post

বিভিন্ন ধর্মে ও সংস্কৃতিতে সুদ । ড. আব্দুল্লাহ ত্বহা

০৫ জানুয়ারি ২০১৯

কার্ল মার্কস সুদের ব্যবসায়ীকে ‘বিকট শয়তান’ নামে অভিহিত করেছেন। সুদখোরকে তিনি তুলনা করেছেন ডাকাত ও সিঁদেল চোরের সঙ্গে। সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিতে সুদ ‘শ্রমিক সমাজের ওপর একটি অসহনীয় বোঝা’। এটি ধনীকে আরও ধনী এবং গরিবকে আরও গরিবে পরিণত করে। লর্ড কিনস ১৯৩৩ সালে অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলার জন্য সুদের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রস্তাব করেন। বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবেই সুদের বিরোধীসুদের প্রচলন বহু পুরনো বিষয়। এটিকে ভালো চোখে দেখা না হলেও এর প্রচলন বন্ধের তাগিদ প্রাথমিক যুগে অনেকেই দেননি। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য উভয় সংস্কৃতির বিভিন্ন পর্বে সুদের প্রচলন ছিল। তবে এর বিরোধিতাও ছিল প্রায় সব সংস্কৃতিতেই। ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বের প্রাচীন সভ্যতায়ও সুদের প্রচলন লক্ষণীয়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে অনেক বিখ্যাত দার্শনিক সুদকে মন্দ বলে অভিহিত করেছেন। তারা এ ব্যবস্থা বন্ধের পক্ষে অনেকেই জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেন। তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য হলেন, প্লেটো (৪২৮/৪২৭ খ্রি.পূ.-৩৪৮/৩৪৭ খ্রি.পূ.)। তিনি দেখান যে, সুদব্যবস্থা স্বভাবতই ন্যায়বান নাগরিকের ধারণার বিরোধী। কেননা, এ ব্যবস্থা নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করে। আমরা জানি, প্লেটো তার Republic নামক বিখ্যাত গ্রন্থে যে আদর্শরাষ্ট্রের ধারণা প্রবর্তন করেন, সে রাষ্ট্রের নাগরিকদের ন্যায়বান হতে হবে বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু সুদভিত্তিক সমাজ ন্যায়ধর্মপূর্ণ সমাজ হয় না। তাই সেখানে ন্যায়বান নাগরিক সৃষ্টি হতে পারে না। সুদ সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের অভিমতে সর্বপ্রথম তার গুরু প্লেটোর যে ধারণাটির প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়, তা হলো : ‘অর্থ নিষ্ফলা’। বস্তুত ছাগল, গরু বা অন্য কোনো প্রাণী বাড়ে, বৃক্ষ বা ফলনের গাছ বৃদ্ধি পায়, কিন্তু অর্থ বা টাকা নিজে বাড়ে না এটি প্রকৃতিগতভাবে বা স্বকীয়ভাবে বন্ধ্যা। একে কোনো বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে হয়। তাই কেবল অর্থ প্রদান করে সেই অর্থের জন্য নির্ধারিত হারে অতিরিক্ত অর্থ নেয়া সঙ্গত হতে পারে না। অ্যারিস্টটল তার নামক বিখ্যাত গ্রন্থে দেখান যে, অর্থসম্পদ ব্যবহারের দুটি দিক রয়েছে : এক ধরনের সম্পদ ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যবহৃত হয় এবং অন্য ধরনের অর্থসম্পদ গৃহস্থালি প্রয়োজন মেটাতে ব্যবহার করা হয়। তার মতে, দ্বিতীয় ধরণের ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয় এবং এই ধরণের সম্পদ প্রশংসনীয়। কিন্তু যে ধরণের অর্থসম্পদ কেবল বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয় তাকে প্রকৃতিগতভাবে মূল্যবান বলা চলে না। কিন্তু সুদের ক্ষেত্রে এ বিনিময়মূলক অর্থকেই স্বকীয়ভাবে মূল্যবান করে নিয়ে তার জন্য অতিরিক্ত অর্থসম্পদ দাবি করা হয়। অ্যারিস্টটলের মতে, এটি মোটেই স্বাভাবিক নয়। ধর্মীয় সংস্কৃতির দিক থেকেও দেখা যায়, বিশ্বের প্রধান ধর্মগুলোর ভাবধারা অনুযায়ী সুদ অগ্রহণযোগ্য বিষয় হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। সেমেটিক ধর্মগুলো সুদকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইহুদি ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ এ সুদের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। খ্রিস্টান ধর্মেও সুদ বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। তবে ঘবি-এর একটি বিশেষ স্থানে সুদের সমর্থন রয়েছে বলে মনে হয়। এর ব্যাখ্যা নিয়ে অবশ্য মতভেদ আছে। অনেকের মতে, বাণিজ্যিকভাবে সুদের সমর্থন এখানে নেই। হিন্দু ধর্মে সুদের বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। ১৫০০০ খ্রি. পূ. পুরনো হিন্দু ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ ‘বেদ’-এ সুদের ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। সুদের প্রকৃতি বর্ণনায় বেদে বলা হয়েছে যে, এটি যে কোনো ধরনের ধার প্রদান প্রক্রিয়া যেখানে (অর্থের জন্য) অতিরিক্ত লাভ নেয়া হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০-এর দিকে হিন্দু আইনবিদ ঠধংরংযঃযধ সুদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। গরিব লোকদের ধার দিয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা যে উচ্চহারে লাভ হিসেবে অর্থগ্রহণ করে তিনি সে প্রক্রিয়াকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু হিন্দু ধর্মীয়-সামাজিক জীবনে সুদের প্রক্রিয়া সামগ্রিকভাবে বর্জনীয় বলে বিবেচিত হয়নি। দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত হিন্দু জগতে একটি সহনীয় মাত্রায় সুদ গ্রহণ বৈধ বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। বৌদ্ধ ধর্মীয় সংস্কৃতিতে সুদ অবৈধ বলে বিবেচিত। গৌতম বুদ্ধ নির্বাণ লাভের জন্য আটটি পথ (অষ্টাঙ্গিক মার্গ) নির্ধারণ করেছেন। এ আটটি পথের মধ্যে অন্যতম হলো ‘সম্যক আজীব’ বা সঠিক জীবিকা অর্জন। জীবিকা অর্জনের যথার্থ পন্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বুদ্ধ কিছু বিষয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন, তার মধ্যে সুদ গ্রহণ অন্যতম। আরবি ‘রিবা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া, যুক্ত হওয়া অথবা বাড়তে থাকা। শব্দগত অর্থে ‘রিবা’ বলতে কেবল ধারের টাকার ওপর নির্ধারিত মুনাফা বা লভ্যাংশ নেয়া বোঝায় না; বরং যে কোনো অবৈধ বা বেআইনি উপায়ে বা অন্যকোনো ধরণের অশুভ সুবিধা ভোগের মাধ্যমে মূলধনের পরিমাণ বা আকার বৃদ্ধি করা রিবার আওতাভুক্ত। ইসলামী ভাবধারা অনুসারে রিবা বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই ব্যবস্থা যেখানে কোনো ব্যক্তিকে ঋণ দিয়ে কোনো ধরনের ঝুঁকি গ্রহণ ছাড়া বাড়তি অর্থসহ তার কাছ থেকে মূল অর্থ আদায় করা। কোরআন ও হাদিসে যে কোনো ধরনের রিবাকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাই সুদকে ব্যবসার সঙ্গে একাত্ম করে দেখা এবং সুদের কারবার করা ইসলামী সংস্কৃতিতে নিষিদ্ধ কর্ম বলেই বিবেচিত হয়। সুদ বাংলা ভাষায় ব্যবহার হলেও এর উৎপত্তি ফার্সি থেকে। একে আল কোরআনে বলা হয়েছে ‘রিবা’। যার অর্থÑ বৃদ্ধি, আধিক্য, অতিরিক্ত, স্ফীতি, সম্প্রসারণ ইত্যাদি। ইসলামে সব বৃদ্ধিকে ‘রিবা’ বলা হয়নি; বরং কেবল সেই বৃদ্ধিকে ‘রিবা’ বলা হয়েছে, যা প্রদত্ত ঋণের আসলের ওপর ধার্য ও আদায় করা হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, জাহেলিয়াতের যুগে আরব দেশে মানুষ অর্থ ঋণ বা ধার দিত, অতঃপর ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে পূর্বচুক্তি মোতাবেক অতিরিক্ত অর্থ আদায় করত, অথচ আসল অপরিবর্তিত থাকত। অনেকে পণ্যসামগ্রী ও শস্য ধার দিত এবং অতিরিক্ত পণ্য ও শস্যসহ আসল ফেরত নিত। তদানীন্তন আরবে আসল ঋণের ওপর ধার্য ও আদায়কৃত এই অতিরিক্ত অর্থ, পণ্য বা শস্যের পরিমাণকে বলা হতো ‘রিবা’। আল কোরআনে এই ‘রিবা’কে হারাম বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুদ মূলত অর্থনীতির সবচেয়ে প্রাচীন ও জটিল সমস্যা এবং শোষণের হাতিয়ার, যা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মেরুদণ্ড। মানবজাতির অর্থনৈতিক মুক্তির পথে সুদ প্রধান বাধা। মিসর, গ্রিস, রোম ও ভারতবর্ষের মতো প্রাচীন সভ্য দেশগুলোতে বহুকাল আগেই সুদবিষয়ক আইন-কানুন প্রণীত হয়। দুনিয়ার সব প্রধান ধর্মে সুদকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বেদ, তাওরাত, ইঞ্জিল প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থে সুদ সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। রোমান আইনশাস্ত্রে এবং হিন্দু ধর্ম-দর্শনে সুদের নিন্দা করা হয়েছে। আর আল কোরআন বলে, আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন (সূরা বাকারা)। হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) সুদদাতা, সুদগ্রহীতা, সুদের চুক্তিপত্রের লেখক ও সাক্ষী সবার ওপর লা’নত দিয়েছেন এবং বলেছেন, তারা সবাই সমান অপরাধী (মুসলিম)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সুদের ৭০টি স্তর রয়েছে। তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা নিম্নস্তরের অপরাধের পরিমাণ হলো মায়ের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া। (ইবনে মাজা)। আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে মুমিনেরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; আর সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা মুমিন হও। আর যদি তা না ছাড়ো, তবে আল্লাহ এবং তার রাসূলের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। কিন্তু তোমরা যদি তওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই। এতে তোমরা অত্যাচার করবে না এবং অত্যাচারিতও হবে না। (সূরা বাকারা)। আরবের জাহিলি যুগে সুদের অর্থকে সাধারণভাবে অপবিত্র মনে করা হতো। ইউরোপীয় দেশগুলোতে ধর্ম ও আইনের চোখে সুদ নিষিদ্ধ ও নীতিবিরুদ্ধ বলে গণ্য হতো। লন্ডনের অধিবাসীরা সুদখোর ইহুদিদের শোষণে ক্ষিপ্ত হয়ে মধ্যযুগে বহু ইহুদিকে হত্যা করেছিল। জনগণের চাপে বাধ্য হয়ে প্রথম এডওয়ার্ড ১২৯০ সালে ব্রিটেন থেকে ইহুদিদের বিতাড়িত করেছিলেন। সেই সঙ্গে সুদের ব্যবসাকে তিনি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছিলেন।


কার্ল মার্কস সুদের ব্যবসায়ীকে ‘বিকট শয়তান’ নামে অভিহিত করেছেন। সুদখোরকে তিনি তুলনা করেছেন ডাকাত ও সিঁদেল চোরের সঙ্গে। সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিতে সুদ ‘শ্রমিক সমাজের ওপর একটি অসহনীয় বোঝা’। এটি ধনীকে আরও ধনী এবং গরিবকে আরও গরিবে পরিণত করে। লর্ড কিনস ১৯৩৩ সালে অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলার জন্য সুদের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রস্তাব করেন। বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবেই সুদের বিরোধী।


কার্ল মার্কস সুদের ব্যবসায়ীকে ‘বিকট শয়তান’ নামে অভিহিত করেছেন। সুদখোরকে তিনি তুলনা করেছেন ডাকাত ও সিঁদেল চোরের সঙ্গে। সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিতে সুদ ‘শ্রমিক সমাজের ওপর একটি অসহনীয় বোঝা’। এটি ধনীকে আরও ধনী এবং গরিবকে আরও গরিবে পরিণত করে। লর্ড কিনস ১৯৩৩ সালে অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলার জন্য সুদের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রস্তাব করেন। বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবেই সুদের বিরোধী। সুদের অভিশাপে পৃথিবীর মানুষ আজ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। আধুনিক দুনিয়ার শক্তিশালী ব্যাংক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সুদ সমাজে আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্যকে দ্রুত বাড়িয়ে তুলছে। সম্পদ ও দায়ের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টিতে সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থা পালন করছে দক্ষ ও কুশলী ভূমিকা। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সুদের গুরুভার কঠিন দুরবস্থার সৃষ্টি করেছে। সুদের এ অভিশাপ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো বিকল্প ব্যবস্থা উদ্ভাবনের চেষ্টা চালাচ্ছে। ১৯৮৪ সালে ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বার্ষিক সাধারণ সভায় স্বীকার করা হয়েছে, সুদের উচ্চহারই বিশ্বের সর্বত্র উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। কার্ল মার্কস সুদের ব্যবসায়ীকে ‘বিকট শয়তান’ নামে অভিহিত করেছেন। সুদখোরকে তিনি তুলনা করেছেন ডাকাত ও সিঁদেল চোরের সঙ্গে। সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিতে সুদ ‘শ্রমিক সমাজের ওপর একটি অসহনীয় বোঝা’। এটি ধনীকে আরও ধনী এবং গরিবকে আরও গরিবে পরিণত করে। লর্ড কিনস ১৯৩৩ সালে অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলার জন্য সুদের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রস্তাব করেন। বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবেই সুদের বিরোধীসুদের বৈশিষ্ট্য হলো ঋণের আসল বৃদ্ধি পাওয়া, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঋণের আসল বৃদ্ধির সীমা বা পরিমাণ বা হার পরিবর্তন হওয়া ও অতিরিক্তের জন্য কোনো বিনিময় না দেয়া। সুদ দুই ধরনের। যথা- নাসিয়া ও ফদল। সাধারণত ঋণের ক্ষেত্রে ‘রিবা নাসিয়া’র উদ্ভব হয়। ঋণদাতা কোনো অর্থ বা পণ্য ঋণ হিসেবে দেয়ার বিনিময়ে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে সময়ের ব্যবধানে পূর্বনির্ধারিত হারে বা পরিমাণে ঋণ বাবদ দেয়া অর্থ বা পণ্যের অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করলে তাকে বলা হয় ‘রিবা নাসিয়া’। আর সমজাতীয় দ্রব্য হাতে হাতে বিনিময়ের ক্ষেত্রে ‘রিবা ফদল’-এর উদ্ভব হয়। কোনো দ্রব্যের সঙ্গে একই জাতীয় দ্রব্য বাড়তি পরিমাণ বিনিময় করলে দ্রব্যের ওই অতিরিক্ত পরিমাণকে ‘রিবা ফদল’ বলা হয়। ‘মুনাফা’ আরবি শব্দ, যার অর্থ লাভ। একে আরবিতে ‘রিবহ’ও বলা হয়। পুঁজির বর্ধিত অংশকে বলা হয় মুনাফা; আর পুঁজির ক্ষয়প্রাপ্ত অংশকে বলা হয় লোকসান। মুনাফা বা লোকসান আসে বিনিয়োগ থেকে। বিনিয়োগ মানে হচ্ছে লাভ করার উদ্দেশ্যে কোনো পণ্যসামগ্রী বা সেবা ক্রয় বা উৎপাদন করা যাতে লোকসানের ঝুঁকিও অবশ্যই বহন করতে হয়। পণ্যসামগ্রী বা সেবা ক্রয় বা উৎপাদন করতে মোট যে ব্যয় হয়, তাকে বলা হয় মোট খরচ। সেই ক্রীত বা উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বা সেবা বিক্রয় করে যে অর্থ পাওয়া যায়, তাকে বলা হয় মোট আয়। মোট আয় থেকে মোট ব্যয় বাদ দিলে যা অবশিষ্ট থাকে, তাকেই মুনাফা বা লাভ বলা হয়। মুনাফা ইসলামে বৈধ। একজন বিনিয়োগকারী তার পুঁজি বিনিয়োগ করে, লোকসানের ঝুঁকি বহন করে, তার মেধা ও শ্রম খাটায় ফলে উপযোগ সৃষ্টি ও মূল্য সংযোজন হয়। এসব কারণে বেশি দাম বা মুনাফা নেয়ায় তার অধিকার সৃষ্টি হয়। এসব সত্ত্বেও কোনো কারণে পণ্যসামগ্রী বা সেবার বাজার পড়ে গেলে বিনিয়োগকারীকে লোকসান দিতে হয়; অপরদিকে যদি বাজার দাম উঠে যায় তবে সে আশার চেয়েও বেশি লাভবান হয়ে থাকে। সুতরাং মুনাফা কিংবা লোকসানের বিষয়টি বাজারের ওপর নির্ভরশীল এবং অনিশ্চিত। ইসলামের অনেক নিষিদ্ধ কাজের অন্যতম হলো সুদ। সুদের ভয়াবহতা অনেক বেশি। সুদের কারণে ব্যাপক সামাজিক অরাজকতা ও বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, সবচেয়ে জঘন্য সুদ হলো পাওনা আদায়ের জন্য কোনো মুসলমান ভাইয়ের সম্পদ দখল বা তার সম্মানহানি করা। অন্য এক হাদিসে আছে, সুদ খাওয়ার জন্য কোনো অজুহাত ও ছলছাতুরী করা যাবে না। এ রকম লোকদের আল্লাহ পাক হাশরের মাঠে কুকুর ও শূকর বানিয়ে দেবেন। বনি ইসরাইলের লোকদের জন্য শনিবার মাছ শিকার নিষিদ্ধ ছিল। একদল লোক চাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করে। তারা মাছ ধরার নিয়তে শনিবার জলাশয়ের পাশে বড় গর্ত খুঁড়ে রাখত। গর্তে মাছ জড়ো হলে রোববার তা শিকার করত। আর বলত, ‘আমরা তো নিয়ম ভঙ্গ করিনি।’ এ চালাকির জন্য আল্লাহপাক তাদের বানর ও শূকরে পরিণত করেছিলেন। যেটা ইসলামে নিষিদ্ধ সেটা কোনোভাবেই জায়েজ করা যাবে না। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণ অর্জন করতে পার এবং তোমরা সেই আগুন থেকে বেঁচে থাক, যা কাফেরদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ ও রাসূলের, যাতে তোমাদের দয়া করা হয়।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৩০-৩২)। আমাদের দেশে বিভিন্নভাবে সুদের ব্যবসা চলছে। একেক স্থানে একেক নামে। বিশেষ করে দেশের চরাঞ্চলে দাদন ব্যবসা হিসেবে। গরিব চাষিরা বিপদে পড়ে মহাজনদের কাছ হতে চড়া সুদে ঋণ নেয়। পরে আর সেটা পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। এভাবে সে তার ভিটেমাটি পর্যন্ত হারায়। বাড়তে থাকে দরিদ্র লোকের সংখ্যা আর সম্পদশালী হয় মহাজনরা। এত গেল একেবারে নিম্নবিত্তদের দৃষ্টান্ত। একটু ওপরে তাকাই! অনেকে বোনের বিয়ে, ছেলের বিদেশে যাওয়া, মায়ের চিকিৎসা ইত্যাদি কারণেও মোটা অঙ্কের ঋণ নেয়। পরে সেটার জন্য শুধু সম্বলহীনই হয় না, অনেকে মামলার শিকার হয়ে কারাবরণ করে। এটাই বাস্তবতা। সুদ মানুষকে শোষণ করে, সমাজ থেকে ভাইয়ে ভাইয়ের বন্ধন কেড়ে নেয়। সমাজের দরিদ্র মানুষদের শোষণের হাতিয়ার হিসেবে সুদ কাজ করে। এজন্য ইসলামে শুধু সুদ গ্রহণকেই নয়, সুদ প্রদান করাকেও হারাম বলা হয়েছে। কারণ সুদ সামাজিক বৈষম্য বাড়িয়ে তোলে।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির