post

দাস

দাসীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা)

০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
নাসির হেলাল

দাস শব্দের অর্থ চাকর, ক্রীতদাস, অনুগতজন, অধীন ইত্যাদি। এর স্ত্রী বাচক শব্দ দাসী। দাস শব্দ থেকেই দাসখত শব্দটি এসেছে-যার অর্থ দাসত্ব স্বীকার পত্র, দাসত্ব করার প্রতিজ্ঞাপত্র। দাসত্ব শব্দটিও দাস শব্দ থেকেই এসেছে যার অর্থ দাস্যবৃত্তি, ক্রীতদাসের কাজ। এর আরেকটি শব্দ দাস প্রথা। এর অর্থ ক্রীতদাস বা ক্রীতদাসী রাখবার রীতি ব্যবস্থা। দাসানুদাস বলেও একটি শব্দ ব্যবহৃত হয়-যার অর্থ গোলামের গোলাম, চাকরের চাকর, একান্ত অনুগতজন (সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান, বা. এ. পৃ. ২৭৭)। দাস প্রথা পৃথিবীর একটি প্রাচীন ও নিন্দনীয় প্রথা। এই প্রথা নানা জাতির মধ্যে নানা পদ্ধতিতে প্রচলিত ছিলো। ইসলামে এই প্রথার কোন স্থান নেই। বরং ইসলামে ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার পূর্ণরূপে স্বীকৃত এবং সংরক্ষিত। দাস প্রথার ভিত্তি হচ্ছে, অপরের শারীরিক শক্তিকে নিজের আরাম আয়েশের জন্য ইচ্ছা মাফিক ব্যবহারের এক তুচ্ছ অভিপ্রায় মাত্র। এ প্রথা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যুগেও প্রচলিত ছিলো। ফলে দাস-দাসীদের পূর্ণ মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা কল্পে রাসূলুল্লাহ (সা) বাস্তব ও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। হযরত মুহাম্মদ (সা)-ই প্রথম যিনি তাদের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে একটি মর্যাদাপূর্ণ আসনে উন্নীত করেন। দাস প্রথার শুরু দাস প্রথা বিশ্ব মানব সমাজের আদিম  প্রথাগুলোর অন্যতম এবং সবচেয়ে ঘৃণিত ও অমানবিক প্রথা। প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক জাতির মধ্যে এই কু-প্রথার অস্তিত্ব ছিলো। এমনকি পৃথিবীর দুটি প্রাচীন সভ্যতা গ্রীক ও রোমক সভ্যতায় দাস প্রথার ব্যাপক প্রচলন ছিলো। আর ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে প্রমাণিত হয় যে, হিন্দু, ইহুদি ও ডখ্রষ্টান এই তিনটি ধর্মের কোন ধর্মীয় গ্রন্থে দাস প্রথাকে অমানবিক নিন্দনীয় সামাজিক প্রথা হিসেবে গণ্য করা হয়নি। পৃথিবীর এই প্রাচীন প্রথার সূচনা সম্পর্কে ধারণা করা হয় যে, সমগ্র পৃথিবীতে যখন মানবতার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেনি ক্ষমতাশালীদের ইচ্ছেটাই যখন সামাজিক আইন, তখনই এই কু-প্রথার উদ্ভব ঘটে। প্রাচীন কালে বিভিন্ন জাতি তাদের যুদ্ধবন্দীদের হত্যা করার পরিবর্তে দাসে পরিণত করাকে বেশি লাভজনক মনে করতো। ফলে দাস প্রথার সূচনা লগ্নে দুটি ধারার প্রচলন হয়। (ক) যুদ্ধ বন্দীদেরকে দাসে পরিণত করা। যা সকলের কাছে খুবই গ্রহণীয় পন্থা ছিলো। (খ) প্রতারণা পূর্বক কাউকে বন্দী করে দাসে পরিণত করা। উভয় পর্যায়ের দাসদাসীদের সাথে একই ধরনের ব্যবহার করা হতো। পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতির মধ্যে দাস প্রথার নতুন নতুন পদ্ধতি ও পন্থার প্রচলন হয়। তবে দাস প্রথার একেবারে প্রথম দিকে উপরিউক্ত দুটি পন্থা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তৎকালীন সময়ে দাসদাসীদেরকে বন্যপশু ও মাছ শিকার এবং খাদ্য সংগ্রহের কাজে ব্যবহার করা হতো। পরবর্তী সময়ে তাদের দিয়ে পশুপালন, চাষাবাদ এবং উদ্যান তৈরির কাজে কাজ করানো হতো। ইসলামে দাস-দাসীদের মর্যাদা ইসলামে দাস-দাসীদের এই রূপ মর্যাদা ঘোষাণা করা হয়েছে যে, তারা ধর্মীয় বিধি বিধান পালন করে মনিবের অধিকার পূর্ণরূপে আদায় করলে প্রত্যেক সৎকর্মের জন্য বিনিময়ে দ্বিগুন সওয়াব পাবে। ফলে দাস-দাসীদের ইবাদত বন্দেগী স্বাধীন মানুষের ইবাদত বন্দেগীর মতো নয়। একমাত্র ইসলামই তাদেরকে কর্তব্য ও দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালনের পুরষ্কার হিসেবে এই মর্যাদা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, তিন ব্যক্তির নেক আমলের দ্বিগুণ পুরস্কার রয়েছে : ষ    এমন ব্যক্তি যে আহালে কিতাবের অন্তর্ভুক্ত। যে তার নবীর প্রতি ঈমান এনেছে এবং হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর প্রতি ও ঈমান এনেছে। ষ    এমন দাস, যে আল্লাহ্ তা‘আলার হক আদায় করে তার মনিবের হক আদায় করে। ষ    এমন ব্যক্তি যে তার অধীনস্ত দাসীর সাথে যৌন সম্ভোগ করে। তাকে উত্তমরূপে শিষ্টাচার শিক্ষা দেয় এবং যথাযথ জ্ঞান প্রদান করে। অতপর তাকে দাসত্বের জিঞ্জির থেকে মুক্তি প্রদান করে তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তার জন্য দ্বিগুণ সওয়াব রয়েছে (ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ১ম খণ্ড)। ইসলামী শরীয়াতে দাস-দাসীদের মর্যাদা প্রদানের বিষয়ে অপর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে : ‘এবং সর্বপ্রথম জান্নাতের দরজায় করাঘাত করবে দাস-দাসীগণ’ (সাঈদ আহমাদ, আর রিকক ফিল ইসলাম, পৃ. ১৯৩)। মর্যাদা প্রদানে ইসলামের এই নীতি ঘোষণা হলে দাস-দাসীরা দাসত্বের জীবনকে হীন জীবন মনে করতো না বরং গৌরবময় মনে করতো। কোন কোন দাস-দাসী গোলামীর জীবন থেকে নি®কৃতি পেয়েও কান্নাকাটি করতো। কেননা দাসত্বের জীবনে প্রত্যেক আমলের দ্বিগুণ নেকী প্রাপ্তির সুযোগ এবং আখেরাতে প্রথমেই জান্নাতে, প্রবেশ করার নিশ্চয়তা রয়েছে (ইব্ন হাজার আল-আসকালানী, তাহজীবুত তাহজীব, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩০)। দাস-দাসীদের মর্যাদা প্রদানে রাসূলুল্লাহ (সা) ইসলামে দাস-দাসীদের মান ইজ্জতের অধিকার পূর্ণরূপে সংরক্ষিত। এটা এমন স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, এই ব্যাপারে আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে জওয়াবদিহী করতে হবে। হযরত আবদুলাহ ইব্ন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : ‘জেনে রাখ, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। কাজেই প্রত্যেককেই নিজ অধীনস্থদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (ইমাম বুখারী, আস-সহীহ) ইসলামের দাস-দাসীদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকল্পে বহু নীতিমালা আছে। রাসূলুল্লাহ (সা) নিজেই সেই নীতিমালা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করেছিলেন এবং সাহাবায়ে কেরামকেও দাস-দাসীদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ ও নসিহত করতেন। তিনি দাস-দাসীদের অধিকার সংরক্ষণের বিষয়টি এতই গুরুত্ব প্রদান করেছেন যে, অন্তিম শয্যায়ও এর হেফাজতের ব্যাপারে জোর তাকিদ দিয়েছেন। হযরত আলী (রা.) শেষ বাণী ছিলো, ‘সালাত এবং অধীনস্থদের ব্যাপারে আল্লাহ্ তা‘লাকে ভয় কর।’ (ইমাম আবু দাউদ, আস্ সুনান, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৪৫) ইসলাম দাস-দাসীদের সাথে সদ্ব্যবহার ও সদারচরণ করার তাকিদ প্রদান করেছে। এ পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ (সা) আল্লাহ্ তা‘আলার হুকুম সকলকে জানিয়ে দেন। আলাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন : ‘‘তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত করবে ও কোন কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না; এবং পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম অভাবগ্রস্থ, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকার ভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। নিশ্চয় আল্লাহ্ পছন্দ করেন না দাম্ভিক, অহংকারীকে।” (সূরা আন-নিসা : আয়াত-৩৬) দাস-দাসীদের প্রাপ্ত ও ইসলামী শরীয়াত সংরক্ষিত অধিকার সমূহের মধ্যে প্রাথমিক অধিকার হল, তাদের সাথে সদাচার করা। উত্তম ব্যবহার করা। রাসূলুল্লাহ (সা) নিজেই দাস-দাসীদের সাথে উত্তম আচরণের উৎকৃষ্ট নমুনা। হযরত খাদিজা (রা.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পরে হযরত যায়েদ (রা.)-কে রাসূল (সা)-এর খেদমতে উৎসর্গ করেন। হযরত যায়েদ (রা.) ছিলেন একজন কৃতদাস। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সাথে পুত্রতুল্য আচরণ করতেন। ফলে সকলেই যায়েদ (রা) কে যায়েদ বিন মুহাম্মদ (সা) বলে সম্বোধন করতো। এক পর্যায়ে তিনি যায়েদ (রা)-কে মুক্ত করে দেন। কিন্তু তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর খেদমত থেকে দূরে থাকতে অপছন্দ করেন। হযরত উসামা (রা) ছিলেন হযরত যায়েদ (রা)-এর সন্তান। হযরত যায়দ (রা) স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পরিবারেই অবস্থান করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত উসামাকেও খুবই স্নেহ করতেন। হযরত উসামা (রা) নিজেই শৈশব কালের একটি ঘটনা এইভাবে বর্ণনা করেছেনÑ হযরত উসামা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে ধরতেন। এবং এরপর এক রানের উপর আমাকে বসাতেন এবং অপর রানের উপর হাসানকে বসাতেন। অতপর উভয়কে একত্রে মিলাইয়া দিতেন। পরে বলতেন, ‘হে আল্লাহ্ আপনি এদের উভয়কে রহম করুন। কেননা আমি এদেরকে ভালবাসি।’ (ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ৯ম খণ্ড, পৃ. ৪০৪) রাসূলুল্লাহ (সা) কৃতদাস-দাসীদের সাথে ও তাদের সন্তানদের সাথে যেমন উত্তম আচরণ করছেন, তেমনি তাদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণের কারণে আচরণকারীকে তিরষ্কারও করেছেন। হাদীসে এসছে : ‘মারুর ইবন সুওয়েদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবূ যরকে রাবাযা নামক স্থানে মোটা চাদার গায়ে দিয়ে থাকতে দেখলাম। এই সময়ে তাঁর গোলামের গায়ে অনুরূপ একটি চাদর দেখলাম। এরপর আমি তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। তখন আবূ যর বললেন, আমি একবার এক আরব ব্যক্তিকে গালি দিয়েছিলাম। আমি তার মায়ের নাম নিয়ে তিরষ্কার করি। রাসূলুল্লাহ (সা) এই সংবাদ জানতে পেরে আমাকে বললেন, ‘হে আবূ যর! তুমি তার মায়ের নামে তিরষ্কার করেছ। এখনও তো তোমার মধ্যে জাহিলী যুুগের স্বভাব রয়েছে।’ (ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৯) দাস-দাসীদের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) শুধু তিরষ্কার করেননি; বরং এমন আচরণের কারণে অনেককে শাস্তি প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ইয়াহুদি এক দাসীর মাথা দু’টি পাথরের মাঝখানে রেখে থেতলিয়ে দিয়েছিলো। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কে তোমাকে এমন করেছে? অমুক ব্যক্তি? অমুক ব্যক্তি? যখন জনৈক ইয়াহুদির নাম বলা হল, তখন সেই দাসী মাথার দ্বারা হ্যাঁ সূচক ইশারা করল। অতপর ইয়াহুদিকে ধরে আনা হলো। সে তার অপরাধ স্বীকার করল। রাসূলুল্লাহ (সা) তখন তার সম্পর্কে আদেশ জারি করলেন। এরপর দুই পাথরের মাঝখানে তার মাথা রেখে থেতলিয়া দেয়া হল। (ইমাম বুখারী, আস-সহীহ (অনু.), ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২২৩) হযরত আবদুলাহ ইবন উমর (রা) বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা) দাস-দাসী এবং নারীদের ব্যাপারে আল্লাহ্ তা‘আলাকে ভয় করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন। জাহিলী যুগে মনিবরা দাস-দাসীদেরকে মানুষ বলে গণ্য করতো না। খাদ্য, বস্ত্র তথা সকল পর্যায়ে তারা দাস-দাসীদের এবং নিজেরদের মধ্যে ব্যাপক ব্যাবধান রাখতো। তাদেরকে পেট ভরে খেতে দিতো না। নিজেরা সুন্দর পোশাক পরতো। আর অধীনস্থদেরকে হীন পোশাক দিতো। বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত রাসূলুল্লাহ (সা) এই গর্হিত আচরণ রোধে ইসলামে দাস-দাসীদের অবস্থান এবং তাদের প্রতি কর্তব্য সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পেশ করেন। তিনি বলেনÑ ‘তোমাদের দাস-দাসীরা তোমাদের ভাই। আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে তোমাদের অধীন করেছেন। কাজেই কারো ভাই যদি তার অধীনে থাকে তা হলে সে যা খায় তা হতে যেন তাকে খেতে দেয় এবং সে যা পরিধান করে তা হতে যেন পরিধান করতে দেয়। তাদেরকে সাধ্যাতীত কোন কাজে বাধ্য করবে না। যদি তোমরা তাদেরকে তাদের সাধ্যের বাইরে কোন কাজ দাও, তাহলে তাদেরকে তোমরা সহযোগিতা করো।’ (ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৬) হযরত আবু হুরাইরা (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘দাস-দাসীদের জন্য যথাযথভাবে খানা পিনা ও পোশাক পরিচ্ছেদের ব্যবস্থা করা মনিবের একান্ত কর্তব্য। এবং তার সাধ্যতীত কোন কাজের জন্য তাকে কষ্ট দেওয়া যাবে না।’ (ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ২৫তম খণ্ড, পৃ. ৫২) দাস-দাসীরাও মানুষ। কাজের মধ্যে তাদেরও ভুল-ভ্রান্তি হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু জাহিলী যুগে ত্র“টি-বিচ্যুতির  কারণে দাস-দাসীদেরকে কঠোর সাজা ভোগ করতে হতো। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের অন্যায় ও ভুলকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য জোর তাকিদ করেছেন। আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর খিদমতে আসলেন। অতপর আরজ করলেন হে রাসূলুল্লাহ (সা)! দাস-দাসীদেরকে আমরা কতবার ক্ষমা করব? রাসূলুল্লাহ (সা) কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, দাস-দাসীদেরকে প্রত্যেক দিন সত্তরবার ক্ষমা করবে।’ (সা‘ঈদ আহমাদ, আর রিকক ফিল ইসলাম, পৃ. ১৮১) রাসূলুল্লাহ (সা) দাস-দাসীদের প্রতি কেবল সদাচারণের আদেশ ও উপদেশ প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন নি। তিনি নিজেই তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করেছেন। তাদের ভুল-ত্র“টিকে ক্ষমার চক্ষে দেখেছেন। আনাস (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহচার্যে দশ বছর ছিলেন। মহানবী ইন্তিকালের সময় তাঁর বয়স হয়েছিলো দশ বছর। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আচরণ সম্পর্কে বর্ণনা করে বলেন : ‘আমি মহানবী (সা)-এর খিদমতে দশ বছর কাটিয়েছি । তিনি আমার প্রতি কখনোও উহ্! শব্দ বলেননি। এই কথা জিজ্ঞাসা করেননি। তুমি এই কাজ কেন করলে অথবা কেন করলে না।’ (ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ৯ম খণ্ড, পৃ. ১৯) হযরত আনাস (রা) অপর এক হাদীসে এ সম্পর্কে আরও বর্ণনা করেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) যখন মদীনা মুনাওয়ারায় আগমন করেন তখন তাঁর কোন খাদিম ছিলো না। আবূ তালহা আমার হাত ধরে আমাকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে নিয়ে আসলেন এবং বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা) আনাস বুদ্ধিমান ছেলে। সে আপনার খিদমত করবে। এরপর প্রবাসে আমি তাঁর খিদমত করেছি। আমার কৃত কোন কাজ সম্পর্কে তিনি কখনও বলেননি, তুমি এমন কেন করলে? কোন কাজ না করলে তিনি বলেননি, তুমি এটি এমন কেন করলে না?’ (ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৯৭) অধীনস্থদের প্রতি এমন সদাচরণ বিশ্ব মানব তরে ইতিহাসে বিরল। রাসূলুল্লাহ (সা) ছিলেন ক্ষমার এক অনুপম নযীর। আবূ হুরায়রা (রা) মহানবী (সা) থেকে বর্ণনা করেন, ‘যখন তোমাদের কোন গোলাম খাদ্য নিয়ে আসে তখন তাকে সাথে বসিয়ে অপেক্ষা না করালে সে যেন তাকে এক লোকমা অথবা দুই লোকমা কিংবা এক গ্রাস খাদ্য দেয়। কেননা সে এর জন্য পরিশ্রম করেছে।’ (ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৭) ইমাম মুসলিম (রহ) এ সম্পর্কিত একটি হাদীস উদ্ধৃতি করেছেন তাঁর হাদীস গ্রন্থে। হাদীসটি হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন, ‘যখন তোমাদের কোন গোলাম কিছু রান্না করে তার মনিবের কাছে নিয়ে আসে যার তাপ ও ধোঁয়া সে সহ্য করেছে, তখন তার উচিত হবে সেই গোলামকে কাছে বসিয়ে তা থেকে কিছু খাদ্য প্রদান করা। আর যদি খাদ্যের পরিমাণ কম হয়, তাহলে সে যেন তার হাতে এক গ্রাস অথবা দুই গ্রাস খাবার প্রদান করে।’ (ইমাম মুসলিম, আস্-সহীহ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৯০) প্রাক-ইসলামী যুগে দাস-দাসীদেরকে কথা-বার্তা, কাজ কর্মে এবং অবজ্ঞামূলক ভাষা প্রয়োগ করে হেয় করা হতো। রাসূলুল্লাহ্ (সা) দাস-দাসীদেরকে দাস-দাসী বলতে নিষেধজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যেন তার দাসকে আমার দাস না বলে। আর দাস-দাসীরা যেন মনিবকে আমার প্রতিপালক বা প্রতিপালক না বলে; বরং মানুষ তার দাসকে বলবে আমার সেবক বা সেবিকা এবং দাস-দাসীরা বলবে আমার সর্দার বা সর্দারনী। কেননা তোমরা সকলেই দাস এবং প্রতিপালক হলেন মহান আল্লাহ্ তা‘আলা।’ (ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৬) দাস-দাসীদের সাথে অসদাচরণ এবং তাদের উপর ক্ষমতার অপব্যবহার করার পরিণাম ভয়াবহ। রাসূলুল্লাহ (সা) এই ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামকে হিকমতের সাথে সতর্ক করতেন। এই পর্যায়ে কয়েকটি বর্ণনা নিম্নরূপ : আবূ মাসউদ আল বাদরী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আমি একবার এক কৃতাদসকে লাঠি দিয়ে মারছিলাম। হঠাৎ আমি আমার পিছন থেকে একটি শব্দ শুনলাম, হে আবু মাসঊদ! জেনে রাখ, কিন্তু আমি রাগের কারণে শব্দটি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম না। বর্ণনাকারী বলেন, যখন তিনি আমার কাছে আসলেন, তখন দেখতে পেলাম, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)! তিনি বললেন, হে আবু মাসঊদ! তুমি জেনে রাখ, হে আবূ মাসঊদ! তুমি জেনে রাখ। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর আমি লাঠিটি আমার হাত থেকে ফেলে দিলাম। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, হে আবূ মাসউদ! জেনে রাখ, আল্লাহ্ তা‘আলার ক্ষমতা এই এই দাসের উপর তোমার ক্ষমতার চেয়ে অধিকতর। বর্ণনাকারী আবূ মাসঊদ বলেন, অতপর আমি বললাম, এরপর কখনো আমি কোন কৃতদাসকে প্রহার করব না।’ (ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৮৬) অপর এক বর্ণনা মতে আবু মাসঊদ আল বদরী (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উক্তি শুনে বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (সা) আমি এই দাসটিকে মুক্ত করে দিলাম। তখন রাসূল (সা) বললেন : ‘সাবধান! তুমি যদি তা না করতে তাহলে অবশ্যই তোমাকে দোযখ গ্রাস করতো। অথবা (বর্ণনাকারীর সন্দেহ) দোযখ অবশ্য তোমাকে স্পর্শ করতো।’ (ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, ৫ম খণ্ড,  পৃ. ৮৭) দাস-দাসীদের সাথে অসদাচরণের ফলে পরকালে নাজাত পাওয়ার সুযোগ নেই। আবূ বকর (রা) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে অধীনস্থদের সাথে ক্ষমতার অপব্যবহারকারীর ঠিকানা জান্নাত নয় বলে সতর্ক করা হয়েছে। হযরত আবূ বকর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘দাস-দাসীদের সাথে ক্ষমতার অপব্যবহারকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (ইব্ন মাজাহ, আস্-সুনান, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৫১) জাহিলী যুগে সাধারণত স্বাধীন ব্যক্তিরা দাস-দাসীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া পছন্দ করতো না। ফলে কোন দাস-দাসী স্বাধীন পুরুষ বা মহিলাকে বিয়ে করতে পারতো না। রাসূলুল্লাহ (সা) এই সামাজিক প্রথা পরিবর্তনে বিপ্লবী ভূমিকা গ্রহণ করেন। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘একদা এক দাস রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে বনু বরাযা গোত্রের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তা পছন্দ করেন এবং উক্ত গোত্রকে এই সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব পেশ করেন। কিন্তু তারা দাস-দাসীদেরকে নিম্ন পর্যায়ের মনে করে আরজ করল, হে আল্লাহ্র রাসূল (সা)! আপনি কি আমাদের কন্যাদেরকে দাসদের সাথে বিবাহ প্রদানের জন্য নির্দেশ করছেন?’ তখন আল্লাহ্  তা‘আলা নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন : ‘হে লোক সকল! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে। এবং তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহ্র কাছে অধিক মর্যাদাবান যে তোমাদের মধ্যে অধিক আল্লাহ্ ভীরু। নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা সকল কিছু জানেন, সব কিছুর খবর রাখেন।’ (সূরা আল-হুজরাত : ১৩) উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা তাকওয়া অর্থাৎ আল্লাহ্ ভীরুতাকে মর্যদার ভিত্তি ও মাপকাঠি হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। জাতি, গোত্র, বর্ণ, স্বাধীনতা কিংবা পরাধীনতা কোনক্রমেই মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির কারণ নয়। দাস-দাসীদের বিবাহ প্রদান সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন : ‘তোমাদের মধ্যে যারা আয়্যিম (যে পুরুষের স্ত্রী নেই অথবা যে নারীর স্বামী নেই কিংবা বিপত্মীক অথবা বিধবা) তাদের বিবাহ সম্পাদন করো এবং তোমাদের দাস ও দাসাীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরও। তারা অভাবগ্রস্থ হলে আল্লাহ্ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাব মুক্ত করে দিবেন। আল্লাহ্তো প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা আন-নূর : ৩২) উপরিউক্ত আয়াতের মনিব ও দাসীর মাঝে বৈবাহিক সম্পর্কের বৈধতা ও আবশ্যকীয়তার দলীল বিদ্যমান। রাসূলুল্লাহ (সা) নিজেই দাসের সাথে স্বাধীন মহিলার বিবাহ সম্পাদন করে দাস-দাসীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিশ্বের ইতিহাসে তিনিই প্রথম যিনি দাস-দাসীদেরকে সামাজিক মর্যাদায় উন্নীত করার এক বাস্তব ও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ইসলামে দাস হত্যার শাস্তি প্রাক-ইসলামী যুগে গোটা আরব সম্রাজ্যে হানা-হানি, মারা-মারি, কাটা-কাটি ও রক্তের হলি খেলা বিরাজ করতো। মানব হত্যাকে কোন দোষের ও পাপের কাজ বলে মনে করা হতো না। সেই যুগের মানুষরা রক্তের নেশায় দিগি¦দিক ছুটতো। এই পরিবেশে দাস-দাসীদের অবস্থা ছিলো আরো নাজুক ও ভয়াবহ। ফলে ইসলামী শরীয়াত দাস-দাসী হত্যা করাকে জঘন্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে আইন জারি করে। কোন স্বাধীন ব্যক্তি যদি দাস বা দাসীকে হত্যা করে তা হলে তাকেও দাস হন্তা হিসেবে গণ্য করা হবে এবং কেসাস স্বরূপ তাকে হত্যা করা হবে। মহান আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন : ‘আমি তাদের জন্য তাতে বিধান দিয়েছিলাম যে, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং যখমের বদলে অনুরূপ যখম। অতঃপর কেউ তা ক্ষমা করলে তাতে তার-ই পাপ মোচন হবে।’ (সূরা আল-মায়েদা : ৪৫) রাসূলুল্লাহ (সা) দাস-দাসীদের হত্যার সাজা প্রদানের বিষয়টি এভাবে বর্ণনা করেছেন : ‘যে ব্যক্তি তার দাসকে হত্যা করবে আমরা কেসাস স্বরূপ তাকে হত্যা করব। আর যে ব্যক্তি তার নাক কর্তন করবে আমরা তার নাক কর্তন করব।’ (সুনানে আবু দাউদ) দাস প্রথা উচ্ছেদে ইসলাম ইসলামের আদেশ উপদেশ হল দাস-দাসীদেরকে দাসত্ব হতে মুক্ত করা, সমাজ হতে দাস প্রথার বিলোপ সাধন করা। পবিত্র কুরআনে দাস মুক্তির আবশ্যকতা এবং এর ফজীলত সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) ও দাস প্রথার উচ্ছেদ সাধনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেছেন। লোকদেরকে উপদেশ ও শিক্ষাদানের মাধ্যমে এবং নিজের ব্যবহারিক জীবনে তা বাস্তবায়ন করে রাসূলুল্লাহ (সা) দাস প্রথার উচ্ছেদ সাধন করেন। যা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। দাস মুক্তির নৈতিক আন্দোলনে আল-কুরআনে নীতিমালা হলো, যে সকল দাস-দাসী দাসত্বের জীবন থেকে মুক্তির ব্যাপারে অন্যের সহযোগিতার মুখাপেক্ষী তাদেরকে যাকাতের অর্থ প্রদান করা যাবে। ইসলাম দাস-দাসীদের মুক্তির লক্ষ্যে অর্থ ব্যয় করাকে যাকাত প্রদানের খাতসমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন : ‘সাদকা তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও তৎসংশিষ্ট কর্মচারীদের জন্য যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাস মুক্তির জন্য, ঋণ ভারাক্রান্তদের জন্য, আল্লাহর পথের মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান, আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা আত-তাওবা : আয়াত-৬০) হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, ‘আল্লাহ্ তা‘আলা ঘোষণা করেছেন, কিয়ামতের দিবসে আমি তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো। এক ব্যক্তি যে আমার নামে প্রতিশ্র“তি দিয়ে ভঙ্গ করে। আরেক ব্যক্তি যে কোন স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রয় করে দাসে পরিণত করে তার মূল্য ভোগ করে। আর এক ব্যক্তি যে কোন মজুর নিয়োগ করে তার কাছ থেকে পূর্ণকাজ আদায় করে অথচ তাকে পারিশ্রমিক দেয় না।’ (ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৮৮) আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদত বন্দেগী করার জন্য। যথাযথভাবে নিষ্ঠার সাথে ইসলামী অনুশাসন মেনে চললে আল্লাহ্ তা‘আলার নৈকট্য লাভ হয় যা প্রত্যেক মু’মিনের জন্য একান্ত অপরিহার্য। পুণ্য লাভের জন্য একজন মু‘মিনের যতগুলি গুণাবলী থাকা প্রয়োজন দাস মুক্তির জন্য অর্থ সম্পদ ব্যায় করা সেগুলির অন্যতম। আল-কুরআনুল করীমে এই গুনাবলীর উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা সালাত কায়েম ও যাকাত প্রদানের আগে দাস-দাসী মুক্তির জন্য অর্থ ব্যয় করার কথা বলায় দাস প্রথা উচ্ছেদের আবশ্যকতা গুরুত্বের সাথে প্রকাশ পেয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন : ‘‘পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফিরানোতে কোন পুণ্য নেই। কিন্তু আছে, আল্লাহ্ পরকাল ফেরেশতাগণ, সমস্ত কিতাব এবং নবীগণের ওপর ঈমান আনলে এবং আল্লাহ্ প্রেমে আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন, অভাবগ্রস্ত, পথিক, সাহায্য-প্রার্থীগণকে এবং দাসমুক্তির জন্য অর্থ দান করলে, সালাত কায়েম করলে, যাকাত প্রদান করলে, প্রতিশ্র“তি দিয়ে তা পূর্ণ করলে এবং অর্থ সংকটে দুঃখ-ক্লেশে ও সংগ্রাম সংকটে ধৈর্য ধারণ করলে। এরা তারা, যারা সত্য পরায়ণ এবং এরাই মুত্তাকী।’ (সূরা আল-বাকারা : ১৭৭) দাস প্রথা উচ্ছেদ সাধন প্রথম করণীয় হলো, দাস-দাসীদের দাসত্বের শৃঙ্খল হতে মুক্তি প্রদান করা। আল্লাহ্ তা‘আলা দাস-দাসী আযাদ করাকে ক্লেশ দায়ক বলে উল্লেখ করেছেন। কেননা এই কাজের জন্য প্রয়োজন মহাত্যাগের ও কুরবানীর। আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন : ‘সে তো বন্ধুর গিরিপথে প্রবেশ করে নি। তুমি কি জান বন্ধুর গিরিপথ কি? এটা হচ্ছে দাস মুক্তি। অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে আহার্য দান। ইয়াতিম আত্মীয়কে অথবা দারিদ্র্য নিষ্পেষিত নিঃস্বকে।’ (সূরা আল-বালাদ : ১১-১৪) দাস-দাসী মুক্তির গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন : ‘আল্লাহ্ তা‘আলা জমীনের উপর এমন কিছু সৃষ্টি করেননি, যা তার কাছে দাস-দাসীকে মুক্ত করে দেওয়ার চাইতে অধিকতর পছন্দনীয়।’ (স্যার সাইয়েদ আহমাদ, মালাকাত, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৯৭) রাসূলুল্লাহ (সা) দাস প্রথা উচ্ছেদ আন্দোলনে দাস-দাসী আযাদ করার বিনিময়ে জাহান্নামের আগুন হতে নি®কৃতি পাওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করে বলেন : ‘কোন মুসলিম ব্যক্তি যদি কোন মুসলমান দাস-দাসীকে দাসত্বের জিঞ্জির থেকে মুক্ত করে তাহলে আল্লাহ্ তা‘আলা দাস-দাসীর প্রত্যেক অঙ্গ প্রতঙ্গের বিনিময়ে মুক্তিদাতার প্রত্যেক অঙ্গ প্রতঙ্গকে জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তি দিবেন।’ (ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪২) মহানবী (সা) দাসীকে মুক্তি প্রদান করে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ করিলে দ্বিগুণ পুরস্কার প্রাপ্তির ঘোষণা দিয়েছেন। আবূ আশ‘আরী (রা,) থেকে বর্ণিত।  তিনি বলেন, মহানবী (সা) বলেছেন, ‘যদি কারও অধীনে একটি দাসী থাকে, তাকে শিষ্টাচার শিক্ষা দেয় এবং তাকে উত্তম রূপে শিক্ষা দান করে, এরপর তাকে মুক্তি দেয় এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে তা হলে সেই ব্যক্তি দ্বিগুণ সওয়াব লাভ করবে।’ (ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৬) ইসলামে দাস মুক্তিকে এতই গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) সূর্য গ্রহণের সময় দাস-দাসী মুক্ত করার নির্দেশ প্রদান করতেন। আছমা বিনত আবু বকর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) সূর্য গ্রহণের সময় দাস-দাসী মুক্ত করার আদেশ করেছেন।’ অপর এক বর্ণনায় আছে, আছমা বিন্ত আবু বকর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) কর্তৃক আমরা সূর্য গ্রহণের সময় দাস-দাসী মুক্ত করার জন্য আদিষ্ট হতাম।’ (ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪২) রাসূলুল্লাহ (সা) দাস-দাসীদের মর্যাদা এভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন যে, কেউ হাসতে হাসতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাস মুক্তির কথা বলে, তাহলেও দাস-দাসী মুক্ত হয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন : তিনটি বিষয় এমন যে, স্বাভাবিকভাবে অথবা হাসতে হাসতে যদি তা বলা হয় তবে সেটি সংঘটিত হয়ে যাবে : ষ    তালাক, ষ    দাস-দাসীর  মুক্তির কথা বলা এবং ষ    বিবাহ (ইমাম আবূ দাউদ, আস-সুনান, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৯৮)। ইসলামী শরীয়াতে দাস মুক্তকরণকে অনেক অপরাধের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে দাস-দাসীদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং দাস প্রথার বিলোপ ঘটে। এই পর্যায়ে নিচে কয়েকটি বিষয়ে আলোকপাত করা হলো। ১. স্বীয় স্ত্রীর সাথে যিহার করে তা ভেঙে ফেললে কাফফারা স্বরূপ দাস মুক্ত করতে হবে। শরীয়াতের পরিভাষায় যিহার হল স্বীয় স্ত্রীকে মা-বোন প্রভৃতি যাদের সঙ্গে বিয়ে হারাম, তাদের এমন অঙ্গের সাথে তুলনা করা, যা দেখার অনুমতি নেই। যেমন কেউ তার স্ত্রীকে বলল, ‘তুমি আমার নিকট আমার মায়ে পৃষ্ঠদেশ তুল্য। তাহলে কাফফারা দিতে হবে। আর সেই কাফফারা হল দাস-দাসী মুক্ত করা।’ এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ ইরাশাদ করেন : ‘যারা নিজেদের স্ত্রীগণের সাথে যিহার করে এবং পরে তাদের উক্তি প্রত্যাহার করে তবে একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে একটি দাস মুক্ত করতে হবে। এর দ্বারা তোমাদেরকে উপদেশ দেওয়া যাচ্ছে। তোমরা যা করা আল্লাহ্ তার খবর রাখেন।’ (সূরা আল-মুজাদালাহ : ৩) ২. আল্লাহ্ তা‘আলার নামে শপথ করে ভঙ্গ করা একটি জঘন্য কাজ। আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআন মজীদে এর পরিণাম বর্ণনা করেছেন। এই অপকর্মের কাফফারা কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত। সেই শ্রেণিগুলির একটি হলো দাস বা দাসী মুক্তকরণ। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন : ‘তোমাদের বৃথা শপথের জন্য আল্লাহ্ তোমাদেরকে দায়ী করবেন না; কিন্তু যে সব শপথ তোমরা ইচ্ছাকৃতভাবে করো সেই সকলের জন্য তিনি তোমাদেরকে দায়ী করবেন। অতঃপর এর কাফফারা দশজন দরিদ্রকে মধ্যম ধরনের আহার্যদান, যা তোমরা তোমাদের পরিজনদেরকে খেতে দাও, অথবা তাদেরকে বস্ত্রদান কিংবা একজন দাস মুক্তি এবং যার সামর্থ নেই তার জন্য তিন দিন সিয়াম পালন। তোমরা শপথ করলে এটাই তোমাদের শপথের কাফফরা। তোমরা তোমদের শপথ রক্ষা করো। এভাবে আল্লাহ্ তোমাদের জন্য তাঁর নিদর্শনসমূহ বিশুদ্ধভাবে বর্ণনা করেন যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।’ (সূরা আল-মায়িদা : আয়াত-৮৯) ৩. মানুষ হত্যা মহা পাপ। ইসলামে মানব জীবনের নিরাপত্তা বিধান পূর্ণরূপে সংরক্ষিত। তবে ভুলবশত কোন মুসলিমকে হত্যা করলে দাসমুক্ত করাকে কাফফরা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিলো। ‘কোন মু’মিনকে হত্যা করা কোন মু‘মিনের কাজ নয়। তবে ভুল বসত হত্যা করলে তা স্বতন্ত্র; এবং কেউ কোন মু’মিনকে ভুল করে হত্যা করলে এক মু’মনি দাস মুক্ত করা এবং তার পরিজনবর্গকে রক্তপণ অর্পণ করা বিধেয়। যদি না তারা ক্ষমা করে।’ (সূরা আন-নিসা : ৯২) ৪. সন্ধিবদ্ধ গোত্রের মুসলিম অথবা অমুসলিমকে হত্যা করলেও দাসাদাসী মুক্ত করে কাফফারা আদায় করতে হবে। অর্থাৎ নিহত ব্যক্তি যদি মুসলমান হয় তাহলে সর্বদা দাস বা দাসী মুক্ত করতে হবে। আর যদি ঐ নিহত ব্যক্তি এমন গোত্রের অন্তর্ভুক্ত হয় যাদের সাথে মুসলমানদের সন্ধি রয়েছে তাহলে সন্ধির কারণ ইনসাফ অনুযায়ী দাস-দাসী মুক্ত করতে হবে। আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন : ‘যদি সে (নিহত ব্যক্তি) তোমাদের শত্র“পক্ষের লোক হয় এবং মু’মিন হয়, তবে এক মু’মিন দাস মুক্ত করা বিধেয়। আর যদি সে এমন সম্প্রদায়ভুক্ত হয় যার সাথে তোমরা অঙ্গীকারবদ্ধ, তবে তার পরিবার পরিজনবর্গকে রক্তপণ অর্পণ এবং মু‘মিন দাস মুক্ত করা বিধেয় এবং যে সংগতিহীন সে একাদিক্রমে দুই মাস সিয়াম পালন করবে। তাওবার জন্য ইহা আল্লাহ্র ব্যবস্থা এবং আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাপময়।’ (সূরা আন-নিসা : ৯২) ৫. দাস-দাসীকে অন্যায়ভাবে মারধোর করার কাফফারা হল সেই দাসীকে মুক্ত করা। মহানবী (সা) বলেন : ‘যদি কেউ তার দাস-দাসীকে অন্যায়ভাবে চড় মারে অথবা প্রহার করে, তা হলে তার কাফফারা হল সেই দাস-দাসীকে মুক্ত করা।’ (সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫১) আল্লাহ্ তা‘আলা দাস-দাসীদের জন্য মুকাতাবাতের অর্থাৎ লিখিত শর্তের ভিত্তিতে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ প্রদান করে আইন জারী করেন। যে সকল দাস-দাসী মুকাতাবাতের শর্তে মুক্তি পেতে আগ্রহী, তাদের সহযোগিতা করার জন্য আল্লাহ্ ইরাশদ করেন : ‘এবং তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীদের মধ্যে কেউ তার মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তি চাইলে, তাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হও; যদি তোমরা তাদের মধ্যে মঙ্গলের সন্ধান পাও। আল্লাহ্ তোমাদেরকে যে সম্পদ দিয়েছেন তা থেকে তোমরা তাদেরকে দান করবে।’ (সূরা আন-নূর : ৩৩) দাস-দাসী মুক্তি দেয়ার আরেকটি পথ হলো মুদাব্বার পন্থা। মুদাব্বার পন্থা হলো কোন ব্যক্তি যদি দাস মুক্ত করতে অক্ষম হয়, তাহলে স্বীয় দাস-দাসী নিজের মৃত্যুর পর স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিপ্রাপ্ত হবে এই সুযোগ দেওয়া।’ (সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৫৪) রাসূলুল্লাহ (সা) উত্তম ওয়ালদ-এর স্বাভাবিক মুক্তির সুসংবাদ প্রদান করেছেন। উম্মে ওয়ালদ ঐ দাসীকে বলা হতো যে মনিবের সন্তান গর্ভে ধারণ করতো। এইরূপ দাসীর ক্রয় বিক্রয় নিষিদ্ধ ছিলো। মনিবের ইন্তিকালের পর মুদাব্বার পন্থার ন্যায় এই দাসী স্বাভাবিক ভাবেই মুক্তি লাভ করতো। হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা) হতে বর্ণনা করেন : ‘রাসূলুল্লাহ (সা) উম্মে ওয়ালদ (অর্থাৎ ঐ দাসী যে মনিবের সন্তান জন্ম দেয়) বেচাকেনা নিষিদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন, এই সব দাসীকে বিক্রয় করা, দান করা এবং ওয়ারিস বানানো যাবেনা। যত দিন মনিব বেঁচে থাকবে এই সব দাসীকে ভোগ করবে। এবং যখন মনিব ইন্তিকাল করবে, তখন দাসী স্বাভাবিকভাবে মুক্তি লাভ করবে।’ (সাঈদ আহমাদ, আর রিকক ফিল ইসলাম, পৃ. ৩৯-৪০) রাসূলুল্লাহ (সা) দাস-দাসীদের মর্যাদা প্রদানে তথা দাস-দাসীদের মুক্তিদানের বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে অনেককে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দেন। নিচে তাদের কয়েক জনের বিবরণ পেশ করা হইল। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবন কালের প্রথম দাস ছিলেন যায়েদ (রা) শৈশবকালে তাঁর মাতা সুদা তাঁকে সঙ্গে কার বনু মা‘আনের সাথে সাক্ষাত করতে এসেছিলো। এই সময়ে বনূ কায়ন গোত্রের লোকজন বনূ মা‘আন গোত্রের উপর আক্রমণ করে। তারা যায়দ ইবন হারিছকে আটক করে তায়েফের কাছাকাছি ‘উকায নামক স্থানে বার্ষিক মেলায় বিক্রয়ের জন্য নিয়ে আসে। তাকে হাকীম ইবন হিযাম তার ফুফু খাদিজা (রা)-এর জন্য চারশত দিরহামে কিনে নিয়ে আসেন। মহানবী (সা)-এর সাথে খাদিজা (রা)-এর বিবাহ অনুষ্ঠিত হলে খাদিজা (রা) যায়েদ (রা.)-কে উপঢৌকন হিসেবে তার খিদমত পেশ করেন। তখন যায়েদ (রা)-এর বয়স ছিলো আট বছর। রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে খিদমত পেশ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে পুত্রতুল্য গণ্য করতেন, দাস হিসেবে নয়। ফলে সকলে যায়েদ (রা)-কে যায়দ ইবন হারিছা না বলে যায়েদ ইবন মুহাম্মদ বলে ডাকতো। রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে মুক্তি দিয়ে ছিলেন। আবূ রাফি আসলাম (রা) ছিলেন মিশরের অধিবাসী এবং কিবতী সম্প্রদায় ভুক্ত। আরবের দাস ব্যবসায়ীরা তাকে মিশর থেকে এনে আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিবের কাছে বিক্রি করেছিলো। তাকে আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-কে দান করেন। আবু রাফি বদর যুদ্ধের আগেই আন্তরিকভাবে ইসলাম কবুল করেন কিন্তু মক্কার প্রতিকূল পরিবেশে তা প্রকাশ করেননি। রাসূলুল্লাহ (সা) আবূ রফির-এর মুখেই আব্বাস (রা)-এর ইসলাম কবুলের সংবাদ শুনে তাকে মুক্ত করে দেন। আবু মুওয়াই হারা (রা) ছিলেন মুযায়না গোত্রের দাস। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে কিনে মুক্ত করে দেন। তিনি মুরায় সী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। (ইবন হাজার আল-আসকালানী, আল ইসাবা, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৮৮) শুকরান (রা) ছিলেন আবদুর রহমান ইবন আওফ (রা)-এর একজন হাবসী গোলাম। আবদুর রহমান ইবন আওফ (রা) তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর খিদমতে উপঢৌকন হিসেবে দিয়েছিলেন। অপর এক বর্ণনা মতে, রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে কিনে নিয়ে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। (ইবন আবদুল বারর, আল ইস্তি‘আয়াব, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৯৪) ছওবান (রা) ছিলেন মক্কা ও ইয়ামানের মধ্যবর্তী অঞ্চল আস সারাত জনপদের অধিবাসী। তিনি হিময়ার গোত্রভুক্ত ছিলেন। তাকে যুদ্ধ বন্দী হিসেবে উকায মেলার বিক্রয়ের জন্য আনা হয়েছিলো। রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে কিনে নিয়ে মুক্ত করে দেন। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা) সহচর। আজীবন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর খিদমতে ছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে সকল যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) শুধু ব্যক্তিগতভাবেই দাস-দাসীকে দাসত্বের শৃঙ্খলা থেকে মুক্তি দেননি বরং রাষ্ট্রীয়ভাবে ও বহু দাসদাসীকে মুক্তি দিয়ে বিরল নযীর স্থাপন করেন। তৎকালীন সময়ে যুদ্ধ বন্দীদেরকে দাস-দাসীতে পরিণত করার নিয়ম ছিলো। যা পূর্ব থেকে প্রচলিত ছিলো। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবনে বহু যুদ্ধবন্দীদের দাস-দাসীতে পরিণত করার সুযোগ এসেছিলো কিন্তু তিনি তা না করে তাদেরকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদর যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে সত্তর জন অমুসলিম বন্ধী হয়েছিলো। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে বিনা শর্তে মুক্ত করে দেন। আর কয়েকজনকে এই শর্তে মুক্তি প্রদান করেন যে, তারা সাহাবীদের লিখন শিক্ষা দিবে। অবশিষ্টদের মুক্তি পনের বিনিময়ে মুক্তি দেয়া হয়েছিলো। অথচ রাসূলুল্লাহ (সা) যদি ইচ্ছা করতেন। তবে সকলকে দাসে পরিণত করতে পারতেন। (সাঈদ আহমাদ, আর রিকক ফিল ইসলাম, পৃ. ৫০-৫১) হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় সত্তর জন এবং হুনায়নের যুদ্ধে ছয় হাজার অমুসলিম মুসলমান শিবিরে বন্দী হয়। রাসূলুল্লাহ (সা) সকলকে ক্ষমা প্রদর্শন করেন। সকলে দাসত্ব থেকে মুক্তি পান। (ইবনুল আছীর, আল কামিল, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭৮) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবনে অগনিত মানুষকে দাস-দাসীতে পরিণত করার সুযোগ এসেছিলো মক্কা বিজয়ের দিন। ইসলামের ইতিহাসে এই দিনটি চির স্মরণীয়। বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় হলে মক্কার কাফের মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলো এবং জানমালের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা কামনা করেছিলো। যারা একদিন রাসূলুল্লাহ (সা)-কে অমানুষিক নির্যাতন করেছিলো জন্মভূমি থেকে বের করে দিয়েছিলো। তাদেরকেই তিনি মুক্ত বলে ঘোষণা দিলেন, তোমরা নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাও, তোমরা সকলেই মুক্ত ও স্বাধীন। মোটকথা রাসূলুল্লাহ (সা) দাস-দাসীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় দাস মুক্তির সর্বাত্মক আন্দোলনে নিজে দাস-দাসী মুক্ত করেছেন এবং লোকদেরকে দাস মুক্তির আদেশ দিয়েছেন ও উৎসাহ প্রদান করেছিলো। রাসূলুল্লাহ (সা)-কে অনুসরণ করে এবং দাস মুক্তির মর্যাদা প্রাপ্তির প্রত্যাশায় সাহাবী ও সাহাবীয়াগণ ব্যাপকভাবে দাস-দাসীগণকে মুক্ত করে ছিলেন। মাওলানা আব্দুস সালাম নদভী বলেন, মুক্তিপ্রাপ্ত দাসদাসীর সংখ্যা ৩৯,২৫৭ জন। এদের মধ্যে উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা সিদ্দিকার (রা.) ৬৭ জন, হাকীম বিন হিযাম (রা.) ১০০ জন, উসমান ইবন আফফান (রা) ২০ জন, আব্দুর রহমান ইবন আওফ (রা.) ৩০,০০০ জন, আব্বাস (রা.) ৭০ জন, আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা.) ১০০০ জন এবং জুল কিলা হিমকারী (রা.) ৮,০০০ জন দাসদাসীকে মুক্ত করেন। (সা‘ঈদ আহমাদ, আর রিকক ফিল ইসলাম, পৃ. ১৩১) সাহাবায়ে কিরাম রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহচর্যে থেকে যে প্রেরণা লাভ করেছিলেন, তা কার্যকর করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিলেন। যখন তারা পারস্য সম্রাটের দরবারে উপনীত হন, তখন তারা তাদের উদ্দেশ্যে বর্ণনা করতে নিম্নরূপ উক্তি পেশ করেন : ‘আমরা এসেছি মানুষকে মানুষের দাসত্বের নিগড় থেকে মুক্ত করে আল্লাহ্র দাসত্বে ফিরিয়ে আনবার জন্য।’ (শেখ মুহাম্মদ ইউসুফ কান্দলজী, হায়াতুস সাহাবা) দাস-দাসীদেরকে দায়িত্ব প্রদান রাসূলুল্লাহ (সা) দাস-দাসীদের মুক্তি প্রদানে করেই তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেননি, বরং তিনি তাদেরকে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করতেন। যাতে তাঁদের মর্যাদা সমুন্নত হয়। সমাজে তাদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যুগেই দাসেরা সালাতে ইমামতী করেছেন। আর খ্যাতনামা সাহাবায়ে কিরাম তাদের ইকাতিদা করতেন। আবু বকর (রা), উমর (রা)-এর ন্যায় বিশেষ সাহাবায়ে কিরামও সেই জামা‘আতে শরীক থাকতেন। আবদুলাহ ইবন উমর (রা) বর্ণনা করেন : আবু হুজায়ফা (রা)-এর মুক্তিপ্রাপ্ত দাস সালিম (রা) মসজিদে কুবাতে প্রথম সারির মুহাজেরীন ও মহানবী (সা)-এর সাহাবিগণের ইমামতী করতেন। তাঁহাদের মাঝে আবু বকর (রা.), উমর (রা.), আবু সালমা (রা.), যায়দ (রা) এবং আমির ইবন রবী‘আ (রা) প্রমুখ সাহাবী ছিলেন। (ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৩১) শুধু মুক্তি প্রাপ্ত দাস নয়, দাসত্বের জিঞ্জিরে আবদ্ধ অবস্থায় ও ইমামতী করার ঘটনা ইতিহাসে নজীর সৃষ্টি করেছে। আবদুল্লাহ ইবন আহমাদের গোলাম আবু সুফিয়ান মুক্তি পাওয়ার আগেই দাস থাকা অবস্থায় সালাতে ইমামতি করেছেন। আর সাহাবীগণও তাঁর পিছনে ইকতিদা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) যায়েদ ইবন হারিছা (রা)-কে ঐতিহাসিক মূতার যুদ্ধে সেনাপতি নিযুক্ত করেছিলেন। তার পুত্র উসামা (রা) কেও তিনি সিরিয়ার যুদ্ধে সেনাপতি হিসেবে পাঠিয়েছিলেন যদিও কতিপয় সাহাবী এতে আপত্তি করেছিলেন। (ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫২৮) বিলাল (রা) ছিলেন হাবসী গোলাম। তাঁর মাতা ছিলে আবিসিনিয়ার রাজ্যকন্যা। তিনি আবরাহার মক্কা অভিযানে আরবে আগমন করেন এবং ঘটনাক্রমে বরাহ নামক এক আরব সরদারের সাথে তার বিয়ে হয়। তাদের ঔরসেই জন্মগ্রহণ করেন বিলাল (রা)। বিলাল (রা) মক্কায় উমায়্যা ইবন খালফের দাস ছিলেন। ইসলামের প্রথম যুগেই তিনি ইসলাম কবুল করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ হয়ে গেলে তাঁর মনিব তাঁকে অমানবিক নির্যাতন করে। একদিন আবু বকর (রা) দেখলেন বিলাল (রা)-এর উপর অমানবিক অত্যাচার চালানো হচ্ছে। অবশেষে তিনি বিলাল (রা)-কে বেশি দামে কিনে মুক্ত করে দেন। আযানের প্রচলন হলে রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে মসজিদে নববীর মুয়াজ্জিন এবং নবী গৃহের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেন। (ইবন আব্দুল র্বার, আল ইস্তীয়াব, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৯) হযরত সালমান ফারসী (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর একজন মক্তিপ্রাপ্ত দাস। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর একজন প্রিয় পাত্র ছিলেন। এমনকি তাঁকে ‘আহলুল বাইত’ বা ‘রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পরিবার ভুক্ত’ গণ্য করা হতো। যুদ্ধ বিদ্যায় তিনিই খন্দক খনন করার পরামর্শ দেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং মদীনার দুই দিকে খন্দক খনন করেন। এই যুদ্ধে মুসলমানরাই বিজয় লাভ করেন। আম্মার ইবন ইয়াসির (রা), আবু বকর (রা)-এর আজাদকৃত দাস ছিলেন। তাঁর পিতা ইয়াসির ইয়ামানের অধিবাসী ছিলেন। মক্কায় আগমন করে প্রথমে তিনি আবূ হুযায়ফার গৃহে অবস্থান করেন। তাঁর মাতা সুমাইয়া (রা) ইসলামের প্রথম শাহাদাত বরণ করার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। আম্মার ইবন ইয়াসির (রা) কুফায় নামাজের ইমাম এবং সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন নিয্ক্তু হয়েছিলেন। মূলকথা, রাসূলুল্লাহ (সা) ছিলেন বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব এবং ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সফল সংস্কারক। তাঁর যুগে দাস-দাসীরা ছিলো চরম ঘৃণীত নিন্দিত, লাঞ্ছিত-বঞ্চিত এবং আরাম আয়েশের সামগ্রী মাত্র। সমাজে তাদের কোন অধিকার ছিলো না। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদেরকে এই দশা থেকে মুক্তি প্রদান করেন। তিনি তাদেরকে এমন মর্যাদায় আসীন করেন যে, বিশ্ব ইতিহাসে তার নজীর বিরল।

 

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির