post

ইরান

০৪ মার্চ ২০১২
আলফাজ আনাম আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর আঞ্চলিক রাজনীতি যে অনেকখানি বদলে যাবে তার ইঙ্গিত সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে হয়ে গেলো পাকিস্তান-ইরান ও আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলন। পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে আফগানিস্তান ও ইরানকে ঘিরে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে ত্রিদেশীয় এ সম্মেলন আন্তর্জাতিক রাজনীতির জন্য গভীর তাৎপর্যপূর্ণ।  এমন এক সময় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন আফগানিস্তান থেকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তুতি চলছে, ইরানের ওপর পশ্চিমা বিশ্বের নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপের পর আরেকটি যুদ্ধের প্রস্তুতির খবর আসছে আর পাকিস্তানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকেছে। অপর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালেবানদের সাথে আলোচনা শুরু করেছে। এই বৈঠকে সন্ত্রাসবাদ, মাদক পাচার ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হলেও বৈঠকের মূল এজেন্ডা যে আফগানিস্তান ও ইরান প্রসঙ্গ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানে একটি স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠায় প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে এই তিনটি দেশ। আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাথে এই তিনটি দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।  তালেবানদের একটি গ্রুপের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজ উদ্যোগে আলোচনা শুরু করেছে তা কতটা সফল হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। মার্কিন-তালেবান আলোচনার চেয়েও এই তিন দেশ যদি আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা গ্রহণ করে তা অনেক বেশি কার্যকর হবে। কারণ শুধু তালেবান নয়, আফগানিস্তানের সব পক্ষের সাথে এই তিন দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে। কিন্তু কাজটি খুব সহজ নয়। বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তির সম্মানজনকভাবে আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে আসা এখন যুক্তরাষ্ট্রের বড় চ্যালেঞ্জ। তালেবানদের সাথে আলোচনা শুরু করতে হচ্ছে একটি ভীতিকর পরিসংখ্যানের মধ্য দিয়ে। মার্কিন সৈন্য মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। খোদ মার্কিন গণমাধ্যম বলছে এই যুদ্ধে বিজয় অর্জন সম্ভব নয়। আফগান যুদ্ধের দশ বছর পূর্তিতে টাইম ম্যাগাজিন এই যুদ্ধকে অভিহিত করেছে ঁহরিহহধনষব ধিৎ। এই যুদ্ধে বিজয়ের কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলছে। প্রতি বছর মার্কিন সৈন্যসংখ্যা মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলছে। পরিসংখ্যান বলছে  ২০০১ সালে আফগান অভিযান শুরুর বছরে মারা গেছে ১১ জন মার্কিন সৈন্য, ২০০২ সালে  ৪৯ জন,  ২০০৩ সালে ৪৫ জন,  ২০০৪ সালে ৫২ জন,  ২০০৬ সালে ৯৮ জন,  ২০০৭ সালে ১১৭ জন,  ২০০৮ সালে ১৫৫ জন,  ২০০৯ সালে ৩১১ জন,  ২০১০ সালে ৪৯৯ এবং  ২০১১ সালে ৪১৮ জন। এ ছাড়া ন্যাটোভুক্ত অন্যান্য দেশের সৈন্য সব মিলিয়ে ২৮৫৭ জন মারা গেছে। এভাবে হতাহতের সংখ্যা যখন বাড়ছে তখন যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করাই উত্তম। কিন্তু ন্যাটো বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা কার হাতে তুলে দেয়া হবে তার আলোচনা চলছে। তালেবানদের সাথে সমঝোতার ওপর নির্ভর করবে সম্মানজনকভাবে বেরিয়ে আসার পথ। না হলে একেবারেই পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে বেরিয়ে আসতে হলে পুরো মধ্য এশিয়া থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চলে আসতে হবে। কারণ পাশেই চীনা ড্রাগন আর রাশিয়ার শ্বেতভল্লুক প্র¯তুত হয়ে আছেই। শুধু শামসি ঘাঁটি নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আরো আগে উজবেকিস্তানের একটি বিমান ঘাঁটি ছেড়ে দিতে হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের ভূরাজনীতির মূল নিয়ন্ত্রক এই তিন দেশের ঐক্যবদ্ধতা বদলে দিতে পারে আঞ্চলিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি। ইরান ও পাকিস্তানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর অব্যাহত  চাপের মধ্যে এই বৈঠক পশ্চিমা দেশগুলোর ওপরও পাল্টা চাপ ফেলেছে।  সীমান্তবর্তী এই তিনটি দেশ যদি ঐক্যবদ্ধভাবে এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে তাহলে পুরো মধ্য-এশিয়ায় বিদেশী শক্তির প্রভাব অনেকটা কমে আসবে। এছাড়া এই তিন দেশের মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বাড়লে তিন পক্ষই অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। ইতোমধ্যে ইরান থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত সরাসরি তেলের পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। এই পাইপলাইন চীন পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে। ইরান থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ লাইনও স্থাপন করেছে পাকিস্তান। এসব অবকাঠামো সুবিধা থেকে আফগানিস্তানও লাভবান হতে পারবে। এ ছাড়া এ ধরনের উদ্যোগের পেছনে চীন ও রাশিয়ার নীরব সমর্থন রয়েছে বলে মনে করা হয়। কার্যত এই সম্মেলনে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে যে এ অঞ্চলে এক নতুন বলয়ের সৃষ্টি করছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ইরাক সফর করেন। দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্রে এই সফরে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি ঘটে। ইরান ও পাকিস্তান ঐকমত্য হয় দুই দেশের মধ্যে গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের ব্যাপারে। ২০১৪ সালে এই পাইপলাইন নির্মাণের কাজ শেষ হবে। এই পাইপলাইন নির্মাণের ইরানের অংশে ৯০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। ২৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পাইপ লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিলো  ইরান থেকে পাকিস্তান  হয়ে ভারতে গ্যাস সরবরাহের জন্য। কিন্তু গত দুই বছর থেকে এই পাইপ লাইন নির্মাণের আলোচনায় ভারত অনুপস্থিত রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে মার্কিন চাপে এবং ভারত-মার্কিন সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে এই পাইপলাইন নির্মাণের আলোচনায় অনুপস্থিত থাকে। ফলে ভারতকে বাদ দিয়ে এখন এই পাইপলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এখন এই পাইপলাইনের রুটেও খানিকটা পরিবর্তন আনা হচ্ছে যাতে চীন পর্যন্ত এই পাইপ লাইন যেতে পারে। যদিও এখন ভারত বলছে তারা ইরানের সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর উদ্যোগ নেবে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান থেকে জ্বালানি কিনবে। ভারতের এ ধরনের অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দেশটির সম্পর্কের ওপর কতটা প্রভাব ফেলে তা দেখার বিষয়। যদিও ভারতের সাথে ইরানের সম্পর্কের সাথে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের ওপর কোনো প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা নেই।  ইরান থেকে পাকিস্তানে শুধু গ্যাস নয়, বিদ্যুৎ সরবরাহের   পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ইরান থেকে ১১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির ব্যাপারে দুই দেশ ঐকমত্য হয়। এর মধ্যে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে গোয়াদরে। যেখানে চীনের সহায়তায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে ইরানের জ্বালানি সম্পদকে ঘিরে চীন-পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে এক ধরনের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ইরান-পাকিস্তান পাইপলাইন নির্মাণে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেবে চীন। ইরানের জ্বালানিসম্পদ বিক্রির ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও  ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিধিনিষেধ এ ক্ষেত্রে চীন আরো সুবিধা পাবে। চীন অব্যাহত জ্বালানি চাহিদার বড় অংশ ইরান থেকে পূরণ করতে পারবে। একইভাবে উপকৃত হবে পাকিস্তানও। জ্বালানি সহযোগিতা তিন দেশের সামরিক সহযোগিতাকেও এগিয়ে নেবে।  অপর দিকে ইরানকে সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো যে উদ্যোগ নিচ্ছে এই সম্মেলনের মাধ্যমে তা অনেকটা অসাড় প্রমাণিত হচ্ছে। শুধু পাকিস্তান নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল সরকার হিসেবে বিবেচিত কারজাই সরকারকে টিকে থাকার জন্য এখন পাকিস্তান ও ইরানের সাথে একযোগে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিতে হচ্ছে। আফগানিস্তান থেকে ২০১৪ সালে সৈন্য প্রত্যাহারকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে যে নতুন প্রভাব বিস্তারের লড়াই শুরু হচ্ছে তার আগাম ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইসলামাবাদ সম্মেলনে। প্রকৃতপক্ষে আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহারের পর চীন-ইরান-পাকিস্তান একটি নতুন শক্তির আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে। আফগানিস্তানের পার্শ্ববর্তী এসব দেশের নীতিনির্ধারণের ওপর নির্ভর করবে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা। তবে ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহারের পর তালেবানরা যে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফিরে আসবে তা অনেকটা নিশ্চিত। আফগানিস্তানের অন্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সাথে বোঝাপড়ার কাজটি এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে করতে হবে। হামিদ কারজাইয়ের এই সম্মেলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সে প্রক্রিয়াটিও হয়তো এগিয়ে নেয়া হলো। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির