post

২৮ অক্টোবর উত্তপ্ত রণাঙ্গনে আদর্শিক লড়াই

০৯ অক্টোবর ২০১৪

 শেখ মুহাম্মদ এনামুল কবির

Chhatrasangbadবাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম কালো দিনের নাম ২৮ অক্টোবর ২০০৬। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট ও তাদের দোসরদের হাত ধরে এই দিনের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক মহা কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চার সকল পথ ধীরে ধীরে রুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব প্রতি পদে পদে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত ছিল ঈদুল আজহার সাংগঠনিক ছুটি। ২৭ অক্টোবর আলফালাহ মিলনায়তনে ঢাকার চার মহানগরী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখাগুলোর ঈদপুনর্মিলনী। বিকাল ৩টা আলফালাহ মিলনায়তন কানায় কানায় পরিপূর্ণ। সকলের চোখে মুখে ঈদের আনন্দ এখনও খেলা করছে। প্রোগাম শুরু করলেন সেক্রেটারি জেনারেল জাহিদুর রহমান ভাই। উপস্থিত পর্যালোচনা শেষ। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে কেন্দ্রীয় সভাপতি শফিকুল ইসলাম মাসুদ ভাই দিকনির্দেশনা দিলেন। প্রোগ্রামে মহানগরীর আমীর সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি রফিকুল ইসলাম খান ভাইসহ অনেকে উপস্থিত হয়েছিলেন। ২৮ অক্টোবরে বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটের সমাবেশকে সামনে রেখে করণীয় নিয়ে অনেক নির্দেশনা খান ভাইও দিলেন। সবাইকে সতর্কতার সাথে আগামী কালের সমাবেশ সফল করার জন্য বললেন। কারণ ঐ দিন মুক্তাঙ্গনেও আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলেরও সমাবেশ। আর আট- দশটা সমাবেশের মতো আমরাও সমাবেশের স্বাভাবিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। ঈদের মাত্র দুইদিন পর সমাবেশ তাই এবারের ছুটিটা একটু কম ছিল। তারপরও কথা ছিল যে সবাই সময়মতো ফিরতে হবে। কিন্তু সকল সাথী-কর্মী তখনও ময়দানে এসে পৌঁছাতে পারেনি। একটু শূন্য শূন্য মনে হচ্ছিল। ২৮ তারিখ সকাল ৮টা থেকে উত্তর গেটে স্টেজ তৈরির কাজে স্বেচ্ছাসেবক এবং সার্বিক শৃঙ্খলার জন্য আগের পরিকল্পনামত লোকজন আসতে শুরু করেছিল। সবাই এসে পৌঁছাতে পারেনি তখনও অনেকে পথে ছিল। ওই দিকে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের আগে থেকেই পূর্বপরিকল্পনা। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কাকরাইল বিজয় নগরের দিক থেকে ডা: ইকবালের নেতৃত্বে এক জঙ্গি মিছিল আসে। এসেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে কস্তুরীর গলিতে থাকা আমাদের শৃঙ্খলার কাজে নিয়োজিত ভাইদের ওপর। সেখানে আমাদের ১৫ থেকে ২০ জন ভাই ছিল তারাও পাল্টা প্রতিরোধ শুরু করে। আল্লাহ সেদিন তার রহমতের চাদর পল্টনের রাজপথে অবারিত রেখেছিলেন দ্বীনের মুজাহিদদের জন্য। মাত্র ১৫-২০ জনের প্রতিরোধে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বিজয়নগরের দিকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। আওয়ামী লীগ সেদিন খুনের নেশায় মেতে উঠেছিল। সারাদেশ থেকে ভাড়া করা সন্ত্রাসীদের ঢাকায় নিয়ে আসে তারা। কস্তুরীর ঐ গলিতেই শহীদ হন আমাদের প্রিয় ভাই মুজাহিদ, গোলাম কিবরিয়া শিপন ভাই। আহতদের তালিকা বাড়তে থাকে আর ময়দানের লড়াইরত ভাইদের সংখ্যাও কমতে থাকে। অসংখ্য ভাই সেদিন আহত হয়েছেন। ময়দানে চারদিক থেকে খবর আসছিল আমাদের অসংখ্য ভাই শাহাদাতবরণ করেছেন। অনেকে আহত অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। প্রত্যেকে সেদিন শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত হয়ে মরণপণ লড়াই করে যাচ্ছিল। ওদের পরিকল্পনা ছিল আমাদের স্টেজ দখল, অফিসে হামলা চালানো এবং আমাদের নেতৃবৃন্দকে আঘাত করা। কিন্তু আমাদের ভাইদের অসিম দৃঢ়তা এবং সাহস আর আল্লাহর অপার রহমতে ওরা তা করতে পারেনি। প্রত্যেকের মানসিকতা ছিল জান দেবো তবুু আমাদের নেতৃবৃন্দের কিছু হতে দেবো না। জামায়াতের মহানগরীর অফিস সেদিন হাসপাতালে পরিণত হয়েছিল। আহতদের সারি আসছিল সামান্য ট্রিটমেন্ট নিয়ে আবার ময়দানে চলে যাচ্ছিল। নেতৃবৃন্দকে রক্ষা করার জন্য কর্মীরা সেদিন যে নজির স্থাপন করেছে তা সাহাবা কেরামের জীবনের সাথে হুবুহু না মিললেও প্রত্যেকেই সে ধরনের মানসিকতা নিয়ে ময়দানে সেদিন লড়াই করেছেন। কেউ হয়তো সকালে সামান্য নাশতা করে আবার কেউ না করে সারাদিন এভাবে লড়াই করা আবার দুপুরের খাবারও হয়নি। সেদিনের চিত্র যেন একটি খণ্ড বদরের চিত্রই মনে হয়েছে। সংখ্যার দিক দিয়ে এ এক অসম লড়াই। যেখানে তারা হাজার হাজার আর আমাদের মাত্র দুই থেকে তিনশত কর্মী। অবশ্য বিকেলে আমাদের কর্মী বেড়েছিল তবে তা ওদের তুলনায় খুবই কম। কারণ ওরা লোক এনেছিল সারাদেশ থেকে। সংখ্যায় ওরা অনেক হলেও দ্বীনের মুজাহিদেরা ছিল ঈমানের বলে বলীয়ান। হামলার গতি তীব্র হয় বিকাল ৩টার দিকে যখন সমাবেশ শুরু হয়ে যায়। কুরআন তেলাওয়াতের মধ্যে দিয়ে সমাবেশ শুরু হয়। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। ওইদিকে বৃষ্টির মতো গুলি আসতে থাকে। পল্টন মোড়ের দিকে চলছিল মরণপণ লড়াই আর উত্তর গেটে সমাবেশ। অবস্থা এমন হয়েছিল যে পল্টন মোড়ে আমাদের ভাইয়েরা মানবঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে এক অপ্রতিরোধ্য দেয়াল তৈরি করে রাখে যা ভেদ করে আওয়ামী হায়েনারা সামনের দিকে এক কদমও আসতে পারেনি। অবিরাম গুলি বোমা বর্ষণের মাঝে আমীরে জামায়াত অত্যন্ত বলিষ্ঠতার সাথে বক্তব্য রাখছিলেন। সামনের দিকের লোকজন আমীরে জামায়াতের বক্তব্য শুনছিল। আমীরে জামায়াত বক্তব্যের মাঝে কোথাও কোনো উসকানিমূলক বক্তব্য রাখেননি বরং আমাদের পরিস্থিতি ধৈর্য ও সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করার আহবান জানিয়েছিলেন। অপর দিকে মুক্তাঙ্গনে আওয়ামী নেতৃবৃন্দ সন্ত্রাসীদের উসকিয়ে দিচ্ছিলেন আমাদের ওপর হামলা চালানোর জন্য। সাহারা খাতুন, ডা: ইকবাল, হাজী সেলিম বারবার হাত উঁচিয়ে আমাদের সমাবেশে হামলা করার জন্য আওয়ামী সন্ত্রাসীদের বক্তব্য রাখছিলেন। আর পুলিশ সেই সকাল থেকে কোন অজানা কারণে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছিল। এত কিছুর মধ্যেও কোন নেতা কর্মী দমে যায়নি। যুদ্ধের ময়দানের মতো নামাজের ওয়াক্তের সময় পালা করে করে নামাজ আদায়ের সে দৃশ্য চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না যে সত্যিকারের মুজাহিদেরা সেদিন লড়াইয়ের ময়দানে মহান রাব্বুল আলামিনকে সেজদা করতে ভুলে যায়নি, ভুলে যায়নি জামায়াতে নামাজের কথা। আল্লাহ তায়ালাও সেদিন তার গোলামদের ভুলে যাননি। আর তাইতো ৬ জন শহীদের জীবনের বিনিময়ে (মুজাহিদুল ইসলাম, গোলাম কিবরিয়া শিপন, হাবিবুর রহমান, জসিম উদ্দিন-১ ও জসিম উদ্দিন-২ এবং সর্বশেষ সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুম যিনি গুরুতর আহত অবস্থায় তিন দিন সেন্সলেস থেকেই শাহাদাতের অমিয় শুধা পান করেন) আমাদেরকে সেদিন কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করেছিলেন। সেদিন মহানগরী পশ্চিমের আমান ভাইকে সন্ত্রাসীরা এমনভাবে আঘাত করেছিল যে প্রায় দুই মাস আসিইউতে ছিলেন। প্রত্যেক দিন আমাদের কাছে মনে হতো এই বুঝি আমান ভাইয়ের শাহাদাতের খবর আমাদের শুনতে হবে...। আজও আমান ভাই পরিপূর্ণ সুস্থ হতে পারেননি। আল্লাহ যেন তাকে পরিপূর্ণ সেফা দান করেন এবং তাকে হায়াতে তাইয়্যেবা দিয়ে সুস্থতার সাথে দিনের খেদমত করার তওফিক দান করেন। আমিন। হালাকু খান ও চেঙ্গিস খানের বাগদাদ নগরীর ওপর ধ্বংস চালানোর ইতিহাস আমরা পড়েছি, আবার মোঙ্গল ও তাতারিদের বর্বরতার ইতিহাসও পড়েছি কিন্তু সে সমাজ বর্বর সমাজ হওয়া সত্ত্বেও কখনো পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে, লাশের ওপর নৃত্য করেছে কি না তা ইতিহাসবিদরা ভালো বলতে পারবেন। পৈশাচিক কায়দায় আধুনিক মানবসভ্যতার এই যুগে লগি-বৈঠা দিয়ে সাপকে পিটিয়ে মারার মত মানুষ হত্যা সেদিন বিশ্বের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। আওয়ামী হায়েনাদের এই হিং¯্রতার মাঝেও জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতা কর্মীরা সেদিন লড়াইয়ের ময়দানেও রাসূলে কারীমের দেখানো পথ থেকে বিন্দু পরিমাণ বিচ্যুত হয়নি। যুদ্ধের ময়দানে রাসূলে আকরাম (সা) শত্রু পক্ষের কোন সৈন্যকে নিরস্ত্র একাকী পেলে আঘাত করেননি, পেছন থেকেও আঘাত করেননি। আওয়ামী হায়েনারা সেদিন আমাদের কোনো ভাইকে পাওয়া মাত্র ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আর বিপরীত চিত্র ছিল ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের মাঝে নিজেদের সাথীদের শাহাদাতের খবর আসছিল নিয়মিত বিরতিতে এমন পরিস্থিতির পর স্বাভাবিকভাবে প্রতিপক্ষের কোন লোক পেলেই উচিত জবাব দেবার কথা। কিন্তু না তারা একবার না কয়েক বার প্রতিপক্ষের কয়েকজনকে আহত অবস্থায় একাকী বাগে পেয়েও হিং¯্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েনি। বরং আহত প্রতিপক্ষকে সেদিন পরম যতেœ প্রাথমিক চিকিৎসা ও সেবা যতœ করে সুস্থ করে তুলে নিরাপদে সরে যেতে সাহায্য করেছে। সেদিনের শত শত মিডিয়ার ক্যামেরায় তা ধারণ করা হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে এও কি সম্ভব! হ্যাঁ আল্লাহ তায়ালার দ্বীনের মুজাহিদেরা সেদিন কঠিন পরিস্থিতিতেও রাসূলের আদর্শ থেকে চুল পরিমাণে সরে যায়নি ভুলে যায়নি তাদের মানবতাবোধ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস রাতের ঐ নিকষ কালো আঁধার চিরে পূর্ব আকাশে ভোরের ¯িœগ্ধ হাওয়ায় সোনালি সূর্যের যে ভাবে আগমন ঘটে সেভাবেই ২৮ তারিখের খুন রাঙ্গা সিঁড়ি বেয়ে কালেমার পতাকা এদেশের আকাশে উঠবেই। ২৮ অক্টোবরের শহীদদের রক্ত কথা বলবেই বলবে ইনশাআল্লাহ। লেখক : কেন্দ্রীয় ছাত্র-আন্দোলন সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির