post

রমাদানে সুন্নাহর আলোকে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি

ড. সালমা লাইজু

১৩ এপ্রিল ২০২২

রমাদান মাস আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ রহমতের মাস। এ মাস আমাদের জীবনে তাকওয়ার প্রশিক্ষণের সুযোগ এনে দেয়, সেই সাথে আমরা শিখতে পারি কিভাবে ভারসাম্যপূর্ণ এবং স্বাস্থ্যসম্মতভাবে জীবন যাপন করা যায়, কিভাবে খাদ্যাভ্যাস সঠিকভাবে করা যায়। এ মাসে পাকস্থলীকে বিশ্রাম দেওয়া হয় এবং শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের হয়ে যায়। রোজা একজন ব্যক্তির শরীর স্বাস্থ্য ভালো করে, কিন্তু খাবার সঠিক না হলে স্বাস্থ্য খারাপ করে দেয়। একজন মানুষের খাদ্যাভ্যাস একজন ব্যক্তির শরীরকে ধ্বংস করে দিতে পারে। শুধু মুখের স্বাদ বিবেচনা করে খাবার খাওয়া উচিত নয়, অতিরিক্ত খাওয়া পরিহার করা উচিত। মানুষের আত্মিক স্বাস্থ্যের জন্যও খাবার ভূমিকা রাখে।
এবারের রোজা হচ্ছে গরমকালে। আমাদের দেশে নানা শ্রেণি-পেশার বিভিন্ন বয়সীরা রোজা রাখেন। এদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। ফলে সবকিছু মাথায় রেখে সাহরি ও ইফতারে খাদ্যসামগ্রী তৈরির পরিকল্পনা করতে হবে।
বাঙালির ইফতারে প্রথা হয়ে গেছে, ভাজা-পোড়া খাবার দিয়ে শুরু করেন। পরে অন্যান্য খাবার গ্রহণ করেন। এতে কিছুটা হলেও আমাদের শরীরের ক্ষতি হচ্ছে। কারণ পেট দীর্ঘক্ষণ খালি থাকার পর তাতে তৈলাক্ত খাবার গেলে হজমের সমস্যা তৈরি করে।
প্রথমে শুধু খেজুর ও পানি মুখে দিয়ে ইফতার করা ভালো, যাদের সুগার নেই, তারা বাসায় বানানো কোনো একটি শরবত রাখতে পারেন। ইফতারের শুরুটা হোক স্বাস্থ্যকর পানীয়, যেমন লেবুর শরবত, তোকমার শরবত, ইসবগুল ও চিয়া বীজের শরবত বা ঘরে তৈরি ফলের রস পান করে। ফলের রস করার সময় ছেঁকে শুধু পানিটা না নিয়ে আঁশসহ রস খেতে হবে। এতে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হবে না। সারা দিন রোজা রাখার পর শরীর যাতে কোনোভাবেই পানিশূন্য (ডিহাইড্রেটেড) না হয়, এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তাই ইফতার থেকে সাহ্রি পর্যন্ত অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান ভালো।
রোজাদাররা অনেক সময় মাথা ধরা, পানিশূন্যতা, মাথা ঘোরা, অবসন্নতা এবং রক্তে চিনির শূন্যতাতে ভোগে। যদি রমাদানে আমরা সঠিকভাবে খাদ্য গ্রহণ করি তাহলে আমাদের উক্ত সমস্যাগুলো থাকবে না। রমাদানের খাদ্য তালিকায় প্রথমে যেটা থাকে সেটি হলো খেজুর। এটি সহজে হজম করা যায়, ক্ষুধার তীব্রতা কমায়, চিনি এবং খাদ্যপ্রাণ সমৃদ্ধ খাবার।
রোজায় যে সমস্ত খাবার খাওয়া ঠিক নয় তার মধ্যে আছে ভাজাপোড়া খাবার (সমুচা, মুরগির ফ্রাই, পটেটো চিপস), অতিরিক্ত চিনি সমৃদ্ধ খাবার, খুব চর্বিযুক্ত খাবার ইত্যাদি। এ সময় বাহিরের তৈরি খোলা খাবার একদম পরিহার করা উচিত। তা ছাড়া এসব তৈলাক্ত খাবারের বেশির ভাগই বাইরে থেকে কেনা হয়।
নিম্নমানের তেল, বাসি-পচা মসলা এবং বিষাক্ত রং মিশিয়ে তৈরি করা বিভিন্ন খাবার যতই লোভনীয় হোক না কেন খাওয়া কখনই উচিত নয়। এসময় পেটে কোনো সমস্যা হলে তার রোজা বাদ দিতে হতে পারে। রমাদানে খাবারে বিশেষ কিছু নিয়ম অবশ্যই মানতে হবে। তাহলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমানো যাবে। যেমন: খুব গরম খাবার এবং খুব ঠাণ্ডা খাবার একসাথে খাওয়া ঠিক নয়। দইয়ের সাথে টক ফল/ গরম খাবার/ মাছ খেলে হজমে ব্যাঘাত ঘটে। দইয়ের সাথে পুরী বা তেলে ভাজা খাবার খেলে শরীর দ্রুত মোটা হয়।
দুধের সাথে ভাজা-পোড়া/ তেলে ভুনা খাবার/ টক ফল/ কাঁচা সবজি/ হজমে খুব সমস্যা করে।
ঘি বা মাখনের সাথে মধু খাওয়া যাবে না। লেবু, মাল্টা এবং কলা একসাথে খাওয়া যাবে না। শাকের সাথে তিল খেলে ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
স্বাস্থ্যকর বিকল্প খাবার হতে পারে ভাপে সিদ্ধ শিঙ্গাড়া, সমুচা, রোল, আলুর চিপস, আগুনে গ্রিল করা মাংস, মাছ, চিকেন। সকল খাবার গ্রুপ থেকে খাবার থাকা উচিত যথা কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, কম চর্বিযুক্ত ফ্যাট, সবজি, ফল এবং পানি।
প্রচুর ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে, ফাইবার কোষ্ঠবদ্ধতা দূর করে। শেষ রাতের খাবারে সেদ্ধ আটার রুটি, ভাত, সবজি, ডাল এবং ফল থাকতে পারে, সেই সাথে চর্বিহীন মাংসের ঝোল অথবা আগুনে ঝলসানো মাংস। ডাল এ মাসে নিয়মিত খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো। এ ছাড়া প্রতিদিন কিছু বাদাম খাওয়া প্রয়োজন যাতে ভিটামিন এ এবং ডি এর চাহিদা পূরণ করবে। প্রচুর তরল খেতে হবে। অনেকেই এ মাসে প্রয়োজনীয় পানি বা তরল খাবার ঠিকভাবে খান না, কেউ কেউ প্রয়োজনীয় পানির পরিবর্তে জুস, কফি, চা বা কোল্ড ড্রিংকস খেয়ে থাকেন, যা ঠিক নয়। খাবার আধঘণ্টা পর গ্রীন টি, হালকা আদা চা, স্যুপ খাওয়া যেতে পারে। ইফতারের আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা পর হাফ লিটার করে, এক ঘণ্টা পর পর তিনবার পানি খেতে হবে। সাহরির পর পানি খাওয়ার সময় থাকে না। সুতরাং ইফতার এবং রাতের ঘুমের আগে পানি খাওয়া শেষ করতে হবে। একসাথে অতিরিক্ত পানি খাওয়া যাবে না। এটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
খাবারের প্রধান উদ্দেশ্য হলো পুষ্টি গ্রহণ, যাতে শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়, শরীর সুস্থ থাকে এবং আমরা ইবাদত ও জাগতিক কাজকর্ম করার জন্য শক্তি পাই। রান্নার ফলে খাদ্য যাতে সুস্বাদু এবং সুখাদ্য হয়। খাবারে কম তেল এবং কম মশলা ব্যবহার করতে হবে। সেদ্ধ ঝোল খাওয়া স্বাস্থ্যকর। এ মাসে যেহেতু খাবার সময় রাত, সুতরাং শাক জাতীয় খাবার বাদ দেওয়া ভালো। তবে শাকের স্যুপ ইফতারিতে খাওয়া যেতে পারে। অনেকেই মনে করেন রোজা আছি সারাদিন খাওয়া হয় না, তাই দুনিয়ার যত খাবার আছে সবই খাব। অনেক মা বোন আছেন সাহরি খেয়ে লম্বা ঘুম দেন, ওঠেন ১০-১১টার দিকে। এরপর শুরু করেন রান্নার আয়োজন। কে কি খাবে, কার কি পছন্দ, সারাদিন খাওয়া হয়নি; মন ভরে খেতেই হবে। সুতরাং ব্যাপক আয়োজন করতে হবে, যতই কষ্টসাধ্য হোক না কেন। ফলে খুব দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং ইবাদত বন্দেগির সময় কম হয়ে যায়।
রমাদান খাবার উৎসবের মাস নয়। এটি ইবাদতের উৎসবের মাস। এমনভাবে খাবার নির্বাচন করতে হবে যাতে সেটা সহজপাচ্য হয় এবং প্রচুর শক্তি পাওয়া যায়। রমাদানে আরো খেয়াল রাখতে হবে, কোনো হারাম খাবার কিংবা হারাম উপায়ে অর্জিত অর্থের খাবারে রোজাও কবুল হবে না, দোয়াও কবুল হবে না।
অনেকে আছেন যারা রোজা রেখে সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাতে চান। যেহেতু শেষরাতে ঘুম থেকে উঠেছি, তাই ঘুম খুব লম্বা হবে এটিও ঠিক না, তাড়াতাড়ি ঘুমানোর চেষ্টা করতে হবে। সব কাজ সন্ধ্যার মধ্যে শেষ করার চেষ্টা করতে হবে তারাবি এবং বিতরের নামাযের পর দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে হবে। রমাদান যেহেতু প্রশিক্ষণের মাস তাই অন্যান্য মাসের চেয়ে পরিশ্রম একটু বেশি হবে। এ জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি থাকতে হবে। ফজরের পর কিছুটা ঘুমিয়ে নেয়া ভালো, তবে অর্ধবেলা কখনই নয়। এ ছাড়া হালকা ব্যায়াম, সাইকেল চালানো, হাঁটাচলা করতে হবে। রোজা আছি দেখে কিছু করতে হবে না, এ ধারণা ভুল। পৃথিবীতে হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ আছে যারা রোজা রেখেও পরিশ্রম করে থাকে। আমরা স্বাভাবিকভাবে যেভাবে চলতাম সেইভাবেই চলতে হবে।
অনেক মানুষ বিশেষ করে যাদের সামর্থ্য আছে উনারা রমাদান শুরুর পূর্বেই বিশেষ কেনা-কাটার আয়োজন করে থাকেন। কিভাবে সারা মাস খুব ভালোভাবে খাওয়া দাওয়া করা যাবে। উনারা ৩০ দিনের বাজার এবং রান্নার জন্য বিশেষ কর্মসূচি তৈরি করে থাকেন। ফলে বাজারমূল্য হঠাৎ করে বেড়ে যায়। মনে হয়, রমাদান তো নয় কোনো খাবার উৎসবের দিন আসছে। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে রমাদান কোনো খাদ্যাভ্যাসের উৎসব নয়, রমাদান শারীরিক মানসিক এবং আত্মিক ইবাদতের প্রশিক্ষণের মাস। এখানে নিজের খাবারের প্রতি এত যত্ন আর চিন্তা সেখানে আশপাশে হাজারো মানুষ না খেয়ে আছে, তাদের জন্যও আমাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। নিজেরা একটু কম খেয়ে অভাবীকে খাবার দেবার মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত তৃপ্তি আর শান্তি। রমাদানে ইবাদতকে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে, রান্নাকে নয়। রমাদান মাসে সুযোগ আসে যখন আমরা যারা বছরের পাপের ক্ষমা লাভের সুযোগ পাই। এ মাসে আমাদের জীবন-যাপন প্রণালী বদলে ফেলে ভালো কাজ এবং ভালো অভ্যাস শুরু করতে পারি। রোজা থাকুক বা নাই থাকুক খাবার বিষয়গুলো একই থাকা উচিত। রান্নাঘরে প্রচুর সময় নষ্ট করা উচিত নয়।
নবী করিম সা. বলেছেন “মানুষের পেট পুরে খাবার খাওয়ার প্রয়োজন নেই, তার জন্য কয়েক লোকমা খাবারই যথেষ্ট যাতে মেরুদণ্ড সোজা করে রাখা যায়, কিন্তু সে পেটপূর্ণ করে খায়, পেটের একাংশ খাবার, একাংশ পানীয়, একাংশ ফাঁকা থাকবে বাতাসের জন্য।” (ইবনে মাজাহ)
নবী করিম সা. ইফতারিতে সাধারণত তাজা আজুয়া খেজুর খেতে পছন্দ করতেন। সাহরির সময় কোনো কোনো দিন নবী সা. তাহিরী (রুটি ও খেজুর) এবং পানি পান করতেন। কোনোকিছু না থাকলে সামান্য খেজুর, দুধ এবং পানি পান করতেন। নবী সা. বলেছেন তোমরা সাহরি খাও, এতে বরকত রয়েছে।
সাধারণত যে খাবার সব জায়গায় পাওয়া যায় সেই খাবারই খেতেন। রমাদান উপলক্ষে কোনো বিশেষ রান্নার আয়োজন হতো না। তবে নবী জীবনীকারদের বিবরণ অনুযায়ী হজরত রাসূলুল্লাহ সা.-এর খাদ্য তালিকায় মাঝে মাঝে গোশত, রুটি, জায়তুন (জলপাই বা তার তেল), খেজুর, দুধ ও মধু থাকত।
রমাদানেও অন্যান্য দিনের মতো সাধারণ খাবার খেতেন। নবীজি সা. রমাদানে খাদ্য নয়, রোজার অন্তর্নিহিত কল্যাণের দিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। সাদাসিধে ও সরল জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন হজরত রাসূলুল্লাহ সা.। জীবনে সবকিছুতেই তিনি ছিলেন অনাড়ম্বর। সীমাহীন প্রাচুর্যের হাতছানি উপেক্ষা করে তিনি বেছে নিয়েছিলেন সাধারণ জীবন।
পছন্দ করতেন সমাজের বিত্ত- ভৈববহীন মানুষদের। খাবারের ব্যাপারেও ছিলো এ সারল্যের ছাপ।
হজরত আয়েশা রা. বলেন, ‘মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মুহাম্মদ সা.-এর পরিবার কখনও পরপর দু’দিন গমের রুটিতে তৃপ্ত হননি।’ (বুখারি-৫৭১৬)
অথচ এ ব্যাপারে হজরত রাসূলুল্লাহ সা.-এর কোনো অভিযোগ ছিলো না। হজরত রাসূলুল্লাহ সা.-এর খাবার গ্রহণের এ সারল্য ও অল্পতুষ্টি বজায় থাকতো রমাদানের সাহরি ইফতারির সময়ও। ঘরে যখন যা থাকতো তাই সাহরি ইফতারি হিসেবে গ্রহণ করতেন।
তৎকালীন সমাজের এ খাদ্যতালিকা থেকে যা সহজসাধ্য হতো রাসূলুল্লাহ সা. তাই খেতেন সাহরিতে। তিরমিজির বর্ণনায়- রোজার মাসে রাসূল সা. মাগরিবের আগে কয়েকটি ভেজা খেজুরের মাধ্যমে ইফতার করতেন। ভেজা খেজুর না থাকলে সাধারণ শুকনো খেজুর। এর ব্যতিক্রম হলে কয়েক ঢোক পানিই ছিল রাসূল সা.-এর ইফতার। আবদুল্লাহ বিন আবি আউফা রহ. সূত্রে বর্ণিত- তিনি বলেন, রোজায় আমরা রাসূল সা.-এর সফরসঙ্গী ছিলাম। সূর্যাস্তের সময় তিনি একজনকে ডেকে বললেন, ছাতু ও পানি মিশিয়ে ইফতার পরিবেশন কর। (মুসলিম-১০৯৯)।
বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা.-এর ইফতার কত সাদাসিধে ছিল। খেজুর ছাতু আর পানির ইফতার। ইফতারের ফজিলত সম্পর্কে হজরত রাসূল সা. বলেন, কেউ যদি রমাদান মাসে কোনো রোজাদারকে ইফতার করায়, আল্লাহ তায়ালা তার গুনাহ মাফ করেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। ইফতার প্রদানকারী একটি রোজার সওয়াব পাবে অথচ রোজা পালনকারীর সওয়াব সামান্য কমানো হবে না। সাহাবিরা বলেন, হে আল্লাহর রাসূল সা., আমাদের এমন সামর্থ্য নেই যা দিয়ে আমরা কাউকে ইফতার করাতে পারি?
তিনি বলেন, আল্লাহ তাকেও এই সওয়াব দিবেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজা পালনকারীকে এক ঢোক দুধ অথবা একটা শুকনো খেজুর কিংবা এক চুমুক পানি দিয়েও ইফতার করাবে আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে পরিতৃপ্তি সহকারে খাওয়াবে আল্লাহ তাকে আমার হাউজে কাওসার থেকে এমনভাবে পানি পান করাবেন যার ফলে, সে জান্নাতে না পৌঁছানো পর্যন্ত তৃষ্ণার্ত হবে না। (বায়হাকি, মিশকাত-১৭৪)
সাহরির খাবার হিসেবে রাসূল সা.-এর বিশেষ কোনো পছন্দের কথা জানা যায় না। তবে হ্যাঁ, তিনি অন্য সব সময়ের মতো সাহরিতেও খেজুর পছন্দ করতেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, ‘উত্তম সাহরি খেজুর এবং উত্তম তরকারি সিরকা। আল্লাহ তায়ালা সাহরি গ্রহণকারীদের প্রতি দয়া করুন।’ (কানজুল উম্মাল-২৩৯৮৩)
অন্য হাদিসে হজরত রাসূল কারিম সা. সাহরির সঙ্গে সারিদের উল্লেখ করেছেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘সাহরি বরকতময়, সারিদ (গোশতের ঝোলে ভেজানো রুটি) বরকতময়, জামাতে নামাজ আদায় করা বরকতময়।’ (কানজুল উম্মাল-২৩৯৭৭)
সাহরির খাবার যাই হোক না কেন নবী করিম সা. নিয়মিত সাহরি গ্রহণ করতেন এবং সাহাবিদেরও সাহরি গ্রহণের পরামর্শ দিতেন।
হজরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, তোমরা সাহরি গ্রহণ কর। কেননা সাহরিতে বরকত রয়েছে।’ (বুখারি-১৯২৩)
রাসূলুল্লাহ সা. খাবারের মান ও পরিমাণের দিকে না তাকিয়ে সাহরি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন এবং সাহরিতে উম্মতের জন্য বরকতের দোয়া করেছেন।
আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত, (নবী করিম সা. বলেছেন)! হে আল্লাহ! আপনি আমার উম্মতের সাহরিতে বরকত দিন। (এরপর বলেন) তোমরা সাহরি গ্রহণ কর এক ঢোক পানি দিয়ে হলেও, একটি খেজুর দিয়ে হলেও, আঙুরের কিছু দানা দিয়ে হলেও। নিশ্চয়ই ফেরেশতাগণ তোমাদের জন্য শান্তির দোয়া করবে। (জামে সুয়ুতি-৫০৭০)
রাসূলুল্লাহ সা. বিলম্বে সাহরি করতে পছন্দ করতেন। তিনি আজানের আনুমানিক বিশ মিনিট পূর্ব পর্যন্ত সাহরি খেতেন।
যায়েদ ইবনে সাবেত রা. বর্ণনা করেন, আমরা রাসূল সা.-এর সঙ্গে ইফতার গ্রহণ করি। অতঃপর তিনি নামাজের জন্য দাঁড়ান। আমি (বর্ণনাকারী) বললাম, আজান ও সাহরির মাঝে কতটুকু সময়ের ব্যবধান ছিলো? তিনি বলেন, পঞ্চাশ আয়াত তথা পঞ্চাশ আয়াত তিলাওয়াত করতে যতটুকু সময়ের প্রয়োজন হয়। (বুখারি-১৯২১)
সারাদিন ক্ষুধার্ত থেকে ইফতারের সময় খাবারের ওপর হামলে পড়তে দেখা যায় অনেককে। এটিও সুন্নাতবিরোধী কাজ। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও ইফতারে অতিভোজন স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর বলে প্রমাণ হয়েছে।
নবীজির ইফতার ছিলো খুবই সাদামাটা। আসলে রাসূল সা. বিজ্ঞানময় জীবনযাপন করতেন। তিনি খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন, দীর্ঘ সময় পাকস্থলী খালি থাকার পর পরই খুব বেশি খাবার গ্রহণ করা উচিত নয়। তা ছাড়া রুহকে তাজা করার এই মাসে দেহকে বেশি খাবার দেয়াও আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে বড় বাধা। তাই তিনি পুরো রমাদান জুড়েই বেশি বেশি ইবাদত করতেন, কিন্তু খুব কম খাবার খেতেন।
হাদিসে বলা হয়েছে, নবীজি ইফতার করতেন তাজা খেজুর দিয়ে। তাজা খেজুর না থাকলে শুকনো খেজুর দিয়ে। তাও না পেলে কয়েক ঢোক দুধ পান করতেন।
মানুষ এখন ওজন কমানোর জন্য কত চেষ্টা করছে কিন্তু আমাদের প্রিয় নবী সা. ১৪০০ বছর পূর্বেই তা দেখিয়ে গেছেন। নবীজি আমাদের পেট ভর্তি করে খাবার খেতে নিষেধ করেছেন, পেট পুরে খেলে ওজন বেড়ে যাবে, অলসতা এবং বিভিন্ন রোগব্যাধিতে মানুষ অসুস্থ হয়ে যাবে। রমাদান মানুষকে খাবারের প্রতি লোভ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। তবে রমাদানের পরিমিত খাবার খেতে হবে যাতে খুব দুর্বল না লাগে এবং ইবাদতে ব্যাঘাত না ঘটে। রোজা অনশন নয়, এটি প্রাকৃতিক নিয়ম। রোজা থাকলে পাকস্থলী বিশ্রাম পায়, ফলে মেটাবলিজম প্রক্রিয়ার দ্রুত হয় এবং ক্যালরি ভালোভাবে কাজে লাগে। রোজা ডায়েটিং নয়, তবে রমাদানের রুটিন মেনে চললে ওজন কম হবে।
রমাদানে পানাহার ইসলামে নিষিদ্ধ নয়, তবে তার জন্য খাবারের প্রতি আসক্তি বা লোভ থাকা যাবে না। রমাদান যেহেতু ত্যাগের মাস, ভোগের মাস নয়, সেজন্য আমরা সবাই সেই পরিমাণ খাবার খাব যাতে আমাদের শরীর সুস্থ থাকে এবং ইবাদতের শক্তি পাই।
সুতরাং রহমত, বরকত এবং মাগফিরাত এ মাসে শরীর-স্বাস্থ্য এবং মনকে ভালো রাখতে হলে অবশ্যই বিশুদ্ধ, পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে, এর কোনো বিকল্প নাই। আসুন, সাহরি ইফতারিতে বিলাসী আয়োজন পরিহার করি, সুস্থ থাকি তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ি এবং ইবাদত বন্দেগিতে সময় দেই। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা প্রতি রাতের তৃতীয়ার্ধে পৃথিবীর আসমানে নেমে আসেন এবং বলেন, যে আমাকে ডাকবে আমি সাড়া দেব, যে আমার কাছে চাইবে আমি তাকে তা দেব এবং যে আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।’ (বুখারি-১০৯৪)
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির