post

আত্মোন্নয়ন ইসলামী বিপ্লবের অনিবার্য শর্ত

২৮ এপ্রিল ২০১২
ড. আহসান হাবীব ইমরোজ আস্আলামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আশা করি পরম প্রভুর অপার মেহেরবানিতে সবাই মঙ্গল মতই আছেন। ছাত্র সংবাদের বন্ধুদের সাথে আমার সাক্ষাৎ কিছুটা অনিয়মিত। কিশোরকণ্ঠেই নিয়মিত হাজিরা দেয়ার চেষ্টা করি; তাতেই নাভিশ্বাস। এর মাঝে কর্তৃপক্ষ দক্ষিণ আমেরিকায় পাওয়া ২৩ ফুট দৈর্ঘ্যরে জায়ান্ট অক্টোপাসের মতোই আঁকড়ে ধরলেন- ‘ছাত্র সংবাদে ক্যারিয়ার নিয়ে নিয়মিত লিখতে হবে।’ বারকয়েক ফসকাতে চেষ্টা করলাম কিন্তু ঐ যে ভালোবাসার টানে আটকে যাওয়া। তাই আল্লাহর নামে শুরু। দোয়া করবেন। দেখা যাক মোল্লার (ভাববেন না, আপনাকে বলছি এ বন্দুক আমার দিকেই তাক করা) দৌড় কদ্দূর । ‘আত্মোন্নয়ন ইসলামী বিপ্লবের অনিবার্য শর্ত’ তারুণ্যের আবেগ দীপ্ত এক শিরোনাম। দু-একটি কবিতা বাদ দিলে খুব সম্ভব এটিই আমার প্রথম লেখা। একজন কর্মী সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারকের জন্য তড়িঘড়ি এবং কাঁচাহাতের লেখা। তখন সবে অনার্স লেভেলের ছাত্র। সেই পুরনো লেখাটি সমসাময়িক প্রেক্ষিতকে সামনে নিয়ে এক চিমটি পরিমার্জন, পরিবর্ধন করে একুশ শতকের সিপাহসালারদের সামনে তুলে ধরা হলো। ক.    বিপ্লব একটি উদ্দীপ্ত চেতনার নাম, যা মানুষের ভেতর এক দুর্বার আবেগের সৃষ্টি করে। যাতে উদ্বেলিত হয়ে মানুষ সাধনা করে সংগ্রাম করে এমনকি জীবন দেয়। খ.    বসনিয়া হার্জেগোভিনার সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. আলিজা আলী ইজেতবেগোভিচ (১৯২৫-২০০৩) তার তুমুল অলোড়ন সৃষ্টিকারী বই ‘প্রাচ্য পাশ্চাত্য ও ইসলাম’ (Islam Between East and West) নামক বইয়ে বলেন, ধর্ম এবং বিপ্লব উভয়েরই জন্ম যন্ত্রণা ও বেদনার মধ্য দিয়ে। কিন্তু এদের মৃত্যু ঘটে বিলাস ও সচ্ছলতার মধ্য দিয়ে। তাদের সত্যিকার জীবন ততক্ষণই যতক্ষণ তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নের সংগ্রাম চলে। সেই প্রক্রিয়াটি শেষ হওয়ার অর্থ তাদের মৃত্যু হওয়া। সুতরাং সংগ্রামের মাধ্যমেই আত্মোন্নয়ন আবার এটিই সংগ্রামের জন্ম দেয়। আত্মোন্নয়ন যে কোনো বিপ্লবের উৎপত্তি, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা নির্ভর করে একটি বিপ্লবী সংগঠনের ওপর। আর সংগঠনের সর্বনিম্ন উপাদান হচ্ছে একজন ব্যক্তি। সুতরাং ব্যক্তির ভেতর বিপ্লবী যোগ্যতার পরিমাণের ওপরই একটি বিপ্লবের শক্তিমত্তা ও স্থায়িত্ব নির্ভর করে। আল্লাহপাক তাই কুরআনুল কারিমের সূরা রাদের ১১ নম্বর আয়াতে বলেন, “তিনি ততক্ষণ কোনো জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ সেই জাতি তাদের নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন না করে।” ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে ‘If you want to change the world first change yourself.’ আরেকটি প্রবাদের কথা এখানে বলতেই হচ্ছে, যে সমস্যাটি প্রায় আমাদের প্রত্যেকের । “Everyone thinks of changing the world, but no one thinks of changing himself” কে বলেছেন এই মহামূল্যবান কথাটি? তার নামটি চট করে না বলে বরং একটু ভূমিকা টানতে চাচ্ছি; অনেকটা কুইজের মতোই। আর হ্যাঁ, এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন কেন? কাউকে না খুঁজে বরং আপনি নিজেইতো এতে অংশ নিতে পারেন। আর বিচারক সেতো আপনার নিজের  ভেতরেই আছে, নয় কি? তাহলে চলুন শুরু করছি : তিনি এমন একজন যিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৪২ কামরাবিশিষ্ট এক সুরম্য প্রাসাদে। যৌবনে তিনি ছিলেন একজন বিলাসী যুবক। দর্জির দোকানে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতেন। মারামারি করতেন, অনেক জঘন্য পাপ কাজ এমনকি খুন-খারাবিও করতেন; একটা নোংরা পাপময় জীবন যাপন করতেন। পৃথিবীর অন্যতম এই শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ১৮২৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক সূত্রেই এক বিশাল জমিদারিতে তার জন্ম। শুধুমাত্র নিজের ভাগেই তিনি পেয়েছিলেন প্রায় ৪০০০ একর জমি এবং ৩৩০ জন ভূমিদাস। মাত্র দুই বছর বয়সেই তিনি তার মা মারিয়াকে এবং ৯ বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে যার শৈশব শুরু হয়। কিন্তু তিনিই পঞ্চাশ বছর বয়সেই রচনা করেন পৃথিবীর দু’টি অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অমরগাথা হয়ে থাকবে। উপন্যাস দুটো হলো ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ ও ‘আন্না কারেনিনা’। এতক্ষণে নিশ্চয় চিচিংফাঁক সব কিছু পরিষ্কার, নয় কি? হ্যাঁ তিনি হচ্ছেন লিউ টলস্টয়। বিশ্ব সাহিত্যের গ্র্যান্ডমাস্টার। ভাবছেন বাড়িয়ে বলছেন, একদম না। The Greatest Books of All Time, As Voted by 125 Famous Authors. এই শিরোনামে ইন্টারনেটে সার্চ করলে জানা যাবে বিশ্বের ১২৫ জন লেখকের জরিপে টলস্টয় শেকসপিয়রের তুলনায় ১১.৬% পয়েন্টস বেশি পেয়ে সর্বকালের সেরা লেখক মনোনীত হয়েছেন। এই জরিপের বিস্তারিত ফলাফল দেয়া আছে ; The Top Ten: Writers Pick Their Favorite Books . নামক বইটিতে। এটি করতে এর লেখকেরা বাছাইকৃত ৫৪৪টি বই জরিপ করেছেন, অতঃপর তাদের দৃষ্টিতে নির্বাচিত সর্বকালের সেরা ১০ লেখকদের পয়েন্টসও দিয়েছেন। চলুন না, ঐ যে একটু আগে প্রত্যেকের ভেতরের বিচারকের কথা বললাম, তাকেই বরং তার আসনে বসিয়ে নিজেকে একটু ঝালিয়ে নেয়া যাক। আরে জনাব, এখনও বুঝেননি একবার নিচের তালিকায় চোখ বুলিয়ে বলুনতো এদের কয়টি বই আপনি পড়েছেন? TOP TEN AUTHORS BY POINTS EARNED
  •     Leo Tolstoy — 327
  •     William Shakespeare — 293
  •     James Joyce — 194
  •     Vladimir Nabokov — 190
  •     Fyodor Dostoevsky — 177
  •     William Faulkner — 173
  •     Charles Dickens — 168
  •     Anton Chekhov — 165
  •     Gustave Flaubert — 163
  •     Jane Austen — 161
লিও টলস্টয়কে নিয়ে এত কথা কেন বলছি? কারণ তার এই প্রবাদের তিনিই ছিলেন সর্বোত্তম উদাহরণ। জমিদারি দান করে গ্রামে একটি ছোট কুটিরে বাসা বাঁধলেন। নিজেই পানি তুলতেন, নিজেই নিজের জুতা পরিষ্কার করতেন। বাড়ি-ঘর-বাগান পরিষ্কার করতেন। সাধারণ মজদুরদের সাথে মিশে কাঠ কাটতেন, জমি চাষ করতেন। তাদের মতোই মোটা কাপড় পরতেন। নিজের বিছানাপত্র সাজাতেন, ঘরদোর ঝাড়– দিতেন এবং একটা সাধারণ ও আবরণহীন টেবিলে কাঠের বাসন থেকে কাঠের চামচ দিয়ে খাবার তুলে খেতেন। হ্যাঁ তার মুখেই মানায় এমন প্রবাদ ; “Everyone thinks of changing the world, but no one thinks of changing himself.” এই বিশ্বাস বা শক্তি তিনি কোথায় পেয়েছিলেন, কারণ তিনি যখন কাযান বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Kazan) ছাত্র তখন আরবি সাহিত্য নিয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন। আর জীবনের শেষপ্রান্তে ইন্তেকালের সময়ও তার ওভারকোটের পকেটে যে বইটি পাওয়া যায় তার নাম হচ্ছে; “The Sayings of Muhammad (PBUH)” of Abdullah al-Suhraverdi Printed in India in 1905. মুহাম্মদ (সা)ই সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছিলেন লিউ টলস্টয়কে। অনেকেই ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেন ৫০ বছর বয়সে খ্রিষ্টান হয়েই তিনি এত মহৎ হয়েছিলেন। কিন্তু আসল সত্য জানা যায় তার মহান উক্তিটি পড়লে । তিনি বলেছেন; “Muhammad has always been standing higher than the Christianity. He does not consider god as a human being and never makes himself equal to God. Muslims worship nothing except God and Muhammad is his Messenger. There is no any mystery and secret in it” ¯ Leo Tolstoy, The Prophet Muhammed's Words and Behaviour আর এই টলস্টয়ের লেখা পড়েই আলোড়িত হয়েছিলেন মাহাত্মা গান্ধী। ১৯০৯-১০ পর্যন্ত সময়ে গান্ধী যখন লন্ডন এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় আছেন সে সময় অনেকটা ছাত্রের মতো ৫বার চিঠি যোগাযোগ করেছেন টলস্টয়ের সাথে, যা তরুণ গান্ধীর জীবন-যাপন ও ভবিষ্যৎ আন্দোলনের কর্মসূচি নির্ধারণে সহযোগিতা করেছিল। আবার এই গান্ধীর শিক্ষাই সংগ্রহ করেছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র তার ১৯৫৯ সালে ভারত সফরের সময়।  নেলসন মেন্ডেলা, অং সাং সুকি এমনকি বারাক ওবামারও একই কথা। এবার আসি সেই বিখ্যাত বই “The Sayings of Muhammad (PBUH)” এর লেখক আবদুল্লাহ আল মামুন আল সোহরাওয়ার্দীর কথায়; তিনি একাধারে ছিলেন আল্লামা, ব্যারিস্টার, পিএইচডিসহ প্রায় ৭টি ডিগ্রির অধিকারী। তিনি আরবি, ইংরেজি এবং দর্শনে বিএ অর্নাস এবং এমএ উভয় ক্ষেত্রেই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলেন। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তার এই বইটি প্রথম প্রকাশ হয় যা দিয়ে তিনি লিউ টলস্টয়ের মত ব্যক্তিকেও প্রভাবিত করেন। আর টলস্টয়ের লেখনীতে প্রভাবিত হয় ভারতের গান্ধী। অতঃপর তার দ্বার প্রভাবিত হয় আফ্রিকার  নেলসন মেন্ডেলা, এশিয়ার অং সাং সুকি এমনকি আমেরিকার মার্টিন লুথার কিং এমনকি বারাক ওবামা যাদের কমন পরিচয় তারা প্রত্যেকেই নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। আত্মপরিচয়ের গুরুত্ব : বিশাল আকৃতির হাতি নিজের শক্তি ও আকৃতি সম্পর্কে জ্ঞাত নয় বলেই ক্ষুদ্রাকৃতির মানুষের কাছেও সে অসহায়। এ জন্যই আত্মপরিচয় জানাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহামতি সক্রেটিস তাই বলেছেন, Know thyself. অর্থাৎ নিজেকে জানো। আরবিতে একটি প্রবাদ আছে, যে ব্যক্তি নিজেকে চিনতে পারলো সে প্রকৃত পক্ষে তার প্রভুকে চিনতে পারলো। মহান আল্লাহ আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে কুরআনের সর্বাগ্রে বলেছেন, ‘পড়! তোমার রবের নামে যিনি পয়দা করেছেন মানুষকে জমাট রক্তপিণ্ড থেকে।’ (সূরা আলাক : ১-২) আমি কে? দর্শনের এই মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দার্শনিকেরা শত শত মতের জন্ম দিয়েছেন। ডারউইন বলেছেন বানরের বংশধর, ফ্রয়েড বলেছেন যৌনজীব, মার্কস বলেছেন অর্থনির্ভর প্রাণী, খ্রিষ্টধর্মের মতে নিষ্পাপ সত্তা বৌদ্ধ ধর্মের মত জন্ম পাপী, হিন্দু ধর্মের মতে সবচেয়ে অসহায় সত্তা আর বস্তুবাদের মতে উন্নত যন্ত্রবিশেষ। সত্যিকার পরিচয় নির্ধারণের মাপকাঠি : এ পৃথিবীতে জ্ঞানার্জনের উপকরণ মনে করা হয় দু’টি। প্রথমত, পঞ্চ ইন্দ্রিয় অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা জিহ্বা ও ত্বক এবং দ্বিতীয়ত, বুদ্ধি। কিন্তু তৃতীয় কোনো উপায়কে স্বীকার করা হয় না। যেমন পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা একজন মানুষের অস্তিত্ব এবং তার কার্যক্রম অনুভব করি। আর বুদ্ধির মাধ্যমে সেগুলোর তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য তালাশ করি। কিন্তু সেই মানুষটির সৃষ্টির উদ্দেশ্য, তার দায়িত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে উপরোক্ত জ্ঞানার্জনের দু’টি উপকরণ দিয়ে নিশ্চিতভাবে বোঝা যায় না। এ জন্য যে জ্ঞানের প্রয়োজন সেটিই হচ্ছে ওহিয়ে এলাহি বা ঐশী বাণী। যেমন পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধি দিয়ে ডারউইন বলেছেন, মানুষ বানরের বংশধর কিন্তু এই মত উল্লেখ করতে গিয়ে তিন তার Origin of Species  শত বার perhaps বা মনে করি শব্দ ব্যবহার করেছেন। সুতরাং সত্যিকার ও নিশ্চিত জ্ঞানের ভাণ্ডার হচ্ছে ঐশী জ্ঞান। আইনের বিখ্যাত Text Book Jurisprudence এ বলা হয়েছে, মানবজাতির ভালো-মন্দ নির্ধারণের মাপকাঠি একটি জিনিসই হতে পারে তা হলো ধর্ম। সঠিক পরিচয় : মানুষর পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহপাক সর্বপ্রথম যে কথাটা বলেছেন তা হচ্ছে ‘‘আমি পৃথিবীতে খলিফা পাঠিয়েছি।” (সূরা বাকারা : ৩০) যেহেতু আমরা আল্লাহর সৃষ্টি সুতরাং আমরা তাঁর দাস; আর দাসত্ব আমাদের কর্তব্য। আর আমরা যেহেতু তাঁর প্রতিনিধি সুতরাং এটা আমাদের দায়িত্ব এবং পদবি। তাই আমাদের প্রকৃত পরিচয় আমরা আল্লাহ কর্তৃক দায়িত্বশীল গোলাম। আমাদের দায়িত্ব : আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সারা বিশ্ব জাহানের মতো এই পৃথিবীতেও শুধুমাত্র তার দ্বীনকেই বিজয়ী রাখা। আর তাঁর গোলাম হিসেবে কর্তব্য হচ্ছে শুধুমাত্র তাঁরই ইবাদত করা। আল্লাহ বলেন, ‘‘তাদেরকে এ ছাড়া অন্য হুকুম দেয়া হয়নি যে, তারা যেন দ্বীনকে আল্লাহর জন্য খালিস করে একমুখী আল্লাহর দাসত্ব করে এবং নামাজ কায়েম করে ও জাকাত আদায় করে- এটাই সঠিক মজমুত দ্বীন।” (সূরা বায়্যিনা : ৫) মানুষের উপাদান : আল্লাহ মানুষকে কয়েকটি মৌলিক উপাদান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। প্রথমত, মাটির দৈহিক কাঠামো। আল্লাহ বলেন, ‘‘আমি পচামাটি শুকনা কাদা দিয়ে মানুষ পয়দা করেছি।” (সূরা হিজর : ২৮) দ্বিতীয়ত, মানসিক ও আত্মিক শক্তি। আল্লাহ বলেন, ‘‘আমার রূহ হতে তার মধ্যে ফুঁকে দেয়া হয়েছে।” (সূরা সায়াদ : ৭২) তৃতীয়ত, জ্ঞান দান। আল্লাহ বলেন,     ‘‘তিনি আদমকে সব জিনিসের নাম শিখিয়ে দিলেন।” (সূরা বাকারা : ৩১) এ তিনটি উপাদানে সজ্জিত করার পর আল্লাহ তাকে সেজদা করার জন্য ফেরেশতাদের নির্দেশ দিলেন এবং খলিফার মর্যাদায় তাকে অভিষিক্ত করলেন। আত্মোন্নয়নের ক্ষেত্র : যে তিনটি উপাদানের সমন্বয়ে প্রকৃত মানুষ গঠিত সত্যিকারভাবে সেগুলোর সুসমন্বিত উন্নয়নই হচ্ছে আত্মোন্নয়ন। এর তৃতীয়টি হচ্ছে জ্ঞান, যার আধার মস্তিষ্ক। যার কাজ অনুধাবন ও পরিকল্পনা। দ্বিতীয়টি মন ও আত্মা যার আধার মনস্তাত্ত্বিক জগৎ। যার কাজ সিদ্ধান্ত নেয়া ও তার বাস্তবায়নে দৃঢ়তা বা শক্তি সঞ্চার করা। প্রথম উপাদান দেহ কাঠামো যার কাজকর্ম বাস্তবায়ন। সুতরাং মগজ, মন ও দেহের সুসমন্বিত উন্নয়নের গঠনই আত্মোন্নয়ন। আবার অন্য দিকে যে কোনো বিপ্লবের জন্যও পর্যায়ক্রমে দরকার প্রথম : অনুধাবন ও পরিকল্পনা। দ্বিতীয় : সিদ্ধান্ত ও দৃঢ়তা। তৃতীয়ত : অব্যাহত সংগ্রাম। সুতরাং আত্মোন্নয়ন বিপ্লব সৃষ্টি ও সংরক্ষণের জন্য একান্তই অপরিহার্য। (ক) জ্ঞানার্জন : আল্লাহপাক তাঁর শ্রেষ্ঠ ফেরেশতার মাধ্যমে সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূলের (সা) নিকট সমস্ত মানবতার জন্য সর্বপ্রথম যে নির্দেশ দিয়েছেন তাই হচ্ছে ‘পড়’। (সূরা আলাক :১) জ্ঞানের কারণেই তিনি সমস্ত মাখলুকের ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে ফেরেশতাদের বলেছেন, ‘‘আদমকে সেজদা কর।’’ (সূরা বাকারা : ৪৪) সূরা আর রাহমানে কেন তিনি ‘রহমান’ এটা বর্ণনা করতে গিয়ে সর্বাগ্রে বলেছেন, ‘‘তিনি কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। আর জ্ঞানের সর্বোচ্চ আধার হচ্ছে কুরআন।” খ) মানসিক ও আত্মিক উন্নয়ন : রাসূলে পাক (সা) মানসিক ও আত্মিক উন্নয়নের জন্য নবুওয়তের আগে ১৫ বছর হেরা গুহায় ধ্যান করেছেন। আর নবুওয়তের পর রাতের অর্ধেক কিংবা কিছু কম কিংবা কিছু বেশি অর্থাৎ প্রায় ৬ ঘণ্টা গড়ে তাহাজ্জুদে ব্যস্ত থাকতেন। প্রতিদিন সত্তর বার এস্তেগফার করতেন (বুখারী শরীফ)। আর সর্বদা জিকিরে লিপ্ত থাকতেন। এ ছাড়া অন্যান্য মহাপুরুষরা যেমন জারথুস্ট ২০ বছর পাহাড়ে ধ্যান করেছেন। ‘মহাবী অরণ্যে ১২ বছর ধ্যান করেছেন। বুদ্ধ অরণ্যে ৮ বছরের ধ্যান করেছেন। এবং এর মাধ্যমে আত্মিক ও মানসিক বিকাশের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে সঠিক সত্য পাননি। (গ) দৈহিক উন্নয়ন : আল্লাহ পাক কুরআনে হজরত দাউদ (আ)কে নেতা মনোনয়ন দেয়ার পেছনে যে দু’টি কারণ উল্লেখ করেছেন তার একটি হচ্ছে দৈহিক যোগ্যতা। রাসূলে পাক (সা) সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং পরিশ্রমী ছিলেন। তিনি সুস্বাস্থ্যকে নেয়ামত হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং দুর্বল আবেদের তুলনায় শক্তিশালী আবেদকে অধিক মর্যাদা দিয়েছেন। মানুষ ছাড়া কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র হতে পারে না, সুতরাং মানুষ হচ্ছে সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রাণ। তাই মানুষের উন্নয়ন সমাজ বা রাষ্ট্রের উন্নয়নের মূল এবং মানুষের যোগ্যতার বিপ্লব বা উন্নয়নই সমাজ বা রাষ্ট্র বিপ্লবের মূল। সুতরাং আত্মোন্নয়নই হচ্ছে যে কোনো সত্যিকার বিপ্লবের অনিবার্য পূর্বশর্ত। আজকের মতো শেষ করতে চাই দু’টি বিখ্যাত বই পড়ার আবেদন জানিয়ে যাদের কথা ইতঃপূর্বে বলেছি; এক.    ড. আলিজা আলী ইজেতবেগোভিচ (১৯২৫-২০০৩) এর ‘ প্রাচ্য পাশ্চাত্য ও ইসলাম’ (Islam Between East and West) দুই.    “The Sayings of Muhammad (PBUH)” of Abdullah al-Suhraverdi. আজ এ পর্যন্তই । শুধু বলছি সেই বিখ্যাত আব্দুল্লাহ মামুন সোহরাওয়ার্দী (Abdullah al-Suhraverdi) কিন্তু এই ঢাকাতেই জন্মেছিলেন; তার মানে এই বাংলাদেশে জন্মে নিজ যোগ্যতায় ও চমৎকার লেখনিতে রাশিয়া, ভারত, আফ্রিকা এমনকি আমেরিকার বরেণ্য নেতৃবৃন্দকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছেন। তাহলে আপনি আমি কেন নয়? আল্লাহু আমীন। লেখক : শিক্ষাবিদ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির