post

১১

সায়ীদ মোস্তাফিজ

২৪ মে ২০২২

=খুব নির্দয় এবং উগ্র ছিল আরবরা। এতটাই কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল যে- কন্যাসন্তানকে হত্যা করতো শুধুমাত্র সামাজিক সম্মান রক্ষার্থে। কারণ নারীরা সে সময় শুধুমাত্র ভোগ্যবস্তু হিসেবে বিবেচিত হতো। মানুষ হিসেবে নারীর ছিল না কোনো সম্মান, স্বীকৃতি। জান-মাল ইজ্জত আবরুর নিরাপত্তা ছিল না কোথাও। সামান্য বিষয়ের জের ধরে বছরের পর বছর চলতো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। গোত্রীয় দ্বন্দ্বের কাছে ভূলুণ্ঠিত হতো ন্যায়বিচার, সুশাসন। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে এক পরশপাথরের সন্ধান পেলেন মানবতার চিন্তায় নিমগ্ন মানবতার বন্ধু হজরত মুহাম্মাদ সা.। যে পরশপাথরের ছোঁয়া সভ্যতায় ভব্যতায় নাদান এক জাতিকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করল। প্রতিষ্ঠিত হলো নারীর মর্যাদা, অধিকার। প্রতিষ্ঠিত হলো সুশাসন, ন্যায়বিচার। যারা কিনা কথায় কথায় একে অন্যের মুণ্ডু আলাদা করে ফেলতেন কালের পরিক্রমায় তারাই নিজেদের মধ্যে অনুকরণীয়, অনুসরণীয় ভ্রাতৃত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। সেই পরশপাথরটি ছিল মহাগ্রন্থ আল কুরআন এবং এর বাহক ছিলেন মুহাম¥দ সা.। যেখানে মুহাম¥দ সা.-এর অনুপম চরিত্রই ছিল একটি জীবন্ত কুরআনের নির্ভুল চিত্র। যে চিত্রের মুগ্ধতায় মাতোয়ারা হয়েছিল পুরো দুনিয়া। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ব্যাপারে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের চ্যালেঞ্জ হলো; ‘এই সেই কিতাব, যেখানে কোনো সন্দেহ নেই।’ (সূরা বাকারা : ২) সুবহান আল্লাহ, পৃথিবীর কোনো গ্রন্থকারের পক্ষে কি এমন চ্যালেঞ্জ দেয়ার সাধ্য থাকতে পারে! এমন স্পষ্ট ঘোষণার পরও জাহিলদের অপপ্রয়াস চলেছে একে মিথ্যে প্রতিপন্ন করার। কুরআনকে মুহাম্মদ সা.-এর নিজস্ব রচনা বলার চেষ্টা করেছে কেউ। কেউবা ছন্দে অলঙ্কারে কবিতা হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে আল্লাহর বাণীকে এবং এর থেকে ভালো কিছু রচনা করার মিথ্যে অহমিকা দেখাতেও পিছপা হয়নি। প্রত্যেক ক্ষেত্রে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন চ্যালেঞ্জসহ দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছেন। তবুও আবু জাহেলদের উত্তরসূরিরা বারবার একই ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। এই সময়ে এসেও ঐতিহাসিক বিশুদ্ধতা, বৈজ্ঞানিক সঙ্গতি, সামাজিক রীতিনীতি নিয়ে আল-কুরআনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এক্ষেত্রে অবশ্য নিরপেক্ষ মন নিয়ে অধ্যয়নকারী হাজার হাজার কৌতূহলী অবশেষে হেদায়াতের শীতলতায় জুড়িয়েছেন হৃদয়। আবার পক্ষপাতদুষ্ট সঙ্কীর্ণতায় অনেক পথভ্রষ্টের বদ্ধ দুয়ার বদ্ধই রয়ে গেছে আজীবন। লেখনী, বক্তব্য এবং কার্যক্রমে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে বিরুদ্ধাচরণ করেই চলেছে অবিরত। এ ব্যাপারে আল্লাহর ঘোষণা হলো- “এ লোকেরা তাদের মুখের ফুৎকারেই আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়; অথচ আল্লাহ তার এই নূরকে পরিপূর্ণ করে দিতে চান। কাফেররা তাকে যতই অপছন্দ করুক না কেন!” (সূরা সফ : ৮) সম্প্রতি ১১ মার্চ কলকাতার সুপ্রিম কোর্টে শিয়া ওয়াকফ বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াসিম রিজভী কুরআনের ২৬টি আয়াতের ব্যাপারে একটি রিট দায়ের করে। যেখানে তার অভিযোগ ছিল এসব আয়াত পরবর্তীতে খলিফারা সংযোজন করেছেন নিজেদের স্বার্থে, যা সন্ত্রাসকে উসকে দেয়। এই সংবাদ মুসলিমবিশ^কে বেশ আহত করে। ফলে সারাবিশে^ প্রতিবাদ হয়েছে এবং হচ্ছে। এটি ইসলামবিদ্বেষীদের এজেন্ডা ছাড়া কিছুই নয়। উপমহাদেশে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে ফায়দা লুটার ষড়যন্ত্র। ইতোমধ্যেই জনগণের হাতে চরমভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে ওয়াসিম রিজভী। যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যুগে যুগে জালিমরা এভাবেই অপমানিত হয়ে থাকে। আশা করা যায় অনতিবিলম্বে রিটটি খারিজ করে এই কুলাঙ্গারকে কুরআন অবমাননার দায়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হবে। কুরআন অবমাননার এই ঘটনা ভারতে প্রথম নয়। ১৯৮৫ সালের ১০ এপ্রিল দুইজন উগ্রবাদী হিন্দু পদ্মমল চোপড়া ও শীতল শিং ভারতের হাইকোর্টে কুরআনের সূরা বাকারার ১৯১ নম্বর এবং সূরা তওবার ৩১ নম্বর আয়াত দুটির বিরুদ্ধে রিট আবেদন করে। তাদের অভিযোগ ছিল এসব আয়াতে মুশরিকদের হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করবে এবং এজন্য কুরআনের আরবী ও অনুবাদ সকল কপি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার স্পষ্ট অভিযোগকে প্রশ্রয় না দিয়ে বিষয়টিকে এখানেই শেষ করে ফেলতে পারতো কলকাতার হাইকোর্ট। কিন্তু ইসলামের দুশমনদের এক গোয়ালেই বসবাস! মিসেস পদ্মা খাস্তগীর রিটটি গ্রহণ করে ইতিহাসের জঘন্যতম উদাহরণের জন্ম দিল। ধীরে ধীরে কলকাতার গণ্ডি পেরিয়ে বিষয়টি পুরো পৃথিবী জানতে পারল। এমন নজিরবিহীন রিটে হতবাক মুসলিম বিশ্ব! মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের অবমাননায় হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হলো মুমিনদের। কলকাতাসহ সারা দুনিয়ার মুসলিমরা ফেটে পড়লেন ক্ষোভে। তৌহিদি জনতাকে সাথে নিয়ে ১০ মে বাদ জুমা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করে ইসলামী ছাত্রশিবির। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে ভারতপ্রেমে অন্ধ তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের প্রশাসন মুসলিমদের আবেগকে ন্যূনতম সম্মান না দেখিয়ে লাঠিচার্জ করে মুসল্লিদের উপর। তবুও প্রতিবাদ থেমে থাকে না। বিভাগীয় শহর, জেলা শহরে মিছিল হয়। গ্রাম-গঞ্জের মানুষও ফেটে পড়েন প্রতিবাদে। সর্ব পশ্চিমের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি প্রতিবাদ কমিটি গঠন করা হয়। এর নেতৃত্ব দেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ আলিয়া মাদরাসার তৎকালীন অধ্যক্ষ মাওলানা হোসাইন আহমেদ। ১১ মে প্রতিবাদ সমাবেশের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। লিফলেট বানিয়ে চালানো হয় প্রচারণা। ইসলামী ছাত্রশিবিরের ভাইয়েরা এর দাওয়াত ছড়িয়ে দেন পাড়া-মহল্লায়, স্কুল-কলেজে, হাটে-ঘাটে সর্বত্র। কিন্তু সমাবেশ শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে আয়োজকদের জরুরি তলব করে এসপি। সমাবেশ না করার মর্মে জোরপূর্বক স্বাক্ষর আদায় করে। জারি হয় ১৪৪ ধারা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিংয়ের মাধ্যমে সমাবেশ না হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে সবার কাছে এ খবর পৌঁছে না। দূর-দূরান্ত থেকে আগত সকল শ্রেণী পেশার মানুষ চাঁপাইনবাবগঞ্জের সেই ঐতিহাসিক নিমতলা ঈদগাহ ময়দানে সমবেত হতে থাকেন। প্রশাসন এই জমায়েত টের পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। গালিগালাজ করে তৌহিদি জনতাকে ফিরে যেতে বলে। নেতৃস্থানীয় আলেমরা শুধুমাত্র দোয়া করে চলে যাওয়ার অনুমতি চান। সেই দিনের ঘাতক ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লা দেয় না সেই অনুমতিটুকুও। এতে আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে জনতা। ভারতবিরোধী স্লোগান দিতে থাকে। নির্দয় ম্যাজিস্ট্রেট গুলি চালানোর নির্দেশ দেয় পুলিশকে। এক নাগাড়ে পনেরো মিনিট গুলি চলে। রক্তাক্ত হয়ে ওঠে ঈদগাহ ময়দান ও পাশের রাস্তা। কুরআনের মর্যাদা রক্ষায় শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন আটজন ভাই। আহত হন অর্ধশতাধিক। কুরআনের জন্য জীবন দানের অসীম তৃষ্ণায় সেদিন ছুটে এসেছিলেন দশম শ্রেণীর ছাত্র সংগঠনের কর্মী ভাই আব্দুল মতিন, দশম শ্রেণীর ছাত্র শহীদ রাশিদুল ইসলাম (কর্মী), অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র শহীদ সেলিম উদ্দিন (কর্মী), অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র শহীদ শীষ মোহাম¥দ (কর্মী), ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র শহীদ শাহাবুদ্দিন (সমর্থক), শহীদ আলতাফুর রহমান সবুর (কৃষক), শহীদ মোক্তার হোসেন (রিকশাচালক) এবং শহীদ নজরুল ইসলাম (রেলশ্রমিক)। এ ঘটনায় সারা বিশ্বের তীব্র নিন্দা ও চাপের মুখে বিতর্কিত রিটটি খারিজ করতে বাধ্য হয় ভারত। অথচ বাংলাদেশে পদোন্নতি পায় ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লা! কুরআনের জন্য জীবন দিলেন যারা তারা তো পেলেন অমরত্বের স্বাদ! কতই না সৌভাগ্যবান সেদিনের শহীদেরা! “আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না, এসব লোক প্রকৃতপক্ষে জীবন্ত; কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তোমাদের কোনো চেতনা হয় না।” (সূরা বাকারা : ১৫৪) ১১ মে কুরআনের জন্য জীবন দানের এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে দিনটিকে কুরআন দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বারবার কুরআনের আলোয় আলোকিত হওয়ার আহ্বান নিয়ে ফিরে আসে ১১ মে। শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত করে হাজারও রাশেদুলকে, শহীদ শাহাবুদ্দিন যাদের জীবন দানের প্রেরণা জোগায়। কুরআনের মর্যাদা রক্ষায় যে জমিন শহীদের পবিত্র রক্তে রঞ্জিত হয়েছে সেই জমিনে কুরআন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বিজয়ী হবেই হবে। ইনশাআল্লাহ। লেখক : প্রাবন্ধিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির