post

ইসলামী জীবনব্যবস্থায় রাষ্ট্র আল্লামা

ড. ইউসুফ আল কারযাভী

১৩ এপ্রিল ২০২২

অনুবাদ : সালমান খাঁ

ইসলামী জীবনব্যবস্থায় রাষ্ট্র একটি অপরিহার্য বিষয়। তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে এ কথার স্বপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করা যায়। তা হলো- (১) কুরআন ও সুন্নাহর নুসুসের আলোকে ইসলামী জীবনব্যবস্থায় রাষ্ট্র; (২) ইসলামী ইতিহাসের আলোকে ইসলামী জীবনব্যবস্থায় রাষ্ট্র এবং (৩) ইসলামের প্রকৃতিগত চাহিদাই হচ্ছে তার একটি রাষ্ট্র থাকবে।
কুরআন ও সুন্নাহর নুসুসের আলোকে ইসলামী জীবনব্যবস্থায় রাষ্ট্র
কুরআন ও সুন্নাহর নুসুসে ইসলামী রাষ্ট্রকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা বোঝার জন্য এই দুটি আয়াতই আমাদের জন্য যথেষ্ট হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, আমানত তার মালিককে ফিরিয়ে দিবে। আর যখন তোমরা মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে উপদেশ দেন, তা কতই না উৎকৃষ্ট। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। হে ঈমানদারগণ, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করো, তাহলে তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, রাসূলের আনুগত্য করো এবং আনুগত্য করো তোমাদের নেতৃবর্গের। আর যদি কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতবিরোধ ঘটে, তাহলে সে বিষয়কে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। এটিই হলো উত্তম এবং পরিণামের দিক থেকে প্রকৃষ্টতর।” (সূরা নিসা : ৫৮,৫৯)
প্রথম আয়াতে শাসক ও দায়িত্বশীলদের সম্বোধন করে আদেশ করা হচ্ছে, তারা যেন আমানত রক্ষা করে এবং আদালতের সাথে বিচার-ফয়সালা করে। কারণ, আমানত ও আদালত বিনষ্ট হওয়ার মানে হচ্ছে গোটা উম্মাহ ও জগতের ধ্বংসের সতর্কবাণী উচ্চারিত হওয়া। সহিহ বুখারিতে এসেছে, রাসূল সা. বলেছেন- “যখন আমানত নষ্ট করা হবে, তখন তোমরা কিয়ামতের জন্য অপেক্ষা করো।” (বুখারি-৫৯, মুসনাদে আহমাদ-৮৭২৯)
আর দ্বিতীয় আয়াতে মুমিন প্রজাদের সম্বোধন করা বলা হচ্ছে, তারা যেন তাদের ‘উলুল আমর’ তথা শাসক ও দায়িত্বশীলদের আনুগত্য করে। আয়াতে বর্ণিত ‘মিনহুম’ শব্দ দিয়ে শর্তারোপ করা হচ্ছে যে, এই শাসকরা অবশ্যই তাদের মধ্য থেকে (অর্থাৎ মুমিন প্রজাদের মধ্য থেকে এবং তাদের মাধ্যমেই নির্বাচিত) হতে হবে। এই আয়াতে, শাসকদের আনুগত্যকে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের পর স্থান দেওয়া হয়েছে। আরও বলা হচ্ছে, কোনো বিষয়ে বিরোধ দেখা দিলে তা যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরানো হয়।
এই আয়াতদ্বয় আমাদের নির্দেশনা দিচ্ছে যে, মুসলমানদের অবশ্যই এমন একটি শাসনকারী রাষ্ট্র থাকবে, যার আনুগত্য করা হবে এবং যাকে মেনে চলা হবে। অন্যথায়, এ আয়াততো নিছক অনর্থক কথাই মনে হবে।
এই দুই আয়াতের ওপর ভিত্তি করেই শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া রাহি. রচনা করেন তাঁর মশহুর কিতাব ‘আস সিয়াসাতুশ শারয়িয়্যাহ ফি ইসলাহির রায়ি ওয়ার রায়িয়্যাহ’ বা ‘শরিয়তি রাষ্ট্রব্যবস্থা’।
এ ছাড়াও, কুরআনুল কারিমে আরও বহু আয়াত আছে যা সমাজ, অর্থনীতি, জিহাদ ও রাজনীতি প্রসঙ্গে আলোকপাত করে। এ আয়াতগুলো তো নিত্যই পঠিত হচ্ছে এবং এগুলো ‘আয়াতুল আহকাম’ অভিধায় সবার কাছে পরিচিত। আহকামুল কুরআন বিষয়ক গ্রন্থপ্রণেতা স্কলাররা এ আয়াতগুলোর ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, আর রাযি আল জাসসাস আল হানাফি (মৃত্যু ৩৭০ খ্রিস্টাব্দ) এবং ইবনুল আরাবি আল মালিকির (মৃত্যু ৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ) কথা বলা যায়।
এবার সুন্নাহর দিকে চোখ ফিরানো যাক। রাসূল সা. বলেছেন- “কেউ যদি এমন অবস্থায় মারা যায় যে, তার গলায় বাইয়াতের রশি নেই; সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করবে।” (মুসলিম-১৮৫১)
নিশ্চয়ই একজন মুসলমান তো এমন কোনো শাসক বা নেতার হাতে বাইয়াত করতে পারে না, যে শাসক বা নেতা ইসলামের আনুগত্য করে না। এ ধরনের নেতার আনুগত্য করা তো মুসলমানদের জন্য হারাম। কেবল আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসনকারী শাসক বা নেতার হাতে বাইয়াতের মাধ্যমেই মুসলমানরা এই পাপ থেকে বাঁচতে পারে। তাই, যতক্ষণ না ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এবং মুসলমানরা এই কাক্সিক্ষত বাইয়াত না নিতে পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা এই পাপের ভাগীদার হিসেবেই বিবেচিত হতে থাকবে। এই পাপ থেকে বাঁচার মাত্র দুইটি পন্থাই আছে-
১. নাকোচ করা, ঘৃণা করা। প্রতিষ্ঠিত এই ইসলাম বিরোধী শাসনব্যবস্থাকে অন্তত অন্তর দিয়ে হলেও ঘৃণা করতে হবে।
২. ইসলামী হুকুমতের আলোকে পরিচালিত জীবনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
এছাড়াও, সুন্নাহর বিভিন্ন কিতাবে শত শত না হলেও ডজন ডজন হাদিস এসেছে খিলাফত, ইমারত, বিচার-ফয়সালা নিয়ে। এসব হাদিসে আরও আলোচনা করা হয়েছে শাসকদের গুণাবলি, সৎকাজে তাদের সহযোগিতা ও সমর্থন, পছন্দ ও অপছন্দ সবসময়ই তাদের আনুগত্য ও কল্যাণ কামনা করা ও তাদের কার্যকলাপের ব্যাপারে ধৈর্য ধরা, এই আনুগত্য ও ধৈর্যের পরিধিসহ তাদের যাবতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে। শাসকদের দায়িত্বের মাঝে রয়েছে- আল্লাহর হদগুলো বাস্তবায়ন করা, মানুষের অধিকারগুলো রক্ষা করা, আহলুর রায়দের সাথে শুরা বা পরামর্শের মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিষয়াদি পরিচালনা করা, সামর্থ্যবান ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়া, সৎ সহচর ও সহযোগী গ্রহণ করা, নামাজ কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধসহ শাসন, প্রশাসন ও রাজনীতির আরও বিভিন্ন বিষয়াদি।
এ কারণেই আমরা তাফসির ও হাদিসের ব্যাখ্যা গ্রন্থগুলোতেও খিলাফত ও ইমামতের আলোচনা দেখতে পাই। আকিদা, উসুলুদ দ্বীন, ফিকাহর কিতাবেও এই সম্পর্কিত আলোচনা এসেছে। এছাড়াও, রাজনীতি, সংবিধান, প্রশাসন, অর্থনীতিসহ রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়াদিতে স্বতন্ত্র গ্রন্থও রচিত হয়েছে বহু। উদাহরণস্বরূপ আল মাওয়ারদির ‘আল আহকামুস সুলতানিয়া’, আবু ইয়ালার ‘আল আহকামুস সুলতানিয়া’, ইমামুল হারামাইন আবুল মায়ালি আল জুয়াইনির ‘আল গিয়াসি’ এবং শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়ার ‘আস সিয়াসাতুশ শারিয়াহ’ এর কথা বলা যায়।
ইসলামী ইতিহাসের আলোকে ইসলামী জীবনব্যবস্থায় রাষ্ট্র
ইসলামী ইতিহাস আমাদেরকে বলছে, রাসূল সা. ওহির হিদায়াতের মাধ্যমে পরিচালিত একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মকভাবে কাজ করে গেছেন। এই রাষ্ট্র হবে ইসলামী দাওয়াতের রাষ্ট্র, মুসলমানদের রাষ্ট্র; এখানে কারো কর্তৃত্ব চলবে না, কর্তৃত্ব চলবে কেবলই ইসলামী শরিয়তের। রাসূল সা. এই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মানসে নিজেকে বিভিন্ন কবিলার সামনে উপস্থাপন করা শুরু করেন, যাতে তারা তাঁকে এবং তাঁর দাওয়াতের রক্ষক হিসেবে কাজ করে। অবশেষে, আল্লাহ তায়ালা আওস ও খাজরায কবিলাকে রাসূল সা.-এর দাওয়াতের ওপর ঈমান আনার তাওফিক দেন। তারা রাসূল সা.-কে রক্ষা ও সহযোগিতা করার শপথ করে। রাসূল সা. তাদের কাছে মুসয়াব ইবনু উমাইর রা.-কে পাঠান, যাতে তিনি তাদের কাছে কুরআন তিলওয়াত করে শুনাতে পারেন এবং ইসলাম শিখাতে পারেন। মদিনায় যখন আওস ও খাজরাযের মাঝে ইসলাম প্রসার ঘটতে শুরু করে, তখন ৭৩ জন সদস্যের নর-নারীর একটি প্রতিনিধিদল হজ্জের মওসুমে রাসূল সা.-এর কাছে আসেন। তারা রাসূল সা.-কাছে এই মর্মে বাইয়াত করেন যে, “তারা নিজেদেরকে, নিজেদের স্ত্রী ও সন্তানদের যেভাবে রক্ষা করে মুহাম্মাদ সা.-কে সেভাবেও রক্ষা করবে; তাঁর কথা শুনবে এবং মেনে চলবে; সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে মানুষকে নিষেধ করবে।”
তাদের এ আশ্বাস পেয়ে রাসূল সা. মদিনায় হিজরত করেন। রাসূল সা. এই হিজরত তো ছিল এমন এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ইসলামী সমাজ গড়ার পদক্ষেপ, যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ইসলামী রাষ্ট্র।
মদিনা ছিল ‘দারুল ইসলাম’ ও নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের মূল ঘাঁটি। এ রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন নবী মুহাম্মাদ সা.। তিনি যেমন ছিলেন নবী ও আল্লাহর রাসূল, তেমনি ছিলেন মুসলমানদের নেতা ও ইমাম। এ কারণেই ফকিহরা রাসূল সা. এর কার্যক্রমকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি যা যা করেছেন। ফকিহরা এর ওপর ভিত্তি করে বহু আহকামও বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহর দ্বীন ইসলামকে কবুল করে নেয়া প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর এই রাষ্ট্রে যোগ দেওয়া, এর শক্তি বৃদ্ধি করা এবং পতাকাতলে জিহাদে শরিক হওয়া ছিল ফরজ। বিধান ছিল, ইসলামের প্রতি শত্রুতা পোষণকারী দারুল কুফর থেকে বের হয়ে দারুল ইসলাম মদিনায় হিজরত করা এবং গোটা বিশ্বকে এক কেন্দ্র থেকে মোকাবেলা করা ঈমানদার মুজাহিদদের জামাতে শরিক হওয়া ছাড়া কারো ঈমান পূর্ণতা পেতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- “আর যারা ঈমান এনেছে; কিন্তু হিজরত করেনি, তারা হিজরত না করা পর্যন্ত তাদের অভিভাবকত্বের কোনো দায়িত্ব তোমাদের নেই।” (সূরা আনফাল : ৭২)
আল কুরআনুল কারিম তাদের তীব্র সমালোচনা করেছে, যারা দ্বীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন না করত স্বেচ্ছায় দারুল কুফর ও দারুল হারবে বসবাস করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- “যারা নিজেদের ওপর জুলম করে, তাদের প্রাণ-হরণের সময় ফিরিশতাগণ বলে, ‘তোমরা কি অবস্থায় ছিলে?’ তারা বলে, ‘দুনিয়ায় আমরা অসহায় ছিলাম।’ তারা বলে, ‘তোমরা নিজ দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে বসবাস করতে পারতে, আল্লাহর দুনিয়া কি এমন প্রশস্ত ছিল না?’ এদেরই আবাসস্থল জাহান্নাম। আর তা কত নিকৃষ্ট আবাস। তবে যেসব অসহায় পুরুষ, নারী ও শিশু কোনো উপায় অবলম্বন করতে পারে না এবং কোনো পথও পায় না (তাদের কথা ভিন্ন)। আল্লাহ হয়ত তাদেরকে ক্ষমা করবেন এবং আল্লাহ মার্জনাকারী, পরম ক্ষমাশীল।” (সূরা নিসা : ৯৭-৯৯)
রাসূল সা.-এর ওফাতের পর সাহাবিদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি ছিল, তা হচ্ছে নিজেদের জন্য একজন ইমাম নির্ধারণ করা। এমনকি তারা এই ইমাম নির্বাচনকে তাঁর কাফন দাফনের ওপর প্রাধান্য দিয়েছিল। প্রথমত তারা আবু বকর রা.-এর হাতে বাইয়াত করে তাকে রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয় এবং তারপরই রাসূল সা.-এর দাফনকার্য সমাধান করেন। এভাবে, এরপর থেকে প্রতিটি যুগেই ইমাম নির্ধারণের এই ব্যাপারটি চলে আসছে। তাই, সাহাবি ও তাবেয়িদের যুগ থেকে চলে আসা ইসলামী ইতিহাস কর্তৃক প্রমাণিত এই ইজমার ভিত্তিতেই আমাদের ওলামারা রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনকে আবশ্যক জ্ঞান করেন। কারণ, রাষ্ট্রপ্রধানই হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রধান শিরোনাম ও মূল ভিত্তি।
ইসলামের প্রকৃতিগত চাহিদাই হচ্ছে তার একটি রাষ্ট্র থাকবে
ইসলাম হচ্ছে ব্যাপকতার ধারণা লালনকারী একটি দ্বীন, জীবনব্যবস্থা ও পূর্ণাঙ্গ শরিয়ত। এই পূর্ণাঙ্গ শরিয়ত দুনিয়া ও আখিরাত, ব্যক্তি ও সমাজ সবকিছু নিয়েই কথা বলে। এই শরিয়তের তবিয়তই হচ্ছে, মানবজীবনের সকল দিক ও বিভাগ নিয়ে কথা বলা, সেগুলোর সংশোধন ও উন্নয়ন সাধনকল্পে বিধান প্রণয়ন করা ও উপদেশ দেওয়া। আর মানবজীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগের ব্যাপারে বিধান প্রণয়ন ও উপদেশ দেওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে রাষ্ট্র। তাই, ইসলাম কোনোভাবেই সমাজ ও রাষ্ট্রের বিষয়টিকে অবহেলা করতে পারে না এবং এগুলোর ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব এমন লোকের হাতে ছেড়ে দিতে পারে না, যারা মানবজীবনের সংশোধনকামী ইসলামী রিসালাতের দাওয়াতে বিশ্বাস করে না কিংবা আইন-কানুন প্রশাসন থেকেই আল্লাহর দ্বীন ইসলামকে বাদ দিতে চায়।
ইসলাম এমন একটি দ্বীন যার তবিয়তই হচ্ছে, সে সকল বিষয়ে শৃঙ্খলা ও দায়িত্বানুভূতি চায় এবং বিশৃঙ্খলা ও গণ্ডগোল অপছন্দ করে। এমনকি নামাজের ক্ষেত্রেও আমরা এই শৃঙ্খলার নজির দেখতে পাই। নামাজের ক্ষেত্রে আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে, কাতারগুলো সোজা রাখতে, সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিকে ইমামতির জন্য সামনে এগিয়ে দিতে। এমনকি সফরের ক্ষেত্রেও বলা হয়েছে- “তোমাদের কোনো একজনকে আমির বানিয়ে নাও।”
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া রাহি. তাঁর মশহুর কিতাব “আস সিয়াসাতুশ শারিয়াহ”তে বলেন- “জ্ঞাতব্য যে, মানুষের শাসনভার ও নেতৃত্ব (অর্থাৎ রাষ্ট্র) দ্বীনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব। বরং বলা চলে, এই রাষ্ট্র ছাড়া তো মানুষের দ্বীন ও দুনিয়া কোনোটাই ঠিকভাবে চলতে পারবে না। মানুষ তাদের পারস্পরিক প্রয়োজন পূরণের জন্য একজন অপরজনের মুখাপেক্ষী। তাই, তাদের একটি সমাজ দরকার। আর সমাজের একটি মাথা (অর্থাৎ নেতা) দরকার। এ কারণেই নবী সা. বলেছেন- ‘তিনজন সফরে বের হলেও যেকোনো একজনকে আমির বানিয়ে নিবে।’ আবদুল্লাহ ইবনু ওমর রা. থেকে ইমাম আহমাদ রাহি. বর্ণনা করেন- ‘তিনজন যদি কোনো ভূখণ্ডে অবস্থান করে, তাহলে তাদের একজন ‘আমির’ বা নেতা না থাকাটা অবৈধ।’
অতএব, ইসলাম সফরের মতো ছোট্ট একটি সংঘবদ্ধতাতেও কোনো একজনকে আমির বানানো আবশ্যক করে দিয়েছে। এর মাধ্যমে মূলত অন্যান্য আর যত সংঘবদ্ধতা আছে, সেগুলোর ক্ষেত্রেও যে আমির থাকা আবশ্যক; সেই ব্যাপারেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের ওপর সৎকাজের আদেশ করা এবং অসৎ কাজে নিষেধ করাকে আবশ্যক করে দিয়েছেন। আর, এই সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ কোনোভাবেই শক্তি ও শাসনক্ষমতা ছাড়া বাস্তবায়ন করা যাবে না। এছাড়াও জিহাদ, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, হজ্জ, জুমা ও ঈদের নামাজ কায়েম করা, মযলুমদের সহযোগিতা করা এবং হুদুদ প্রতিষ্ঠাসহ আল্লাহ তায়ালা যা কিছু ফরজ করেছেন; তার কোনো কিছুই শক্তি ও শাসনক্ষমতা ছাড়া বাস্তবায়ন করা যাবে না। এ কারণেই বর্ণিত হয়েছে- ‘সুলতান হচ্ছে যমিনে আল্লাহ তায়ালার ছায়া।’
ফুযাইল ইবনু ইয়ায এবং আহমাদ ইবনু হাম্বলসহ আরও অনেক সালাফরা বলতেন- ‘আমাদের যদি একটিমাত্র কবুলযোগ্য দোয়া থাকত, তাহলে এই দোয়াটি আমরা সুলতানের জন্যই করতাম।’ (মাজমাউল ফাতাওয়া : খণ্ড ২৮, পৃষ্ঠা ৩৯০-৩৯১)
কারণ সুলতানের সংশোধনের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বহুলোকের সংশোধন করান। তারপর কথা হচ্ছে, ইসলাম যেহেতু একটি জীবনব্যবস্থা; তাই এর তবিয়তই হচ্ছে, সে মানুষের জীবনের ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দিতে চায়, সমাজকে পরিচালনা করতে চায় এবং মানুষের আচার-আচরণকে আল্লাহর বিধানের আলোকে সাজাতে চায়। আর ইসলাম এক্ষেত্রে কেবল ওয়াজ, নসিহত কিংবা পরামর্শ দিয়েই বসে থাকাকে যথেষ্ট মনে করে না। মানবজীবনের বিবিধক্ষেত্রে ইসলাম তার প্রণীত বিধান, অসিয়ত ও শিক্ষাগুলোকে কেবল মানুষের অন্তরের ওপর ছেড়ে দেইনি। এমনটি হলে তো মানুষের অন্তর মারা গেলে, এর সাথে সাথে এই বিধান, অসিয়ত ও শিক্ষাগুলোও রহিত হয়ে যাবে। অথচ, আমরা দেখি, তৃতীয় খলিফা উসমান রা. বলেছেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সুলতানের মাধ্যমে এমন কিছু বাধা প্রদান করান, যা কুরআন দিয়ে হয় না।” (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ২/১০)
মানুষের মাঝে কিছু লোক তো এমন আছে, যারা কুরআন ও মিযানের মাধ্যমেই সোজা পথে চলে; আবার কিছু লোক এমন আছে, যাদেরকে কেবল আইন আর দণ্ডই ঠিক করতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- “নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সঙ্গে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও তুলাদণ্ড (ন্যায়-নীতি); যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি লোহা অবতীর্ণ করেছি; যাতে রয়েছে প্রচণ্ড শক্তি ও রয়েছে মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ।” (সূরা হাদিদ : ২৫)
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া রাহি. বলেন- “যারা কিতাব থেকে সরে গেছে, দণ্ডের মাধ্যমে তাদের ঠিক করা হবে। আর এ কারণেই (বলা হয়), দ্বীনের স্থিরতা মুসহাফ (কুরআন) আর সাইফের (তরবারির) ওপর।” (মাজমাউল ফাতাওয়া : ২৮/২৬৪)
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম আবু হামিদ আল গাজ্জালি রাহি. বলেন- “দুনিয়া হচ্ছে আখিরাতের শস্যক্ষেত্র। দ্বীন ছাড়া দুনিয়া পূর্ণতা পেতে পারে না। ক্ষমতা আর দ্বীন হচ্ছে একটি জোড়া। এর মাঝে, দ্বীন হচ্ছে মূলভিত্তি আর সুলতান হচ্ছেন তার প্রহরী বা রক্ষাকর্তা। যার মূলভিত্তি নেই, তা তো ধ্বংস হয়ে যাবে; আর যার প্রহরী বা রক্ষাকর্তা নেই, তাও তো অচিরেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। সুলতান ছাড়া রাজত্ব (ক্ষমতা) ও আইন-শৃঙ্খলা কোনোটিই ঠিক মতো চলবে না।” (ইহইয়ায়ু উলুমুদ্দিন : ১/৭১)
ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আবশ্যকতার ব্যাপারে যদি কুরআন ও সুন্নাহর নুসুস (ঞবীঃং) এবং ইসলামী ইতিহাসের পাতায় রাসূলুল্লাহ সা. ও সাহাবিদের সিরাতে-এর স্বপক্ষে বাস্তব কর্মগত দলিল নাও থাকত, তবুও ইসলামী রিসালাতের তবিয়তই দাবি করত যে, ইসলামের একটি রাষ্ট্র বা আবাসভূমি থাকা লাগবে। আর, এই রাষ্ট্র বা আবাসভূমিটি ইসলামী আকিদা, নিদর্শন, শিক্ষা, মূল্যবোধ, আখলাক, শরিয়ত ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে হয়ে উঠবে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এক চমৎকার রাষ্ট্র ।
কোনো যুগেই ইসলাম এই ধরনের রাষ্ট্রের চাহিদা থেকে মুক্ত ছিল না, থাকতে পারে না। তবে, বর্তমান এই আধুনিক যুগে এই ধরনের একটি রাষ্ট্রের চাহিদা আরও অনেক বেশি। কারণ, বর্তমান যুগে ‘ওফবড়ষড়মরপধষ ঝঃধঃব’ বা আদর্শিক রাষ্ট্রের ধারণা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আদর্শিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠে একটি চিন্তা বা আদর্শের ওপর ভিত্তি করে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, আইন-কানুন, বিচার-ফয়সালা, অর্থনীতি, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি ও পররাষ্ট্রনীতিসহ এই রাষ্ট্রের সকল কিছুই এই চিন্তা বা আদর্শের মূলনীতির আলোকে পরিচালিত হবে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র এই ধরনের আদর্শিক রাষ্ট্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বর্তমান সময়ে বিজ্ঞান তার ক্রমাগত উন্নতির ফলে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন টেকনোলজি আবিষ্কার করে রাষ্ট্রের সেবায় নিয়োজিত করছে। আর, এগুলোর মাধ্যমে রাষ্ট্র হয়ে উঠছে শক্তিশালী। রাষ্ট্র এখন এগুলোর মাধ্যমে মানুষের আকিদা-বিশ্বাস, চাহিদা, আবেগ-অনুভূতি, চাল-চলন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে, প্রভাবিত করতে পারছে। অথচ, অতীতে রাষ্ট্রের পক্ষে এ ধরনের কোনো কিছু করা সম্ভব ছিল না। এমনকি বর্তমানে রাষ্ট্র তার আধুনিক টেকনোলজি ও সরঞ্জাম ব্যবহার করে একটি সমাজের মূল্যবোধ ও আখলাকি চেতনা পুরোপুরি পাল্টে দিতে পারে না; যদি না এর বিপরীতে কোনো শক্তিশালী প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে ওঠে।
মনে রাখতে হবে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী আকিদা-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, দাওয়াত ও জীবনপদ্ধতির ওপর। ইসলামী রাষ্ট্র নিছক জাতিকে অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রু থেকে রক্ষার নিয়ামক নয়। বরং, ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব আরও অনেক ব্যাপক। ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে- নাগরিকদের ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধের আলোকে প্রশিক্ষিত করে তোলা এবং ইসলামী আকিদা-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা ও শিক্ষাকে বাস্তবে রূপদান করতে একটি ইতিবাচক ও উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা; যাতে করে, এই রাষ্ট্রটি হিদায়াত অন্বেষক প্রতিটি ব্যক্তির জন্য আদর্শ হতে পারে এবং ভুলে পথে চলা প্রতিটি পথিকের জন্য হুজ্জত বা প্রমাণ হতে পারে।
এ কারণেই, আল্লাহ তায়ালা যখন মুসলমানদের দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করবেন অর্থাৎ তাদের কোনো রাষ্ট্র কায়েম হবে, তখন তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে বলা হচ্ছে-
“আমি তাদেরকে পৃথিবীতে (রাজ) ক্ষমতা দান করলে; তারা নামাজ কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং সৎকাজের আদেশ দেয় ও অসৎকার্য হতে নিষেধ করে।” (সূরা হজ্জ : ৪১)
তারপর কথা হচ্ছে, ইসলামী আকিদার ওপর প্রতিষ্ঠিত এই আদর্শবাদী রাষ্ট্রটি কোনো আঞ্চলিকতা লালন করে না। বরং, এই রাষ্ট্রটি হচ্ছে বিশ্বজনীন দাওয়াতের বার্তাবাহী এক রাষ্ট্র। কারণ, আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহর ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন, তারা যেনো গোটা বিশ্ববাসীকে তাদের কাছে থাকা নুর ও হিদায়াতের দিকে আহ্বান জানায়। আল্লাহ তায়ালা এই উম্মাহকে গোটা দুনিয়ার জন্য সাক্ষ্যদানকারী ও পথপ্রদর্শক বানিয়েছেন। এই উম্মাহ (দুনিয়ায়) নিজে নিজে আসেনি; নিজের জন্যও আসেনি। বরং, এ উম্মাহকে দুনিয়াতে আনা হয়েছে গোটা দুনিয়ার মানুষের কল্যাণের জন্য। আল্লাহ তায়ালা এই উম্মাহকে বানিয়েছেন ‘সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মাহ’। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
“এভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি; যাতে তোমরা মানবজাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ হতে পারো।” (সূরা বাকারা : ১৪৩)
এ কারণেই আমরা দেখি, হুদাইবিয়া সন্ধির পর পরিবেশ যখন কিছুটা শান্ত হয়, প্রথম সুযোগেই রাসূল সা. দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের রাজা-বাদশাহদের কাছে পত্র লেখা শুরু করেন; তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানান; তাওহিদের পতাকাতলে সমবেত হতে বলেন। যদি তারা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে অস্বীকার করে, তাহলে তাদের বলা হয়েছে, তারা কেবল নিজেদের পাপের বোঝাই বহন করবে না; বরং এর পাশাপাশি তাদের জনগণের পাপের বোঝাও তাদের কাঁধে এসে পড়বে। রাসূল সা. বিভিন্ন আহলুল কিতাব রাজা-বাদশাহদের কাছে লিখা পত্র এই আয়াত উদ্ধৃতি করে ইতি টানতেন- “আপনি বলুন, হে আহলে কিতাবগণ, এসো সে কথায় যা আমাদের ও তোমাদের মাঝে একই; (আর তা হচ্ছে) আমরা যেনো একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত না করি, তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরিক না করি এবং আমাদের কেউ আল্লাহ ছাড়া একে অন্যকে রব হিসেবে গ্রহণ না করি। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তোমরা বলো, তোমরা সাক্ষী থাকো যে, নিশ্চয়ই আমরা মুসলিম।” (সূরা আলে ইমরান : ৬৪)
সবশেষ আমরা বলতে চাই, ইসলামী রাষ্ট্রের নিদর্শন হচ্ছে রাবি ইবনু আমর রা.-এর সেই কথা, যা তিনি পারস্যের সেনাপতি রুস্তমকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন। রাবি ইবনু আমর রা. বলেছিলেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে পাঠিয়েছেন মানুষকে মানুষের গোলামি থেকে বের করে আল্লাহর গোলামির দিকে নিয়ে যেতে; তাদেরকে দুনিয়ার সঙ্কীর্ণতা থেকে বের করে দুনিয়ার প্রশস্তার দিকে নিয়ে যেতে এবং বিভিন্ন ধর্মের জুলুম থেকে বের করে ইসলামের আদালতের দিকে নিয়ে যেতে।”
লেখক : আন্তর্জাতিক মুসলিম নেতা ও ইসলামী চিন্তাবিদ
অনুবাদক : শিক্ষার্থী, ঢাবি

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির