post

রিবা বা সুদের সামাজিক ও নৈতিক কুফল

০৫ মে ২০১২
ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম সামাজিক ও নৈতিক কুফল (Social and Moral Impact) ১. সুদ মানুষের মধ্যে লোভ, স্বার্থপরতা ও কার্পণ্য সৃষ্টি করে (Riva nurtures greed selfishness and misery among human beings) : সুদ মানুষের মধ্যে লোভ-লালসা, অর্থলিপ্সা, নির্মমতা, সঙ্কীর্ণতা, স্বার্থপরতা, কৃপণতা, নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতা জন্ম দেয়। সুদের কারবারিরা স্বার্থপর, অর্থলিপ্সু ও কৃপণ হয়ে থাকে। সুদখোরদের মধ্যে ক্রমান্বয়ে স্বার্থপরতা, লোভ ও কৃপণতা এমনভাবে বিকাশ হতে থাকে যে তারা সমাজের অন্যান্য লোকের সাথে শাইলকের মতো আচরণ করতেও কুণ্ঠিত হয় না। ড. আনোয়ার ইকবাল কোরেশী যথার্থই বলেছেন যে, সুদভিত্তিক ঋণব্যবস্থা সুদখোরদের মধ্যে অর্থলিপ্সা, লোভ, স্বার্থপরতা ও সহানুভূতিহীন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে। সুদ কৃপণতা বাড়ায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে সুদ ব্যক্তি, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কত মারাত্মক। এ ছাড়াও সুদের আরও বহু ক্ষতিকর দিক রয়েছে। সুদ এক বড় ধরনের অপরাধ যা আল্লাহর ক্রোধকে প্রজ্ব¡লিত করে এবং সুদখোররা আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠিন শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। ২. সুদ সমাজে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে (Riba enhances hatred and enmity in Society) : সুদখোর মহাজন ও পুঁজিপতিরা সুদের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষদের সম্পদ কুক্ষিগত করে নেয়। ঋণগ্রহীতারা দিবা-রাত্র পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে সামান্য অর্থ উপার্জন করেন, তার প্রায় সবটাই ঋণদাতাদের সুদ পরিশোধ করার জন্য ব্যয় করতে বাধ্য হয়। কখনো কখনো সুদাসলে ঋণ শোধ দিতে গিয়ে ভিটেমাটি পর্যন্ত নব্যকাবুলিওয়ালা সুদখোরদের হাতে তুলে দিতে হয়। এ জন্য সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠী সুদখোর ঋণদাতাদেরকে বন্ধু ভাবার পরিবর্তে শত্রু মনে করে। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ) লিখেছেন, ‘যে সমাজে ব্যাপকভাবে সুদখোরি প্রচলিত থাকে তাতে এই সুদখোরির কারণে দুই প্রকারের নৈতিক রোগ দেখা দেয়, তা হলোÑ সুদগ্রহীতাদের মধ্যে লোভ-লালসা, কার্পণ্য ও স্বার্থপরতা আর সুদদাতাদের মধ্যে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা। ৩. সুদ সঞ্চয়কারীদের মধ্যে অলসতা সৃষ্টি করে (Riba creates idleness among the depositors) : সুদের নির্দিষ্ট হার আমানতকারীদের আরও অলস করে তোলে। সুদ মানুষকে কর্মবিমুখ করে। কারণ বিনা পরিশ্রমে সুদ পাওয়া যায় বিধায় বিত্তবানেরা পুঁজিকে ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে ব্যাংকে জমা রাখে। সুদি ব্যাংকে অর্থ জমা রাখলে বিনাপরিশ্রমে বিনা ঝুঁকিতে নির্ধারিত সুদ পাওয়া যায়। এ অবস্থা যোগ্যতাসম্পন্ন ও উদ্যোক্তা হতে পারেন এমন সব সঞ্চয়কারীকে অলস ও অকর্মণ্য বানিয়ে দেয়। সুদ অর্জনের পথকেই তারা নিরাপদ ও সহজ মনে করে। এভাবে সুদের কারণে সমাজে ব্যাপক সংখ্যক যোগ্য আমানতকারীর মেধা, শ্রম ও ঝুঁকি গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। মোটকথা রিবা আলস্য সৃষ্টি করে। এতে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৪. সুদ নৈতিক অবক্ষয় সাধন করে (Riba creates moral disaster) : সুদভিত্তিক অর্থনীতিতে ঋণভারে জর্জরিত দরিদ্র জনসাধারণ তাদের কষ্টার্জিত স্বল্প উপার্জন দ্বারা সুদখোর মহাজনের সুদ পরিশোধ করার পর নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের মধ্যে জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। এ অবস্থা তাদের নৈতিক চরিত্রের ধ্বংস সাধন করে এবং তাদেরকে অপরাধ প্রবণতার দিকে ঠেলে দেয়। অভাবের তাড়নায় তারা হয়ে ওঠে অপরাধপ্রবণ। তাছাড়া অর্থাভাবে সন্তান-সন্ততিরা বঞ্চিত হয় সুশিক্ষার আলো থেকে। অশিক্ষা, দারিদ্র্য ও বঞ্চনার পুঞ্জীভূত ক্ষোভ তাদের মধ্যে জন্ম দেয় এক ধরনের প্রতিশোধস্পৃহা যা তাদেরকে অমানুষ বানিয়ে দেয়। সর্বোপরি সুদলগ্নিকারী নিশ্চিত মুনাফ পাওয়ার লোভে অনেক অহিতকর ও কদর্য খাতেও মূলধন বিনিয়োগ করে। এর স্বাভাবিক পরিণতিতে সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ বিনষ্ট হয়, এমনকি কখনো কখনো স্বাভাবিক নৈতিকতাবোধও লোপ পায়। সুদের কারণে ব্যবসায়ীর নৈতিকতা নষ্ট হয়। সুদখোর ব্যবসায়ীরা অধিক অর্থপ্রাপ্তির আশায় হারাম পণ্য যেমন মদ, গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল, ইয়াবা বিপণনে অর্থ খাটায়। ফলে যুবসমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সমাজে নৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টি হয়। ৫. সুদ সমাজ শোষণের কার্যকরী শক্তিশালী মাধ্যম : সুদনির্ভর প্রতিষ্ঠান বা সুদের কারবারিরা সুদের মাধ্যমে সমাজের মানুষকে শোষণ করে। সুদ শোষণ (Exploitation) ও বৈষম্যের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। সুদ অতিবড় অবিচার, জুলুমু, অভিশাপ (curse) ও শোষণ। সুদ মানুষকে শুধু শোষণই করে। সুদের সাহায্যে একদল কারবারি বিনা শ্রমে অন্যের উপার্জনে ভাগ বসায়। ঋণগ্রহীতা যে কারবারের জন্য ঋণ নেয় যে কারবারে তার লাভ হোক বা লোকসান হোক তাকে সুদের অর্থ দিতেই হবে। এর ফলে অনেক সময় ঋণগ্রহীতা আগের স্থাবর অস্থাবর সম্পদ বিক্রি করে হলেও সুদাসলে ঋণ পরিশোধ করতে হয়। পরিণামে ঋণগ্রহীতারা দরিদ্র ও অসহায় হয়ে পড়েন। সমাজে শ্রেণীবৈষম্য আরো বৃদ্ধি পায়। সুদখোররা সমাজের পরগাছা। এরা অন্যের উপার্জন ও সম্পদে ভাগ বসিয়ে সুখের স্বপ্ন দেখে। এ ছাড়াও বিনাশ্রমে অর্থসম্পদ অর্জনের ফলে সমাজের প্রত্যক্ষ উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে এদের কোনো ভূমিকা থাকে না। ৬. সুদ বিত্তবানকে আরো বিত্তবান এবং দরিদ্রকে আরো দরিদ্র করে : সুদের প্রভাবে সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য বেড়ে যায়। অসহায়, দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত মানুষ একান্ত প্রয়োজনে সাহায্যের কোনো উপায় না পেয়ে নিরুপায় হয়ে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। সে ঋণ উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল উভয় প্রকার খাতেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিশেষ করে অনুৎপাদনশীল কার্মকাণ্ডে ঋণের অর্থ ব্যবহারের ফলে গ্রহীতার ঋণ পরিশোধের ক্ষমতাই লোপ পায়। পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতিতে করজে হাসান-এর কোনো সুযোগ না থাকায় অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণ তো দূরের কথা উৎপাদনী খাতেও বিনা সুদে ঋণ মেলে না। বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো তাকে সুদ পরিশোধ করতে হয়। এর ফলে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি তার শেষ সম্বল যা হাতের কাছে পায় তাই বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য হয়। সুদের অর্থ পেয়ে ধনী আরো ধনী হয়। ঋণগ্রহীতা হয় আরও দরিদ্র। ফলে বৃদ্ধি পায় সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য। ৭. সুদ পরিবেশ ধ্বংস করে (Riba vitiating and polluting the environment) : মুহাম্মদ আকরম খান দেখিয়েছেন, পরিবেশ ধ্বংস ও দূষণের ক্ষেত্রে সুদ বিরাট ভূমিকা পালন করে। দরিদ্র দেশগুলো যেহেতু তাদের ঋণ সুদসহ পরিশোধের জন্য প্রচণ্ড চাপের মধ্যে থাকে সেহেতু রফতানি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তাদের জমিগুলো অতিরিক্ত ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। অথবা বন কেটে সাবাড় করে। ফলে তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ (খনিসহ) আরো ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়। ৮. সুদ মানুষকে ঋণের ভারে জর্জরিত করে : সুদ ঋণগ্রহীতাকে ঋণভারে জর্জরিত করে। ঋণগ্রহীতার ব্যবসায় যদি ফেল (Fail) করে সে অবস্থায় ঋণগ্রহীতাকে ব্যবসার সাকুল্য লোকসান তো বহন করতেই হয়, একই সাথে ঋণদাতার পাওনা স¤পূর্ণ সুদও পরিশোধ করতে হয়। অন্যকথায় ঋণভারে জর্জরিত ঋণগ্রহীতাকে সর্বস্ব খুইয়ে হলেও ঋণদাতার সুদের নিশ্চয়তা বিধান করতে হয়। ৯. সুদ জীবনীশক্তি ক্ষয় ও কর্মক্ষমতা হ্রাস করে : সুদের একটি কুফল হচ্ছে এই যে, তা মানুষকে প্রকৃত অর্থনৈতিক কার্যকলাপ থেকে ফিরিয়ে রাখে। এতে তার কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। এটা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও প্রচেষ্টার লক্ষ্যকে ঘুরিয়ে দেয়; যার জন্য প্রকৃত পণ্যসামগ্রী ও সেবা জোগানের পরিবর্তে অর্থ দিয়ে অর্থ লাভ করার লক্ষ্যেই যাবতীয় প্রচেষ্টা পরিচালিত হয়। লেখক : বিশিষ্ট ব্যাংকার

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির