post

চাঁদ যদি না থাকতো

০৪ জানুয়ারি ২০১৪

গোলাপ মুনীর

Chadচাঁদ যদি না থাকতো তবে কেমন হতো আমাদের এই চাঁদহীন দুনিয়া? চাঁদ না থাকলে থাকতো না চন্দ্র কিংবা গড়ড়হ বলে শব্দ। থাকতো না চাঁদমুখ, চন্দ্রমুখী, অর্ধচন্দ্র, মধুচন্দ্র্রিমা, চাঁদনিরাত, honeymoon, hunters moon(পূূর্ণিমার চাঁদ), New moon(অমাবস্যা), moon beam (চাঁদের আলো), moon calf (আজন্ম নির্বোধ), moonlight (চাঁদনি), moon rise (চন্দ্রোদয়), moonset (চন্দ্রাস্ত), moonstone(চন্দ্রকান্তমণি) এমনি আরো অনেক শব্দ। চাঁদ না থাকলে চাঁদ এর কক্ষপথে ঘুরতো না। তখন পৃথিবী এর নিজ অক্ষের ওপর আরো বেশি গতিতে ঘুরতো। কারণ, পৃথিবীর সমুদ্রের ওপর চাদের টান (Gravity pull) কাজ করতো না। চাঁদের টানেই তো পৃথিবীতে জোয়ার-ভাটা হয়। পৃথিবীর ওপর চাঁদের টান ও স্রোতের প্রবাহের ওপর চাঁদের প্রভাবে পৃথিবীর প্রতিদিনের ঘূর্ণনগতি কমে যায়। শত শত কোটি বছর আগে পৃথিবী এর নিজ অক্ষের ওপর আরো অনেক বেশি গতিতে ঘুরতো। এক সময় দিন ও বাতের চক্র ঘটতো ১০ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে। পৃথিবী যদি নিজ অক্ষের ওপর আরো বেশি গতিতে ঘুরতো, তার আরো নানা ধরনের প্রভাব লক্ষ্য করা যেত। বায়ু প্রবাহের গতি আরো বেশি হতো। কোনো প্রবাহ ঘটতো আরো বেশি সময় ধরে। জুপিটার গ্রহের কথাই ধরা যাক। জুপিটার তার নিজের অক্ষের ওপর একবার ঘুরতে সময় নেয় প্রায় ১০ ঘণ্টা। সে জন্য জুপিটারে প্রচুর হ্যারিকেন দেখা দেয় এবং এ হ্যারিকেন চলতে পারে শতবর্ষ ধরে। চাঁদ না থাকলে পৃথিবীর প্রাণীর ওপরও এর একটা দৃশ্যমান প্রভাব পড়তো। যেমন বায়ুপ্রবাহের ধরন পাল্টে গেলে এর প্রভাব পড়তো আমাদের হাঁটাচলা, কাজকর্ম, কথাবলা ইত্যাদির ওপরও। এর প্রভাব পড়তো সমুদ্রের জাহাজ চলাচলের ওপরও। সে জন্য বলা যায়, মহাকাশে আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী চাঁদ আমাদের জীবনযাত্রার এক বড় অংশ। সে জন্য এর পর যখন চাঁদের দিকে তাকাবেন, তখন ভাববেন চাঁদ আমাদের জীবনে কী ভূমিকা পালন করছে, আর চাঁদ না থাকলেই বা আমরা কী হারাতাম। চাঁদহীন জীবন জীবন (Life) হচ্ছে একটি অতি সূক্ষ্ম বিষয়। আমাদের পৃথিবীটার অবস্থান সৌরজগতের habitable zone তথা বসবাসযোগ্য অঞ্চলে। পৃথিবীর ওপর অনবরত বর্ষিত হচ্ছে সৌর বিকিরণ ও অসংখ্য মহাজাগতিক রশ্মি (solar radiation and cosmic rays)। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রস্তরময় অনেক মহাজাগতিক বস্তু সৃষ্টির পর অব্যাহতভাবে অতিক্রম করছে পৃথিবীর কক্ষপথ। এগুলো ছিলো পৃথিবীবাসী অনেক প্রাণীর বিলুপ্তির জন্য হুমকি। প্রকৃতপক্ষে, এটি প্রায় নিশ্চিত ছিল যে আমাদের পৃথিবীপৃষ্ঠের অসংখ্য প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটতো, যদি আমাদের উপকারী প্রতিবেশী চাঁদ না থাকতো। পৃথিবীতে এমন অনেক মহাজাগতিক দুর্ঘটনা ঘটতো, যা ঘটতে দিচ্ছে না এই চাঁদ। আকাশে আমরা অসংখ্য বস্তু দেখি। জ্যোতির্বিদ্যার ভাষায় এগুলোকে বলা হয় গাগনিক বস্তু বা Celestial body। চাঁদ হচ্ছে অনন্য এক গাগনিক বস্তু। বামন-গ্রহ (dwarf planet) প্লুটোর কথা বাদ দিলে চাঁদের মতো আর এমন কোনো উপগ্রহ (Satellite) নেই যার আকার মাতৃগ্রহের (mother planet) কাছাকাছি, আর পৃথিবী-চাঁদ ব্যবস্থাটি হচ্ছে একমাত্র টাইডলি লকড পেয়ার। অর্থাৎ পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যে একটা প্রবাহগত বন্ধন রয়েছে। অধিকন্তু সৌরজগতে একমাত্র চাঁদই একটি বুদ্ধিমান সভ্যতার (intelligent civilization) চারপাশে ঘুরছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, সাড়ে ৪ শত কোটি বছর আগে নতুন Earth নামের  planetesimal গঠিত হতে শুরু করে সূর্যের বর্ধিষ্ণু ধূলিকণা ও পাথরের চাকতি থেকে। প্ল্যানেটেসিমাল হচ্ছে সৌরজগৎ সৃষ্টির সময়কার অসংখ্য গাগনিক বস্তুর একটি। যা-ই হোক পৃথিবীর আশপাশে আরো বেশ কয়েকটি গ্রহও গড়ে উঠছিল। বিশেষ করে একটি প্লটোপ্ল্যানেট সৃষ্টি করে যাচ্ছিল কিছু উদাহরণতুল্য অগ্রগতিÑ পৃথিবীর ঘূর্ণন এলাকার আশপাশে ঘুরাফেরা করে। এটি ঘুরতে থাকে পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে নিরাপদ নিরপেক্ষ অভিকর্ষ দূরত্বে থেকে। শৈশবের  Earth ও এর ক্ষুদ্রতম প্রতিপক্ষ Thiea যখন বেড়েই চলছিল, তখন তাদের মধ্যকার অভিকর্ষ বল এমন মাত্রায় পৌঁছুল যে, এ দুয়ের এক হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এ দিকে চাঁদও গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ছিল। এর আগে পৃথিবীর আবর্তন গতি তথা নিজ অক্ষের ওপর ঘুরে চলার গতি নির্ণয়ের ব্যাপার নিয়ে ভাবেননি। তবে এটি এখন প্রমাণিত। এর পর থেকে পৃথিবীর আবর্তন গতির শুরু। সে সময় চাঁদ পৃথিবীর আরো বেশি কাছে ছিল। তখন চাঁদকে সূর্যের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি বড় দেখাতো। দীর্ঘ একটা সময় চাঁদ ছিল একটি ম-ের মতো এবং এর একটা চৌম্বকক্ষেত্র ছিল, যার ভূতাত্ত্বিক চিহ্ন রয়ে গেছে আমাদের পৃথিবীতে। যখন সবকিছু প্রায় ঠিকঠাক হয়ে এলো, তখন একটা যুগ আসে যার নাম Late planetary Bombardnest, সে যুগেই পৃথিবী ও এর সাথীর ওপর বর্ষিত হয় গ্রহজাত বর্জ্য বা আবর্জনা কিংবা গ্রহের ধ্বংসাবশেষ। যুগ যুগ ধরে ক্ষয়ের ফলে পৃথিবী থেকে প্রাচীনকালের এসব চিহ্ন উধাও হয়ে গেছে। কিন্তু চাঁদ বর্ষিত কিছু প্রস্তরখণ্ড হিমায়িত অবস্থায় অপরিবর্তিত আকারে থেকে যায়, এমন প্রমাণ মিলেছে। অ্যাপোলো-১৫’র নভোচারীদের চাঁদ থেকে সংগৃহীত বিখ্যাত পাথর genesis rock তেমনি একটি নমুনা। সৌরব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা জানতে পারি, চাঁদের জন্ম হওয়াটা বরং ছিল অস্বাভাবিক। অন্যান্য গ্রহগুলোর সবগুলোতেই হয় কোনো উপগ্রহ নেই, নয়তো তা ধারণ করেছে অন্য জায়গা থেকে। অবশ্য শুধু চাঁদই পৃথিবীর একমাত্র অস্বাভাবিক আবাসী (unusual resident) নয়। এর উপরিভাগ হামাগুড়ি দিয়ে চলছে অদ্ভুত ও মজার মজার কার্বনভিত্তিক নানা ধরনের প্রাণী নিয়ে। Rare Earth theory-র অনুসারীরা বলেন, আমাদের এই চাঁদ শুধু জীবনের জন্য উপকারীই নয়, বরং অপরিহার্য এক প্রয়োজন। যদিও আমাদের গ্রহগত প্রতিবেশী মঙ্গলগ্রহ কারিগরি দিক থেকে সৌরজগতের হেভিটেবল জোনের মধ্যেই অবস্থান করে, তবুও এমনটি ভাবার কারণ নেই যে, এর অক্ষ কাত হয়ে থাকার কারণে সেখানে কখনো প্রাণের অস্তিত্ব ছিল না। হতে পারে মঙ্গলগ্রহের অক্ষ আজকের ২৫ ডিগ্রি কাত হওয়ার বদলে ১০ ডিগ্রি পর্যন্ত কিংবা তারও কম কাত কোনো সময়ে থাকতে পারে। এর একটি মেরু এমন অবস্থায় থাকতে পারে, যে জন্য এর একটি মেরুর বরফ পুরোপুরি গলে যায়। এর ফলে বায়ুমণ্ডল পরিপূর্ণ হয়ে থাকতে পারে বাষ্পকণায়। পরবর্তী মওসুমে আবার তা জমে উঠতেও পারে। এভাবে মঙ্গলে অক্ষের কাত ও সোজা হওয়ার ফলে এক সময় বরফ জমা আর অন্য সময় বরফ গলা দেখা যেতে পারে। মে মাসে মঙ্গোলীয় আইসক্যাপের কাছে পোযিনিক্স ল্যান্ডারস ল্যান্ডে আমরা এই বরফযুগের চক্র হয়তো দেখতে পারি মঙ্গলের পৃষ্ঠে। পৃথিবীপৃষ্ঠেও এক সময় বরফ যুগ নেমে এসেছিল। তখন চাঁদের অভিকর্ষ কাজ করেছে একটি গ্রাইস্কোপ হিসেবে, পৃথিবীর অক্ষকে স্থিতিশীলভাবে ২৩.৫ ডিগ্রি কাত অবস্থায় রাখতে। এর ফলে আমরা বেঁচে যাই মঙ্গলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বিষম আবহাওয়া পরিবর্তনের হাত থেকে। এই দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য নিয়মিত মৌসুমি পরিবর্তনচক্রের মাঝেও পৃথিবীর প্রাণীরা বেঁচে থাকার সুযোগ পায়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমাদের পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভবে জোয়ার-ভাটার অবদানও মহামূল্যবান ছিল। সূর্য একাই কিছু কিছুটা জোয়ার-ভাটা ঘটাতে হয়তো সক্ষম ছিল, কিন্তু জোয়ার-ভাটায় চাঁদের ভূমিকা সূর্যের চেয়েও বেশি। শুধু ঢেউয়ের ফেনায় অনেক প্রাণী বেঁচে থাকার সুযোগ পেতো না। চাঁদের টানে বড় ধরনের জোয়ার আসার ফলে উপকূলীয় বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়মিত ভেজা ও শুকনা অবস্থায় থাকে। এ পরিবর্তনীয় এলাকায় উদ্ভব ঘটে প্রথম দিককার সামুদ্রিক প্রাণীগুলোর। এরা উপকূলীয় এলাকাকেই বেছে নেয় যথাযোগ্য আবাস হিসেবে। সমুদ্রতীর থেকে দূরের অঞ্চল শুষ্ক। সাধারণ নিম্নমাত্রার জোয়ার সেখানে গিয়ে পৌঁছে না। কেউ সমুদ্রতীরের যত বেশি কাছাকাছি আসবে, তার জন্য বায়ুর সান্নিধ্যকাল তত বাড়বে। যত বেশি সমুদ্রের কাছাকাছি যাওয়া যাবে পানিহীন শুষ্ক পরিবেশ ততই কমবে। আবহাওয়ার ক্রমপরিবর্তনের সুযোগটাই হয়তো পূর্বকালের প্রাণীরা নিয়েছিল। চাঁদের অভিকর্ষ টানের প্রভাব শুধু পানির ওপরই পড়ে, তেমনটি নয়। সম্ভবত চাঁদ পৃথিবীর অন্তর্বর্তী এলাকা ও সমুদ্রকে অধিকতর গরম রাখতে সাহায্য করে, চাঁদ না থাকার অবস্থার তাপমাত্রার তুলনায়। যেহেতু চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে মাসে একবার ঘুরে, এবং পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর ২৪ ঘণ্টায় একবার ঘুরে, চাঁদের অভিকর্ষ সৃষ্টি করছে ভূপৃষ্ঠের ওপর এক ধরনের টান। এর ফলে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে; চাঁদের অভিকর্ষ পৃথিবীর ওপর টান অনুভব করে, ঠিক রুটি দলাই করে দলা তৈরির মতো এর ফলে সৃষ্টি হয় এক গুরুভার ভাঙা পি-। ওই পি-কে আমরা বলি  plate tectonics. এমনকি পৃথিবীর ঘূর্ণন গতিও কমে যায় চাঁদের টানে। চাঁদ না থাকলে পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর আরো বেশি গতিতে ঘুরতো। এর ফলে আবহাওয়া থাকতো আরো অস্থির। ফলে অব্যাহতভাবে প্রবাহিত হতো আমাদের এই পৃথিবীতে প্রবল বায়ু। এমন প্রবল বায়ু বইতো যে, গায়ে কাপড় রাখা পর্যন্ত অসম্ভব হয়ে পড়তো। যেহেতু চাঁদের কক্ষপথ ধীরে ধীরে প্রতি বছর দেড় ইঞ্চি করে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, এতএব চাঁদের অভিকর্ষীয় টান এর ফলে কমে যাবে পৃথিবীর ঘূর্ণনগতি চাঁদের কক্ষপথের সাথে সামঞ্জস্য রাখার জন্য। একদিন হবে ৯৬০০ ঘণ্টায় এবং চাঁদ শুধু দেখা যাবে পৃথিবীর অর্ধাংশ থেকে। অবশ্যই তখন সূর্য পৌঁছুবে প্রসারমান red-giant পর্যায়ে। এবং সূর্য ধীরে ধীরে গিলে খাবে এর গ্রহগুলোকে। লেখক : বিজ্ঞান লেখক ও সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির