post

প্রহসনের বিচার ও সাজানো রায় জীবন দিয়ে প্রতিবাদ করলো ছাত্র

জনতা

৩১ জানুয়ারি ২০১৫
[caption id="attachment_3074" align="alignleft" width="200"]মুহাম্মদ ইমরান খান রাজিব  পিতা : বাবুল খান মাতা : জান্নাতুল ফেরদৌসী ভাই-বোন : ২ ভাই, ২ বোন (সবার বড় ) সাংগঠনিক মান : সাথী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম : কেনাই, থানা-ফরিদপুর, জেলা-পাবনা শাহাদতের তারিখ : ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ১৪৪তম শহীদ। মুহাম্মদ ইমরান খান রাজিব
পিতা : বাবুল খান
মাতা : জান্নাতুল ফেরদৌসী
ভাই-বোন : ২ ভাই, ২ বোন (সবার বড় )
সাংগঠনিক মান : সাথী
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম : কেনাই, থানা-ফরিদপুর, জেলা-পাবনা
শাহাদতের তারিখ : ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
১৪৪তম শহীদ।[/caption]

মুহাম্মদ নুরুল হক

পৃথিবীতে সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ¦ চিরন্তন। হযরত আদম (আ) কে সৃষ্টির পর থেকে শয়তানের বিরোধিতার যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা এখনও চলমান। যুগে যুগে নানা কৌশলে বিভিন্ন রূপ নিয়ে শয়তানের সহযাত্রীরা সত্যকে স্তব্ধ করতে মরিয়া হয়ে কাজ করছে। হযরত ইবরাহিম (আ)-এর যুগে নমরুদের অহঙ্কার, হযরত মূসা (আ) এর যুগে ফেরাউনের দাম্ভিকতা এবং হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর যুগে আবু জাহেলের হুঙ্কার যেমন ছিলো, বর্তমানেও কুরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত সত্যের পতাকাবাহীদের সাথে দ্বন্দ্ব চলছে নব্য-ফেরাউন, নমরুদ ও আবু জাহেলসহ অসংখ্য বাতিল শক্তির। বাংলার সবুজ ভূখন্ডেও বাতিলের বিরুদ্ধে সত্যের পতাকা বহন করতে গিয়ে অনেকেই জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে সংগ্রাম করে ইতিহাসে সত্যের সাক্ষী হয়েছেন। প্রহসনের বিচার ও সাজানো রায়। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ মঙ্গলবার। সকালের সূর্যটা ছিলো অন্য দিনের মতো আলোকিত। সকাল পেরিয়ে সূর্য যখন ঠিক মাথার ওপর তখনই নেমে আসে ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। এ দিন ছিল সত্যকে পদদলিত করে মিথ্যার আধিপত্য বিস্তারের, বিচারের নামে প্রহসনের ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মেধাবী, দেশপ্রেমিক নেতৃত্বকে ধ্বংসের নীলনকশা বাস্তবায়নের দিন। ঘটনার সূত্রপাত বেলা ১টা। তথাকথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রহসনের রায় দেয়ার দিন ধার্য ছিল। সমগ্র বাংলাদেশে তাওহিদি ছাত্র-জনতা এ রায়কে প্রত্যাখ্যান করার সিদ্ধান্ত নেয়। ট্রাইব্যুনালে যখন আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় ঘোষণা করে, তখন বাংলাদেশের তাওহিদি ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে আসে প্রতিবাদ করার জন্য। চট্টগ্রামের ছাত্র-জনতাও প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসে মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা অলঙ্কার মোড়ে। সেই মিছিলে অংশগ্রহণ করে ইমরান খান রাজিব। ইমরান ছিল চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মেধাবী ছাত্র। যার পিতা-মাতার স্বপ্ন ছিলো ‘ছেলে লেখাপড়া শেষ করে একজন প্রকৌশলী হবে, সমাজ ও দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করবে’। কিন্তু পিতা-মাতার স্বপ্ন পূরণ হলো না। বাতিলের বিপক্ষে প্রহসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে রাজপথে সত্যের পক্ষে জীবন দিয়ে মানবজাতির কাছে নিজেকে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে চলে গেল মহান প্রভুর সান্নিধ্যে। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী সমবেত হওয়ার জন্য চারদিক থেকে চারটি মিছিল এগিয়ে আসছিল চট্টগ্রাম অলঙ্কার মোড়ের উদ্দেশে। কিন্তু যখনই মিছিল মোড়ের কাছে আসে, তখনই আওয়ামী হায়েনার দল প্রশাসনের লেবাসধারী নরপশুরা প্রতিবাদী ছাত্র, জনতার ওপর বৃষ্টির মত গুলি বর্ষণ করে। এক পর্যায়ে হায়েনার গুলি এসে ইমরানের বুকের বাম পাশে লাগে, বুক ছেদ করে বেরিয়ে যায় পেছন দিকে। মুহূর্তেই রাজপথে ঢলে পড়ে ইমরানের রক্তাক্ত দেহ। তাকে উদ্ধার করে ডাক্তারের কাছে নিতে আমাদের প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয় হায়েনার আক্রমণে। পুলিশ তার রক্তাক্ত দেহ টেনে হিঁচড়ে তুলে নেয় পুলিশ ভ্যানে, তার চিকিৎসা নিশ্চিত করার পরিবর্তে মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর মরদেহ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। রাজপথেই থেমে গেল পিতা-মাতার স্বপ্ন, থেমে যায় ইমরান। ইমরানের শাহাদতের খবর চট্টগ্রাম শহরে ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা আরও বেশি প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। ইমরানের শাহাদতের প্রতিবাদে আবারও মিছিলের সিদ্ধান্ত হয় নগরীর ব্যস্ততম এলাকা আগ্রাবাদ দেওয়ানহাট থেকে আগ্রাবাদ বাদামতলী পর্যন্ত। সময় তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা। হাজার হাজার প্রতিবাদী ছাত্র, জনতা উপস্থিত হয় প্রতিবাদ মিছিলে। ঐ মিছিলে আবিদ বিন ইসলামও উপস্থিত হয়। এইচএসসি পরীক্ষার্থী হওয়াতে মিছিলে আসার বাধ্যবাধকতা না থাকলেও শহীদের রক্তের টানে ছুটে আসে মিছিলে। আর আসার সময় মাকে বলে -‘আম্মা আমি যদি আজ প্রতিবাদ মিছিলে না যাই তাহলে শহীদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে, কেবল সুসময়ে মিছিল করলেই হবে না, এটা মুনাফিকের লক্ষণ, সুতরাং আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিন।’ মায়ের অনুমতি নিয়ে মিছিলে অংশগ্রহণ করে। মিছিল শুরু হওয়া মাত্রই আওয়ামী পুলিশ বাহিনী এবং ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা মিছিলে হামলা শুরু করে। পুলিশের আক্রমণের শিকার হয় আবিদসহ অনেকে। পুলিশ আবিদের ওপর মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করে মাথা ও পায়ে গুলি করে, তার দুই চোখ উপড়ে ফেলে, বন্দুকের নলের আঘাতে দাঁত ভেঙে দেয় এবং সমস্ত শরীর থেঁতলে দেয়। তাতেই নির্যাতন শেষ নয়, তারা আবিদকে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের হাতে লেলিয়ে দেয়। ঐ সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি আঘাত করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে লাশ গুম করার চেষ্টা করে। অবশেষে পুলিশ আবিদের লাশ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। ছেলে ব্যারিস্টার হবে, আবিদের পিতা-মাতার সে স্বপ্ন অঙ্কুরেই শেষ হয়ে যায়। ঐ মিছিলে শফিকুর রহমান ও আফজাল হোসেন নামে আরো দুইজন জামায়াতকর্মী শাহাদত বরণ করেন। তাদের লাশও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে নেয়া হয়। আরও অনেক ভাইকে আটক করে পুলিশ নির্মম নির্যাতন করে। পরদিন ৬ ফেব্রুয়ারি শহীদের সাথীরা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে তাদের লাশ আনতে গেলে সেখানেও ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা হামলার চেষ্টা করে। সেদিন বাদ জোহর চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক প্যারেড ময়দানে চার শহীদের জানাজার আয়োজন করা হয়। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন বিনা কারণে লাশ হস্তান্তরে গড়িমসি করে। শহীদের লাখো সাথী তাদের লাশ না পেয়ে অবশেষে গায়েবানা জানাজার মাধ্যমে তাদের জন্য দোয়া করে। শেষ বিকেলে পরিবারের কাছে তাদের লাশ হস্তান্তর করা হয়। চারজনের মধ্যে আবিদের লাশ নেয়া হয় হালিশহর বিডিআর মাঠে এবং আফজালের লাশ নেয়া হয় পাহাড়তলী এলাকায়। পৃথক জানাজা শেষে তাদেরকে দাফন করা হয়। আর শহীদ শফিকুর রহমানের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় তার গ্রামের বাড়ি বরগুনাতে এবং আমরা শহীদ ইমরানের লাশ নিয়ে যাত্রা করি তার গ্রামের বাড়ি পাবনার উদ্দেশে। পাবনার ফরিদপুরের কেনাই গ্রামে তার লাশ পৌঁছলে সেখানে স্বজনদের আহাজারি ও সাথীদের কান্নায় এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সেখানে তিন দফা জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়।

[caption id="attachment_3075" align="alignleft" width="200"]আবিদ বিন ইসলাম পিতা : অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম মাতা : উম্মে সালমা নার্গিস ভাই-বোন : ২ ভাই, (ছোট) সাংগঠনিক মান : সাথী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম : সন্দ্বীপ, থানা : সন্দ্বীপ, জেলা : চট্টগ্রাম শাহাদতের তারিখ : ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ১৪৫তম শহীদ। আবিদ বিন ইসলাম
পিতা : অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম
মাতা : উম্মে সালমা নার্গিস
ভাই-বোন : ২ ভাই, (ছোট)
সাংগঠনিক মান : সাথী
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম : সন্দ্বীপ, থানা : সন্দ্বীপ, জেলা : চট্টগ্রাম
শাহাদতের তারিখ : ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
১৪৫তম শহীদ।[/caption]

শহীদ ইমরান ও আবিদ আমাদের ছেড়ে মহান রবের সান্নিধ্যে চলে গেলেন। কিন্তু আমাদের জন্য যে অনুপম আদর্শ ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত অবশিষ্ট রইলো তাহলো মুসলমান কখনও মিথ্যার কাছে সত্যকে বিলিয়ে দেয় না, বাতিলের কাছে কখনও মাথা নত করে না। তারা যেন পবিত্র কুরআনের সেই আয়াতের অনুসরণ করেছে, ‘আর এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যমপন্থী জাতি হিসেবে সৃষ্টি করেছি, যাতে করে তোমরা সাক্ষী হও মানবজাতির জন্য।’ (সূরা বাকারা : ১৪৩) যে সত্যের পক্ষে কথা বলার কারণে শহীদ আবদুল কাদের মোল্লার বিচার করেছে সরকার, সে সত্যের পক্ষেই সাক্ষী হয়ে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিলেন শহীদ ইমরান ও আবিদ। ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে তাদের শাহাদত কর্মীদের জন্য সত্যের পক্ষে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এবং আন্দোলনের কর্মীরা শাহাদতের অনুপ্রেরণা নিয়ে সত্যের পক্ষে আজীবন সংগ্রাম করে যাবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাদের শাহাদাত কবুল করুন এবং তাদেরকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন। আমিন। লেখক : কেন্দ্রীয় মাদ্রাসা কার্যক্রম সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির