post

কুরবানি ইসলাম প্রতিষ্ঠায় ত্যাগের নজরানা

এম মুহাম্মদ আব্দুল গাফ্ফার

০৫ জুলাই ২০২২

ইসলামী বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী জিলহজ মাসটি হলো বছরের সর্বশেষ মাস। এ মাসেই জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ) কর্তৃক ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রুকন হজের পুনঃপ্রবর্তন এবং মুসলমানদের জাতীয় জীবনের অন্যতম শরয়ী পর্ব কুরবানির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। আরবি ‘ক্বরব’ থেকে কুরবানি শব্দের উৎপত্তি। ‘ক্বরব’ অর্থ নিকটবর্তী আর কুরবানির শাব্দিক অর্থ নিকটবর্তী হওয়া। আভিধানিক অর্থ হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে তাঁর নিকটবর্তী হয়ে আল্লাহকেই একমাত্র রব হিসেবে গ্রহণ করা। এজন্য প্রতিটি জাতির জন্যই আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন ‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানির একটি নিয়ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছি, যেন লোকেরা সে জন্তুর ওপর আল্লাহর নাম নেয় যা তিনি তাদেরকে দান করেছেন ...।’ (সূরা হজ : ৩৪)। মহান রাব্বুল আলামিনের এ ঘোষণা দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, আবহমানকাল থেকেই কুরবানির এ বিধান প্রত্যেক উম্মতের জন্য চালু রয়েছে। হজরত আদম (আ)-এর পুত্র হাবিল ও কাবিল থেকেই কুরবানি শুরু হয়। তাদের উভয়ের কুরবানির মধ্যে মহান আল্লাহর নিকট হাবিলের কুরবানি কবুল হয়। অন্যান্য নবি-রাসূলদের যুগেও কুরবানির ইতিহাস পাওয়া যায়। তবে সব নবি-রাসূলের কুরবানির পদ্ধতি এক নয়। আধুনিক ইসলাম তথা উম্মাতে মুহাম্মাদির কুরবানিতে মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ)-এর পদ্ধতির অনুসরণ করা হয়। হাদিসে এসেছে, ‘হজরত জায়েদ ইবনে আরকাম রা. বর্ণনা করেন ‘মহানবি সা.-এর সাহাবিগণ রাসূলুল্লাহ সা.কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, আমাদের জন্য কুরবানি কী কারণে? উত্তরে আল্লাহর রাসূল সা. বলেছিলেন এটা তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ)-এর সুন্নাত, তাঁকে আবারও জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল সা.! এতে আমাদের কি ফজিলত (পুণ্য রয়েছে)? রাসূলুল্লাহ সা. উত্তরে বললেন, ‘(কুরবানির জন্তুর) প্রতিটি লোমের পরিবর্তে (একটি করে) নেকি রয়েছে। তাঁরা আবারও জিজ্ঞাসা করলেন, পশম বিশিষ্ট পশুর বেলায় কী হবে? (পশুরতো পশম অনেক বেশি)। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, পশমওয়ালা পশুর প্রতিটি পশমের পরিবর্তেও একটি করে নেকি রয়েছে। ’(মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত)। এর দ্বারা একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, জাতির পিতা আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী প্রিয়পুত্র ইসমাঈল (আ)কে কুরবানি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে চরম ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন সে ত্যাগের সুন্নাতকে জারি রাখার জন্যই ঈদুল আজহাতে পশু কুরবানি করতে হয়। মূলত আমাদের জন্য এ কুরবানিটা প্রতীকী হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। হজরত ইবরাহিম (আ)কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে স্বপ্নের মাধ্যমে প্রিয় বস্তু কুরবানির নির্দেশ দেওয়া হয়। পবিত্র কুরআনে সূরা সাফফাতের ১০২-১০৮ নং আয়াতে মহান আল্লাহ কুরবানির ঘটনা সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন- “অতঃপর যখন (ইসমাঈল) পিতার সাথে (তার কাজে সাহায্য) করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইবরাহিম তাকে বলল: পুত্র আমার! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে জবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি (ভেবে) দেখ।  সে বলল: পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে গণ্য দেখতে পাবেন। 

যখন পিতা-পুত্র উভয়েই (আল্লাহর আদেশের সামনে) আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহিম (জবেহ করার জন্য) সন্তানের কপাল মাটিতে চেপে ধরল।

তখন আমি তাকে ডেকে বললাম: হে ইবরাহিম! সত্যিই তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে! 

আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। 

নিশ্চয়ই এটি এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা।

আর আমি তার পরিবর্তে জবেহযোগ্য এক মহান জন্তু দিয়ে তাকে মুক্ত করে নিলাম।

আর এ বিষয়টি পরবর্তীদের জন্য স্মরণীয় করে রাখলাম।”

স্নেহভাজন একমাত্র সন্তানকে জবেহ করার আদেশ একটা বড় পরীক্ষা ছিল; এতে হজরত ইবরাহিম (আ) সফল হয়েছেন। জবেহযোগ্য মহান জন্তু একটি দুম্বার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা ইসমাঈল (আ)কে বাঁচিয়ে দেন। সেই দুম্বাটি জান্নাত থেকে জিবরাঈল (আ)-এর মারফতে তিনি পাঠিয়েছিলেন। (তাফসীরে ইবনে কাসীর) এবং ইবরাহিম (আ)-এর উক্ত সুন্নতকে কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ ও ঈদুল আজহার সব থেকে পছন্দনীয় আমল বলে স্বীকৃতি দেওয়া হল। এজন্য মহানবি হজরত মুহাম্মদ সা. ও তাঁর উম্মাত বা অনুসারীদের জন্যও হজরত ইবরাহিম (আ)-এর পদ্ধতিতে পশু কুরবানি অপরিহার্য করা হয়।

ইসলামিক বিধানে এবং মুসলিম সমাজে কুরবানি বা পশু জবেহ অন্যতম অপরিহার্য ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়। এ জন্য জিলহজ মাসের নির্ধারিত সময়ে বা ঈদ উৎসবে কুরবানি করা হয়। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে কুরবানির উদ্দেশ্য হলেও কারো কারো কুরবানিতে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। কে কত বড়-দামী পশু কুরবানি করে এ নিয়েও কিছু লোকের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। কারো কারো কুরবানির মধ্যে সম্পদ-অহমিকা প্রকাশ করার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়! এছাড়া সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর লক্ষ্যেও অনেককে কুরবানি করতে দেখা যায়। এসব লোক দেখানো কিংবা প্রভাব বাড়ানোর কুরবানি পশুহত্যায় পর্যবশিত হয়। অধিকন্তু দরিদ্র-দুস্ত লোকদেরকে কুরবানির মাংস দান না করে শুধু নিজেরা ভোগ করার পরিণতিও একই হয়। অথচ পার্থিব স্বার্থ ত্যাগ করে শুধু মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই কুরবানি করতে হয়। কুরবানির পশুর আকার বড়-ছোট কিংবা রং-মূল্য বিবেচ্য বিষয় নয়। তবু বিত্তশালীদের বড় পশু কুরবানি করাই শ্রেয়। সর্বোপরি কুরবানির জন্য উপার্জন অবশ্যই বৈধ হতে হয়। এক্ষেত্রে কুরবানি দাতার সামগ্রিক উপার্জনই বিবেচনায় আনতে হয়। শুধু কুরবানির পশু ক্রয়ের অর্থ বৈধ হওয়াই যথার্থ নয়, বরং সামগ্রিক উপার্জনই বৈধ হতে হয়। অন্যায়-অবৈধ উপার্জনের অর্থে যত বড়-দামী পশুই জবেহ করা হোক তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। অনুরূপভাবে বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া কুরবানিও আল্লাহ তায়ালার নিকট গৃহীত হয় না। তাই মহান আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য কুরবানির জন্য বিশুদ্ধ নিয়তের প্রয়োজন হয় এবং ত্যাগের প্রবল সাধনা থাকতে হয়। অধিকন্তু কুরবানির পশুর মাংস গরিব-অসহায় লোকদের দান করা শ্রেয়। এতে একদিকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। অন্যদিকে সামাজিক বন্ধন সুসংহত হয়। আপাত দৃষ্টিতে কুরবানি বলতে ’পশুজবেহ’ বা ’রক্তপ্রবাহ’ মনে হলেও এর মাধ্যমে অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে এবং সত্য-ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগ্রাম-সাধনার শক্তি সঞ্চারিত হয়; কুরবানির ত্যাগের মধ্যে মুক্তি-স্বাধীনতা অর্জনের দীক্ষা পাওয়া যায়। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, “ওরে সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন! ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!” (কোরবানী)। প্রকৃতপক্ষে কুরবানির ত্যাগের মাধ্যমে মানবিক-নৈতিক শক্তি ও সাহস অর্জিত হয়, যা দিয়ে অন্যায়-অপশক্তিকে পরাজিত করা যায়। একইভাবে ধৈর্য-ত্যাগের শিক্ষাও গ্রহণ করা যায়। যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময়।

এ কুরবানির মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের পশুবৃত্তিকে যেমন হত্যার আনুষ্ঠানিক মহড়া করা হয় তেমনি নিজের পালিত পশুকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জবেহ করে নিঃস্বার্থভাবে মানুষের আহার্যের জন্য বিলিয়ে দেওয়া আরেকটি স্বার্থ ত্যাগের অনন্য উদাহরণ অবশ্যই। কুরবানির এ অনুষ্ঠান তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি অর্জনের একটা পদ্ধতি, তাতে আর সন্দেহ কী? এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন ‘ওদের (পশুদের) গোশত আল্লাহর নিকট পৌঁছে না রক্তও না, কিন্তু তোমাদের তাকওয়া তাঁর নিকট অবশ্যই পৌঁছে, তিনি ওগুলোকে তোমাদের জন্য এভাবে নিয়ন্ত্রিত করেছেন যেন তাঁর দেওয়া হিদায়াত অনুযায়ী তোমরা তাঁর তাকবির করতে পারো, আর হে নবি! নেককার লোকদেরকে সুসংবাদ দাও।’ (সূরা হজ : ৩৭)। 

পবিত্র কুরআনুল কারীমের এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুসলমানদেরকে তাকওয়া অর্জনের পদ্ধতি যে কুরবানির মাধ্যমে অর্জন করতে হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন আর এ তাকওয়াটাই মানুষের হিদায়াতের পথ প্রদর্শনের পাথেয় হতে পারে। মূলত এ কুরবানিটা ছিল মহান রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছা তথা হুকুমের নিকট মাথা নুইয়ে দেওয়া তথা আনুগত্যের অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন। কুরবানি ত্যাগের সাধনা, তাই কুরবানির মূল লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধিতার পথে পরিচালিত হতে হবে মুসলমানদের। কুচক্রি মহলের ব্যবসায়িক স্বার্থে কুরবানিকে ত্যাগের পরিবর্তে ভোগের উৎসবে পরিণত করতে দেওয়া যাবে না, কারণ তারা মুসলিমসমাজকে কুরবানির লক্ষ্যচ্যুত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। বিজাতীয় সংস্কৃতি-অশ্লীলতা-বেহায়াপনার মাধ্যমে কুরবানি ঈদের পবিত্রতা যেন কলুষিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। হজরত ইবরাহিম (আ)-এর কুরবানির প্রকৃত শিক্ষা হলো আল্লাহর হুকুমের কাছে নির্দ্বিধায় মাথা নত করা, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করা এবং ইকামাতে দ্বীনের জন্য জীবনের সর্বস্ব আল্লাহর রাহে কুরবানি করতে প্রস্তুত থাকা। আল্লাহ আমাদের সকলকে এ শিক্ষা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন। 

লেখক : সদস্য, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, সিরাজগঞ্জ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির