post

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার অপরিহার্য

০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৩

তানভীর আহমেদ

দেশের বর্তমান ঘনীভূত রাজনৈতিক সঙ্কটের মূলে রয়েছে আগামী সংসদ নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার অনিশ্চয়তা। একতরফাভাবে এবং অন্যায্যভাবে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে এ অনিশ্চয়তা এবং সঙ্ঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে খোদ সরকার। অথচ আমাদের দেশের রাজনীতির বাস্তবতায় গণতন্ত্রের জন্য নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অপরিহার্য। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে দেশে গণতন্ত্র এবং সুস্থ রাজনীতি বিকাশের পথ উন্মুক্ত হয়েছিল এবং দেশে গণতান্ত্রিক ধারা পথচলা শুরু করেছিল। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বাতিল করে গণতন্ত্রের পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে এবং রাজনীতিকে সঙ্ঘাতময় করে তুলেছে। কাজেই গণতন্ত্রকে মুক্ত এবং রাজনীতিকে সুস্থতায় ফেরাতে হলে আবার সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন। গণতন্ত্রকে বাঁচানোর জন্য এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নাম যা-ই দেয়া হোক, তাকে অবশ্যই হতে হবে নির্দলীয় এবং নিরপেক্ষ, হতে হবে দলীয় সরকারের প্রভাবমুক্ত। গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ হচ্ছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার জন্য প্রয়োজন নিরপেক্ষ পরিবেশ। নিরপেক্ষ পরিবেশ ছাড়া জনগণের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ ও ভোটাধিকার প্রয়োগ সম্ভব নয়। আর জনগণের স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে গণতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব নয়। একমাত্র নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নিরপেক্ষ পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে এবং জনগণ স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ ও ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন আদৌ সম্ভব নয়। নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার জন্য মোটা দাগে প্রয়োজন : ১. ক্ষমতাসীন সরকারের গণতান্ত্রিক আচরণ এবং ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা ২. আইন প্রয়োগে স্বচ্ছতা ও সমতা ৩. নির্বাচন কমিশনের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ও সক্ষমতা ৪. দলীয় প্রভাবমুক্ত জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ৫. ভোটগ্রহণ কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয় প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করার পরিবেশ ৬. সব দলের জন্য সমতল ক্ষেত্র বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এবং ৭. জনগণের জন্য অবাধ ও ভয়মুক্ত পরিবেশ। দলীয় সরকারের অধীনে এসব শর্ত পূরণ এবং পরিবেশ নিশ্চিত করা এমনিতে কঠিন, আর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সরকারের মাত্রাতিরিক্ত দলীয়করণ নীতির ফলে এসবের অবস্থা আরো করুণ। যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তারা গোটা দেশ ও জাতির অভিভাবকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অভিভাবক হিসেবে সরকারের উচিত, দেশের সব মানুষের জন্য আইনানুগ নিরপেক্ষ ও সমান আচরণ করা। ভিন্ন মতের প্রতি সহিষ্ণুতা এবং সম্মান প্রদর্শন গণতন্ত্রের প্রাণ। কিন্তু বর্তমান সরকার দলীয় চিন্তাচেতনায় এতটাই আচ্ছন্ন যে, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা দূরের কথা, বরং তাদের কথাবার্তা ও আচার-আচরণে মনে হয় বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন করাই সরকারের প্রধান কাজ। সরকার ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম থেকেই বিরোধী দলকে তাদের ন্যায্য গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে আসছে। কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। সংসদ নির্বাচনের পর সরকারদলীয় নির্বাচিত সংসদ-সদস্যরা যেদিন স্পিকারের কাছে শপথ গ্রহণ করেন, তাদের সে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। কিন্তু কয়েক দিন পর যখন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হয়, সে অনুষ্ঠান সদ্য ক্ষমতাসীন বর্তমান সরকার বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করতে দেয়নি। জাতীয় সংসদের বিদায়ী স্পিকার সংসদের অনুসৃত নিয়মানুযায়ী সংসদ সদস্যদের বসার আসনবিন্যাসে বাম দিকের প্রথম সারির আসন বিরোধী দলকে প্রদান করেন। কিন্তু নতুন স্পিকার এসেই বিরোধী দলের সাথে কোনো আলোচনা না করে সরকারি দলের নির্দেশে তিনটি ছাড?া প্রথম সারির সব আসন বিরোধী দলের নাম কেটে সরকারদলীয় সদস্যদের প্রদান করেন, যা ছিল বিরোধী দলের প্রতি চরম অবজ্ঞা ও অপমানের শামিল। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল, তারা জয়লাভ করলে বিরোধী দল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার গ্রহণ করবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। বিরোধী দল থেকে কোনো ডেপুটি স্পিকার গ্রহণ করেনি। বিএনপি থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার নেয়া বিএনপির প্রতি সরকারের কোনো অনুগ্রহ বা দয়ার বিষয় ছিল না, এটা ছিল জনগণের কাছে দেয়া আওয়ামী লীগের ওয়াদা। বিরোধী দলের যেকোনো কর্মসূচিকে সরকার ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শেয়ারবাজারের লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর অর্থ লোপাট, হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো ঘটনায় হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ, কুইক রেন্টালের নামে দলীয় লোকদের সুবিধা প্রদান, রেলের নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে গরিব লোকের অর্থ শোষণÑ এরূপ অসংখ্য দুঃশাসনে জনগণের জীবন যখন অতিষ্ঠ, তখন এসবের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বললে কিংবা বিরোধী দল কোনো কর্মসূচি দিলেই সরকারি লোকদের এক কথাÑ বিরোধী দল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র করছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এ দেশের সব মানুষের দাবি। এ বিষয়ে বিরোধী দলের যেকোনো আন্দোলন, কর্মসূচি সরকারের ভাষায় বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র। জনগণের পক্ষে কথা বলার জন্য বিরোধী দলকে ঠিকমতো সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং করতে দেয়া হয় না। বিএনপির অফিস পুলিশ দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়, জামায়াতের অফিস তালা মেরে বন্ধ করে দেয়া হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিরোধী দল ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর সভা আহ্বানের একই দিনে একই স্থানে সরকারি দল সভা আহ্বান করে, প্রশাসনকে দিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করিয়ে সভা বন্ধ করা হয়। এমনকি বিরোধী দলের নিরীহ টাইপের মানববন্ধন কর্মসূচিও অনেক সময় ভেঙে দেয়া হয়। ১৯৯৪-৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ ১৭৩ দিন হরতাল ডেকেছিল। বিএনপির ২০০১-২০০৬ মেয়াদেও তারা অনেক দিন হরতাল-অবরোধ দিয়েছিল। তার বিপরীতে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের চার বছরকালে বিএনপি মাত্র ছয়-সাত দিন হরতাল আহ্বান করলেও সরকার তা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। এক হরতালের সময় পুলিশ বিএনপির সিনিয়র নেতা, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বাড়িতে হামলা চালিয়ে মহিলা ও শিশুদেরও মারধর করে। বিএনপির এমপি শহীদউদ্দীন চৌধুরী এ্যানীকে হাসপাতাল চত্বরে ঢুকে মারধর করে রক্তাক্ত করে দেয়। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে সংসদ এলাকাতেই রাস্তার ওপর মাটিতে ফেলে বর্বরভাবে নির্যাতন করে। সরকার সেই নির্যাতনকারী পুলিশ কর্মকর্তাকে পুরস্কারস্বরূপ দ্রুত পদোন্নতি দেয়। নাটোরের বিএনপি নেতা বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান বাবুকে সরকারদলীয় লাঠিধারী ক্যাডাররা রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে হত্যা করে। হত্যাকারীদের বিচার হয় না, উল্টো মন্ত্রী তাদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেন। নেত্রকোনায় বিরোধী জোট নেতাদের ওপর সরকারি দলের লোকদের হামলার প্রতিবাদে গত ২ অক্টোবর নয়া পল্টনে দলীয় অফিসের সামনে বিএনপি একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। কিন্তু পুলিশ বেধড?ক লাঠিচার্জ, রাবার বুলেট এবং টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে সভা ছঙ্গভঙ্গ করে দেয়। পুলিশ তিন দিন ধরে ২০০-৩০০ নেতাকর্মীকে অফিসের ভেতরে অবরুদ্ধ করে রাখে। বাসায় ফেরার পথে যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে গাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আটক করা হয়। বিরোধী জোটের একটি দল জামায়াতে ইসলামীকে সরকার প্রথম থেকেই সভা-সমাবেশ করতে দেয় না। গত বছর ও ডিসেম্বর তারা একটি সভা করার জন্য মহানগর পুলিশের কাছে অনুমতি চায় এবং পত্রপত্রিকায় খবরও প্রকাশ হয়। কিন্তু সরকার অনুমতি তো দেয়ইনি, উল্টো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, তারা কোনো আবেদনই করেনি। অথচ ডিএমপির পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, তারা আগেই আবেদন করেছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো ঘোষণা দেন যে, জামায়াতকে সভা করতে দেয়া হবে না বরং তাদের দমন ও প্রতিহত করতে হবে। তিনি ছাত্রলীগ-যুবলীগকে নির্দেশ দেন, তাদের যেখানে পাও, প্রতিহত করো। এ সরকার বিরোধী দলের প্রতি কতখানি প্রতিহিংসাপরায়ণ তার একটি বড় উদাহরণ বেগম জিয়াকে তার ৪০ বছরের স্মৃতিবিজড়িত এবং শহীদ স্বামীর স্মৃতিমাখা বসবাসের বাড়ি থেকে সর্বোচ্চ আদালতে মামলা অনিষ্পন্ন থাকা অবস্থায় কয়েক ঘণ্টার নোটিশে জোর করে উচ্ছেদ করে। যিনি নিজে এ দেশের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, যার মরহুম স্বামী দেশের জননন্দিত রাষ্ট্রনায়ক এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার, তাকে চার দশকের বৈধভাবে বসবাস করা বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে সরকার ন্যূনতম সৌজন্য বোধটুকু দেখায়নি। বিরোধী মতের প্রতি সরকারি দলের নেতাদের অসহিষ্ণুতা এতই প্রকট যে, টেলিভিশন টাকশোতে একজন মন্ত্রী বিএনপিদলীয় একজন সাবেক মন্ত্রীকে আক্রমণে উদ্যত হয়ে গালি দিয়ে বলেন, ‘হারামজাদা! তোর চোখ তুলে নেবো।’ সরকারের দুর্নীতির সমালোচনা করায় আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে তথাকথিত আদালত অবমাননার মামলা দিয়ে ১০ মাস কারাগারে বন্দী রাখা হয়। এ সরকারের আমলে সরকারি দলের লোকদের জন্য আইনের প্রয়োগ এক রকম আর বিরোধী দলের লোকদের জন্য অন্য রকম। সরকার ক্ষমতায় এসেই প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী ও নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা সাত হাজারেরও বেশি মামলা ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অথচ একই ধরনের বিএনপি চেয়ারপারসন ও নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা প্রত্যাহার করা তো হয়নি, উল্টো তাদের বিরুদ্ধে নিত্যনতুন মামলা করা হচ্ছে। এক দিকে পুলিশের তালিকাভুক্ত দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং খুনের অভিযোগে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিকে সরকারি অনুকম্পায় জেল থেকে মুক্ত করে দেয়া হচ্ছে, অন্য দিকে বিরোধী দলের হাজার হাজার নিরপরাধ নেতাকর্মীকে মিথ্যা ও কাল্পনিক অভিযোগে কারাগার ভরে দেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনে গাড়ি পোড়ানোর একটি হাস্যকর অভিযোগ এনে (যাকে বেশির ভাগ মানুষই মিথ্যা মনে করে এবং একটি জাতীয় দৈনিকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনেও মিথ্যা বলে দেখানো হয়েছে) বিএনপি মহাসচিবসহ ১৮ দলের প্রথম সারির প্রায় ৫০ জন সিনিয়র ও বর্ষীয়ান নেতার বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে মামলা দিয়ে আরো দ্রুত তাদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। ৯ ডিসেম্বর বিরোধী জোটের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে সরকার-সমর্থক ছাত্রলীগ কর্মীরা রামদা-চাপাতি আর রড-পিস্তল নিয়ে সারা দেশে বিরোধী দলের ওপর হামলা চালায়। সিরাজগঞ্জে এক জামায়াতকর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করে। ঢাকার রাজপথে পুলিশ এবং শত শত লোকের সামনে প্রকাশ্যে নিরীহ যুবক বিশ্বজিৎকে পিটিয়ে এবং রামদা-চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। টিভি ক্যামেরায় এবং পত্রিকার ছবিতে সবাই দেখল খুনিরা ছাত্রলীগ কর্মী, কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, তারা ছাত্রলীগের কেউ নয়। অপর দিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব আরো এগিয়ে ঘোষণা করলেন, খুনিরা ছাত্রলীগের তো নয়ই, বরং তাদের জ্ঞাতি-গোষ্ঠী, বংশাবলি তদন্ত করে পাওয়া গেছে তাদের বাপ-দাদা, ভাই-চাচারা বিএনপি-জামায়াতের লোক। নিজদলীয় খুনিদের বাঁচানোর এ কী ঘৃণ্য প্রয়াস। অথচ তার বিপরীত একই দিনের সিটি করপোরেশনের একটি ময়লার গাড়ি পোড়ানোর হাস্যকর অভিযোগ তুলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ৩৮টি মামলা দায়ের করে তাকে তাৎক্ষণিক গ্রেফতার করা হয়। দু’টি মামলায় জামিন হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে নতুন করে দু’টি মামলা দিয়ে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। সরকারি দলের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ কথায় কথায় বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধী জোটনেত্রীকে গ্রেফতারের হুমকি দেন। যে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকার বিরোধী দলের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচি সহ্য করতে পারে না, বিরোধী দলের ওপর প্রতিনিয়ত দমন-পীড়ন আর হামলা-মামলা চালায়, যে দলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিরোধী দলকে উৎখাত আর প্রতিহতের ঘোষণা দেন, যে সরকারের অধীনে বিরোধী দলের দলীয় অফিস পুলিশ দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় কিংবা তালা মেরে বন্ধ করা হয়, সে সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন আদৌ সম্ভব হতে পারে না। এরূপ পরিবেশে নির্বাচন কমিশনও স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে না। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অন্যতম প্রধান শর্ত নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা এবং সক্ষমতা। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনে, সরকারের প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করার মতো যথেষ্ট স্বাধীনতা, কাগজে যা-ই থাক, বাস্তবে দেখা যায় না এবং তাই নিরপেক্ষভাবে কাজও করতে পারে না। আমরা দেখেছি, বিগত কমিশন ক্ষমতাসীন সরকারের দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। ওই কমিশন মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারের এজেন্ডা মতো দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে ভেঙে দুই ভাগ করার ষড?যন্ত্রে সরকারের সাথে সহযোগিতা করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এসেও বিগত কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে প্রার্থীদের দাবি অনুযায়ী কমিশন সেনা মোতায়েন করতে চেয়েছিল। কিন্তু সরকার সেনা মোতায়েন করেনি। কমিশনের লিখিত অনুরোধ অগ্রাহ্য করার জন্য কমিশন সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতেও পারেনি। বিগত কমিশন সরকারের ইচ্ছার বাইরে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনও অনুষ্ঠান করতে পারেনি। একবার নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে বিগত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, এবার কেউ নির্বাচন অনুষ্ঠান ঠেকাতে পারবে না। সরকারের ইঙ্গিতে নির্বাচন থেকে সরে আসতে হয়েছিল। ঢাকা সিটি করপোরেশন ভেঙে দুই টুকরো করা হলো কিন্তু নির্বাচন করা গেল না। বিগত কমিশন পারেনি, বর্তমান কমিশন এখন পর্যন্ত পারেনি। সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিবেশে এবং বিশেষভাবে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার ক্ষেত্রে আরো অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে বিভিন্ন সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান ও তাদের ব্যক্তিবর্গকে ব্যবহার করতে হয়। যেমন সিভিল প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারি-আধা সরকারি দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। এসব প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিরা সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং স্বাভাবিকভাবেই তাদের ওপর ক্ষমতাসীন সরকার ও দলের প্রভাব কার্যকর থাকে। তার ওপর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার গত চার বছরে এসব প্রতিষ্ঠানকে অত্যন্ত নগ্নভাবে দলীয়করণ করেছে। সব প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসনযন্ত্রের সর্বত্র শীর্ষস্তরসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দলীয় লোকদের দ্বারা পূর্ণ করা হয়েছে। শুধু ওপর লেভেলে মন্ত্রী, এমপিরা নয়, তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সরকারদলীয় কর্মীরা প্রশাসনের সব বিভাগ ও ক্ষেত্রের ওপর প্রচ- প্রভাব বিস্তার করে আছে। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে কিন্তু তাদের পক্ষেও সরকারদলীয় প্রভাবের বাইরে কাজ করা খুবই দুরূহ। পাবনার একজন জেলা প্রশাসক নিরপেক্ষভাবে আইন মোতাবেক নিয়োগপ্রক্রিয়া গ্রহণ করতে গিয়ে সরকারদলীয় লোকদের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে তাকে জেলা ছাড়তে হয়েছে। কোনো কোনো পুলিশ অফিসারকে আইনানুগ কাজ করতে গিয়ে সরকারদলীয় এমপি কিংবা স্থানীয় নেতাদের চড়-থাপ্পড় পর্যন্ত খেতে হয়েছে। সুতরাং নির্বাচন কমিশন চাইলেও দলীয় সরকার ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় উপরিউক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যক্তিদের দ্বারা নিরপেক্ষ নির্বাচন কোনোমতেই অনুষ্ঠান করা কমিশনের পক্ষে সম্ভব নয়। নির্বাচনকালে দুই-তিন সপ্তাহের জন্য এসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের ধারণাগতভাবে কমিশনের অধীনে ন্যস্ত করা হলেও দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলে তাদের আনুগত্যের কোনো হেরফের হবে না। দেশের রাজনীতির প্রধান দুই জোটের মধ্যে যখন একটি জোট ক্ষমতাসীন থেকে অন্য জোটভুক্ত দলের ওপর দমন-পীড়ন, হামলা-মামলা-গ্রেফতার এবং নির্মূল অভিযান চালায় এবং দেশের সব প্রতিষ্ঠান যখন সরকারের দলীয় নিয়ন্ত্রণে থাকে, তখন সব দলের জন্য সমতল ক্ষেত্র তৈরি করা আদৌ সম্ভব নয়। দলীয় সরকারের অধীনে এরূপ পরিবেশে জনগণের পক্ষে অবাধ ও ভয়মুক্ত পরিবেশে ভোটাধিকার প্রয়োগ করাও সম্ভব নয়। একমাত্র নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই উপরিউক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে সক্ষম হবে, তখন নির্বাচন কমিশনও তাদের সাহায্যে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারবে। অতএব সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এবং গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির