post

আওয়ামী নগ্ন হামলায় আক্রান্ত সম্পাদক ও সংবাদপত্র

ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম

১৪ জানুয়ারি ২০২০

১৯৭২ সালে মওলানা ভাসানী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে লেখা খোলা চিঠিতে আক্ষেপ করে বলেছিলেন- ‘স্বাধীন বাংলাদেশে পত্রিকা প্রকাশের সাধারণ অধিকারটুকুও না থাকলে আমি এ দেশে থাকতে চাই না, হয় পত্রিকা প্রকাশনার অনুমতি দানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দাও, নয়তো আমাকে এ দেশ থেকে বহিষ্কার করো।’ এ দেশের মানুষ সংগ্রাম করেছিলো মানুষের স্বাধীনভাবে কথা বলা, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ ও সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকবার জন্য। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর এই ধরনের আচরণ সংবাদপত্রের জন্য আজও অশনিসঙ্কেত। তারই ধারাবাহিকতায় গত ১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশের খ্যাতনামা সাংবাদিক, প্রবীণ বুদ্ধিজীবী, অসংখ্য গ্রন্থপ্রণেতা, দৈনিক সংগ্রামের সম্মানিত সম্পাদক জনাব আবুল আসাদ সাহেবের ওপর আক্রমণ, পত্রিকা অফিসে হামলা ভাঙচুর, লুটপাট ও তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে আওয়ামী-ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। এই ন্যক্কারজনক হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড়। তারা অবিলম্বে জনাব আবুল আসাদ সাহেবের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছে। স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ মানুষের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার। প্রত্যেকেই স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারবে এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। কিন্তু নিজের আদর্শ, চিন্তা-চেতনার বাহিরে কোন কথা বলাই যাবে না এটা গণতন্ত্রবিরোধী, অসহিষ্ণুতা ও স্বৈরাচারী মানসিকতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। দৈনিক সংগ্রাম কোনো ভুল করলে প্রেস আইনে মামলা হতে পারে। কারো অধিকার ক্ষুন্ন করলে তার জন্য আইন-আদালত রয়েছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও কতিপয় মিডিয়ার সামনে যেভাবে একজন প্রবীণ সম্পাদককে লাঞ্ছিত করা হয়েছে তা কোনো সভ্য সমাজে কল্পনা করা যায় না। আওয়ামী লীগের ইতিহাস হচ্ছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, সাংবাদিক হত্যা, পত্রিকা অফিস ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ইতিহাস। পুলিশ হামলাকারীদের আটকের পরিবর্তে উল্টো সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদ সাহেবকে আটক করে নিয়ে যায়। হায়রে! আইনের শাসন! আবুল আসাদ একটি বহুমুখী প্রতিভার নাম। তিনি একাধারে লেখক, প্রাবন্ধিক, রাজনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক এবং সম্পাদক। তবে তিনি বিখ্যাত সাইমুম সিরিজের জন্য। সেই নব্বইয়ের দশক থেকে আবুল আসাদ পড়ুয়া তরুণদের হৃদয়ের মধ্যমণি হয়ে আছেন। আবুল আসাদের জন্ম ১৯৪২ সালের ৫ আগস্ট রাজশাহী জেলার বাগমারা থানায়। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম.এ পাস করেন। ছাত্রজীবন থেকে তার লেখক ও সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। তিনি কয়েকটি দৈনিক ও সাপ্তাহিকে রাজশাহী সংবাদদাতা হিসাবে কাজ করেছেন। ১৯৭০ সালে ১৭ই জানুয়ারি দৈনিক সংগ্রামে সহকারী সম্পাদক হিসাবে যোগদানের মাধ্যমে তিনি তার সাংবাদিক পরিচয়টি স্থায়ী করেন। ১৯৮১ সালে তিনি দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ইতিহাস গ্রন্থ ‘কাল পঁচিশের আগে ও পরে’ এবং ‘এক শ বছরের রাজনীতি’, ঐতিহাসিক ঘটনার চিত্রধর্মী গল্প ‘আমরা সেই সে জাতি’ এবং প্রবন্ধ সংকলন ‘একুশ শতকের এজেন্ডা’। তার সবচেয়ে সাড়া জাগানো সাহিত্যকর্ম হলো সাইমুম সিরিজ। এ পর্যন্ত এই সিরিজের ৬১টি বই প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নামধারী একদল সন্ত্রাসী মগবাজারে বাংলাদেশের প্রাচীন সংবাদমাধ্যম দৈনিক সংগ্রামের অফিসে হামলা করে। সমগ্র অফিস তছনছ করে ফেলে তারা। মুহূর্তেই তারা দৈনিক সংগ্রামের অফিসকে যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে ফেলে। তারা আঘাত করে প্রবীণ সাংবাদিক ও সম্পাদক জনাব আবুল আসাদকে। ছাত্র ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা প্রবীণ ও জনপ্রিয় লেখককে হেনস্তা ও অপমান করে। এরই মধ্যে পুলিশ এসে আবুল আসাদকে নিরাপত্তা হেফাজতে নেয়। মানুষ ভেবেছে আবুল আসাদ তার দৈনিক সংগ্রামে সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে ও তাকে হেনস্তা করার অভিযোগে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা করবেন। হাতিরঝিল থানায় মামলা হলো কিন্তু মামলা হলো সন্ত্রাসীদের পক্ষে ও আবুল আসাদের বিপক্ষে। আমাদের বিস্মিত হওয়ার আরো বাকি রয়েছে। আদালত যেখানে একটি পত্রিকা অফিসে হামলার ব্যাপারে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মন্তব্য করার কথা ছিলো সেখানে আদালত প্রবীণ লেখক ও প্রাচীনতম সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। এ দেশের বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যে কোথায় অবস্থান করছে তা সহজেই অনুমেয়। এর আগেও এই ইসলামপন্থী লেখক ও বুদ্ধিজীবী আবুল আসাদকে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে গ্রেফতার করে। আজ যেন সর্বত্র কালোমেঘের ঘনঘটা চতুর্দিকে খিটমিট করছে। দেশের এই নাজুক পরিস্থিতিতে এখনতো মওলানা ভাসানীর মতো বলিষ্ঠ নেতা নেই!! নেই সাংবাদিক মুসা আতাউস সামাদ। যারা সাংবাদিকদের পাশে এসে দাঁড়াবেন। দৃঢ়তা আর অধিকার নিয়ে শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করবেন। বর্তমানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ চেয়ার থেকে যখন দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত ব্যক্তিদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে অপমান করা হয়। তখন এ জাতির কল্যাণে কেউ কি আর এগিয়ে আসার হিম্মত রাখে? মূলত ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্লজ্জ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যা করেছে। মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ আইন করে এখন তারা অনেকটা নির্ভেজাল বাকশালের দিকে রওয়ানা হয়েছে। এটি জাতির জন্য মহা দুঃসংবাদ। পৃথিবীবাসী জানতে পারলো আওয়ামী লীগ এখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, আর আইনের শাসনে বিশ্বাস করে না। সর্বশেষ দৈনিক সংগ্রাম অফিস ও সম্পাদকের নগ্ন হামলা করে তা ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ। ‘আওয়ামী লীগ এখনো চেতনায় বাকশালকে লালন করে।’ খুন আর গুম-প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ এখন নির্ভেজাল বাকশাল আর একনায়কতান্ত্রিকতার পথযাত্রী। সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের বক্তব্য, আচরণে আর শৃঙ্খলিত আইন কানুনে বাংলার জনগণ এখন সেই প্রতিধ্বনি খুঁজে পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই নগ্ন আক্রমণের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম আবার জানলো আওয়ামী লীগ সত্যপন্থী মিডিয়া, সম্পাদক ও সাংবাদিকদের সাথে কেমন শত্রুতা পোষণ করে। আমরা নতুন প্রজন্ম বাকশালের ইতিহাস পড়েছি কিন্তু আওয়ামী লীগের দুঃশাসন দেখেনি। আমার বিশ্বাস আওয়ামী শাসনামলে সংবাদপত্র ও মিডিয়ার অধিকাংশ সাংবাদিক, রিপোর্টার, কলামিস্ট, আর কলাকৌশলীরা মিডিয়ার উপর আওয়ামী লীগের খড়গহস্ততা দেখার সুযোগটিও পেয়েছে। আওয়ামী লীগ জন্ম থেকেই মিডিয়ার ব্যাপারে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদপত্র ও সৎ-সাংবাদিকদের ওপর চালিয়েছে দমন-নিপীড়ন। ’৭২-৭৪ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ৩ বছর শাসনামল ছিল সংবাদপত্রের জন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়। চারটি পত্রিকা বাদে সকল সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করে দেয়া, সাংবাদিক নির্যাতন, সম্পাদক গ্রেফতার, প্রেসে তালা লাগানো- এ সবই ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এই আওয়ামী লীগই জাসদের তৎকালীন সমাজতন্ত্রের ধারক বাহক দৈনিক গণকণ্ঠকে বন্ধ করে পত্রিকার সম্পাদক কবি আল মাহমুদকে রাতের অন্ধকারে গ্রেফতার করার নির্লজ্জ ইতিহাস কায়েম করেছিল। জাসদের ৪০ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছিল। স্বাধীনতা লাভের বারো মাসের মধ্যে গণশক্তি, হক কথা, লাল পতাকা, মুখপত্র, বাংলার মুখ, স্পোকসম্যান ইত্যাদি সাপ্তাহিক পত্রিকা নিষিদ্ধ হয়। পত্রিকাগুলোর সম্পাদক গ্রেফতার হন। এসব পত্রিকা বন্ধের ফলে তখন প্রায় চার শ’ সাংবাদিক বেকার হন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় বসার পর থেকেই সরকারের সমালোচনা এবং বিরোধী রাজনীতিকে সহিংস পন্থায় দমনের ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। চতুর্থ সংশোধনীর ফলে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতির স্থলে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং সকল রাজনৈতিক দল বাতিল ও বিলুপ্ত করে দেশে একটি মাত্র দল রাখার বিধান করা হয়। এই সংশোধনীর ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব একমাত্র দল বাকশাল গঠন করেন। তার নির্দেশে সরকারনিয়ন্ত্রিত চারটি ‘দৈনিক ইত্তেফাক’, ‘দৈনিক বাংলা’, ‘বাংলাদেশ অবজারভার’ ও ‘বাংলাদেশ টাইমস’ ছাড়া দেশের সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয়েছিল ১৬ জুন। আওয়ামী লীগ কখনোই মিডিয়াবান্ধব ছিলো না। তাদের জন্মই হয়েছে জনগণের অধিকার হরণ, কণ্ঠরোধ করার মাধ্যমে। প্রতিনিয়ত হামলা-মামলার শিকার হচ্ছেন সম্পাদক, সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী কলম সৈনিকরা। আমার দেশ পত্রিকার সাহসী সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আওয়ামী শাসনের অধিকাংশ সময়ই থাকতে হয়েছে কারাগারে। বিগত দিনে এই সরকার ঠুনকো অজুহাতে বন্ধ করে দিয়েছে চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশন, আমার দেশ পত্রিকা, অনলাইন মিডিয়াসহ মতপ্রকাশের অনেক গণমাধ্যম। হুমকির শিকার হয়েছে, দৈনিক ইনকিলাব, মানব জমিনসহ অনেক পত্রিকা ও সাময়িকী। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের ব্যাপারে দেশী-বিদেশী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একের পর এক অশনিসঙ্কেত ও উদ্বেগ প্রকাশ করে এলেও আওয়ামী লীগ এর কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। বাংলাদেশে গণমাধ্যম স্বাধীন নয় বলে তথ্য প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘ফ্রিডম অব দ্য প্রেস। রিপোর্টে বলা হয়েছে গত বছরের তুলনায় বাংলাদেশে মিডিয়ার স্বাধীনতা কমেছে। সূচকে এবার বাংলাদেশ ১১৫তম অবস্থানে রয়েছে।’ ‘দি ডেইলি স্টার’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ও সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, জনাব মাহফুজ আনাম ‘একটি পশ্চাৎপদ নীতি’ শিরোনামে এক প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘স্বাধীন গণমাধ্যম ও সরকারের মধ্যে যে কোন দ্বন্দ্বে প্রাথমিকভাবে সরকার জিতলেও শেষ পর্যন্ত স্বাধীন গণমাধ্যমেরই জয় হয়। সরকার প্রাথমিকভাবে জয় লাভ করে সরকারি প্রশাসন যন্ত্র, পুলিশ, গোয়েন্দা বাহিনী প্রভৃতির ব্যবহার, পেশিশক্তির প্রয়োগ ও অর্থের জোরে। প্রাথমিকভাবে এই বিজয় সম্ভব হলেও শেষ পর্যন্ত বাক-স্বাধীনতা ও স্বাধীন গণমাধ্যমের জয় হয় জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনে। আওয়ামী লীগ চায় বিরোধী দলশূন্য রাজপথ ও বিরোধী আওয়াজশূন্য মিডিয়া। সে জন্যই দেশের সবচেয়ে পুরাতন সংবাদপত্র সংগ্রাম অফিসে ও প্রবীণ সম্পাদকের ওপর এই নগ্ন হামলা চালিয়েছে। এভাবে কেল্লা ফতেহ করে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে চায় আওয়ামী লীগ। সেই স্বপ্নের ঘোরে আওয়ামী লীগ এখন বড়ই বেসামাল!!

লেখক : সহকারী সম্পাদক, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির