post

ইসলামী চিন্তার উপাদান আল্লামা ড. ইউসুফ আল কারযাভী অনুবাদ : সালমান খাঁ

২৮ জানুয়ারি ২০২২

আল্লামা ড. ইউসুফ আল কারযাভী ১৯৭০ সালে একবার পাকিস্তানে আসেন। তখন তিনি আরব ছাত্রদের সংগঠন ‘জামায়াতুল ফিকরিল ইসলামী’ কর্তৃক আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। সেই বক্তব্যের বিষয় ছিল ‘ইসলামী চিন্তার উপাদান’। বক্তব্যটি লিখিত আকারে লেবাননি পত্রিকা ‘আশ শিহাব’ এর দশম সংখ্যায় ১৯৭০ সাল/ ১৩৯০ হিজরিতে প্রকাশিত হয়।

ইসলামী মূল্যবোধ লালনকারী হে যুবকরা, আমি তোমাদের ইসলামী সম্ভাষণে অভিবাদন জানাচ্ছি- সালামুল্লাহি আলাইকুম ওয়া রাহমাতুহু। হে আরব যুবকরা, হে নাকবার সন্তানরা, আমরা বহু বিজাতীয় চিন্তাধারা প্রত্যক্ষ করেছি এবং তাদের ফলাফল সম্পর্কেও অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। এই বিজাতীয় চিন্তাধারাগুলো আমাদের কোনো উপকারই করতে পারেনি। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে আমরা পাশ্চাত্য চিন্তার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। এই যুদ্ধের পরাজয় আমাদের কপালে কলঙ্কের দাগ এঁকে দিয়েছে। এই পরাজয় ছিল একাধারে মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও বিশ্বাসগত পরাজয়। (পাশ্চাত্য চিন্তার এই ব্যর্থতা দেখে) তারপর আমরা প্রাচ্যের বস্তুবাদী মার্কসবাদী চিন্তার দিকে ঝুঁকে পড়েছিলাম, এর ওপর নির্ভর করা শুরু করেছিলাম। এই নির্ভরতার ফলাফলও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ছয় দিনের যুদ্ধ মার্কসাবাদী চিন্তার ব্যর্থতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আমরা এখন ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছি। এখন সময় এসেছে আমাদের চিন্তা ও সভ্যতার উপাদানগুলো পর্যালোচনা করার। পর্যালোচনা করতে হবে একজন বস্তুনিষ্ঠ সমালোচকের দৃষ্টিতে, পক্ষপাতযুক্ত দৃষ্টিতে নয়। এখন সময় এসেছে আমাদের ইসলামী চিন্তার দিকে ফিরে যাওয়ার। কারণ মানবসভ্যতা যখন এই চিন্তা ধারণ করেছিল, লালন করেছিল এবং বাস্তবায়ন করেছিল, তখন তারা নিজেরাও সুখী হয়েছিল এবং অপরকেও সুখী করতে পেরেছিল। এই দ্বীনের মূল উপাদানগুলো এর মাঝেই লুক্কায়িত আছে। যখনই কেউ এর পুনর্জাগরণের জন্য চেষ্টা-পরিশ্রম করবে, তখন সে অবশ্যই এ লুক্কায়িত মূল উপাদানগুলো সম্পর্কে অবগত হবে।

আজ ইসলামকে প্রতিনিধিত্বকারী এই চিন্তার ঘোড়াকে জীবনযুদ্ধে নামতে দেওয়া হচ্ছে না, তাকে শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়েছে, তার লাগাম বেঁধে রাখা হয়েছে, তার চলার পথে ধুলা ছিটানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, “জীবনযুদ্ধের ময়দানে এই ঘোড়া মানবজীবনের প্রয়োজনীয়তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে না।” অথচ একই যুদ্ধে গাধাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, আর সে দিকভ্রান্ত হয়ে ইতস্ততভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইসলামী চিন্তার কিছু অনন্য উপাদান আছে, এর মাঝে প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করব।

মৌলিকত্ব ইসলামী চিন্তা এক স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও মৌলিক চিন্তাধারা। এই চিন্তা কারো অনুসারী, অনুগামী নয়। এই চিন্তা তার উৎস, গতিপথ, উদ্দেশ্য সবদিক থেকে অন্যের চেয়ে স্বতন্ত্র। এর উৎস হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগত নির্ভুল ওহি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “বাতিল এতে অনুপ্রবেশ করতে পারে না, সামনে থেকেও না, পিছন থেকেও না। এটা প্রজ্ঞাময়, চিরপ্রশংসিতের কাছ থেকে নাযিলকৃত।” (সূরা ফুসসিলাত : ৪২) এই চিন্তা স্বতন্ত্র; জগতের প্রতিটি বিষয়কে স্বতন্ত্রভাবে বিবেচনা করে। এই চিন্তা পার্থিব কোনো চিন্তাধারার রঙ-ঢঙকে অনুসরণ করে না। তাই তা ইতিহাসের ক্ষেত্রে নিতান্তই বস্তুবাদী ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে উঠে ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করতে পারে, আচরণের ক্ষেত্রে নিতান্তই শ্রেণিগত ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে উঠে আচরণকে ব্যাখ্যা করতে পারে এবং অনুভূতির ক্ষেত্রে নিতান্তই দৈহিক ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে উঠে অনুভূতিকে ব্যাখ্যা করতে পারে। ইসলামী চিন্তার মূল বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে মৌলিকত্ব, অনুকরণ প্রবণতা নয়। এই চিন্তা অন্য কোনো চিন্তাধারার ব্যাখ্যার সাথে একমত হয় না, হলেও নিতান্তই শাখাগত বিষয়ে; মৌলিক বিষয়ে নয়।

ব্যাপকতা ইসলামী চিন্তা কোনো খণ্ডিত বা আংশিক চিন্তাধারা নয়। ইসলামী চিন্তার মাঝে স্বয়ং ইসলামেরই তবিয়ত বিদ্যমান। ইসলাম হচ্ছে ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান আর মুহাম্মাদ সা. রিসালাত হচ্ছে সব যুগ ও সব জাতির জন্য প্রযোজ্য বিশ্বজনীন রিসালাত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আমি তো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি শুধু করুণা রূপেই প্রেরণ করেছি।” (সূরা আম্বিয়া : ১০৭) আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, “আর আমরা আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি প্রত্যেক বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ, পথনির্দেশ, দয়া ও মুসলিমদের জন্য সুসংবাদস্বরূপ।” (সূরা নাহল : ৮৯) প্রথম প্রজন্মের মুসলমানরা ইসলামী চিন্তার এই গতিময়তা ও ব্যাপকতাকে তাদের জীবনে যথার্থরূপেই বাস্তবায়ন করেছিলেন। যেমন আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা.-এর কথাই ধরা যাক। তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজগোজ করতেন, দাড়ি হালকা কেটে- ছেঁটে পরিপাটি রাখতেন। তাঁকে দেখে আবদুল্লাহ ইবনু ওমর রা.-এর গোলাম নাফি (রহ.) বললেন, “হে রাসূল সা.-এর চাচাতো ভাই, আপনি এসব কী করছেন? মানুষজন তো বহু দূর-দূরান্তের পথ পাড়ি দিয়ে আপনার কাছে জ্ঞান শিখতে আসে। (আর আপনার এই অবস্থা? অর্থাৎ আপনি সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত?” তখন আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. জবাব দিলেন, “আমি তো এটা আল্লাহর কিতাবেই পেয়েছি।” তারপর তিনি কুরআনুল কারিমের এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন, “আর নারীদের তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে যেমন আছে তাদের উপর পুরুষদের।” (সূরা বাকারা : ২২৮) প্রথম খলিফা মহামতি আবু বকর রা. বলেছিলেন, “আমার কোনো উটের রশিও যদি হারিয়ে যায়, আমি তার সমাধানও আল্লাহর কিতাবে পেয়ে যাই।” আবু বকর রা. এর এই কথা ইতিহাসের পাতায় আজও স্বর্ণাক্ষরের লিখা আছে। অতএব, বোঝা যাচ্ছে, আমাদের প্রথম প্রজন্মের মুসলমানরা ইসলামকে মৌলিকত্ব ও ব্যাপকতার নীতির আলোকেই অনুধাবন করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান মুসলিম আলিমরা যেন এই সত্যকে পাশ কেটে যাচ্ছেন। তারা প্রত্যেকেই এক একটি খণ্ডিত বিষয় নিয়ে পড়ে আছেন। যার ফলে, উম্মাহর মাঝ থেকে আজ ইসলামের সামগ্রিকতা ও ব্যাপকতার চেতনা হারিয়ে যাচ্ছে। উম্মাহ আজ ইসলামের সামগ্রিকতাকে ভুলে যাচ্ছে, যেহেতু তাদের আলিমরাই তা ভুলে গেছেন। তারা আজ ভুলে গেছে যে, ইসলাম জীবনের সকল দিক ও বিভাগকেই বিবেচনায় আনে এবং সকল দিক ও বিভাগের সমস্যারই সমাধান দেয়। আমাদের আলিমদের আজ অবস্থা হয়েছে ওই তিন অন্ধের হাতি দেখার মতো, যাদের গল্প হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম আবু হামিদ আল গাজ্জালি (রহ.) তাঁর “ইহইয়ায়ু উলুমুদ্দিন” কিতাবে বর্ণনা করেছেন। গল্পটি হচ্ছে, তিন অন্ধ একবার হাতি দেখতে গিয়েছিল। একজন হাতির শুঁড় ধরে বলল, হাতি হচ্ছে খাম্বার মতো। আরেকজন হাতির দাঁত ধরে বলল, হাতি হচ্ছে কীলকের মতো। আর বাকি একজন হাতির পেট ধরে বলল, হাতি হচ্ছে ফাঁপা তবলার মতো। আমাদের আলিমদের অবস্থাও আজ এমন হয়েছে। তাদের কেউ ইসলামের পেট ধরেছে, কেউ দাঁত ধরেছে কিংবা কেউ লেজ ধরেছে আর বলছে, “এটাই হচ্ছে ইসলাম।”

কোমলতা ও গতিশীলতা সত্তাগতভাবেই ইসলামী চিন্তা গতিশীল। ইসলামী চিন্তা জড়তাকে অপছন্দ করে এবং তাকলিদ বা অন্ধ অনুকরণকে নাকচ করে। ইসলাম বলে, “কখনোই সমাজ ও এর রীতিনীতির অন্ধ অনুসারী হবে না।” ইসলাম সবসময়ই কঠোরতা থেকে মুক্ত। ইসলাম সবসময়ই স্বীয় আদর্শ ও মূল্যবোধের দিক থেকে গতিশীল। ইসলাম কোমল ও গতিশীল, এই কথার সবচেয়ে বড় দলিল হচ্ছে আল্লাহর রাসূল সা.-এর এই কথা, “কোনো মুজতাহিদ ইজতিহাদ করলে তার যদি ভুলও হয়, তাও তার জন্য রয়েছে এক সাওয়াব। আর সে যদি সঠিক হয়, তাহলে তার জন্য রয়েছে দুই সাওয়াব।” আমরা দেখি আশয়ারি, সালাফি ও মুতাযিলাসহ আরও বিভিন্ন মত ও মাযহাব ইসলামের অনুসারীদের মধ্যে পাওয়া যায়। এই বিভিন্নতাই হচ্ছে ইসলামী চিন্তার কোমলতা ও গতিশীলতার জীবন্ত প্রমাণ। ইসলাম ছাড়া এমন আর কোন চিন্তা আছে, যা ভুলেরও স্বাধীনতা দেয়? ইমাম শাফিয়ি (রহ.) বলেন, “আমার মত সঠিক, তবে তা ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও রাখে। আর অন্যের মত ভুল, তবে তা সঠিক হওয়ার সম্ভাবনাও রাখে।”

দৃঢ়তা অবাক হওয়ার কিছুই নেই, ইসলামী চিন্তা একইসাথে কোমলতা ও দৃঢ়তাকে ধারণ করে। কারণ ইসলাম হচ্ছে সুমহান মহাবিজ্ঞ আল্লাহ তায়ালার মনোনীত জীবনবিধান, যিনি মানুষের ভিতর-বাহির সবকিছু জানেন; তিনি জানেন কিসে মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণ। ইসলাম গতিশীল, তবে তা একটি মিহওয়ার বা কেন্দ্রবিন্দুকে ঘিরে এবং একটি সুনির্দিষ্ট গণ্ডির আওতায় গতিশীল। বস্তুত এই নিয়ন্ত্রিত গতিশীলতাই জগতের প্রতিটি বস্তুর ধর্ম। যেমন, নক্ষত্রগুলো একটি নির্দিষ্ট গতিপথে গতিশীল। অর্থাৎ তাদের গতিশীলতাও তাদের গতিপথের সীমানার মাঝে আওতাভুক্ত। যদি তারা এই গতিপথকে অতিক্রম করতে চায় কিংবা এই গতিপথ ছেড়ে গতিশীল হতে চায়, তাহলে এই জগতের ধ্বংস অনিবার্য। একইভাবে মানুষও যদি কোনো কেন্দ্রবিন্দু ছাড়াই চিন্তা করতে চায়, তাহলে এটা তার জন্য কেবল ধ্বংস ও বিপর্যয়ই সৃষ্টি করবে। অতএব, চিন্তার উদাহরণ হচ্ছে বহতা নদী ও প্রবল বন্যার মতো। নদী যখন তার নিজ গতিপথে চলে, তখন সে মানুষের জন্য কল্যাণ ও উৎকর্ষতা বহনকারী হয়। কিন্তু নদী যখন তার গতিপথ ছেড়ে গতিশীল হতে শুরু করে, তখন সে মানুষের জন্য ধ্বংস ও বিপর্যয়ের কারণ ‘বন্যা’ হয়ে ওঠে। অথচ, নদী ও বন্যার তবিয়ত একই রকম। উভয়টিই পানি থেকে উৎপত্তি হয়েছে। কিন্তু প্রথমটি কল্যাণকর হলেও দ্বিতীয়টি ধ্বংস ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী।

ইসলামী চিন্তা গৌণ ও শাখাগত ব্যাপারে কোমল ও নমনীয়, কিন্তু তার উসুল ও মূলনীতির ব্যাপারে সুদৃঢ় কঠোর। ইসলামী চিন্তা এমন কোনো দ্বিধাগ্রস্ত চিন্তাধারা নয় যে, সে পূর্ব আর পশ্চিমের মাঝে দোল খাবে। ইসলামী চিন্তা হচ্ছে এমন এক চিন্তাধারা, যার রয়েছে সুনির্দিষ্ট মূলনীতি এবং সুনিশ্চিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। ইসলামী চিন্তা একাধারে মৌলিক, স্বতন্ত্র, গতিশীল, সুদৃঢ় এবং কোমল। ইসলামী চিন্তা উপায়, উপকরণ ও শাখাগত বিষয়াবলির পরিবর্তন বিশ্বাস করে। ইসলাম সকল সভ্যতা ও সংস্কৃতিকেই ধারণ করার ক্ষমতা রাখে। আর তাই, ইসলাম বিজয়ী বেশে রুম ও পারস্য প্রবেশ করার পর মুসলমানরা এই জাতিগুলোকে আদালত ও ইনসাফের ভিত্তিতে শাসন করতে পেরেছে এবং মুসলমানরা আল্লাহর ভাষায় হয়ে উঠেছে, “তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির জন্য যাদের বের করা হয়েছে।” (সূরা আলে ইমরান : ১১০)

ইতিবাচকতা ইসলামী চিন্তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক উপাদান হচ্ছে ইতিবাচকতা। দাওয়াতের ক্ষেত্রে ইতিবাচকতার সর্বোচ্চ উপমা উপস্থাপন করে গেছেন আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সা. ও তাঁর সাহাবিরা। রাসূলুল্লাহর মাক্কি যুগের কথাই ভাবা যাক। তিনি মানুষকে সৎ উপদেশ ও প্রজ্ঞার সাহায্যে আল্লাহর দিকে ডাকছিলেন। এ সময় মক্কার প্রতিষ্ঠিত জাহিলি শক্তি তাঁর দাওয়াতে বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু তিনি এতে দমে যাননি। বরং তিনি তায়িফ হিজরত করেন কিন্তু সেখান থেকেও ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসেন। এই কঠিন অবস্থায়ও সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিবাচক দ্বীন ইসলাম তার প্রথম ও প্রধান আহ্বায়ক মুহাম্মাদ সা.-এর ওপর ইতিবাচকতার সাথে কাজ করা ফরজ করে দিয়েছিল। তাই তিনি এই কঠিন পরিস্থিতিতেও হতাশ না হয়ে নিজেকে বিভিন্ন কওমের সামনে উপস্থাপন করতে লাগলেন। অবশেষে তাঁকে আল্লাহ তায়ালা আওস ও খাযরাজ কওম মিলিয়ে দিলেন। ইসলামী কাফিলার প্রথম সারির সদস্য আল্লাহর রাসূল সা.-এর সাহাবিরাও মক্কার কাফিরদের এই তীব্র বিরোধিতার মুখে দমে যাননি এবং আত্মসমর্পণও করেননি। বরং তারা প্রথমে হাবশায় হিজরত করেছেন, তারপর আবার দ্বিতীয়বার মদিনায় হিজরত করেছেন এবং জাহিলি শক্তির বিরুদ্ধে প্রকৃত ঈমানদারদের মতো ইতিবাচক এক সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছেন।

রাসূল সা. হাবশাকে ইসলামের আবাস বা প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করতে পারতেন; কিন্তু তিনি তা করেননি, যদিও সেখানে তিনি পরিপূর্ণ নিরাপত্তা ও উষ্ণ অভ্যর্থনা পেতেন। বরং আওস ও খাযরাজের সাথে কথা হওয়ার পর দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ সেনাপতি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সা. মদিনাকেই বেছে নিলেন ইসলামের আবাস বা প্রাণকেন্দ্র হিসেবে। এখান থেকেই ইসলামের দাওয়াত দিগি¦দিকে ছড়িয়ে পড়বে। এই মদিনাই হবে জাহিলি শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধদুর্গ। আল্লাহর রাসূল সা. জানতেন, আরব ভূমি থেকেই ইসলাম সবদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কারণ, আরবদের মাঝেই আভিজাত্য, বীরত্ব ও পুরুষত্ব পাওয়া যায়। আরব ভূমিতে ইসলাম শক্ত খুঁটি গেড়ে বসার পরই তা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে পারবে। ইসলামী চিন্তায় ইতিবাচকতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হচ্ছে রাসূলুল্লাহর এই হাদিস, “আল্লাহ তায়ালা এমন কোনো রোগ দেননি, যার ঔষধ তিনি পাঠাননি। যে জানার সে জানল, আর সে অজ্ঞ থাকার সে অজ্ঞই থেকে গেল।” এই হাদিসটি সেই সকল গবেষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পথনির্দেশনা হতে পারে, যারা শরীর ও মনের ঔষধ এবং রোগের জীবাণু সম্পর্কে অনুসন্ধান করে থাকেন। প্রচলিত একটি প্রবাদ বাক্য আছে, “সম্মানিত ব্যক্তির কাছে প্রতিটি সমস্যারই একটি সমাধান আছে।” অতএব, প্রতিটি সমস্যার জন্যই সুমহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে দেয়া একটি সমাধান আছে। তাই একজন মুসলমান কখনোই নেতিবাচক কোনো অবস্থান গ্রহণ করতে পারে না, কারণ তার দ্বীনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক উপাদানই হচ্ছে ইতিবাচকতা। ইসলামী চিন্তায় ইতিবাচকতার আরেকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে যুদ্ধকালীন নামাজ। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, যুদ্ধের ময়দানে মনোবল বৃদ্ধি করতে নামাজের ভূমিকা অপরিসীম। আর মনোবল হচ্ছে যুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি হাতিয়ার। তবে এই মনোবল বৃদ্ধিকরণ ছাড়াও যুদ্ধকালীন নামাজের পদ্ধতি ইতিবাচকতার আরও অনেক বড় উদাহরণ। যুদ্ধকালীন নামাজের পদ্ধতি হচ্ছে, মুসলমানদের একদল ইমামের পিছনে নামাজ পড়বে আর আরেকদল পাহারায় নিয়োজিত থাকবে। অর্ধেক নামাজ শেষ হওয়ার পরে পাহারারত দল ইমামের পিছনে এসে নামাজে দাঁড়াবে আর প্রথম দল চলে পাহারায়। যুদ্ধকালীন এই নামাজের পদ্ধতির মাঝে আমাদের জন্য রয়েছে অনেকগুলো ইতিবাচক শিক্ষা। যথা- প্রথমত, যুদ্ধকালীন নামাজ মূলত আমাদের সর্বদা সজাগ থাকার শিক্ষা দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের বর্তমান নেতারা এ ব্যাপারে একবারেই অসচেতন। তাই আজ আমরা সবক্ষেত্রে পরাজিত হচ্ছি। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধকালীন নামাজ আমাদের শত্রুর সামনে ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার শিক্ষাও দিচ্ছে। তৃতীয়ত, ইসলামী চিন্তার ইতিবাচকতার আরও একটি উদাহরণ দিচ্ছি। এক বেদুইন তার উটের দিকে ইশারা করে রাসূল সা.কে বললেন, “আমি কি আল্লাহর ওপর ভরসা করব?” আল্লাহর রাসূল সা. জবাব দিলেন, “আগে উট বাঁধো, তারপর আল্লাহর ওপর ভরসা করো।” তারপর ইতিবাচকতার আরেকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে, আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, “দুর্বল মুমিন আল্লাহর সিদ্ধান্ত ও তাকদির দিয়ে যুক্তি উপস্থাপন করে। আর শক্তিশালী মুমিন বিশ্বাস করে সে নিজেই হচ্ছে আল্লাহর সিদ্ধান্ত ও তাকদির।” সবশেষ আমি বলতে চাই, মৌলিকত্ব, ব্যাপকতা, কোমলতা ও গতিশীলতা, দৃঢ়তা এবং ইতিবাচকতার উপাদান নিয়ে গঠিত ইসলামী চিন্তাই নাকবা পরবর্তী এই পৃথিবীকে শাসন করার অধিকার রাখে। এ ইসলামী চিন্তাই মানুষকে মুক্তির রাজপথ দেখাতে পারে। এটাই হচ্ছে সহজ সরল পথ, সিরাতুল মুসতাকিম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর যে আল্লাহকে অবলম্বন করবে, সে অবশ্যই সরল পথ পাবে।” (সূরা আলে ইমরান : ১০১) লেখক : আন্তর্জাতিক মুসলিম নেতা ও ইসলামী চিন্তাবিদ অনুবাদক : শিক্ষার্থী, ঢাবি

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির