post

গ্রামীণ সংস্কৃতির বিবর্তন

ড. মো. ইকবাল হোছাইন

০৬ আগস্ট ২০২১

বর্তমানে অর্থনীতির ভাষায় দ্রুত বর্ধনশীল গ্রামীণ কাঠামো দ্রুততার সাথে পরিবর্তিত হয়ে শহুরে কাঠামোর দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিষয়টি লোকাল গভর্নমেন্ট বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমদ তার লেখা ‘আমার গ্রাম রূপান্তরের রেখচিত্র’তে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি তার লেখায় চমৎকারভাবে বলেছেন, একসময় বাংলাদেশকে বৃহৎ গ্রাম ভাবা হতো যা এখন ক্রমবর্ধমান শহুরে রূপ নিচ্ছে। কোনো বৃহৎ শহরকে আরেক শহর থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাচ্ছে না। তবে অপরিকল্পিত এসব উন্নয়ন সত্যিকার উন্নয়ন সূচকের কতগুলো ধাপ পূর্ণ করতে পারবে সেটাও পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। তার পর্যবেক্ষণ অনেকটাই বাস্তবসম্মত। গ্রামের অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে। আজ বাড়ির যিনি জ্যেষ্ঠ সদস্য স্বাধীনতা পরবর্তীতে তার পোশাক আশাক, খাবার-দাবার, বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা-ঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুবিধা-অসুবিধাগুলো যদি বর্তমানে তার তৃতীয় জেনারেশন তথা নাতি (ছেলে/মেয়ের পক্ষের সন্তান) সাথে তুলনা করে তাহলে আকাশ-পাতাল পরিবর্তন স্বচক্ষে দেখতে পাবেন। এ জন্য কোনো তাত্ত্বিক গবেষকের বিশেষ ধারায় গবেষণার প্রয়োজন হবে না। তবে এ উন্নয়নের ধরন বিভিন্ন সময় বদলেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তীতে গ্রামীণ অবকাঠামো বা উৎপাদনের মূল চালিকাশক্তি ছিল পাট আর ধান। নব্বই দশকের শুরু থেকে বাংলাদেশে কৃষি বিপ্লবের যে ধারার সূচনা হয় তা গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির ধারণা ও বাস্তব প্রয়োগে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। বিগত শতকের শুরুতে বাজারে মাছ অনেকটা দু®প্রাপ্য ছিল। অনেককেই বলতে শুনেছি এক দশকের মধ্যে মাছ বলতে বাংলাদেশে কিছুই থাকবে না। যেভাবে জলাশয় ভরাট, নদীতে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে তাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মাছ বলে কিছু ছিল তা জানতে মিউজিয়ামে যেতে হবে। কিন্তু সঠিক নীতিমালা আর জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার কারণে বাংলাদেশ আজ চতুর্থ বৃহৎ মৎস্য উৎপাদনকারী দেশ। মানুষের আয়ের সাধ্যের মধ্যেই আছে মাছের দাম। পূর্বে মাছ চাষ ও বিক্রির সাথে সমাজের বিশেষ শ্রেণি জড়িত ছিল। তাদেরকে সমাজে অনেকটা অচ্ছুত ধরনের গোষ্ঠী ভাবা হতো। ‘মাছ পাড়া’ বা নিকারি সম্প্রদায় তাদের পরিচয় ছিল। কিন্তু গ্রামীণ জীবনেও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এসেছে। এখন শিক্ষিত অশিক্ষিত এমনকি শরিফ গোষ্ঠীর অনেকেই এ মাছ চাষ ও বিক্রির সাথে জড়িত। ক্রেতা-বিক্রেতা কেউ কাউকে ঘৃণার চোখে দেখছে না। এ পরিবর্তন একটি সমাজের উন্নয়নের জন্য খুবই জরুরি। ঠিক ডিমের ক্ষেত্রেও একই কথা। এক সময় ভারতীয় ডিমের বিশাল বাজার ছিল বাংলাদেশ। এখন নিজের উৎপাদনই আমাদের চাহিদা মিটে। আমার গ্রামেই পঞ্চাশোর্ধ্ব মুরগির খামার আর ছোটখাটো অনেক মৎস্য প্রজেক্ট দেখেছি। ঠিক এমনিভাবে মহিলারা হাঁস-মুরগি, শাক-সবজি এমনকি গরু পালনে অনেকটা মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন। পূর্বের ট্র্যাডিশনাল বাজার ব্যবস্থাপনায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আগের নির্দিষ্ট দিনের পরিবর্তে এখন মানুষজন প্রতিদিনই বাজারে যায় এবং টাটকা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করে। আজ থেকে দুই দশক পূর্বে যেখানে উন্নয়নের ধারণাই ছিল না সেখানে বিদ্যুতায়িত হয়ে অনেক ছোট বড় কল-কারখানা গড়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিটি পরিবারে এখন সিলিন্ডার গ্যাসের মাধ্যমে রান্নাবান্না হয়। ট্র্যাডিশনাল রান্নাঘরের ভিতরেই ডাইনিং টেবিলে খাবারের ব্যবস্থা হয়। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ি থেকে কেউ না কেউ বিদেশ থাকে এবং যারা ভূমিহীন বা শ্রমজীবী তাদের শ্রমের মূল্য আছে। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সর্বনিম্ন পাঁচশত টাকা যা বিভিন্ন মৌসুমে হাজার টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। গ্রামে এখন পরিকল্পনাহীন পাকাঘর তৈরির ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। বাড়িতে বাড়িতে এ বিষয়ে কেমন জানি অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। প্রতিবেশীর বাড়ি পাকা হয়েছে তাই আমার বাড়িও পাকা করতে হবে এ মানসিকতা গ্রামে প্রবল। অবশ্য প্রয়োজনেও অনেকে বাড়িঘর করছেন। করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর রাজধানী ঢাকা থেকে অন্তত তিন মিলিয়ন লোক কর্ম হারিয়ে নিজের বাস্তুভিটায় ফিরে যায়। দারিদ্র্য হঠাৎ করে ৪০% পার্সেন্টে উন্নীত হয়। তখন অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন গ্রামের অর্থনীতিতে চাপ বাড়বে আর অর্থনীতির এ অস্থিরতা প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত সম্প্রসারিত হলো। কিন্তু তখন আমি আমার লেখায় এ ধারণার সাথে দ্বিমত পোষণ করে ভিন্ন একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিলাম। ঢাকা শহরের দৈনন্দির জীবিকা নির্বাহকারী এ পরিশ্রমী মানুষগুলো গ্রামে গিয়ে কারো উপর বসে খাবার মতো অবস্থায় নেই। নেই রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার কোনো সম্ভাবনা। যে কারণে আমার ধারণা ছিল, তারা গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করবে তবে এ চাপ অবশ্যই গ্রামীণ অর্থনীতিতে পজিটিভ দৃষ্টিতে চাঙ্গা করবে। আমার দেখা এমন অনেকজন আছে যারা বাড়িতে ফিরে কোনো না কোনো কাজের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে এবং মোটামুটি ভালো দিনাতিপাত করছেন। বরং শহরে জীবনে দারিদ্র্যের কশাঘাত গ্রামের চেয়ে বেশি অনুভূত হয়। আমরা যারা শহরে বসবাস করি আমার ধারণা প্রত্যকেই আমার সাথে একমত হবেন, বাজারে বা স্থানীয় কোনো দোকানে কেনা-কাটা করতে গেলে দুস্থ ও নিঃস্ব মানুষের হাতপাতার লাইন পড়ে যায়। করোনা মহামারীর পর থেকে এ অবস্থা বেড়েই চলেছে। মানুষ বড় অসহায় হয়েই হাত পাতে। দুস্থ তালিকায় মহিলাদের সংখ্যাই বেশি। এ ক্রমবর্ধমান দুস্থ মানুষের হার গ্রামে অপেক্ষাকৃত কম। আমি ২০২১ সালে নিকটতম আত্মীয়দের দুটি বিয়েতে উপস্থিত হয়েছি যা গ্রামেই সম্পন্ন হয়েছে। আজ থেকে দশ-পনেরো বছর পূর্বে এসব বিবাহ অনুষ্ঠানে ২০% ফকির মিসকিনের খাবারের বিশেষ ব্যবস্থাপনা করতে হতো। বর্তমানে একজন ফকির বা দুস্থকে বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে এলাকার হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে আমার আলাপ হয়েছে। তিনি বললেন, ‘এখন দুস্থ বা দরিদ্রদেরকে দাওয়াত না দিলে এসব সামাজিক অনুষ্ঠানে তারা আসে না।’ খাদ্য ও বাসস্থানের ন্যূনতম আয়োজন থাকায় তাদের সম্মানের বিষয়টি জাগ্রত হয়েছে বলা যায়। যে অবস্থাটা শহরে নেই। আমার বাসায় প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচজন দুস্থ কিছু পাওয়ার জন্য হাঁক দেয়। গ্রামীণ জীবনধারার সাথে আরেকটি নতুন বিষয়ের সংযুক্তি বেশ উৎসাহব্যঞ্জক। আর তা হলো গ্রামীণ ট্যুরিজম। ট্যুরিজম বা পর্যটন বলতেই আমাদের চোখের সামনে চিড়িয়াখানা, বড় বড় শহর, দালান-কোঠা, চোখধাঁধানো রেস্টুরেন্ট আর কৃত্রিম রিসোর্ট বা পার্ক, ঐতিহাসিক স্থান বা সি-বিচের কথা মানসপটে ভেসে ওঠে। আজ থেকে ১০ বছর পূর্বেও গ্রামে ট্যুরিজম হতে পারে এ ধারণা ছিল কি না সন্দেহ! বর্তমানে একেবারেই নিভৃত স্থানে গ্রামীণ পরিবেশে খাওয়া-দাওয়ার হোটেল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে খাবারের আয়োজনে গ্রামীণ সংস্কৃতির ছোঁয়া থাকে। এ বিশেষ ধরনের আয়োজন উপভোগ করার জন্য শহর থেকে মানুষ গাড়ি হাঁকিয়ে সে সব স্থানে ভিড় করছে। এসব শহরে ও গ্রামীণ সংমিশ্রণে একটি বিকল্প মিথ সংস্কৃতির বলয় গড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। যেখানে আমাদের সহজ-সরল গ্রামীণ ধারণা খুঁজে পাওয়া অনেকটাই দুষ্কর। এতসব উন্নয়ন আর আশার বিপরীতেও জমে উঠছে কিছু কালোমেঘ আর অপসংস্কৃতি যা গ্রামীণ পরিবেশ ও মর্যাদাকে কলুষিত করছে প্রতিনিয়ত....। 

আমরা কি আবু যায়েদ আবদুর রহমান ইবনে খালদুনের (১৩৩২-১৪০৬ খ্রি.) কথা স্মরণ করতে পারি? সমাজ বিশ্লেষণের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। আজ থেকে ছয়শত বছর পূর্বে তাঁর সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় ইউরোপীয় পণ্ডিতগণও বিস্ময় প্রকাশ করতেন। আরনল্ড টয়েনবি ও রবার্ট ফ্লিন্ট প্রমুখ ঐতিহাসিকদের মতে- তিনি দেশ, কাল, পাত্রভেদে সর্বাপেক্ষা চমৎকার ও তাৎপর্যপূর্ণ সমাজ ও ইতিহাস দর্শনের প্রণেতা এবং প্লেটো, অ্যারিস্টটল বা অগাস্টিনও তার সমকক্ষ ছিলেন না। তিনি আল মুকাদ্দিমায় সমাজ বিশ্লেষণের ছয়টি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়ার কথা বলেন। চতুর্দশ শতকের আরব ইতিহাসবেত্তা ও সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুন তার ‘আল-মুকাদ্দিমা’ গ্রন্থে সমাজবিজ্ঞান তথা ইতিহাসতত্ত্বের যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন তাই আধুনিক সমাজের ভিত্তি বলে অনেকে একবাক্যে স্বীকার করেছেন। ইবনে খালদুনের মতে, সকল ভৌত ও সমাজবিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু মানুষ। এখানে মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। তিনি বলেছেন, কোনো মানুষ একা জীবন ধারণের উপযোগী প্রয়োজনীয় সব দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করে নিজের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। এ জন্য প্রয়োজন পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতা। ইবনে খালদুনের মতে, পরিপূর্ণ সহযোগিতা এক জটিল সামাজিক বিবর্তনের সৃষ্টি করে, যাকে তিনি নগরায়ণ বলে আখ্যা দেন। তার তত্ত্বের নগরায়ণ প্রক্রিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান গ্রামীণ কাঠামোকে আনা যায়। তার বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামকে এখন শহরতলি বললে অত্যুক্তি হবে না। ইবনে খালদুন শহরতলির ভালো দিক উল্লেখ করেছেন তবে এও জোর দিয়ে বলেছেন, শহরের খারাপ দিকগুলোর কেন্দ্রস্থলও এ শহরতলি। আমার বিশ্লেষণে বর্তমানের গ্রামগুলোকে অনেকটা ভালো-খারাপের সংমিশ্রণের দিক-নির্দেশনাহীন জগাখিচুড়ি সংস্কৃতির প্রয়োগস্থল বলা চলে। 

আসুন কিছুটা ব্যাখ্যা করি কিভাবে-

এক সময় গ্রাম ছিল অল্প মানুষের আবাসস্থল। জনসংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম হলেও আন্তর্জাতিক পরিমাত্রায় আমাদের গ্রামগুলোতে জনংসংখ্যার ঘনত্ব তুলনামূলক বেশি। এ বেশি মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগের প্রাথমিক স্তরটিই নগরায়ণের সূত্রপাত। নগর সংস্কৃতি ও গ্রামীণ সংস্কৃতির জটিল সংস্কৃতির সামাজিক বিবর্তনের যে প্রক্রিয়া বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে শুরু হয়েছে এর ভালো দিকও আছে আবার খারাপ দিকও আছে। করোনা পরবর্তী আর্থসামাজিক প্রভাবে শহরের জনসংখ্যাসহ পরিচিত ব্যবসা বাণিজ্যের যে কাঠামোর সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম তা দ্রুতই বদলে যাচ্ছে এবং পর্যায়ক্রমে আরো সম্প্রসারিত হবে। তবে গ্রামীণ আবহ অনেকটাই ব্যতিক্রম। বরং এ পরিস্থিতিতে শহরের মানুষদের গ্রামে ফিরে যাওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতি অনেকটা শক্তিশালী হয়েছে। অর্থনৈতিক ভিত শক্তিশালী থাকলেও সমাজের যুবসমাজ একেবারেই দিকদর্শনহীন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে, যা আমার কাছে সবচে চ্যালেঞ্জিং মনে হয়েছে। প্রযুক্তি একটি সমাজের উন্নয়নের জন্য অতীব প্রয়োজন। প্রযুক্তির কারণেই আজ উন্নয়নের সুফল প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছেছে সন্দেহ নেই। তবে আমার কাছে মনে হয় গ্রামের বর্তমান যুবসমাজ নিজেদের প্রযুক্তির দাস বানিয়ে ফেলছে। সরকার মাধ্যমিক স্তরে প্রযুক্তি শিক্ষায় জোর দিয়েছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা অনেকেই ভালোভাবে কম্পিউটার ওপেন করা শিখেনি। তবে বাপ-মায়ের কাছে আবদার করে অ্যানড্রয়েট মোবাইল নিজে করায়ত্ত করে এর অশ্লীল ব্যবহারে সবচে বেশি সময় দিচ্ছে। আমি অনেক শিক্ষক ও সমাজের অভিভাবকের কাছে শুনেছি এবং যুবকদের সাথে কথা বলে এ বিশ^াস আমার জন্মেছে, অ্যানড্রয়েট সংস্কৃতির এবং এর উচ্ছৃঙ্খল ব্যবহারে ছেলে-মেয়েরা নৈতিকভাবে বেশি সময় নষ্ট করছে এবং সমাজে পর্নোগ্রাফির প্রভাবে নৈতিকতা এমন তলানিতে গিয়েছে যে, বাবা-মায়ের বয়সী শিক্ষক-শিক্ষিকার সাথেও এ যুবসমাজ অশ্লীল কাজে লিপ্ত হতে কাউকে পরোয়া করছে না। সকলকে মানার বা সম্মান করা গ্রামের সামাজিক সংস্কৃতির একটি অলঙ্ঘনীয় দিক ছিল। বর্তমানে এ দিকটি ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে যাচ্ছে। এ নোংরামি আর অশ্লীলতার দিক থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রাম শহর থেকেও অগ্রগামী। শহরে এসব অসামাজিক কাজ অনেকটাই চার দেয়ালের মধ্যে থাকে কিন্তু গ্রামে খুব দ্রুতই তা ছড়িয়ে পড়ে এবং এর খারাপ দিকটির প্রভাবই যুবসমাজে বেশি পড়ে।

আগে গ্রামে ব্যাপকভাবে সামাজিক অনুষ্ঠান হতো। যুবকরা ছোট ছোট ক্লাবের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, খেলাধুলার আয়োজন করতো। গ্রামে এমন কোনো শিক্ষার্থী পাওয়া যেত না যারা কোনো সামাজিক কাজে সম্পৃক্ত থাকতো না। গ্রামে লাইব্রেরি স্থাপন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার, দরিদ্রদের সহযোগিতার জন্য অর্থ উত্তোলনসহ এমন কোনো ভালো কাজ নেই যেখানে গ্রামের যুবসমাজের সম্পৃক্ততা ছিল না। কিন্তু আজ সকল কাজ মৃত প্রায়। তবে জাতীয় রাজনীতির নামে সমাজের অতীত ঐক্যের ঐতিহ্যকে খণ্ড-বিখণ্ড করা হয়েছে, এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। 

তাহলে সমাজে ব্যাপক উন্নয়নের কথা যে প্রচার করা হয় তা কি? নিশ্চয়ই কিছু একটা উন্নয়ন হয়েছে। সমাজের উন্নয়ন সুষম না হলেও অল্প কিছু উদাহরণ বাদে দুর্নীতি আর রাজনীতির নাম ভাঙিয়ে অনেকে দ্রুতই অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে। রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন হয়েছে। দ্রুত প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এর ভালো দিকের চেয়ে খারাপ চর্চাই বেশি হচ্ছে বলে অনেকেই একবাক্যে স্বীকার করছেন। প্রান্তিক পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা জাতীয় রাজনীতির সাথে এমনভাবে সম্পৃক্ত, ভালো কাজ দেখিয়ে পুনঃনির্বাচনের চিন্তা করেন না। ফলে তারা জনসম্পৃক্ত নন। উভ্রান্ত উটের পিঠে চড়ে সম্প্রীতি ও ভালোবাসার গ্রামে ইবনে খালদুনের ভাষায় খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপনের দিকেই হাঁটছে। এ উদ্দেশহীন অনিশ্চিত যাত্রায় গ্রাম হেরে গেলে বাংলাদেশের শিকড়ের অস্তিত্বই প্রশ্নবোধক হবে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কেবল কথা বললে হবে না। সমাজের প্রত্যেকটি শ্রেণির হাতে কাজ তুলে দিতে হবে। তাদেরকে ব্যস্ত রাখতে হবে। এজন্য দরকার জনসম্পৃক্ততা। বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদ বা একজন ওয়ার্ড মেম্বারের তত্ত্বাবধানে উন্নয়নের সাথে জনগণ কমই সম্পৃক্ত হন। ২০১৬ সালের ১০ জানুয়ারি ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও বাংলাদেশের গ্রাম’ শীর্ষক এক আলোচনায় থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেদিন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ নজরুল ইসলাম উল্লিখিত বিষয়ে চমৎকারভাবে প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেছিলেন। দেশের প্রবীণ অর্থনীতিবিদদের উপস্থিতিতে এ আলোচনায় উঠে এসেছিল গ্রামকে সমৃদ্ধ করতে হলে দক্ষ ও সৎ মানুষ তৈরির পাশাপাশি সমাজের সকলকে উন্নয়নে সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা নিতে হবে। এখানে বঙ্গবন্ধুর সমবায় গ্রাম বা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের গ্রাম সরকার ধারণাটি খুবই প্রাসঙ্গিক। তবে অর্থনৈতিক স্লোগানে গ্রামীণ ঐতিহ্য মলিন হচ্ছে এ কথা সত্যি হলেও একেবারে রাস টানা যাবে না। বরং গ্রামীণ সংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় কর্মসূচি নিতে হবে। 

লেখক : অধ্যাপক, দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইবি

আপনার মন্তব্য লিখুন

Abdur Rahman

- 1 year ago

Effective writing

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির