post

বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বনাম পররাষ্ট্রমন্ত্রীর রাষ্ট্রদ্রোহী বক্তব্য

ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম

১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

“শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে ভারতকে অনুরোধ করেছি”- বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন এমন একটি বক্তব্য দেওয়ার পর এটি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এই বক্তব্যের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় টিকে থাকার উৎস ও থলের বেড়াল বেরিয়ে এসেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন গণতন্ত্র কখনো শক্তিশালী ভিত না পাওয়ার কারণেই বাংলাদেশে প্রায়শ বিদেশি শক্তিগুলো প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পায়। বিনা ভোটে কিংবা জোর করে ক্ষমতায় থাকা দলগুলো নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে গিয়ে দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করে এবং শক্তিশালী প্রতিবেশীদের কাছে নতজানু হয়। আওয়ামী লীগ গত ১৩ বছর ধরে জনগণের কোনো মেন্ডেট ছাড়াই বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমানে  ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রতিবেশী ভারতের সাথে আপস করছেন বলে বিশিষ্টজনেরা সন্দেহ করছেন।

অনেকের মতে, বর্তমান সরকারের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা কারও অজানা নয়। বিশেষ করে ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পাশাপাশি ২০১৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতি সরাসরি সমর্থন ছিল ভারতের। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারতের সমর্থন না থাকলে আওয়ামী লীগের জন্য পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন ছিল, এটাও কারো অজানা নয়। কূটনীতিকরাও মনে করেন, ভারতের সমর্থন ও ঘনিষ্ঠতা নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনা যদি হয়েই থাকে, সেটা জনসমক্ষে আনাটা ঠিক হয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অযাচিত মন্তব্য দুই দেশের কূটনীতিকদের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, “শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে যাবে এবং সত্যিকারের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত দেশ হবে। আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারতবর্ষের সরকারকে সেটা করতে অনুরোধ করেছি।” তিনি আরো বলেন “অনেকেই আমাকে ভারতের দালাল বলেন। কারণ অনেক কিছু হয়, আমি স্ট্রং স্টেটমেন্ট দেই না। কিন্তু আমারও তো একটি কনস্টিটিউশনি আছে। সেটা তো আমি ইগনোর করতে পারি না।”

তা ছাড়া এ ধরনের কথাবার্তা নতুন বা আকস্মিক নয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য। তিনি এর আগে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো বলে অচিন্তনীয় বক্তব্য দিয়েছেন। বাংলাদেশের সংবিধানে কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে এমন সম্পর্কের অনুমোদন নেই, সেখানে শুধু সমমর্যাদাভিত্তিক বন্ধুত্বের কথা আছে। তিনি এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে সেখানকার ভারতীয় অভিবাসীদের র‌্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভূমিকা রাখার অনুরোধ করেছেন। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের আন্তঃরাষ্ট্রীয় কোনো বিষয়ে অন্য দেশের নাগরিকদের ভূমিকা রাখার কোনো অবকাশ নেই। তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ভারতীয় অভিবাসীদের সমাবেশে এ কথা বলার আগে তাঁর স্মরণ রাখা উচিত ছিল, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।

সার্বভৌমত্ব যা ইংরেজিতে SOVEREIGNTY ল্যাটিন Suparanus হতে আগত। এর অর্থ চরম ক্ষমতা। Encyclopedia Britannica তে বলা হয়েছে: Sovereignty, in political theory, the ultimate over seer, or authority, in the decision-making process of the state and in the maintenance of order.

OXFORD DICTIONARY-তে বলা হয়েছে Complete power to govern a country; the county claimed Sovereignty over the island; the Sovereignty of parliament; the idea of consumer Sovereignty; the state of being a country with freedom to govern itself, The declaration proclaimed the full Sovereignty of the republic.

আমেরিকার খ্যাতনামা অধ্যাপক বার্জেস বলেন, “সার্বভৌমত্ব হচ্ছে প্রত্যেক প্রজা ও প্রজাদের সকল প্রকার সংঘের ওপর মৌলিক, চরম, অসীম ও সর্বাত্মক ক্ষমতা। সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের আদেশ দেওয়ার এবং নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের প্রত্যেক নর-নারীকে শর্তহীন নির্দেশ প্রদানের ক্ষমতা।” সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের সেই বৈশিষ্ট্য, যার জন্য ইহার নিজের ইচ্ছা ছাড়া অন্য কোনো ইচ্ছার দ্বারা আইনত ইহাকে বাঁধা যায় না এবং নিজের শক্তি ব্যতীত অন্য কোন শক্তি দ্বারা সীমিত করার যায় না। ব্রেক স্টোন ইহাকে চরম অপ্রতিরোধ্য শর্তহীন সীমাহীন কর্তৃত্ব বলে আখ্যায়িত করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পোলক-এর মতে, সার্বভৌমত্ব সেই ক্ষমতা যা সাময়িক নহে, যা অন্য কারো নিকট হতে প্রাপ্ত ক্ষমতা নহে, যা এমন কোনো নিয়মের দ্বারা সীমাবদ্ধ নহে যা রাষ্ট্র বদলাতে পারে।

বাস্তব সত্য হচ্ছে এই তামাম দুনিয়ার যিনি স্রষ্টা তিনিই সার্বভৌমত্বের প্রকৃত মালিক এবং রক্ষক। আর এর উপেক্ষা করাই যত সমস্যার মূল। আন্তর্জাতিক আইনের আদি শুরু হুগো গ্রোসিয়াস-এর নির্দেশ করতে গিয়ে বলেন, ইহা তাঁহাদের হস্তে ন্যস্ত চরম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, যার কোনো কার্যে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। রাষ্ট্রযন্ত্র যখন কোনো দিক থেকে দুর্বল অথবা অন্য কোনো রাষ্ট্রের নীতি বা চড়ষষরপু-র নিকট হেরে যায় বা নতিস্বীকার করে তখন-ই সার্বভৌমত্ব মানে চরম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কথাটি চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়। তখন এই সার্বভৌম রাষ্ট্র তার আসল রূপ, ক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্য হারাতে থাকে। আর এমন রাষ্ট্রকে-ই উপাধি দেওয়া হয় নতজানু রাষ্ট্র বা নতজানু পররাষ্ট্রনীতি হিসেবে। আসলে রাষ্ট্র অনেকটা মানুষের শরীরের মতই। মানুষের শরীর যখন রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তখনি নানা রোগব্যাধি শরীরকে আক্রান্ত করে, ঠিক তেমনি রাষ্ট্র যখন দুর্বল হয়ে পড়ে তখনি দেশের সার্বভৌম ক্ষমতার ওপর সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো দানবের মতো আক্রমণ চালায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলোবির মতে, “রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ইচ্ছাই সার্বভৌমত্ব।”

বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তৃতা যে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর সুদূরপ্রসারী চিন্তার অংশ তা আরএসএস প্রধান মোহন ভগবতের একই সুরের বক্তব্যে প্রমাণ পাওয়া যায়, যারা ভারতকে ভাগ করার কথা বলে তাদের নিশানা করে তিনি বলেছিলেন, “দেশভাগের সময় ভারত একটি বড় ধাক্কা দেখেছিল। ওই ধাক্কা ভুলে যাওয়ার মতো না। এর আর কোনও পুনরাবৃত্তি হবে না।” তিনি আরও বলেছিলেন, “দেশভাগের সময় ভারতের দুর্ভোগের কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়। এই ধাক্কা একমাত্র তখনই কাটিয়ে ওঠা যাবে, যখন ভারত আবার অখণ্ড হবে।”

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তৃতার সূত্র ধরে তীব্র প্রতিবাদও হয়েছে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক মহলে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আজকে প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশ কি সত্যিকার অর্থে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র থাকবে কি থাকবে না, বাংলাদেশ কি সত্যিকার অর্থেই একটা গণতান্ত্রিক দেশ থাকবে কি থাকবে না, বাংলাদেশ কি সত্যিকার অর্থে কি মানুষের অধিকারগুলো ফিরিয়ে এখানে একটা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তৈরি করবে কি করবে না...? আজকে এই প্রশ্নগুলো কেন এসেছে, কারণ আমরা দেখলাম আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের সমস্ত অধিকারগুলোকে কেড়ে নিয়েছে, সংবিধানকে পরিবর্তন করেছে, ভোট দেওয়ার ক্ষমতাকে হরণ করে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানকে তারা বাতিল করে দিয়েছে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম বলেন বাংলাদেশে কারা সরকারে থাকবেন বা থাকবেন না, তা নির্ধারণ করবে এদেশের জনগণ। কাউকে সরকারে বসানোর কোনো এখতিয়ার বাংলাদেশের জনগণ অন্য কোনো দেশকে দেয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রাখার জন্য ভারতকে যে অনুরোধ করেছেন’ তাতে বাংলাদেশের জনগণকে চরমভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছে। তার এ বক্তব্য বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি মারাত্মক আঘাত। কোনো মন্ত্রী তো দূরের কথা, দেশের একজন নাগরিকও ভিন্ন কোনো দেশকে বাংলাদেশের সরকারে কাউকে রাখার অনুরোধ জানাতে পারে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্য বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত শপথনামায় ‘বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস এ আনুগত্য করিব’-এর সুস্পষ্ট লংঘন।

জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের বলেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্য দেশের সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের দায় সরকার এড়াতে পারে না। দেশের নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। মানুষ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। আবার প্রতিনিধি পছন্দ না হলে ভোটের মাধ্যমে পরিবর্তন করার অধিকার চান।

গণফোরাম সভাপতি মোস্তফা মোহসীন মন্টু বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে আঘাত করছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এটা রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধ। অবিলম্বে মূল্যবোধহীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অব্যাহতি দিয়ে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার দায়ে তাকে গ্রেফতার করতে হবে। ভারত আমাদের প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র। কিন্তু মনে রাখতে হবে তারা প্রভু নয়। এদেশের জনগণ কারো দাসত্ব কোনোদিন মেনে নেয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো যেসব রাষ্ট্রদ্রোহীরা দেশের জনগণকে দাসত্বের শৃঙ্খল পরাতে চায়, তাদের ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করা হবে এবং জনতার আদালতে বিচার হবে।

জেএসডির সভাপতি আ.স.ম রব বলেন, ‘ভারতের কাছে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ক্ষমতায় টিকে থাকার এ হীন আকুতি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বার্থ ও মর্যাদার পরিপন্থী। রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ববিরোধী চক্রান্তে জড়িত হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার সাংবিধানিক শপথ ভঙ্গ করেছেন। তিনি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনে অযোগ্য হয়ে পড়েছেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ, ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়া এদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি প্রজাতন্ত্র এখানে বিদেশী শক্তির অশুভ প্রভাবকে শক্তিশালী কেন করা হচ্ছে তার জবাব চায় জাতি। জাতির প্রশ্ন আওয়ামী লীগ কি তাহলে স্বীকার করল যে জনগণ নয়, ভারতের সমর্থনের ওপর টিকে আছে এই সরকার...? নাকি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দলের পরবর্তী প্রজন্মই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বন্ধক রেখে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার অপচেষ্টা করে যাচ্ছে...?

প্রশ্ন হচ্ছে, এগুলো কি একটি স্বাধীন দেশের জন্য গ্রহণযোগ্য? পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে সত্য উদোম করে দিয়েছেন, তা কি অসীম আত্মদানে দেশ স্বাধীন করা জাতির জন্য গৌরবজনক? ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের প্রকৃতিই বা কি এই সরকারে আমলে?

বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার অনুরোধ জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে ভারতকে কিছু বিষয় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সীমান্তে এখন ভারতের অতিরিক্ত খরচ করতে হয় না। বছরে ২৮ লাখ মানুষ ভারতে বেড়াতে যায়। কয়েক লাখ ভারতীয় বাংলাদেশে কাজ করে। বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা হলেও তিনি ও সরকার নীরব থাকেন। কিন্তু এগুলো যদি ক্ষমতায় থাকার বিনিময়মূল্য হয়, তাহলে তা কি স্বস্তিকর বাংলাদেশের জন্য?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আইন বিশেষজ্ঞ ড. আসিফ নজরুল লিখেছেন- ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে অকুণ্ঠ সমর্থনদানকারী দেশ। কিন্তু এ জন্য ভারতকে কোনো প্রভুত্ব, খবরদারি বা একচেটিয়া সুবিধা দেওয়ার জন্য শর্ত ছিল না। ভারতের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করিয়ে, যৌথ নদীর ন্যায্য হিস্যা দাবি করে, পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলনে যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকার তা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিল। তাঁর নেতৃত্বে প্রণীত সংবিধানে ক্ষমতায় আসা ও থাকার জন্য নিরঙ্কুশভাবে জনগণের ভোটাধিকারের ওপর নির্ভর করার কথা বলা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তিনি জিতেছেন মানুষের ভোটে, ভারতের সমর্থনে নয়। কোনোদিন এভাবে অন্য দেশের সমর্থন চাননি তিনি, গণপরিষদে আলোচনাকালে নির্বাচনে হারলে আনন্দের সঙ্গে বিরোধী দলকে স্বাগত জানাবেন বলেছিলেন তিনি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য তাই সংবিধানবিরোধী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী। তিনি নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভারতের কাছে কারিগরি বা প্রযুক্তি-সহায়তা চাইতে পারতেন। কিন্তু ক্ষমতায় থাকার জন্য বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতের অবাধ হস্তক্ষেপ চাইতে পারেন না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের বক্তব্য বাংলাদেশের মানুষের জন্য চরম অবমাননাকরও। এটি বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকারের প্রতি চরম অস্বীকৃতিজ্ঞাপন, জনরায়ের প্রতি অবজ্ঞাসূচক।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য উদ্বেগজনক। তবে আরও উদ্বেগজনক হচ্ছে এই সন্দেহ যে এটি শুধু তাঁর বক্তব্য বা দৃষ্টিভঙ্গি কি না? অনলাইনে মন্তব্য দেখলে মনে হয় অনেক মানুষ বিশ্বাস করে ক্ষমতায় থাকার উপায় হিসেবে বর্তমান সরকারের নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলনই ঘটিয়েছেন তিনি তাঁর বক্তব্যে।

মোট কথা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এসব মন্তব্যকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। তাঁর এসব মন্তব্যে পরিশীলতার বিষয়টি অনুপস্থিত। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ও ভৌগোলিক ভাবে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পররাষ্ট্রমন্ত্রীর লাগামহীন বক্তব্য থেকে দেশের সক্ষমতার ঘাটতি প্রকাশ পায়। একই সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তি নিয়েও সংশয় দেখা দেয়।

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ এখন প্রতিবেশী রাষ্ট্র দ্বারা দারুণভাবে আক্রান্ত। এদেশে আধিপত্য বিস্তারের জন্য তারা এখন তথাকথিত সমাজপত্তি, মিডিয়া, এনজিও, একশ্রেণির প্রগতিশীল আর সুশীলদের উপর ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে। একথা আজ অনেকেই বলে থাকেন এদেশের প্রায় সব সেক্টরেই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত কেনা গোলাম রয়েছে। এটা দেশের স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের জন্য ভয়াবহ হুমকি। মূলত একটি দেশের সার্বভৌমত্ব যদি বহিরাষ্ট্রের আক্রমণের মুখে পড়ে যায় তাহলে সেখানে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং সামাজিক নিরাপত্তা ও প্রজাতন্ত্রের কোনোকিছুই তার আসল লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না।

এছাড়া মানবজীবনে কার সার্বভৌমত্ব কার্যকর হবে তা নির্ধারণের ভিত্তিই রাষ্ট্র দর্শন। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের মূল বিবেচ্য বিষয়-ই আমাদের রাষ্ট্রে উপেক্ষিত। সেটি নির্ধারণ না করে শতাব্দী কাল চেষ্টা করেও আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ মানবজীবন ঐশী সার্বভৌমত্বের অধীন, না মানবীয় সার্বভৌমত্বের নিয়ন্ত্রণে হবে তা নির্ধারণ করতে হবে। যদি ঐশী নির্দেশ হয় তাহলে এর পদ্ধতি কিভাবে মানবসমাজে প্রচারিত ও কার্যকর হবে, তা বিবেচনা করতে হবে আবার মানবীয় সার্বভৌমত্বের অধীন হলে তার রূপরেখাই বা কী হবে অর্থাৎ সেই সার্বভৌমত্ব ক্ষমতা প্রয়োগকারী কে হবে? তিনি কি একক ব্যক্তি হবেন, না কোন গোষ্ঠী হবে। এদের নিয়োগকর্তাই বা কে হবেন। কিসের ভিত্তিতে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করা হবে। শুধুমাত্র ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শক্তি বিবেচনায় আনা হবে অথবা সাধারণ জ্ঞান অথবা অলৌকিক অথবা বিশেষজ্ঞদের জ্ঞান বিবেচনায় আনা হবে। এই সব কিছুর ওপরই নির্ভর করছে সার্বভৌমত্বের প্রকৃত শক্তি এবং এর অবস্থান ও অবস্থিতি। কিন্তু এই সার্বভৌমত্ব কার নির্দেশে চলবে আল্লাহ সে সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বলেন, “ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ” জমিন যার আইন চলবে তার। তা যদি না হয় তাহলে বন্য প্রাণীর মতো এখানে সংঘাত অনিবার্য।

মূলত রাষ্ট্র নিজেই একটি সত্তা। এই তার রয়েছে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও শক্তি। এই অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস তার অতীত ইতিহাস। আমাদের ইতিহাস অনেক গৌরবের। অনেক ঐতিহ্যমণ্ডিত আবার অনেক বেদনাবিধুরও বটে। এই জনপদের মানুষের ইতিহাস অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের। এই বিস্ময়কর সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় নিকট-অতীতে এখানে আর্যদের আগ্রাসন, ইংরেজদের শোষণ চলেছে। তারপরেও এই জাতি রক্তে মাংসে সংগ্রামী, অস্তিত্বে স্বাধীনচেতা আর মূল্যবোধ ও বিশ্বাসে এক আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করে না। কিন্তু এই চেতনা ও মূল্যবোধের ওপর আঘাত হয়েছে অসংখ্যবার। এই আঘাতের যাত্রা ১৬৩৪ সালে বাংলায় বাণিজ্য করার নামে ব্রিটিশ বেনিয়ারা এখানে এসে ইঙ্গ-হিন্দু মৈত্রী গড়ে তুলে মূলত মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। এরই অংশ হিসেবে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন, আর এদেশীয় মীরজাফর ও ঘসেটি বেগমদের অন্যের নিকট মাথা বিক্রি করে এই জনপদে যে বিভক্তির বীজ বপন করেছে তা আজ অঙ্কুরিত হয়ে বিভক্তির অনেক ডালপালা গজিয়েছে।

একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনার মূলমন্ত্র হবে গণতন্ত্র। এটি সংবিধানে খচিত হলেও দেশ পরিচালিত হয়েছে কখনও একনায়কতন্ত্র তথা বাকশাল, কখনো সামরিক জান্তা, আবার কখনো স্বৈরশাসনের অধীনে। অনেক আন্দোলনের পর ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসনের অবসান হয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হলেও জনগণের চাহিদার সত্যিকারের প্রতিফলন এখনো ঘটেনি। কারণ গণতান্ত্রিক পন্থায় এগিয়ে যাওয়া এই অপরূপ ও অবারিত সম্ভাবনার বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী দেশ ও বহিঃবিশ্বের চক্ষুশূল হয়ে ওঠে ফলে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্তি, হিংসা, বিদ্বেষ ও নেতৃবৃন্দের ক্ষমতার লোভ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি পরিবারতন্ত্র ও অনৈতিকতার সুযোগকে পুঁজি করে ষড়যন্ত্রকারীরা এগিয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। আর দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ বহিঃশত্রুর ষড়যন্ত্রের শিকারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যতটুকু তার থেকে অনেক পিছিয়ে যাচ্ছে এদেশের মীরজাফরদের উত্তরসূরিদের কারণে।

একথা সত্য যে,গণতান্ত্রিক শাসনের বিকল্প আজও কিছু আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু আমাদের দেশে প্রত্যেক শাসকশ্রেণিই তাদের নিজস্ব সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতায় চৌহদ্দি ঠিক রেখে গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করেছি। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় যে প্রকৃত গণতন্ত্রের সুফল ভোগ করতে পারিনি। এর রহস্যাবৃত কারণ মিলিয়ে দেখা যাক এবার- গ্যাটিসবার্গে প্রদত্ত পূর্ণ বক্তব্য হল, 'That this nation, under God, shall have a new birth of freedom; and that the government of the people, by the people. for the people, shall not perish from the earth'। শাসনক্ষমতায় যাবার একটিই মাত্র পথ হলো জনগণের রায়। জনগণের রায়ে শাসন ক্ষমতায় গিয়ে শাসক নিজের ইচ্ছানুসারে শাসন করতে পারে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হল জনমত, তাই জনগণের মতপ্রকাশের অধিকার থাকতে হবে। গণতান্ত্রিক শাসনে মতপ্রকাশের অবাধ অধিকার থাকবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দল গঠন মতপ্রকাশ ও সমালোচনার অধিকার স্বীকৃত থাকে। রাষ্ট্রে বিরোধী দল অবশ্যই থাকবে। বিরোধী দলের অস্তিত্বকে মেনে না নিলে তা গণতান্ত্রিক শাসন হতে পারে না।

এই স্বৈরাচার সরকার আজ মানুষের ভোটের অধিকার, স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি, সাংস্কৃতিক গোলামি হতে মানুষের মুক্তির পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। এই সরকার মূলত অন্য রাষ্ট্রের পদলেহন করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে এটি আবারও প্রমাণিত হয়েছে। তাই জাতির ঘাড়ে চেপে বসা জগদ্দল পাথর থেকে জাতিকে মুক্ত করতে প্রয়োজনের একটি চূড়ান্ত সংগ্রামের। জনগণের সেই সংগ্রাম-ই কেবলমাত্র দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ইসলাম ও গণতান্ত্রিক শাসন নিশ্চিত করতে পারে। একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জনগণের অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন-ই এর কবল থেকে জাতিকে মুক্ত করতে পারে। নব্য স্বৈরাচার ও নতজানু রাষ্ট্রের কবল থেকে এই জাতির মুক্তি নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সবার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। সেটিই হোক আজ আমজনতার অঙ্গীকার। 

লেখক : সহকারী সম্পাদক, 

সাপ্তাহিক সোনার বাংলা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির