকেই বুঝায়। ২০০৬ সাল থেকে হেলোডোমর ইউক্রেন ও আরো ১৫টি দেশে ইউক্রেনীয় জনগণের ওপর সোভিয়েত সরকারের পরিচালিত এক জেনোসাইড বা গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃত। বক্ষ্যমাণ এ লেখায় আলোচনা শুধু হোলোডোমরের ওপর সীমাবদ্ধ রাখার প্রয়াস পাবো।

এই গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা সম্পর্কে পণ্ডিতবর্গ ও বিভিন্ন সরকারের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এক হিসাব মতে, এই দুর্ভিক্ষে নিহতের সংখ্যা এক কোটি ২০ লাখ। এদের সবাই ইউক্রেনীয় জাতিগোষ্ঠীর লোক। ২০০৩ সালে পঁচিশটি দেশের স্বাক্ষরিত এক যৌথ বিবৃতিতে জাতিসঙ্ঘ বলে এই গণহত্যায় ৭০ লাখ থেকে এক কোটি লোক নিহত হয়। গবেষণার মাধ্যমে এই পরিসংখ্যানের মধ্যকার ব্যবধান কমে আসছে। বিভিন্ন গবেষকের দেয়া তথ্য মতে, এই সংখ্যা ৩৩ লাখ থেকে ৭৫ লাখ। ২০১০ সালে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের এক আপিল আদালত এই সংখ্যা উল্লেখ করে এক কোটি, যার মধ্যে ৩৯ লাখ নিহত হয় সরাসরি দুর্ভিক্ষে, বাকি ৬১ লাখ মারা যায় বার্থ ডেফিসিটে।

হোলোডোমর একটি গণহত্যা কিনা, শিক্ষাবিদদের মাঝে এই বিতর্ক এখনো চলছে। বিতর্ক আছে এ দুর্ভিক্ষের কারণ ও তা ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল কিনা, তা নিয়েও। কিছু কিছু পণ্ডিতজনের বিশ্বাস, এই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি পরিকল্পনাটি করেছিলেন স্ট্যালিন। উদ্দেশ্য ইউক্রেনীয়দের স্বাধীনতা আন্দোলন নিঃশেষ করে দেয়া। নাতালিয়া নাউমেনকোর অভিমত, সোভিয়েত ইউনিয়নের যৌথ চাষাবাদ নীতি এবং অনুকূল শিল্পের অভাব ছিল এর কারণ। এটি ছিল দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর (৫২ শতাংশ অতিরিক্ত মৃত্যুর) প্রাথমিক কারণ। কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়, ইউক্রেনীয় নৃগোষ্ঠী ও জার্মানবিরোধী বৈষম্যও তখন বিদ্যমান ছিল। ইতিহাস বলে এই দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র ‘ইউক্রেনীয় সোশ্যালিস্ট রাশিয়া’ ও সেইসাথে মোলদাভীয় অটোনোমাস সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকেও। সে সময় মোলদাভীয় অটোনামাস সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক ছিল ইউক্রেনীয় সোশ্যালিস্টের একটি অংশ। সময়টা ছিল ১৯৩২ সালের বসন্তকাল ও ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই। এর পরিণতির প্রতিফলন রয়েছে জনসংখ্যাগত পরিসংখ্যানে: ১৯২৬ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত সময়ে ইউক্রেনীয় জনসংখ্যা বাড়ে মাত্র ৬.৬ শতাংশ, যেখানে রাশিয়া ও বেলারুশে বাড়ে যথাক্রমে ১৬.৯ শতাংশ ও ১১.৭ শতাংশ।

১৯৩২ সালের ফসলি সময়ে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ কিনে মাত্র ৪৩ লাখ টন খাদ্য, যেখানে ১৯৩১ সালের ফসলি সময়ে কেনা হয়েছিল ৭২ লাখ টন। শহরাঞ্চলে ১৯৩২-৩৩ সময়ের শীতকালে এবং ১৯৩৩ সালে বসন্তে ব্যাপকভাবে রেশনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়। শহরাঞ্চলের মানুষ তখন খাদ্যাভাবে পড়ে। শহুরে শ্রমিকদের খাবার সরবরাহ করা হতো রেশন ব্যবস্থার আওতায়। ফলে এরা দুর্ভিক্ষের সময়ে গ্রামের আত্মীয়স্বজনদের কোনো সহায়তা করতে পারতো না। রেশন ক্রমেই কমিয়ে দেয়া হচ্ছিল। ১৯৩৩ সালের বসন্তে এসে শহরের লোকজনও খাদ্যাভাবে পড়ে। এক সময় শ্রমিকদের দেখানো হতো agitprop (agitation + propaganda) মুভি। এসব অপপ্রচারমূলক চলচ্চিত্রে কৃষকদের দেখানো হতো প্রতিবিপ্লবী হিসেবে। বলা হতো, শ্রমিকেরা যখন সমাজতন্ত্রের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে ব্যস্ত, তখন কৃষকেরা খাদ্যশস্য ও আলু লুুকিয়ে রাখছে। ফলে শ্রমিকেরা দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছে।

খাবারের অভাবে উমান সিটির দুটি প্রশাসনিক স্থানের ব্যাপক অপুষ্টি ও মৃত্যুর প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৯৩৩ সালের জানুয়ারি মাসে। ১৯৩৩ সালের মধ্য-জানুয়ারি বিভিন্ন শহর এলাকায় খাদ্য নিয়ে ব্যাপক সমস্যা দেখা দেয়। রেশনের মাধ্যমে খাদ্যসরবরাহ কমিয়ে দেয়ার কারণে এমনটি ঘটে। ১৯৩২ সালের ডিসেম্বরে ইউক্রেনীয় কমিউনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল কমিটির এক ডিক্রি অনুসারে রেশন দেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে দুর্ভিক্ষের শিকার হয়ে মানুষ ব্যাপকভাবে মারা যেতে থাকে। ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে ইউক্রেনীয় স্থানীয় কর্র্তৃপক্ষ ও ইউক্রেনীয় গোপন পুলিশ (জিপিইউ)-এর রিপোর্ট মতে, সবচেয়ে দুর্ভিক্ষপীড়িত ছিল ডিনিপ্রোপেট্রোভস্ক নামের প্রশাসনিক এলাকা। তখন সে এলাকায় টাইপাস ও ম্যালেরিয়া জ্বরের প্রাদুর্ভাবও ঘটেছিল। ওডেসা ও কিয়েভ প্রশাসনিক এলাকা ছিল যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এলাকা। মধ্য-মার্চের মধ্যে দুর্ভিক্ষের বেশির ভাগ খবর আসে কিয়েভ এলাকা থেকে।

১৯৩৩ সালের মধ্য-এপ্রিলে খারকিভ এলাকা হয়ে ওঠে সবচেয়ে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ-পীড়িত এলাকা। এর পরেই আসে ডিনিপ্রোপেট্রোভস্ক, ওডেসা, ভিনিটশিয়া ও ডোনেটস্ক প্রশাসনিক এলাকা ও মোলদাভিয়ান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের নাম। দুর্ভিক্ষের কারণে ব্যাপক মৃত্যুর খবর আসে ১৯৩৩ সালের মধ্য-মে থেকে জুনের শুরুর দিকটায়। দুর্ভিক্ষের কম শিকার হয় চারনিহিভ এলাকা ও কিয়েভ ভিনিটশিয়ার উত্তরাঞ্চল। ১৯৩৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের কমিউনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল কমিটির এক ডিক্রিতে বলা হয়, কোনো ক্ষুধার্তকে না খেয়ে মরতে দেয়া হবে না। স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট করতে হবে: সংশ্লিষ্ট এলাকায় কতসংখ্যক মানুষ ক্ষুধার শিকার, ক্ষুধার কারণ কী, দুর্ভিক্ষের কারণে মৃত্যুসংখ্যা, স্থানীয় উৎস থেকে সরবরাহ করা খাবারের হিসাব, কেন্দ্র থেকে কী পরিমাণ খাবার সরবরাহ প্রয়োজন ইত্যাদি। জিপিইউ সমান্তরালভাবে ইউক্রেনের খাদ্যসহায়তার খবর সংগ্রহ করছিল। অনেক আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় রিপোর্ট এখন পাওয়া যায় ইউক্রেনের কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক আর্কাইভে। ‘দ্য ইউক্রেনিয়ান উইকলি’ ১৯৩৩ সালের দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির ওপর খবর রাখছিল। এর রিপোর্ট থেকে জানা যায়, তখন ইউক্রেনের যোগাযোগ পরিস্থিতি ছিল খুবই খারাপ।

মানুষ খেয়েছে মানুষের গোশত

হোলোডোমর নামের এই দুর্ভিক্ষের সময়ে ব্যাপকভাবে ক্যানিবালিজমের ঘটনা ঘটার সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে। এই সময়ে মানুষের গোশত মানুষ খেয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। তখন বেঁচে থাকাটাই হয়ে উঠেছিল তাদের কাছে নৈতিক এক বিষয়। জনৈক ডাক্তার ১৯৩৩ সালের জুনে এক চিঠিতে তার বন্ধুকে লিখেছিলেন: ‘আমি এখনো ক্যানিবাল হইনি, মানুষ হয়ে মানুষের গোশত খাইনি। কিন্তু এ চিঠি তোমার কাছে পৌঁছার সময় পর্যন্ত আমি ক্যানিবাল হবো কি না, তা নিশ্চিত নই। ভালো মানুষই সবার আগে মরে। যারা চুরি করতে অস্বীকার করেছে অথবা নিজেদের বেশ্যা বানাতে চায়নি, তারা মরে গেছে। যারা নিজের খাবার অন্যকে দিয়ে দিয়েছে, এরা বেঁচে নেই। যারা মানুষের লাশ খেতে অস্বীকার করেছে, তারাও মরেছে। যারা তার সাথের মানুষকে হত্যা করতে অস্বীকার করেছে, তারা মারা গেছে। যারা কানিবালিজমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, তারা মারা গেছে; তাদের সন্তানদের আগে।’ সোভিয়েত সরকার তখন পোস্টার ছাপিয়ে ঘোষণা দেয়: ‘টু ইট ইউর ওউন চিলড্রেন ইজ অ্যা বারবারিয়ান অ্যাক্ট’। হোলোডোমর চলার সময় কানিবালিজমের অপরাধে ২৫০০-এরও বেশি লোককে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

হোলোডোমরের কারণ

এই দুর্ভিক্ষের কারণ যেমনি পণ্ডিতজনদের বিতর্কের বিষয়, তেমনি রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয়ও। কিছুসংখ্যক পণ্ডিতের অভিমত, সোভিয়েত শিল্পায়নের সময়ে যেসব পরিবর্তন বাস্তবায়ন করা হচ্ছিল, এর সাথে সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিক সমস্যাই ছিল এর কারণ। তা ছাড়া এর পেছনে স্ট্যালিনের অধীন সোভিয়েত সরকার ইউক্রেনীয়দের নিধনের যে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছিল, তা-ও এই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির একটি কারণ।

কয়েকজন পণ্ডিত মনে করেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের কালেক্টিভাইজেশন পলিসি (যৌথ চাষাবাদ নীতি) এবং অনুকূল শিল্পায়নের অভাব এই দুর্ভিক্ষের প্রাথমিক কারণ। এ কারণে দুর্ভিক্ষের শিকার হয়ে মারা যাওয়া মানুষের ৫২ শতাংশ। আর কিছু কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ মিলে ইউক্রেনীয় নৃ-গোষ্ঠীর ওপর জার্মানদের বৈষম্যমূলক আচরণও এর জন্য কিছুটা দায়ী। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নে যৌথ চাষাবাদের নীতি (কালেকটিভিজম পলিসি) কার্যকর করা হয়। এর ফলে সেখানে চরম খাদ্যসঙ্কট দেখা দেয়, যার ফলে এই দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব ঘটে। ১৯২৯-৩০ সময়ে কৃষকদের রাজি করানো হয় তাদের জমিজমা ও পশু সরকারি খামারে হস্তান্তর করতে। আর কৃষকেরা দিনমজুর হিসেবে সেখানে কাজ করবে। আর মজুরি হিসেবে এরা পাবে সেবা ও পণ্য। নগদ অর্থ তাদের দেয়া হবে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইউক্রেনীয় সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের চাষিদের মধ্যে এই যৌথ চাষাবাদ নীতি জনপ্রিয় ছিল না। বাধ্যতামূলক যৌথ চাষাবাদ চালু করার ফলে প্রচুর কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয়। প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনায় ইউক্রেনীয় খামারগুলোর প্রত্যাশিত উৎপাদনে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। কৃষকদের চিরপরিচিত খাদ্যশস্যের বদলে সরকারি খামারে উৎপাদন শুরু হয় সুগার বিট ও তুলা। তা ছাড়া, পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে যায় খামার পরিচালনায় প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে। প্রচুর পরিমাণ ফসল ক্ষেতেই পড়ে থাকে। অসময়ে ফসল তোলার কারণে প্রক্রিয়াজাত, পরিবহন ও মজুদ করার সময় অনেক ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৩০ সালের গ্রীষ্মে সরকার লোকদেখানো ভাবে খাদ্যশস্য রফতানির নামে চালু করে ফুড রিকুইজিশন কর্মসূচি। খাদ্য চুরিকে করা হয় মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অথবা ১০ বছরের কারাবাসযোগ্য অপরাধ। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, দুর্ভিক্ষ চলার সময়েও এমনকি কমিয়ে আনা দামে খাদ্যশস্য রফতানি চলতে থাকে।

বলা হয়ে থাকে, সোভিয়েত নেতারা এই দুর্ভিক্ষকে কাজে লাগায় ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শাণাতে। ফলে এই দুর্ভিক্ষকে গণহত্যার বৈধ সংজ্ঞাভুক্ত করা যায়। উদাহরণত, ১৯৩২ সালের শেষদিকে ও ১৯৩৩ সালে বিশেষ ও সুনির্দিষ্ট মারাত্মক নীতি ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো হয়েছে সোভিয়েত ইউক্রেনে। উদাহরণ টেনে বলা যায়, কালেক্টিভিজম পলিসির আওতায় কৃষকদের শুধু তাদের সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা হয়নি, সেই সাথে বিপুল সংখ্যক কৃষক পরিবারকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হয় জীবন-জীবিকার কোনো ব্যবস্থা না করেই। যারা দেশেই থেকে যায় এবং দুর্ভিক্ষ এলাকা থেকে পালাতে চেয়েছিল, তাদের গুলি করে মারা হয়। বিদেশী ব্যক্তিরা এর সাক্ষী, যারা এই নিষ্ঠুর বর্বরতা ও এর প্রভাব প্রত্যক্ষ করেছে। যেমন- হাঙ্গেরিয়ান-ব্রিটিশ সাংবাদিক আর্থার কোয়েস্টলার হোলোডোমরের সময়ের প্রবল দুর্ভিক্ষের বছরের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন: ‘প্রতিটা ট্রেন স্টেশনে নোংরা কাপড় পরা কৃষকেরা ভিড় জমাতো, এরা লোপ ও রুটির বদলে প্রতিমা বা বস্ত্র দিয়ে দিতো। মহিলারা ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের জানালা দিয়ে তাদের শিশুদের তুলে ধরতো- এসব শিশুর অবস্থা ছিল করুণ ও ভয়াবহ। অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো কাঠির মতো। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলা পেট, বড় ও বিশীর্ণ মাথা, অলসভাবে ঝুলে আছে ঘাড়ে।’

দুর্ভিক্ষের পর

সরকার দুর্ভিক্ষের ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা লুকানোর অনেক চেষ্টা চালালেও, তা দেশ-বিদেশে জানাজানি হয়ে যায়। এসব জানাজানি হয় সাংবাদিক গ্যারেথ জোনস, ম্যালকম মুগেরিডজ, ইয়াল ড্যামেন্ডি ও ক্লিম্যানের লেখা প্রকাশের পর। প্রকৌশলী আলেক্সান্ডার ওয়েনবার্গারের প্রকাশিত ছবির সুবাদেও তা প্রকাশ পায়। এর প্রতিক্রিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন চালায় পাল্টা-অপপ্রচার অভিযান। এর মাধ্যমে বার্নার্ড শ, এডোয়ার্ড হেরট ও আরো কয়েকজন সেলিব্রিটি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন এবং তারা বিবৃতি দিয়ে বলেন: তারা কোনো দুর্ভিক্ষ দেখতে পাননি। জার্মানের ইউক্রেন দখলের সময় (১৯৪১-৪৪) দখলদার কর্র্তৃপক্ষ হোলোডোমর ও অন্যান্য কমিউনিস্ট অপরাধ সম্পর্কিত লেখালেখি সংবাদপত্রে প্রকাশ করতে দেয়। তবে তারা এ বিষয়টিতে ততটা মনোযোগ দিতে চায়নি, যাতে জাতীয় মনোভাবে বিষয়টি নাড়া না দেয়। ১৯৪২ সালে কারকিভের অ্যাগ্রোনস্টিক স্টিফেন সসনভি প্রকাশ করেন একটি ব্যাপকভিত্তিক পরিসংখ্যানিক গবেষণা, যাতে দুর্ভিক্ষের লোকক্ষয়ের পরিসংখ্যান রয়েছে। তার এই পরিসংখ্যানের ভিত্তি সোভিয়েত আর্কাইভের দলিলপত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে বিদেশে থাকা ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূতরা হোলোডোমর-সম্পর্কিত তথ্য ছড়িয়ে দেয় ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায়। প্রথমে, মানুষ বরং এ ব্যাপারে সতর্ক ছিল। কারণ, এসব খবর আসতো তাদের কাছ থেকে, যারা বসবাস করতো দখল করা এলাকায়। কিন্তু ১৯৫০-এর দশকে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। দুর্ভিক্ষের পর বেঁচে থাকাদের ক্রমবর্ধমান স্মৃতিচারণের ওপর ভিত্তি করে হোলোডোমরের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয় ১৯৫০-এর দশকে।

মৃতের সংখ্যা

সুদীর্ঘ সময় ধরে সোভিয়েত ইউনিয়ন এই দুুর্ভিক্ষের কথা অস্বীকার করে আসছিল। সোভিয়েত গুপ্ত পুলিশ বাহিনী এনকেভিডি (পরবর্তী সময়ের কেজিবি) হোলোডোমর সময়ের আর্কাইভ নিয়ন্ত্রণ করতো। এরা খুব ধীরগতিতে আর্কাইভে থাকা এ সম্পর্কিত রেকর্ডপত্র প্রকাশ করতো। ফলে এই দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা অজানাই থেকে যায়। আন্দাজ অনুমান করাও রীতিমতো মুশকিল। তা সত্ত্বেও এ কথা ঠিক- ১৯৩৩ সালের শেষদিক পর্যন্ত সময়ে নিঃসন্দেহে সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে কিংবা অস্বাভাবিকভাবে মারা গেছে।

২০০১ সালে জনসসংখ্যা-সম্পর্কিত বিভিন্ন সরকারি উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস-শিক্ষা বিষয়ের অধ্যাপক স্টিফেন জি. হুইটক্রফট উল্লেখ করেছেন, সরকারি নথিপত্রে দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা কমিয়ে দেখানো হয়েছে, অনেক মৃতের সংখ্যা নথিবদ্ধ করা হয়নি। তাদের হিসাবপত্রেও মৃতের সংখ্যায় আছে পার্থক্য। কেউ হিসাব দেখিয়েছেন ১৯৩৩ সালের সীমান্তের ওপর ভিত্তি করে, কেউ দেখিয়েছেন বর্তমান সীমান্তকে ভিত্তি করে। আবার কেউ মৃতের সংখ্যা উল্লেখ করছেন ইউক্রেনীয় নৃগোষ্ঠীর ওপর ভিত্তি করে। কেউ এলাকাভিত্তিক মৃতের অনুমিত সংখ্যা উল্লেখ করেন। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ প্রশ্ন তুলেছেন সেভিয়েত জনমিতি নিয়ে। তাদের মতে, এর মধ্যে রয়েছে অপপ্রচার আর মিথ্যাচার। কিছু অনুমিত পরিসংখ্যান এসেছে বিশ্বনেতাদের আলোচনা থেকে। ১৯৪২ সালে উইন্সটন চার্চিলের সাথে আলোচনার সময় স্ট্যালিন জানান, শুধু ইউক্রেন নয় বরং সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়নে মোটামুটিভাবে এক কোটি কুলাক (ধনী কৃষক, যাদের সোভিয়েত ইউনিয়ন-পূর্ব সময়ে ৮ একরের বেশি জমি ছিল) যৌথ চাষাবাদের বিরোধিতা করায় নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এই সংখ্যা উল্লেখের সময় স্ট্যালিন বুঝাতে চেয়েছেন, এদের মধ্যে শুধু দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যাই নয়, যাদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল তাদের সংখ্যাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তা ছাড়া, ভিন্নমত রয়েছে, মৃৃতের সংখ্যায় কি শুধু তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে যারা ‘গুলাগ’ নামের বাধ্যতামূলক শ্রম শিবিরে ছিল তাদের, না শুধু যারা না খেয়ে মারা গেছে তাদেরকেও। আর্কাইভ অনুযায়ী অনুমিত মৃতের সংখ্যায় আছে ভিন্নতা: ২৫ লাখ (ভøাদিমির কুবিওভিচ), ৪৮ লাখ (ভ্যাসিল রিশকো), এবং ৫০ লাখ (রবার্ট কনকুয়েস্ট)।

১৯৮০-এর দশকে ভিন্ন মতাবলম্বী জনমিতিকার ও ইতিহাসবিদ আলেক্সান্ডার পি. ব্যাবিওনিশেভ (সারগেই মাকসুদভ নামে লিখে) জানান, সরকারিভাবে ১৯৩৩ সালে দেড় লাখ শিশুর মৃত্যুর কথা গণনায় ধরা হয়নি। নইলে ১৯৩৩ সালে শিশু জন্মের সংখ্যা ৪ লাখ ৭১ হাজার থেকে বেড়ে দাঁড়াতো ৬ লাখ ২১ হাজার, যা ১৯২৭ সালের তুলনায় ১১ লাখ ৮৪ হাজার কম। ২০০০-এর দশকের ইতিহাসবিদ ও সুশীলসমাজের মধ্যে বিতর্ক চলে হোলোডোমরে মৃতের সংখ্যা নিয়ে। তখন সোভিয়েত ফাইল প্রকাশ করা নিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ও ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভিক্টর উশচেনকোর মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। উশচেনকো ও অন্যান্য ইউক্রেনীয় রাজনীতিবিদেরা বলেছেন, ইউক্রেন অঞ্চলে সে সময় ৭০ লাখ থেকে এক কোটি লোক মারা গেছে। উশচেনকো যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে এক ভাষণে উল্লেখ করেন, হোলোডোমরে ইউক্রেনে দুই কোটি লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। অপরদিকে কানাডীয় প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পার এক সরকারি বিবৃতিতে এ মৃতের সংখ্যা এক কোটি উল্লেখ করেন। কিছু ইউক্রেনীয় ও পাশ্চাত্যের ইতিহাসবিদ মৃতের সংখ্যা এমনটিই বলেন। ইতিহাসবিদ, ড্যাভিড আর. মার্পলস ২০০৭ সালে এই সংখ্যাটি ৭৫ লাখ বলে উল্লেখ করেন। ২০১৬ সালে ইউক্রেনের কিয়েভ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘হোলোডোমর ১০৩২-১৯৩৩ অ্যান্ড লস অব দ্য ইউক্রেনিয়ান ন্যাশন’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এ সম্মেলনে দাবি তোলা হয়, হোলোডোমরের মাধ্যমে হত্যা করা হয় ৭০ লাখ লোক। আর পুরো সোভিয়েত ইউনিয়নে না খেয়ে মারা যায় ১০ লাখ লোক। তা সত্ত্বেও, ইতিহাসবিদ টিমোথি ডি. ¯িœডার এবং স্টিফেন জি, হুইটক্রফট ৭০ লাখ থেকে দুই কোটি লোকক্ষয়ের পরিসংখ্যানের সমালোচনা করেন। ¯িœডার লিখেন: প্রেসিডেন্ট ভিক্টর এক কোটি লোকের মৃত্যুর দাবি তুলে তার নিজের দেশেরই ক্ষতি করলেন। তিনি এই সংখ্যা তিনগুণ বাড়িয়ে বলেছেন। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে: ১৯৩২-৩৩ সময়ে ইউক্রেনে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যতাড়িত এক সিদ্ধান্তের ফল এবং সে দুর্ভিক্ষে মারা যায় ৩০ লাখ লোক। ‘পোস্টমিডিয়া নিউজে’র কাছে পাঠানো এক ই-মেইলে হুইটক্রফট লিখেছিলেন : আমার কাছে এটি দুঃখজনক- স্টিফেন হার্পার ও পাশ্চাত্যের অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা অনবরত ইউক্রেনীয় দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা বাড়িয়ে বলে চলেছেন। সত্যিকার অর্থে এমন কোনো ভিত্তি নেই, যাতে এই দুর্ভিক্ষে ইউক্রেনীয়দের মৃতের সংখ্যা এক কোটি মেনে নেয়া যায়। ২০০১ সালে হুইটক্রফট বলেন, সে সময় পুরো সোভিয়েত ইউনিয়নে মৃতের সংখ্যা এক কোটি।

গণহত্যার প্রশ্ন

পণ্ডিতজনদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে: মানবসৃষ্ট এই সোভিয়েত দুর্ভিক্ষ মুখ্যত একটি গণহত্যা অভিযান ছিল কিনা? না এটি ছিল শুধু ইউক্রেনীয় কৃষকদের বাগে আনার এক অভিযান? এর মাধ্যমে কৃষকদের চাপে ফেলে যৌথ চাষাবাদে আনার মাধ্যমে সোভিয়েত শিল্পায়নে কাঁচামাল সরবরাহ নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা এটি ছিল কিনা? হলোডোমর একটি গণহত্যা কি না, তা আধুনিক রাজনীতির একটি উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তবে হোলোডোমর-সম্পর্কিত সোভিয়েত নীতি গণহত্যার কোনো বৈধ সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে কি না, সে ব্যাপারে কোনো আন্তর্জাতিক ঐকমত্য নেই। এ ব্যাপারে পণ্ডিতজনদের অবস্থানও ভিন্ন ভিন্ন। র‌্যাফায়েল লেমকিন, জেমস মেইস, নরম্যান নেইমার্ক, টিমোথি ¯িœডার ও অ্যানি অ্যাপলবাউম হোলোডোমরকে বিবেচনা করেন একটি গণহত্যা এবং স্ট্যালিনবাদী নীতির একটি ঐচ্ছিক পরিণতি হিসেবে। মাইকেল এলম্যান মনে করেন, হোলোডোমর একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ, কিন্তু তিনি একে ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেননি। রবার্ট কনকুয়েস্ট ও স্টিভেন রোজফিল্ড মনে করেন: এসব মৃত্যুর কারণ প্রাথমিকভাবে ইচ্ছাকৃত রাষ্ট্রীয় নীতি, ফসল কম হওয়ার কারণে নয়। রবার্ট ড্যাভিস, স্টিফেন কটকিন ও স্টিফেন হুইটক্রফট মনে করেন, স্ট্যালিন ইচ্ছাকৃতভাবে চাননি ইউক্রেনীয়দের এভাবে হত্যা করতে। কিন্তু স্ট্যালিন পরিস্থিতি বিশৃঙ্খল করে তুলেছিলেন ভুল নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে এবং সমস্যা সম্পর্কে তার অজ্ঞতাও ছিল কম। ১৯৯১ সালে আমেরিকান ইতিহাসবিদ মার্ক টাউগার বলেন, প্রাথমিকভাবে হোলোডোমর ছিল প্রাকৃতিক পরিস্থিতি ও ব্যর্থ আর্থনীতিক নীতির একটি পরিণতি, তবে এটি রাষ্ট্রের ইচ্ছাকৃত কোনো নীতি ছিল না।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য- উপরে উল্লিখিত ব্যক্তিদের মধ্যে র‌্যাফায়েল নেমকিন ছিলেন ইহুদি বংশোদ্ভূত পোলিশ আইনজীবী, যিনি সমধিক পরিচিত ‘জেনোসাইড’ শব্দটির সূচনা করার জন্য; জেমস মেইস একজন আমেরিকান ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক ও হোলোডোমর গবেষক; নরম্যান নেইমার্ক একজন আমেরিকান ইতিহাসবিদ, যুক্ত রয়েছেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যায়ের অধ্যাপক ও হোভার ইনস্টিটিউটের ফেলো হিসেবে, লেখালেখি করেন পূর্ব-ইউরোপীয় ইতিহাস, এ অঞ্চলের জেনোসাইড ও জাতিনিধন বিষয়ে; টিমোথি ¯িœডার হচ্ছেন আমেরিকান লেখক ও ইতিহাসবিদ, যার বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের জ্ঞান রয়েছে মধ্য ও পূর্ব-ইউরোপ ও হলোকাস্ট বিষয়ে; অ্যানি এলিজাবেথ অ্যাপলবাউম হচ্ছেন ২০০৪ সালের পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী (আগের বছরে ‘গুলাগ: অ্যা হিস্টি লেখার জন্য) আমেরিকান সাংবাদিক ও ইতিহাসবিদ এবং ব্যাপকভাবে লেখালেখি করেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ নিয়ে, তিনি ‘দ্য আটলান্টিক’ পত্রিকার স্টাফ রাইটার; মাইকেল ইলম্যান ১৯৭৮ সাল থেকে ছিলেন অ্যামস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক, বর্তমানে এমেরিটাস প্রফেসর। সোভিয়েত অর্থনীতি নিয়ে লেখালেখি করেন; স্টিভেন রোজফিল্ড চ্যাফের হিলের নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্প্যারাটিভ ইকোনমিক সিস্টেমের অধ্যাপক এবং রুশিয়ান অ্যাকাডেমি অব ন্যাচারাল সায়েন্সের সদস্য; রবার্ট ড্যাভিস ছিলেন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ, লেখক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক; স্টিফেন মার্ক কটকিন একজন আমেরিকান ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ ও লেখক এবং বর্তমানে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের অধ্যাপক, স্টিফেন হুইটক্রফট হচ্ছেন মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক, যার আগ্রহ সোভিয়েত ইতিহাস নিয়ে এবং তিনি মার্ক টাউগার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক।

শেষ কথা

হোলোডোমর নিয়ে বিতর্কটা হচ্ছে: ১৯৩২-৩৩ সময়ে সোভিয়েত ইউক্রেনে দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়েছিল কিংবা হয়নি। দুর্ভিক্ষ অস্বীকার করা হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্রীয় অবস্থান। এর প্রতিফলন রয়েছে সোভিয়েত অপপ্রচার ও পাশ্চাত্যের কিছু সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীর কর্মে। যাদের মধ্যে রয়েছেন জর্জ বার্নার্ড শ, ওয়াল্টার ডুরান্টি এবং লুই ফিশার। সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষ দুর্ভিক্ষ-সম্পর্কিত যাবতীয় আলোচনা নিষিদ্ধ করেছিল। ইউক্রেনীয় ইতিহাসবিদ স্ট্যানিস্লাভ কুলচিটস্কি বলেছেন, সোভিয়েত সরকার তাকে আদেশ দিয়েছিলেন তার প্রাপ্ত তথ্য প্রকাশ না করে দুর্ভিক্ষকে একটি অপরিহারযোগ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে বর্ণনা করতে। আর এ কাজটি তাকে করতে বলা হয়েছিল, কমিউনিস্ট পার্টির দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির পাপমুক্তি করতে ও সেই সাথে স্ট্যালিনের উত্তরাধিকার সমুন্নত রাখতে। ইতিহাস কমিউনিস্ট পার্টি, কমিউনিজম ও স্ট্যালিনকে সে পাপমুক্তি দেয়নি। হোলোডোমর একটি নৃগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যা কিনা, এটি মানবসৃষ্ট না প্রাকৃতিক, এই ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল কি না, এসব আজো আধুনিক রাজনীতির বিতর্কের বিষয়বস্তু হলেও ইউহিাসে এটি এরই মধ্যে প্রায় প্রতিষ্ঠিত একটি ‘কমিউনিজম ক্রাইম’ হিসেবে। ইউক্রেনের কাছে এটি একটি গণহত্যা, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কাছ একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ। রুশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষও সোভিয়েত সরকাররের প্রতি নিন্দা জানিয়েছে জনজীবনবিধ্বংসী এ অপকর্মের জন্য।

২০০৩ সালের ১০ নভেম্বর জাতিসঙ্ঘে রাশিয়া, ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ২৫টি দেশ হোলোডোমরের ৭০তম বার্ষিকী পালনের সময় এক যৌথবিবৃতির প্রারম্ভে বলে: ‘সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে লাখ লাখ নারী-পুরুষ ও শিশু টোটালিটারিয়ান সরকারের নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড ও নীতির শিকারে পরিণত হয়। ইউক্রেনের ১৯৩২-৩৩-এর মহাদুর্ভিক্ষ (হোলোডোমর) ছিনিয়ে নেয় ৭০ লাখ থেকে এক কোটি নিরপরাধ মানুষের প্রাণ এবং তা ইউক্রেনীয় জনগণের জন্য এক জাতীয় ট্র্যাজেডি। এই দুর্ভিক্ষের ৭০তম বার্ষিকী, বিশেষত ইউক্রেনীয় সরকারের আয়োজনে আমরা পালন করছি। ইউক্রেনীয় এই ট্রাজেডি উদযাপনের পাশাপাশি আমরা স্মরণ করছি লাখ লাখ রুশ, কাজাখ ও অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের, যারা না খেয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ভলগা নদী অঞ্চলে, উত্তর ককেশাসে, কাজাখস্থানে ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিনের অন্যান্য অংশে গৃহযুদ্ধ ও বাধ্যতামূলক যৌথ চাষাবাদ নীতির কারণে।’ লেখক : কলামিস্ট ও সিনিয়র সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির