post

মুমিনের বাসনা শাহাদতের মৃত্যু

এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান

২৫ জুলাই ২০১৫
মুমিন শব্দের অর্থ বিশ্বাসী। আল মুমিনুন এর শাব্দিক অর্থ, যে বিশ্বাস করে, স্বীকৃতি দেয়। আর পারিভাষিক অর্থ আন্তরিক বিশ্বাস স্থাপনকারী। আর যদি সংজ্ঞায়িত করা হয় তবে বলা যায়, মহান রাব্বুল আলামিনের একক সত্তা, তার প্রেরিত রাসূল, ফিরেশতা, কিতাব, পরকাল এবং তাকদিরের ওপর আন্তরিক বিশ্বাস স্থাপনকারীকে ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় মুমিন বলা হয়। কুরআনের ভাষায় মুমিন ১. অবশ্যই মুমিনগণ সফল হয়েছে ২. যারা নিজদের সালাতে বিনয়াবনত ৩. আর যারা অনর্থক কথাকর্ম থেকে বিমুখ ৪. আর যারা জাকাতের ক্ষেত্রে সক্রিয় ৫. আর যারা তাদের নিজদের লজ্জাস্থানের হিফাজতকারী ৬. তবে তাদের স্ত্রী ও তাদের ডান হাত যার মালিক হয়েছে তারা ছাড়া, নিশ্চয়ই এতে তারা নিন্দিত হবে না ৭. অতঃপর যারা এদের ছাড়া অন্যকে কামনা করে তারাই সীমালঙ্ঘনকারী ৮. আর যারা নিজদের আমানতসমূহ ও অঙ্গীকারে যতœবান ৯. আর যারা নিজেদের সালাতসমূহ হিফাজত করে ১০. তারাই হবে ওয়ারিশ ১১. যারা ফিরদাউসের অধিকারী হবে ও তারা সেখানে স্থায়ী হবে। (সুরা আল মুমিনুন : ১-১১) আল কুরআনের আলোকে মুমিনের গুণাবলি ১. প্রকৃত মুমিন তারাই, যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান আনার পর আর সন্দেহে পড়ে না এবং নিজেদের জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে। আর এরাই তাদের ঈমানের দাবিতে সত্যবাদী। (সূরা হুজুরাত : ১৫) ২. প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে আল্লাহর স্মরণে তাদের অন্তর কেঁপে ওঠে, তাদের সামনে আল্লাহর বাণী তেলাওয়াত হলে তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়, তারা আল্লাহর ওপর আস্থাশীল ও নির্ভরশীল হয়ে থাকে, সালাত কায়েম করে এবং আল্লাহপ্রদত্ত রিজিক থেকে ব্যয় করে। বস্তুত এরাই হচ্ছে সত্যিকারের মুমিন। তাদের জন্য আল্লাহর নিকট খুবই উচ্চ মর্যাদা রয়েছে, আরো রয়েছে অপরাধের ক্ষমা ও অতি উত্তম রিজিক। (সূরা আনফাল : ২-৪) ৩. মুমিনের বৈশিষ্ট্য এই যে, যখন তাদের মাঝে ফয়সালার জন্য আল্লাহ ও তার রাসূলের বিধানের প্রতি ডাকা হয়, তখন তারা বলে, আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। আর এরূপ লোকেরাই প্রকৃত সফলকাম।” (সূরা নূর : ৫১) ৪. যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর প্রশান্ত হয়; জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়।’’ (সূরা রা’দ : ২৮) ৫. মুমিনরা যেন মুমিনদের ছাড়া কাফিরদেরকে বন্ধু না বানায়। আর যে কেউ এরূপ করবে, আল্লাহর সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। তবে যদি তাদের পক্ষ থেকে তোমাদের কোন ভয়ের আশঙ্কা থাকে। আর আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর নিজের ব্যাপারে সতর্ক করছেন এবং আল্লাহর নিকটই প্রত্যাবর্তন। (সূরা আলে ইমরান : ২৮) হাদিসের আলোকে মুমিনের গুণাবলি ১. নুমান ইবনে বশির রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা মুমিনদেরকে পারস্পরিক দয়া, ভালোবাসা এবং হৃদ্যতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে একটি দেহের ন্যায় দেখতে পাবে। দেহের কোন অঙ্গ যদি পীড়িত হয়ে পড়ে তাহলে অপর অঙ্গগুলোও জ্বর এবং নিদ্রাহীনতাসহ তার ডাকে সাড়া দিয়ে থাকে। (বুখারী ও মুসলিম) ২. আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মুমিন ব্যক্তি তার গোনাহ সম্পর্কে এতদূর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকে যে, সে মনে করে যেন কোন পাহাড়ের পাদদেশে বসে আছে এবং প্রতিটি মুহূর্তে সে এই ভয় করে যে, পাহাড় তার ওপর ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু আল্লাহদ্রোহী ও পাপিষ্ঠ লোক গোনাহকে মনে করে একটি মাছির মত, যা তার নাকের ডগার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়েছে এবং সে তাকে হাতের ইশারায় তাড়িয়ে দিয়েছে এই বলে হাদিস বর্ণনাকারী আবু শিহাব নাকের ওপর হাত দ্বারা ইশারা করলেন। (বুখারী) ৩. আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মুমিন মহব্বত ও দয়ার প্রতীক। ঐ ব্যক্তির মধ্যে কোন কল্যাণ নেই, যে কারো সাথে মহব্বত রাখে না এবং মহব্বত প্রাপ্ত হয় না। (মুসনাদে আহমদ) ৪. নুমান রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সমস্ত মুমিন একই ব্যক্তিসত্তার মতো। যখন তার চোখে যন্ত্রণা হয়, তখন তার গোটা শরীরেই তা অনুভূত হয়। যদি তার ব্যথা হয় তবে তার গোটা শরীরই বিচলিত হয়ে পড়ে। (মিশকাত) মুমিন জীবনের বাসনা মুমিনের নিকট ঈমানের অপরিহার্য দাবি শাহাদত। সৃষ্টির আদি হতে এ যাবৎ কাল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণহীন ধারাবাহিকতা, সত্য ও মিথ্যার চিরন্তন সঙ্ঘাত, কল্যাণ ও অকল্যাণের রশি টানাটানি, আলো ও আঁধারের বৈপরীত্য সুন্দরের আরোহী কাঠিন্যতার প্রাচীর মাড়িয়ে ফুলের উৎসব অসুন্দরের আস্ফালন ও হীনতার অতল গহ্বরে পতন ঠেকাতে একজন মুমিনের সমগ্র জীবনের প্রকাশ জীবনাচার হবে শাহাদতের তামান্নায় উজ্জীবিত। তার জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত ও গোপনীয় বিষয়; হৃদয়ের আবেগ অনুভূতির প্রকাশ, সামাজিক তৎপরতায় অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক লেনদেন, রাজনৈতিক প্রতিপত্তি, সাংস্কৃতিক রুচিবোধ ও মননশীলতা, অবসর ও বিনোদন, শয়ন ও জাগরণ সব কিছুই বিল্পবী ঘোষণা দেবে শাহাদতের চূড়ান্ত- প্রত্যাশা, মুমিনের জীবন চলার প্রতিটি কদম, তাদের প্রতিটি স্পর্শ, চাহনির প্রতিটি পলক, জিহ্বার প্রতিটি বুলি, লেখনীর প্রতিটি আঁচড়, ব্যয়ের প্রতিটি কপর্দক, সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত, রক্তের প্রতিটি ফোঁটা এবং হৃদয়ের সবগুলো অনুভূতি শাহাদতের অমিয় সুধা পান করার জন্য থাকে সতত নিবেদিত। শাহাদত বা শাহাদাহ শব্দটি অতি ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি আরবি শব্দ। ‘শাহাদত’ অর্থ হলো, সাক্ষ্য, সনদ, সার্টিফিকেট, প্রত্যয়নপত্র ইত্যাদি। ‘শহীদের’ ভাবার্থ হলো, ‘শহীদ ব্যক্তি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সফলতায় তার জীবন কোরবানির মাধ্যমে তার ঈমানের দাবি পূরণের সত্যতার সাক্ষ্য, সনদ, সার্টিফিকেট বা প্রত্যয়ন প্রদান করলো।’ আরবি ডিকশনারি ‘মু’জাম আল-অসিত’-এর লেখক ‘শহীদ’ শব্দের অর্থ করে লিখেছেন, (ইস্তাশ্হাদা: তায়ার্’রাদা আয়্যুক্তালা ফি-সাবিলিল্লাহ্) অর্থাৎ: “তিনি আল্লাহর পথে নিহত হওয়ার জন্য নিজকে পেশ করলেন।” (ইবরাহিম মাযকুর, আল মু’জাম আল-অসিত ১/৪৯৭) শাহাদত শব্দ থেকে শহীদ ও শাহেদ শব্দ এসেছে। শাহেদ মানে যে দেখেছে বা সাক্ষ্য দিয়েছে। সাক্ষ্য সেই দেয় যে নিজে স্বচক্ষে দেখেছে। আশ-শাহিদ মানে আমি দেখার জন্য ঐ স্থানে উপস্থিত ছিলাম, আমি নিজে দেখেছি, এভাবেই দেখা, সাক্ষ্য দেয়া অর্থে শাহাদত শব্দ ব্যবহার করা হয়। ইমাম রাগিব ইসপাহানি এবং অন্যান্য আরবি ভাষাতত্ত্ববিদ শাহাদত শব্দটির অর্থ মোটামুটি একইরূপ লিখেছেন। কেউ লিখেছেন শহদ মানে উপস্থিত হয়ে স্বচক্ষে দেখে কিংবা অন্তরদৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করে সাক্ষ্য দেয়া। আবার কেউ বলেছেন- শাহাদত হচ্ছে এমন জ্ঞান বা জ্ঞানের বিবরণ যা চোখে দেখে বা অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে অর্জিত হয়। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি শাহাদত শব্দের অর্থের সাথে জড়িত রয়েছে নিম্নোক্তে শব্দগুলো : উপস্থিতি, জানা, দেখা, দর্শন, অন্তর্দৃষ্টি, জ্ঞান কিংবা (স্বচক্ষে অথবা জ্ঞানচক্ষু দ্বারা অর্জিত) জ্ঞানের বিবরণ বা সাক্ষ্যদান, মন মগজ ও বিবেক বুদ্ধি দ্বারা উপলব্ধি করা প্রভৃতি। “হানাফি মাজহাবে ‘শহীদ’ বলতে বুঝানো হয়েছে: “শহীদ ঐ ব্যক্তি (যে মুসলমান) অত্যাচারিত বা নির্যাতিত অবস্থায় নিহত হয়েছে। চাই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন অথবা কোনো বিদ্রোহী কিংবা কোনো শত্রু তাকে হত্যা করুক অথবা কোনো চোর বা ডাকাত তাকে নিহত করুক।” (আব্দুর রহমান আল-জাযাইরি, কিতাবুল ফিক্হ ‘আলাল মাযাহিবিল আরবা’আ, ১/৫২৭-৫২৯) “শাফেয়ি মাজহাবে ‘শহীদ’ হলো : “দুনিয়া ও আখেরাতের শহীদ হলেন : যিনি গনিমতের মাল গোপনে আত্মসাৎ অথবা মানুষের বাহ্বা কুড়ানোর উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করার উদ্দেশ্যে কাফিরদের সাথে যুদ্ধে নিহত হয়েছেন।” (আলাল মাযাহিবিল আরবা‘আ, প্রাগুক্ত) হাম্বলি মাজহাবে ‘শহীদ’ বলা হয় : “শহীদ তিনি, যিনি কাফেরদের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করার সময় নিহত হয়েছেন।” (আলাল মাযাহিবিল আরবা‘আ, প্রাগুক্ত) মালিকি মাজহাবে ‘শহীদ’ অর্থ : “শহীদ ঐ ব্যক্তি, যাকে কোনো কাফের যোদ্ধা হত্যা করেছে অথবা মুসলমান ও কাফেরদের মধ্যে লড়াইয়ে মারা গিয়েছে।” (আলাল মাযাহিবিল আরবা‘আ, প্রাগুক্ত) শাহাদত ঈমানের অপরিহার্য দাবি মুমিনের নিকট “শাহাদত” ঈমানের অপরিহার্য দাবি। শাহাদতের কামনা যদি কোন মুমিন জীবনে থাকে তাহলে সে আল্লাাহর পথে লড়াইয়ে কোন সময় গাফেল হতে পারে না। কারণ জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ ছাড়া শাহাদতের দ্বিতীয় কোন পথ নেই। একজন ভালো ছাত্র যেমন ভাবে ফলাফলের প্রমাণ দেবার জন্য পরীক্ষা কামনা করে তেমনি একজন মুমিন শাহাদতের মাধ্যমে বিজয়ী হওয়ার জন্য বাতিলের বিরুদ্ধে হকের সংগ্রামে আপসহীনভাবে লড়াই করে যাবে। আন্দোলনের কর্মকান্ডে বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যদি সে উৎসাহ পায় মৃত্যু অথবা অন্যান্য প্রতিকূলতা তাকে গাফেল করে না রাখে তাহলে বুঝতে হবে শাহাদতের কামনা তার মধ্যে উপস্থিত রয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহর পথে লড়াই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “আল্লাহর পথে লড়াই করা কর্তব্য সেই সব লোকেরই যারা পরকালের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন বিক্রয় করে দেয়, আল্লাহর পথে যে লড়াই করে ও নিহত হয়, কিংবা বিজয়ী হয়, তাকে আমরা অবশ্যই বিরাট ফল দান করব।” (সূরা আন-নিসা : ৭৪) ঈমানের দাবি পূরণের অঙ্গীকার আদায়ে মু’মিনদেরকে কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়, কখনো কখনো বিপদের পাহাড় তাদের মাথায় ভেঙে পড়ে, তাদেরকে চরম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, এমনকি প্রয়োজনে তাদেরকে নিজ নিজ জীবন কোরবানি করতে হয়। মহান আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূরণের প্রমাণ পেশ করতে হয়। এমনি শাহাদত বরণ করেই তারা লাভ করেন আল্লাহর সাহায্য ও অনুগ্রহ। শহীদের মর্যাদা শহীদগণ শাহাদতের মাধ্যমে ঈমানের দাবি পূরণ করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেন, এ মর্মে আল্লাহ তায়া’লা বলেন : “মুমিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে, তাদের মধ্যে কেউ শাহাদত বরণ করেছে এবং কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে। তারা তাদের অঙ্গীকারে কোনো পরিবর্তন করেনি, কারণ আল্লাহ সত্যবাদীদেরকে পুরস্কৃত করেন তাদের সত্যবাদিতার জন্য এবং তাঁর ইচ্ছা হলে মুনাফিকদেরকে শাস্তি দেন অথবা ক্ষমা করেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা-৩৩ আল-আহজাব :২৩-২৪) মহান আল্লাহর বিধান কার্যকর করার চেষ্টা সাধনার মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রেজামন্দি অর্জন করতে পারেন, যার জন্যই মহান আল্লাহ মানুষকে সষ্টি করেছেন। এমনি চেষ্টা-সাধনার শেষ পর্যায়ে প্রয়োজনে বান্দাহ আল্লাহর পথে নিজ জীবন উৎসর্গ করে হন শহীদ। আর আল্লাহ তায়া’লা এমনি শাহাদত বরণকারী শহীদের ওপর অত্যন্ত খুশি হন। যার কারণে শহীদের মর্যাদা অসীম। এখানে কিছু বিষয় উল্লেখ করা হলো। ১. শহীদগণ মৃত নন, বরং তাঁরা জীবিত, আল্লাহর নিকট থেকে রিজিকপ্রাপ্ত কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে, “যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয়েছে তোমরা তাদেরকে মৃত মনে কর না, বরং তারা জীবিত এবং তাদের রবের নিকট হতে তারা রিজিকপ্রাপ্ত।” (সূরা আলে ইমরান : ১৬৯) কুরআনুল কারিমের অন্যত্র বলা হয়েছে, “আল্লাহর পথে যারা শহীদ হয়, তাদেরকে তোমরা মৃত বল না, বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা উপলব্ধি করতে পার না।” (সূরা আল-বাকারা : ১৫৪) দুনিয়ার জীবিত মানুষের চর্মচক্ষে শহীদদেরকে প্রাণহীন মৃত লাশ দেখলেও আসলে মহান আল্লাহর নিকট তারা মৃত নন, তাদেরকে মৃত মনে করতে ও মৃত বলতে নিষেধ করা হয়েছে। শহীদদের মৃত্যুকে অন্যদের মৃত্যুর সমপর্যায়ভুক্ত মনে করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা শহীদদেরকে অন্যান্য মৃতের তুলনায় একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মর্যাদা দান করা হয়েছে। অনেক সময় শহীদদের রক্ত-গোশতের দেহ পর্যন্ত মাটিতে বিনষ্ট হয় না। জীবিত মানুষের দেহের মতোই অবিকৃত থাকতে দেখা যায়। এ কারণেই শহীদগণকে জীবিত বলা হয়েছে। তবে সাধারণ নিয়মে তাদেরকেও মৃতই ধরা হয় এবং তাদের পরিত্যক্ত সম্পদ নিজ নিজ ওয়ারিশগণের মধ্যে বণ্টিত হয়, তাদের বিধবাগণ ইদ্দত পালনের পর অন্যের সাথে পুনর্বিবাহ করতে পারে। (মুফতি মোহাম্মদ শফি, তাফসির মা’আরেফুল কুরআন-১/৩৯৬) ২. শহীদগণ আল্লাহর পুরস্কার পেয়ে আনন্দিত হয় কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে, “আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে যা দিয়েছেন তাতে তারা (শহীদগণ) আনন্দিত এবং তাদের পেছনে যারা এখনও তাদের সাথে মিলিত হয়নি, তাদের জন্য আনন্দ প্রকাশ করে এ জন্য যে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না, আল্লাহর নিয়ামত ও অনুগ্রহের জন্য তারা আনন্দ প্রকাশ করে এবং তা এ কারণে যে, আল্লাহ্ মু‘মিনদের শ্রমফল বিনষ্ট করেন না।” (সূরা আলে-ইমরান :১৭০-১৭১) ৩. শহীদগণ শহীদ হওয়ার জন্য দুনিয়ায় ফিরে আসার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করবে আনাস ইবনে মালেক রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একমাত্র শহীদ ছাড়া এমন কোনো ব্যক্তি মৃত্যুর পরে দুনিয়ায় ফিরে আসতে আনন্দ পাবে না, সে আল্লাহর নিকট এমন কল্যাণপ্রাপ্ত হয়েছে যা দুনিয়া ও তার সমস্ত সম্পদের সমান। কেননা সে বাস্তবে শাহাদতের মর্যাদা দেখতে পাবে, সুতরাং সে পুনরায় দুনিয়ায় ফিরে এসে আর একবার আল্লাহর পথে প্রাণ দিতে আনন্দ অনুভব করবে।” (সহীহ আল-বুখারী, কিতাবুল জিহাদ-১/৩৯২) আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: সেই সত্তার শপথ যাঁর মুঠির মধ্যে আমার প্রাণ, আমার নিকট অত্যন্ত পছন্দনীয় হচ্ছে, আমি আল্লাহর পথে শহীদ হয়ে যাই, অতঃপর জীবন লাভ করি এবং পুনরায় শহীদ হই তারপর আবার জীবন লাভ করি এবং পুনরায় শহীদ হই, তারপর আবার জীবন লাভ করি এবং পুনরায় শহীদ হই।” (সহীহ আল-বুখারী, কিতাবুল জিহাদ-১/৩৯২) ৪. শহীদের লাশের ওপর ফিরেশতারা ছায়া দান করেন জাবের রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উহুদের দিন যুদ্ধ শেষে আমার আব্বার লাশ রাসূলুল্লাহর সামনে এনে রাখা হলো, তার লাশ বিকৃত (নাক কাটা ও চক্ষু উপড়ানো) করা হয়েছিলো, আমি তার চেহারা উন্মুক্ত করে দেখতে গেলে লোকেরা আমাকে নিষেধ করলো। ইতোমধ্যে কোনো ক্রন্দনকারিণীর ক্রন্দন-ধ্বনি ভেসে এলো। বলা হলো, আমরের কন্যা বা ভগ্নি ক্রন্দন করছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ক্রন্দন করছো কেন? অথবা ক্রন্দন করো না, এখনও ফিরেশতারা তাকে ডানা দ্বারা ছায়াদান করছে।” (সহীহ আল-বুখারী, কিতাবুল জিহাদ-১/৩৯৫) ৫. মানুষের পাওনা ঋণ ছাড়া শহীদের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয় আমর ইবনুল আস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শহীদের ঋণ ছাড়া তার সকল গুনাহ শাহাদত প্রাপ্তির কারণে ক্ষমা হয়ে যায়।” (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ইমারত-২/১৩৫) ৬. শহীদগণের মৃত্যুকষ্ট সামান্য চিমটি কাটার চেয়ে বেশি হয় না আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শহীদ ব্যক্তির নিহত হওয়ার কষ্ট হলো, তোমাদের মধ্যে কেউ সামান্য একটু চিমটি কাটার মতো স্পর্শ অনুভব করে মাত্র।” (জামে’ আততিরমিজি, আবওয়াবুল ফাদায়িলিল জিহাদ ১/২৯৬) ৭. শহীদের জন্য মহান আল্লাহর নিকট রয়েছে আরো বিশেষ কিছু মর্যাদা মিকদাম ইবনে মা’দিকাব রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর নিকট শহীদের ছয়টি (বিশেষ) মর্যাদা রয়েছে : ক. শহীদের শরীর থেকে প্রবাহিত রক্তের প্রথম ফোঁটা মাটিতে পড়ার সাথে সাথে তার সকল গুনাহ ক্ষমা করা হয়, খ. জান্নাতে শহীদের আবাসস্থান দেখানো হয়, গ. শহীদের কবরে আজাব হয় না, ঘ. শহীদ ব্যক্তি ভয়ানক-আতঙ্কজনক কিয়ামতের বিভীষিকা থেকে নিরাপদ থাকে, ঙ. শহীদের মাথায় মহাসম্মানিত টুপি পরানো হয়, যার একটু ইয়াকুত পাথর দুনিয়া ও দুনিয়ার সকল সম্পদ থেকে উত্তম, শহীদের সাথে বাহাত্তর জন মহাপবিত্রতমা জান্নাতি হুরের বিয়ে দেয়া হয়, চ. শহীদকে তাঁর নিকটাত্মীয়দের থেকে সত্তরজন লোকের জন্য সুপারিশ করার ক্ষমতা দেয়া হয়।” (জামে’ আততিরমিজি, আবওয়াবুল ফাদায়িলিল জিহাদ ১/২৯৫) শহীদের মর্যাদার কারণেই সাহাবায়ে কিরামগণ শাহাদতের অমিয় সুধা পান করার জন্য ছিলেন সর্বদা ব্যাকুল, পাগলপারা। একটি ঘটনাই তার উজ্জ্বল নমুনা, একবার রাবি আবিবকর ইবনে আবি মুসা আশয়ারি রাদিআল্লাহু আনহু বললেন, “তারা দু’জনেই যুদ্ধের সময় উপস্থিত ছিলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, নিশ্চয়ই জান্নাতের দরজাগুলো তলোয়ারের ছায়াতলে।” একজন লোক দাঁড়িয়ে গেল যার কাপড়-চোপড় তেমন ছিল না, বললো, “হে আবি মুসা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বললেন শুনলেন তো? তিনি বললেন, হ্যাঁ শুনলাম। তো তারপর লোকটি বন্ধুদের কাছে গিয়ে বললেন, তোমাদেরকে সালাম দিয়ে যাচ্ছি। আর আসবো না।” তারপর তার তলোয়ারের খাপটা ভেঙে ফেলে দিলেন। এরপর তলোয়ার নিয়ে দুশমনদের দিকে চললেন, তাদেরকে মারতে থাকলেন যে পর্যন্ত না তিনি নিহত হলেন। শাহাদাতের মর্যাদা পাওয়ার খাঁটি কামনা যারা করবে তাদের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুসংবাদ দিয়েছেন, “তারা বিছানায় মারা গেলেও আল্লাহ্তাদেরকে সে মর্যাদা দান করবেন।” শাহাদাতের রক্ত আল্লাহ বৃথা যেতে দেন না। এটাই আল্লাহর বিনিময়। শহীদের উত্তরসূরিরা যখন সংগঠিতভাবে শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত হয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় তখন তাদের সাহায্য করা আল্লাহর দায়িত্ব হয়ে পড়ে। বিংশ শতকের কর্মক্লান্ত সূর্য যখন পাশ্চাত্যের আকাশে বিদায়ের পটে, আমরা বিশ্ববাসী উৎসুক চোখে মহাসাগরের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের দৃশ্য অবলোকন করছি। পাশ্চাত্য সভ্যতার অহঙ্কার বিশাল টাইটানিক সব কিছুসহ কালের অতল গহ্বরে বিলীন প্রায় অবস্থায় ক্যাপ্টেন টি.সি. ইলিয়ট বিশ্ববাসীকে জরুরি মেসেজ দিয়ে বলেছেন, “Pray for us now, we are at the time of our death.” “আমাদের জন্য প্রার্থনা কর, বাঁচাও আমাদেরকে, আমরা মৃত্যুর দ্বারে।” গোটা মুসলিম বিশ্বও আজ যেন সন্দেহ, অবিশ্বাস, ভোগবাদ, নেশা ও যৌনাচারের এ ভয়াল সমুদ্র থেকে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে ঘোষণা করছে কুরআনের সেই অমিয় বাণী- “হে মনিব, তুমি আমাদের এ জালিম অধ্যুষিত এলাকা থেকে বের করে নাও।” এই মজলুম, দিশেহারা পথিককে মুক্ত করতে একদল মর্দে মুমিনকে দায়িত্ব নিতে হবে যারা ঈমানের চেতনায় তেজোদীপ্ত এবং শাহাদতের উদ্দীপনায় সদা উদ্বেলিত, আর যারা বাতিলের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে উমর ফারুক, উসমান, হামযা, জাফর বিন আবু তালিব, আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা, হুসাইন, মুসাইয়্যিব, সাইয়্যেদ আহমদ ব্রেলভী, তিতুমীর, সালাহ উদ্দীন, ইবনে কাশিম, হাসানুল বান্নাহ, আবদুল কাদের আওদাহ, সাইয়্যেদ কুতুবসহ ইসলামী আন্দোলনের বীর শহীদদের মত ভুবনকাঁপানো সে ঘোষণা সদম্ভে উচ্চারণ করতে পারে, কুরআনের ভাষায়, “হে প্রভু, আমরা তোমার ওপর ঈমান আনলাম, আর শহীদদের কাতারে আমাদের নাম লিখে দাও।” বিশ্বজাহানের মালিকের কাছে সিজদাবনত চিত্তে আমাদেরও মুনাজাত, হে আল্লাহ! এ দিকভ্রান্ত জাতিকে সঠিক পথের দিশা দাও এবং আমরাও যেন তোমার দ্বীন প্রতিষ্ঠার মিছিলে অংশগ্রহণ করে শাহাদতের অমিয় সুধা পান করতে পারি সে তাওফিক দাও। আমিন! লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির