post

গভীর সঙ্কটে বাংলাদেশের অর্থনীতি

০৭ জানুয়ারি ২০১২
ইকবাল কবীর মোহন আধুনিক বিশ্বের অর্থনীতিতে এখন টালমাটাল অবস্থা। ঋণসমস্যার ভারে ইউরোপের দেশগুলোর অর্থনীতি যখন চরমভাবে বিপর্যস্ত, তখন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশ আমেরিকার ঋণ ব্যবস্থাপনাও বেশ জটিলতার মধ্যে পড়েছে। এতে বিশ্বের তাবৎ অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর ভিত নড়ে উঠেছে। এ প্রেক্ষাপটে জাঁদরেল অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা ইদানীংকালে নানা আশঙ্কার কথা উচ্চারণ করছেন। তারা বিশ্ব অর্থনীতিতে ভয়ানক এক অস্থিরতার আভাসও দিচ্ছেন। এই অবস্থায় ইউরোপের অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলেপমেন্ট (ওইসিডি) সম্প্রতি এক কঠোর সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছে। ওইসিডি বলেছে, ইউরোপের অব্যাহত ঋণসমস্যার কারণে আন্তর্জাতিক হার্ড কারেন্সি হিসেবে ইউরো টিকে থাকতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। এই সংস্থা বিশ্ববাসীকে আরো সাবধান করে বলেছে, ইউরোপের অর্থনৈতিক সমস্যা এতটাই জটিল ও গভীর যে, এটাকে সময়মতো সামাল দিতে না পারলে বিশ্বের অনেক নিরাপদ অর্থনীতির দেশও যেমন, ব্রাজিল, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম ২০১২ সালের দিকে আক্রান্ত হতে পারে। এতে গোটা দুনিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারও আশঙ্কাজনক হারে কমতে থাকবে। ফলে তৈরি হবে মহাসঙ্কট। এই আশঙ্কার কথা ইতোমধ্যেই উচ্চারণ করেছে ইউনিয়ন ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ড (ইউবিএস)। ইউবিএস সম্প্রতি ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছে, ইউরোপ-আমেরিকার অর্থনীতি যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে ২০১২ সালে পৃথিবীতে গড়ে ৩.১ শতাংশ হারে যে প্রবৃদ্ধির আশা করা হয়েছিল, তা মাত্র ২.৭ শতাংশে গিয়ে ঠেকবে। এই আশঙ্কার প্রতিফলন আমরা লক্ষ্য করি প্যারিসভিত্তিক অর্থনৈতিক থিঙ্কট্যাঙ্ক-এর এক প্রতিবেদন থেকে। এরা ইউরোপের অর্থনীতির সমস্যার আলোকে ইইউভুক্ত ৩৪ দেশের প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি ২.৩ শতাংশ থেকে নামিয়ে ১.৭ শতাংশে নির্ধারণ করেছে। এ ছাড়াও আমরা লক্ষ্য করি, ইউরোপ ও আমেরিকার অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে ক্রেটিক রেটিং সংস্থা মুডিস আমেরিকার রেটিং নিম্নগামী করেছে এবং ইউরোপের ১৫টি দেশের ব্যাংকের  ক্রেটিক রেটিং কমিয়ে আনার প্রস্তাব করেছে। সার্বিকভাবে বলতে গেলে উন্নত বিশ্ব ও উন্নয়নশীল বিশ্বের সাম্প্রতিক অর্থনীতির হালচাল যে মোটেও সুখকর নয়, তার আলামত এখন সবার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দুনিয়ার এই অবনতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থাও জটিলতার মধ্যে প্রবেশ করেছে। ২০০৮-২০০৯ সালে বিশ্ব মন্দার ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, তার প্রভাব বাংলাদেশকে তেমন নাড়া দিতে না পারলেও, সাম্প্রতিকালের অর্থসঙ্কট আমাদের মতো ছোট অর্থনীতির দেশকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছে। ফলে বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা ও ব্যবস্থাপনা জটিল আকার ধারণ করেছে। সরকারের অত্যধিক হারে ব্যাংক ঋণগ্রহণ, লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, রেমিট্যান্সপ্রবাহে ব্যাপক ধস, রফতানি বাণিজ্যে ঘাটতি ও আমদানি বাণিজ্যে ব্যয়বৃদ্ধি, বিভিন্ন খাতে অতিমাত্রায় ভর্তুকি প্রদান, লেনদেন ভারসাম্যে চাপ দেশের অর্থনীতিকে জটিল করে তুলেছে। অর্থনীতির এই টালমাটাল অবস্থাকে সামাল দিতে না পারার কারণে আমাদের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেও চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। ফলে দেশের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও অন্যান্য অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান তার সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়েছে। এই অবস্থায় ২০১১-২০১২ অর্থ বছরের জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে খোদ সরকারের ভেতরেও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের পক্ষে বারবার নানা উদ্যোগ আয়োজন করেও অর্থনীতির ক্রম বর্ধমান ধস ঠেকানো যাচ্ছে না। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা অর্থনীতির এই বেহাল দশার জন্য সরকারের সম্প্রসারিত রাজস্বনীতি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকুচিত মুদ্রানীতি ও নানা অনিয়মকে দায়ী করেছেন। দেশের অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর দেশের অর্থনীতির এ নাজুক দশা স্বীকার করলেও এ পরিস্থিতি উন্নয়নে দৃশ্যনীয় ও কার্যকর কোনো পরিকল্পনা বা পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। তা ছাড়া বিশ্বমন্দার প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সরকারের তিন বছরের মাথায় এসে দেশের অর্থনীতি এক গভীর সঙ্কটে পড়েছে। বিনিয়োগে বিপর্যয় বর্তমান মহাজোট সরকারের আকাশচুম্বী বিজয় মানুষের মাঝে বিপুল প্রত্যাশা সৃষ্টি করলেও  অর্থনীতির নানা সমস্যা জনমানুষের আশা ভঙ্গ করেছে। বিশেষ করে সরকারের সময়মত পদক্ষেপের অভাব ও অদক্ষতা ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। তীব্র গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কট ও অবকাঠানোগত সমস্যার ফলে দেশের সার্বিক বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে। সরকারি উদ্যোগে তেমন কোনো বিনিয়োগ না হলেও বেসরকারি খাতে কিছুটা অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ২৫ শতাংশ প্রাক্কলন করা হলেও তা অর্জিত হয়েছে মাত্র ১৫ শতাংশ। কল-কারখানায় গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারায় দেশের অধিকাংশ কারখানা তার উৎপাদনের নির্ধারিত মাত্রা অর্জন করতে পারছে না। ফলে ব্যাংকগুলো একদিকে ঋণ ফেরত পেতে অসুবিধায় পড়ছে, অন্যদিকে ব্যাংকগুলো তারল্য সঙ্কট নিয়ে চলতে বাধ্য হচ্ছে। এ অবস্থার কারণে নতুন নতুন কল-কারখানা যেমন গড়ে ওঠেনি, তেমনি সৃষ্টি হয়নি নতুন কর্মসংস্থানের। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের রেকর্ড পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করার ফলে ব্যাংকের তারল্য সঙ্কট ও ঋণপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত  হয়েছে। উল্লেখ্য সরকার তার ব্যয় মেটাতে মাত্র পাঁচ মাসেই ব্যাংকগুলো থেকে ২১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। যদিও চলতি বাজেটে সরকারের ঋণের প্রাক্কলন ছিল ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির হার আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। রেমিট্যান্সপ্রবাহে ঘাটতি দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখা ও অর্থনীতির অন্যতম সূচক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সুস্থ রাখায় প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর আমাদের দেশের এই রেমিট্যান্সপ্রবাহে বড় শেয়ার ধারণ করে আছে মধ্যপ্রচ্যের দেশগুলো, বিশেষ করে সৌদি আরব। বিগত বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক ফিরে আসায় রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমতে থাকে। বিশেষ করে সৌদি আরবের সাথে সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্ক যথাযথ মানে না থাকায় দেশটি থেকে বেশি সংখ্যক শ্রমিক যেমন ফেরত আসছে, তেমনি নতুন করে শ্রমিক সেখানে যেতে পারছে না। ফলে রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধিতে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের বিপর্যয়। এতে রিজার্ভের ওপরও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী গত বছর নভেম্বরে রেমিট্যান্স আয় হয়েছিল ৯৯৮ মিলিয়ন ডলার, যা এই নভেম্বরে এসে ৮.৩৩ শতাংশ কমেছে। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে রেমিট্যান্স আয় হয়েছে ৪ হাজার ৯২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছর এই সময়ের তুলনায় ৩৪৬ মিলিয়ন ডলার বেশি হলেও প্রবৃদ্ধির হার মাত্র ৭.৫৫ শতাংশ। আমদানি ও রফতানি খাতে সমস্যা টাকার বিপরীতে অস্বাভাবিকভাবে ডলারের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়ে চলছে অব্যাহতভাবে। ফলে গত বছরের তুলনায় এ বছর অতিরিক্ত ডলার আমদানি ব্যয় মেটাতে হয়েছে। অন্যদিকে আমদানির জোগান দিতে গিয়ে যে পরিমাণ রফতানি আয়  হওয়ার কথা তা কমছে অব্যাহতভাবে। গেল নভেম্বরে অক্টোবরের তুলনায় রফতানি আয় কমেছে আড়াই হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ শতাংশ। অথচ তা গত বছর একই সময়ে ছিল ২৫ শতাংশের বেশি। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও রফতানি আয় কম হওয়ায় বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়েছে। তীব্র রিজার্ভ সঙ্কট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে এখন শঙ্কার মধ্যে আছে অর্থনীতি। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমে আসায় রিজার্ভ ঘাটতি আশঙ্কার মধ্যে পড়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেলেও তা সম্প্রতি ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে এসে ঠেকেছে। ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভ ছিল ৯.২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারকে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মিটানোর মত রিজার্ভ কমপক্ষে নিশ্চিত করার প্রয়োজন হয়। এই হিসেবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ৯ বিলিয়ন ডলার রাখতে হবে। আর এটা এখন প্রায় সমান সমান চলছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে হারে রেমিট্যান্স কমছে এবং ইউরোপ ও আমেরিকার ঋণ সংকটের কারণে যেভাবে রফতানি খাতে চাপ বাড়ছে তাতে রিজার্ভে মার্কিন ডলার যোগ হওয়া তো দূরের কথা, বরং তা কমে যাওয়ার যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে। জানা গেছে, সামনে আমদানি দায় বাড়বে, কুইকরেন্টাল কেন্দ্রের যন্ত্রাংশ, তেল অনুসন্ধান কোম্পানি শেভরনের পাওনা মিটানো, বিসিআইসির সার আমদানি ও বিপিসির তেল আমদানি দায় পরিশোধ করতে গেলে রিজার্ভে চাপ বাড়বে। অথচ এই সময়ে সরবরাহ বাড়বে না। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসতে পারে, যা তিন মাসের আমদানি ব্যয় মিটানোর সামর্থ্য হারাবে এবং তা সরকার ও দেশের অর্থনীতির জন্য হবে বড় এক চ্যালেঞ্জ। ডলার সঙ্কট চলতি বছরের শুরু থেকে টাকার বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের দাম বেড়ে চলেছে। যদিও বিশ্বের অন্যান্য দেশে ডলারের দাম পড়তির দিকে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১০ সালের ডিসেম্বরে আন্তঃ ব্যাংক লেনদেনে ডলার ৭০ টাকা ৬৫ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। এটা এখন ৮০ টাকা ৯০ পয়সায় লেনদেন হচ্ছে। এক বছরের ব্যবধানে ডলারপ্রতি দর বেড়েছে ১০ টাকা ২৫ পয়সা যা বাংলাদেশের ৪০ বছরের ইতিহাসে একটি রেকর্ড। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন যে ডলারের দর আরো বাড়তে পারে। ফলে বেড়ে যাবে আমদানি ব্যয় এবং এর ফলে দেশের মূল্যস্ফীতি আবারো বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। লাগামহীন মূল্যস্ফীতি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এ বছর ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। ৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে বছর শুরু হলেও তা নভেম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৫৮ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি অক্টোবরে ছিল ১১ দশমিক ৪২ শতাংশ, আর সেপ্টেম্বরে ছিল ১১ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অথচ বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের প্রধান বিষয় ছিল মূল্যস্ফীতি কমানো। লাগামহীন এই মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ব্যয় বেড়েছে এবং তাতে মানুষের জীবননির্বাহ কঠিন হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি ভর্তুকি সমন্বয়ের জন্য জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্ত আরেক দফা মূল্যস্ফীতি বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এখানে বলা যেতে পারে যে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে মূল্যস্ফীতি আর কখনও ডাবল ডিজিট অতিক্রম করেনি। সরকার চেষ্টা করেও এ মূল্যস্ফীতি বাগে আনতে পারছে না। লেনদেন ভারসাম্যে অসঙ্গতি দেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া এবং রফতানি আয় কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে লেনদেন ভারসাম্যও রক্ষা করা যাচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। গত সেপ্টেম্বরে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৩২৭ কোটি মার্কিন ডলার, যা বেড়ে গিয়ে অক্টোবরে দাঁড়িয়েছে ৩২৮ কোটি ডলারে। অথচ অক্টোবরে রফতানি আয় হয়েছে মাত্র ১৯৫ কোটি মার্কিন ডলার। এই রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি মাত্র ১৫ শতাংশ, যা আগের বছরে একই সময়ে ছিল ৬৫ শতাংশ। আর তখন আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৪ শতাংশ। আমদানি ব্যয়ের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। পুঁজিবাজারে ধস এই সরকারের বিগত আমলে পুঁজিবাজারে এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। বাস্তবতা হচ্ছে সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদেও পুঁজিবাজার রয়েছে অশান্ত। পুঁজিবাজার নিয়ে ইতোমধ্যেই নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্ম হয়েছে। ফলে পুঁজিবাজারের সাথে জড়িত দেশের প্রায় ৩৩ লাখ গ্রাহককে পুঁজি হারিয়ে পথে বসতে হয়েছে। নানা অনৈতিক কারসাজিতে গ্রাহকরা পুঁজি হারিয়ে অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছে এবং এ অবস্থা সরকারের ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তাকে শূন্যের কোটায় এনে দাঁড় করিয়েছে। সম্প্রতি কালো টাকা জায়েজ করার ঘোষণাসহ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ পুঁজিবাজারে খানিকটা ধনাত্মক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। তারপরও পুঁজিবাজারে এসে পুঁজি খোয়ানোর ক্ষত থেকে মানুষ উঠে আসতে পারবে কি না তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বৈদেশিক ঋণ অবমুক্তিতে অনিশ্চয়তা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের যখন অর্থনৈতিক টানাপড়েন চলছে, সেই মুহূর্তে সরকারের আয় বাড়ানো বা অর্থ ব্যবস্থাপনার অন্যতম শক্তি ছিল বৈদেশিক ঋণসহায়তা। এ ক্ষেত্রেও বর্তমান সরকার দাতা সংস্থার কাছ থেকে তেমন সাড়া পাচ্ছে না। সরকারের এই তিন বছরে সামান্য যা ঋণসহায়তা পেয়েছে তার সিংহভাগ ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে বলে ঋণের অর্থ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। সরকারের সাথে দাতা সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীদের সম্পর্কে টানাপড়েন থাকায় কেউ প্রতিশ্র“ত ঋণ অবমুক্ত করছে না। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বৈদেশিক সহায়তার হিসেবে দেখা যায় এক বছরের ব্যবধানে বৈদেশিক ঋণসহায়তা কমে গেছে ২০ কোটি ৫ লাখ মার্কিন ডলার। শতকরা হিসেবে এই কমতি দাঁড়িয়েছে ৩৩ শতাংশ। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের এক তথ্যানুযায়ী এ সময়ে ১৮৭ কোটি ৪৪ লাখ মার্কিন ডলার ছাড় দেয়ার কথা থাকলেও দাতাদের কাছ থেকে ৭৮ ভাগ বৈদেশিক সহায়তাই অনাদায়ী রয়েছে। ফলে সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা দারুনভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এর ফলে গত কয়েক বছর ধরে দেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি স্থবির হয়ে আছে। চলতি অর্থ বছরের ছয়মাস অতিক্রান্ত হলেও এ পর্যন্ত এডিপির বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২০ ভাগ। শেষকথা সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে যে স্থবিরতা ও জটিলতা তৈরি হয়েছে তা থেকে শীঘ্রই বের হয়ে আসার কোনো লক্ষন দেখা যাচ্ছে না,বরং দিনদিন সঙ্কট বেড়েই চলছে। দেশের তাবৎ অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা সরকারের সফলতা নিয়ে যেমন আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন, তেমনি দেশের জনগণের দুর্দশা নিয়ে চরম হতাশা উচ্চারণ করেছেন। সবার একটাই প্রত্যাশা সরকার সময় থাকতে অর্থনীতির হাল ধরতে পারবেন এবং দেশের অর্থনীতি বর্তমান নাজুক অবস্থা থেকে পরিত্রাণ লাভ করতে পারবে। লেখক : ইভিপি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি:

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির