post

ছাত্ররাজনীতি লেজুড় বৃত্তিতে বাড়ছে অবক্ষয়

০১ এপ্রিল ২০১৫

মনির আহমেদ#

Raznityডিসেম্বর ২০১৪ সংখ্যায় একই বিষয়ে যেখানে শেষ করেছিলাম আজ সেখান থেকেই শুরু করার চেষ্টা করছি। একজন সচেতন মানুষ কখনোই একটি টেপ রেকর্ডারের মতো নয়। একটি টেপ রেকর্ডার যেকোনো কিছু ধারণ করে হুবহু তা তুলে ধরে। সচেতন যেকোনো মন কোন কিছু শোনার পর তা যাচাই করে নেয়। নিজের বিবেচনাবোধকে কাজে লাগিয়ে কোন কাজে যুক্ত হয়। কিন্তু ছাত্ররাজনীতির সাথে আজ যারা যুক্ত, তাদের মাঝে এ বিবেচনাবোধ আছে কি? ছাত্ররাজনীতিকে সঠিক পথে ফেরানোর দায়িত্ব আমাদেরই। আর এ জন্য আমাদের এই রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। ছাত্ররাজনীতি কেন প্রয়োজন? যদিও নিকট অতীতে বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছেন অনেকেই, কিন্তু প্রায় শতভাগ মানুষই এই রাজনীতির প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে নেন। ছাত্ররাজনীতি যেমন ছাত্রসমাজের জন্য প্রয়োজন, তেমনিভাবে দেশের উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ চিন্তাকে সামনে রাখলেও এ রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা পরিষ্কার হয়ে যায়। ক. ছাত্রসমাজের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা পালন আজ যারা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদরাসায় পড়ছে, তারা প্রতিনিয়তই নানা ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করে পথ চলছে। ছাত্রসমাজের যেকোনো সমস্যাকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে ও তা সমাধানের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যই ছাত্ররাজনীতি প্রয়োজন। ধরুন, একটি কলেজে কোন ধরনের রাজনীতি নেই। সেই কলেজে হাজারো সমস্যা রয়েছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে সেই কলেজের এসব সমস্যাকে তুলে ধরে প্রতিকারের দাবি নিয়ে উচ্চবাচ্য করার মতো তেমনভাবে কেউ এগিয়ে আসছে না। ছাত্রদের আবাসন, শিক্ষার পরিবেশ, সামর্থ্যরে আলোকে বেতনাদি নির্ধারণ, এসব বিষয় নিয়ে ছাত্রদেরই তো সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকতে হবে। আর সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার বিষয়টিই ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনকে স্পষ্ট করে। খ. শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে সহযোগিতা অবক্ষয়ের ফলে আজ ছাত্ররাজনীতি যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেখান থেকে অনেকেই শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকার পেছনে এই রাজনীতিকেই দেখতে পান। কিন্তু প্রশ্ন হলোÑ ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দেয়াই কি এর সমাধান। নাকি ছাত্ররাজনীতিকে সঠিক পথে ফেরানো? মূলত, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের জন্যই ছাত্ররাজনীতি প্রয়োজন। রাজনীতি হলো একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্য ব্যক্তিরা সামনের সারিতে চলে আসেন। তারাই সমাজ ও দেশগঠনে ভূমিকা রাখেন। ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রেও তেমনি। যোগ্য ছাত্ররা নেতৃত্বে আসে ও শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে সচেষ্ট থাকে। ছাত্ররাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের ফলে আজ অনেক ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীকে সামনের সারিতে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, যোগ্য ছাত্র কোনো শিক্ষাঙ্গনে নেতৃত্বে থাকলে সে অনেক ছাত্রকে ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দিতে পারে। ছাত্রদের মেধার বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসসহ নানা সমস্যার থাবা থেকে রক্ষা করতে পারে। ফলে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার চমৎকার পরিবেশ বিরাজ করে। গ. গণতন্ত্রচর্চার শিক্ষাক্ষেত্র গণতন্ত্র এখন পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনায় গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত। এই পদ্ধতি শুধু রাষ্ট্রের জন্যই যে প্রয়োজন, তা নয়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ, রাষ্ট্রের ভেতরের নানা পর্যায়ে এর চর্চার প্রয়োজন রয়েছে। ছাত্ররাজনীতি একজন ছাত্রকে গণতন্ত্রমনস্ক করে তোলে। গণতন্ত্রের পথ ধরে কিভাবে চলতে হয়, তা-ই শিক্ষা দেয়। আজ যখন আমাদের জাতীয় রাজনীতির পর্যালোচনা হয়, তখন বোদ্ধারা ঠিকই বলেন, রাজনীতির পথ বেয়ে উঠে আসা নেতা জাতীয় রাজনীতিতে কমে যাচ্ছে। ফলে অবক্ষয় বাড়ছে। যে ছেলেটি ছাত্ররাজনীতি করেছে, পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখছে, সে স্বাভাবিকভাবেই তার দেশ ও দেশের সমস্যা-সম্ভাবনাকে ভালোভাবে অনুধাবন করবে। কিন্তু এ ধরনের মানুষের অভাবের কথাই বোদ্ধারা বলে থাকেন। আমরা নিশ্চিত করেই বলতে পারি, গণতন্ত্রের প্রথম ধাপের সব কয়টি দেয় ছাত্ররাজনীতি। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে যদি নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়, তাহলে তা দেশের সার্বিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই আরো শক্তিশালী করবে। ঘ. সমসাময়িক সঙ্কটে ভূমিকা পালন রাজপথের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িতরাই। এটাকে খারাপ হিসেবে দেখার কোনো কারণ নেই। দেশে যেকোনো সঙ্কট তৈরি হলে ছাত্ররাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টরা হয়তো টেবিল আলোচনায় সমাধানের পথ দেখান না, কিন্তু যেকোনো অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রাজপথে তারা সংগ্রাম করেন। অতীতে ছাত্ররাজনীতি কিভাবে সঙ্কট মোকাবেলায় ভূমিকা রেখেছে, ইতঃপূর্বে তা আলোচনা করা হয়েছে। দেশের চলমান সঙ্কটেও ছাত্ররাজনীতি বড় ভূমিকা রাখছে। অপশাসনবিরোধী সংগ্রামে ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা রাজপথে সংগ্রাম চালিয়েই যাচ্ছে। ঙ. ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি এই প্রয়োজনটি সকলেই ভালোভাবে অনুধাবন করেন। ছাত্ররাজনীতি করার মাধ্যমেই একজন ছাত্র নেতৃত্ব কী, জনগণের প্রত্যাশা কী, কিভাবে জনপ্রত্যাশা পূরণে ভূমিকা রাখতে হয়, তা শিখতে পারেন। এসব শেখার মধ্য দিয়েই রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ছাত্রটির মাঝে জাতীয় নেতৃত্ব দেয়ার সক্ষমতা তৈরি হয়। কোন ব্যক্তি হঠাৎ করেই নেতা হয়ে যান না। কিংবা কেউ নেতা হয়েই জন্ম নেন না। নেতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার আগে অনেক চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়। ছাত্ররাজনীতি একজন ছাত্রকে তার গুণাবলি বিকশিত করার মাধ্যমে আগামী দিনের কারিগর হিসেবে তৈরি করে। কাজেই, দেশ ও জাতির প্রয়োজনে দেশে ছাত্ররাজনীতি অব্যাহত থাকা জরুরি। কারা ছাত্ররাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয় দুঃখজনক হলেও সত্য, এখন জনমনে একটা ধারণা জন্মেছে যে ভালো ছেলেরা রাজনীতির সাথে যুক্ত হয় না। বাস্তবতা হলো, ছাত্ররাজনীতি কলুষযুক্ত হওয়ায় ভালো অনেকে চাইলেও কলুষমুক্ত থাকতে পারছে না। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা নি¤œবিত্তÑ সব ধরনের পরিবার থেকেই একটা সংখ্যক ছাত্রছাত্রী রাজনীতিতে যুক্ত হন। একেক ধরনের অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে এসে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া ছাত্রছাত্রীদের চিন্তা ও কাজে পার্থক্য থাকে। একটু আলোকপাতের চেষ্টা করছি। উচ্চবিত্ত : স্বাভাবিকভাবে উচ্চবিত্ত পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের খুব বেশি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হতে দেখা যায় না। যারা রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান তারা পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রয়োজনে রাজনীতি করে। আর একটি অংশ করে শখের বশে। যেহেতু উচ্চবিত্ত হওয়ায় সম্পদের কোনো অভাব নেই, তাই অর্থব্যয়ের একটা মাধ্যম হিসেবেও অনেকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা ছাত্ররাজনীতিতে এলে অবশ্য কম সময়ে নেতৃত্বে চলে আসারও সুযোগ পায়। মধ্যবিত্ত : মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা স্বাভাবিকভাবেই আর দশজনের মাঝে একটু মর্যাদার আসনে থাকার স্বপ্ন দেখে। একইভাবে স্বপ্ন দেখে অর্থশালী হওয়ার। দেখা যায়, মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরাই রাজনীতিতে বেশি সক্রিয়। নিজেকে চূড়ান্ত উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা যেকোনো বড় ভাইয়ের হাত ধরে শুরু করে রাজনীতি। বড় ভাইয়ের সকল চাহিদা পূরণেও তারা সচেষ্ট থাকে। এ ক্ষেত্রে অনেকেই কোনটা নৈতিক কোনটা অনৈতিক সেটা বিবেচনায় নেয় না। কলুষযুক্ত ছাত্র নেতারা এর সুযোগ নেন। নতুন রাজনীতিতে আসা ছেলেমেয়েদের নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেন। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মেও এই ছেলেমেয়েদের ব্যবহার করা হয়। কমিটি গঠনকে সামনে রেখে কাউকে পোস্ট দেয়ার মুলো ঝুলিয়ে নানান অপকর্ম করিয়ে নেয়া হয়। এক সময়ে মধ্যবিত্ত ঘরের কেউ কেউ নেতা হওয়ার সুযোগও পেয়ে যায়, কিন্তু তাদের নৈতিকতা বোধ ততদিনে চুলোয় ওঠে। দুঃখ হলো, যে নেতৃত্বের বেড়ে ওঠাই এভাবে, সেই নেতৃত্ব থেকে দেশ-জাতি খুব বেশি কী-ই বা আশা করতে পারে? ঠেকায় পড়ে রাজনীতি : বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর হলে উঠতে হলে মোটামুটি কোন না কোন বড় ভাইয়ের হাত ধরেই উঠতে হয়। আর কেউ যদি নিজে নিজেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে হলে ওঠে, তাহলে তাকে প্রথম অথবা দ্বিতীয় রাতেই র‌্যাগের শিকার হতে হয়। এই র‌্যাগ সম্পর্কে সবার জানা আছে। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে এক নতুন ছাত্রকে র‌্যাগ দেয়ার একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। হলে নতুন ওঠা এক ছেলেকে প্রথম রাতেই ৬-৭ জন বড় ভাই তাদের রুমে নিয়ে বিভিন্নভাবে নাজেহাল করতে থাকে। ছেলেটিকে মদ পান করিয়ে অ্যাবনরমাল করে ফেলে। পরে তার সাথে সবাই একের পর এক জোর করে সমকামিতায় লিপ্ত হয়। ছেলেটি বুঝতে পারে না কী করবে। সকালবেলায় তার অচেতন দেহ পড়ে থাকতে দেখে হল কর্তৃপক্ষ। ছেলেটি বেঁচে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু চট্টগ্রাম মেডিক্যালে তার আর পড়ালেখা হয়ে ওঠেনি। এ রকম বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়ে বাধ্য হয়ে বড় ভাইদের গ্রুপের সদস্য হতে হয়। কাউকে আবার নির্যাতন না করে ধমক দিয়েই গ্রুপের মেম্বার করে নেয়। শুরু হয় বড় ভাইদের কথা অনুযায়ী নিয়মিত মিছিল-মিটিংয়ে যাওয়া। এক পর্যায়ে কেউ কেউ ভালোভাবেই শুরু করে, কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আবার কেউ নেতৃত্বে চলে যায়। মূলত লেজুড়বৃত্তির কারণেই ছাত্রদের মাঝে আলাদা আলাদা গ্রুপ হয়ে যায়। নিজেকে সবাই তুলে ধরার চেষ্টা করে। আর তুলে ধরতে গিয়েই আতঙ্ক ছড়ানোর প্রয়োজন হয়। এটা অবশ্যই অস্ত্র ব্যতীত হয় না। অস্ত্রের ব্যবহার এখন রাজনীতির জন্য অনেকটা ডাল-ভাত হয়ে গেছে। গত নভেম্বর মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগ সভাপতি স্বীকার করে নিয়েছেন যে তারা অস্ত্র ব্যবহার করেন। তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন যে, আগের থেকে অস্ত্রের পরিমাণ কমানো হয়েছে। এর দ্বারা  বোঝা যায় আগে আরো বেশি অস্ত্রের ব্যবহার ছিল। আর বিভিন্ন মিছিল সমাবেশে প্রকাশ্যে অস্ত্র ব্যবহার, বিভিন্ন সময়ে মিডিয়াতে ফলাও করে প্রকাশ এবং নিজেদের স্বীকারোক্তির পরও প্রশাসন তাদের গ্রেফতার করে না কারণ এ সকল ছাত্রনেতাকে তারা সরকারের অংশ মনে করে। ছাত্রনেতাদের কথায় অনেক সময় তাদের চাকরি, বদলি, প্রমোশন সুপারিশ এগুলো নির্ভর করে। সুতরাং ইচ্ছা করেই এমপি-মন্ত্রীর রোষানলে পড়ার কী দরকার? যখন যে দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকে তখন তাদের অস্ত্র ব্যবহার জায়েজ হয়ে যায়। এ ছাড়া আদর্শিক কারণেও অনেকে ছাত্ররাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে থাকেন। লেখক : প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির