post

স্বদেশ নিয়ে কিছু ভাবনা

শাহাদত হোসেন

০৫ জুলাই ২০২০

বাংলাদেশের মানুষ এক চরম সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে। এই সঙ্কট একদিনে তৈরি হয়নি। বরং বলা যায় এটা দীর্ঘ দিনের ত্রুটিপূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থার ফল। রাষ্ট্রযন্ত্র ত্রুটিযুক্ত হওয়ার পিছনে যে কারণটি সবচেয়ে বেশি প্রভাবক তাহলো আওয়ামী লীগ সরকারের গণতন্ত্র হত্যা ও দাফন। ২০১৩ সালের একপক্ষীয় নির্বাচনে গলা টিপে হত্যা করা হয় গণতন্ত্রকে। আর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের প্রহসনমূলক নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে দাফন কার্য করা হয়। ১৩ সালের নির্বাচনে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল সেই জঘন্যতম হত্যার কার্য সম্পন্ন করে জনগণের অধিকার ছিনিয়ে নিলেও; এতটুকু লজ্জাবোধ তাদের মধ্যে দেখা যায়নি। বরং জনগণ এটা দেখেই আরো বেশি বিচলিত ও শঙ্কিত হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের শাসন যন্ত্রকে ত্রুটিযুক্তের পাশাপাশি স্বয়ং সরকারপ্রধান দেশের স্বার্থ বিলিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী চুক্তির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অপমানিত করছেন। যদিও এ বিষয়ে দেশে বিরোধী এক শ্রেণির সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবী সাফাই গেয়েছেন নির্লজ্জের মতো। এই চুক্তি এটিও মনে করিয়ে দেয় যে স্বদেশপ্রেমের কুলখানির আমল চলছে এখন। তবে এটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে আবরার ফরহাদ সেই দেশবিরোধী চুক্তির প্রতিবাদের জন্য শহীদ হয়েছেন। আবরার ফরহাদের মৃত্যুই আমাদের মনে করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আসলে কী বুঝায়। তাঁর ত্যাগ ও দেশপ্রেম আমাদের চেতনা জগৎ নাড়িয়ে দেয়। তাঁর প্রাণ দান মনে করিয়ে দেয় মহান মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাসের কষ্টে ও ত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা আজ আর নিরাপদ নেই। নিরাপদ নেই এদেশের মানুষ। আজ আর নিরাপদ নয় তাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। আজকে যখন দেখি বিশ্বমানবাধিকার দিবসে বিরোধী দল সমাবেশ করার অধিকার হারায়। অনুমতি চেয়েও পুলিশ অনুমতি দেয়নি। উল্টো শাসায়। তখন আমাদের দেশের গণতন্ত্র কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে তা বুঝতে বাকি থাকে না। এমনকি দীর্ঘদিনব্যাপী প্রকাশিত দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার অফিসে ঠুনকো অভিযোগে ভাঙচুর করা হলো। যা স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধার নামান্তর। এর এহেন কাজ গণতন্ত্র বিরোধী। এমন অসংখ্য উদাহরণ হাজির করা সম্ভব। যাতে দেখা যাবে দেশের মানুষ আজ কতটা গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। আর এই গণতন্ত্রের নি¤œগামিতার ফলে তা অন্য বিষয়কেও করছে আক্রান্ত। নিরাপদ নয় এদেশের ১৭ কোটি মানুষের তমদ্দুন-তাহজিব। এক ভয়াবহ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ঘিরে ফেলেছে আমাদের পুরো সমাজব্যবস্থাকে। এই সাংস্কৃতিক দেউলিয়াপনার পিছনেও রয়েছে গণতস্ত্রের কণ্ঠরোধ করার মত গর্হিত কাজ। আজকে বাংলাদেশের টেলিভিশনগুলো যে ধরনের অনুষ্ঠানগুলো উপস্থাপন করে তাতে এদেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন থাকে না। আর যাওবা থাকে তাতে সমাজ বিকৃতি ছাড়া ভালো কিছু যে আমাদের পরিচালকরা দেখতে পান না তা পানির মত স্বচ্ছ। বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের বিশ^াস ও মূল্যবোধের পরিপন্থী। আর এর সাথে অবাধে প্রবেশকৃত ভারতীয় চ্যানেলের বদলৌতে প্রাপ্ত নগ্ন ও নি¤œরুচির সংস্কৃতি গ্রাস করছে এদেশের সকল শ্রেণির মানুষকেই। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা এই অপসংস্কৃৃতির শিকারে পরিণত হচ্ছে সর্বাগ্রে। তারা ভারতীয় চ্যানেলগুলো থেকে খারাপ দিকটায় অধিকমাত্রায় গ্রহণ করছে। এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন টিনএজের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এতটায় প্রভাব বিস্তারী ভূমিকা রাখছে যে, খুব অল্প বয়সেই তারা হয়ে পড়ছে বিপথগামী। এমন এই সকল বিপথগামী পথ থেকে রক্ষার জন্যে বাবা-মায়ের যে ভূমিকা তাও খুব শিথিল হয়ে পড়েছে। ঠিক বলা যায়, তারা মিডিয়ার প্রচারে নিজেদের চিন্তাশক্তি এতটায় হারিয়ে ফেলেছেন যে, কোনটা উচিত আর কোনটা উচিত নয়? কোনটি সমাজগর্হিত কিংবা সমাজে প্রশংসিত তাও ভুলে বসে আছেন। এখানে আমার একটি ব্যক্তিগত কথা শেয়ার না করে পারলাম না। আমি একটা কোচিংয়ে ক্লাস নিতাম। সেই কোচিং পরিচালক প্রায় প্রতি মাসে অভিভাবক সমাবেশ আয়োজন করতেন। এমন এক সমাবেশে একজন ছাত্রের মা এসে আমাকে বললেন, ‘স্যার, আমার ছেলেকে একটু বেশি করে পড়া দিবেন। ও চাপ ছাড়া পড়তে চায় না। অবশ্য আমি পাশে বসে থাকলে পড়ে। তবে, সিরিয়াল দেখার কারণে সময় দিনে পারি না।’ এই কথা শোনার পর নেপোলিয়ানের করুণ মুখ ভেসে উঠেছিলো আমার সামনে। আমি মনে মনে ভেবেছিলাম নেপোলিয়ান যদি কাণ্ডজ্ঞানহীন এই বাংলাদেশি মাকে দেখতেন, তাহলে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলতেন। অথবা বলতেন বাংলাদেশকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের তাঁবেদারে রাখতে আর কিছু দরকার নেই। কারণে তারা ঘরে ঘরে এমন স্থূল চিন্তার অনেক মাকেই তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। শুধু যে, মায়েদের চিন্তার দৈন্যতা চরমে। আর পিতৃকুল মহাজ্ঞানী এমনটি কিন্তু নয়। আমাদের পিতৃকুলের অবস্থা আরো করুণ। এটা ঠিক যে তাদের পেশাগত কারণে হয়তো সিরিয়ালের মত বস্তাপচা জিনিস উপভোগের সময় পান না। তাই বলে যে ছেলেমেয়েকে আদর্শবান রূপে গড়ে তুলতে তারা মহৎ ভূমিকা পালন করেন, এমনটি খুব কম পাওয়া যাবে। যা উদাহরণ জুটবে তাতে গুনতে কর গনা লাগবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের অধিকাংশ পিতায় সন্তানকে ক্লাসের বাইরে বই কিনে দিতে নারাজ। এমনকি তারা বছরে বারো মাসে ভুল করেও কোন মহৎ ব্যক্তির জীবনী কিনে দেন কি না তা বলা দুষ্কর। আর আমাদের দেশের হলুদ সাংবাদিকতা এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে যে, অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানকে পবিত্র আল কোরআন পড়তে দিতেও শঙ্কিত হন। তাদের সংশয়যুক্ত মনে আধুনিকতার নতুন এক বিষবৃক্ষ লালন করছে। যে বিষবৃক্ষ ধ্বংস করছে আগামীর বাংলাদেশের নেতৃত্বদানকারী প্রজন্মকে। এই ধ্বংসপ্রক্রিয়াকে বেগবান করতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন কতিপয় রামপন্থী বৃদ্ধিজীবী। যারা বাংলাদেশে থেকেও আগ্রাসী দেশের দোসর হিসাবে কাজ করছে। আর পুরো বিষয়টাকে এককেন্দ্রিক করে আমাদের দেশের স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে পতিত করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের মতো স্পর্শকাতর ঘটনাকে। যদিও সাধারণ জনগণের বুঝতে বাকি নেই যে, আসলে ‘স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি’ বাচক শব্দটি ভারতীয় আগ্রাসনের দোসর শব্দ হয়ে উঠেছে। তবে এই সকল বিতর্কের মধ্যেও আশার দিক হলো একশ্রেণির দেশপ্রেমিক প্রজন্ম এগিয়ে আসছে এদেশের পতাকাকে হাতের মুঠে ধরে রাখতে। যাদের হৃদয়ের অলিন্দে দেশপ্রেমের খুশবু টগবগ করছে। আর তার প্রমাণ জ্বলজ্বল করছে আমাদের চোখের সামনে। যখনি দেখি ন্যায্য দাবি নিয়ে কোন প্রকার রাজনৈতিক ব্যানার ছাড়াই সাধারণ ছাত্রছাত্রী নাস্তায় নেমে পড়ে। প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে দেশের পক্ষে শ্লোগান তুলে। তারা চায় সত্যিকারের গণতন্ত্র। চায় গণমানুষের নির্বিঘেœ বেঁচে থাকার অধিকার। আর এই সকল তরুণই আমাদের স্বদেশকে উপস্থাপন করবে বিশে^র দরবারে বাস্তবিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে। লেখক : প্রাবন্ধিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির