post

শহীদ শেখ আমিনুল ইসলাম বিমান প্রেরণার মিনার

মুশাররফ আনসারী

২৪ মার্চ ২০২৩

জাহেলিয়াতের তীব্র নখরাঘাতে এ দেশের তরুণ ছাত্রসমাজ যখন বিপর্যস্ত ঠিক তখনই সময়ের অনিবার্য প্রয়োজনে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের যাত্রা শুরু হয়েছিলো। হেরার আলোয় উদ্ভাসিত কুরআনের প্রজ্বলিত আভা নিয়ে বিপর্যস্ত তরুণ সমাজকে মুক্তির মোহনায় পৌঁছে দিতে ছাত্রশিবিরের এ পথচলা কখনো মসৃণ ছিলো না। সহস্র জুলুমের সোপান মাড়িয়ে ২৩৪ জন শহীদের শাহাদাতের অতুলনীয় নজরানা এ কাফেলাকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। হজরত খানজাহান আলী (রহ) এর পদধূলিধন্য খুলনা নগরীতে জন্মলগ্ন থেকে ছাত্রশিবির তরুণ প্রজন্মের আলোকবর্তিকার ভূমিকা পালন করে আসছে। সহস্র তরুণের আলোর মিছিল যখন ছাত্রশিবিরের পতাকাতলে সমবেত হতে শুরু করেছে ঠিক তখনই মানবরচিত আদর্শের বাহকেরা শিবিরের এ অগ্রযাত্রা রুখে দিতে খুনের নেশায় বুঁদ হয়েছে। তাদের টার্গেট কিলিংয়ের অংশ হিসেবে একে একে পাঁচ শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে খুলনার জমিন। শহীদ আমিনুল ইসলাম বিমান তাদেরই একজন। খুলনার মাটিতে দ্বীন কায়েমের এ কাফেলা সর্বপ্রথম তারই রক্তে রঞ্জিত হয়েছিলো। সেই রক্তের স্রােতধারা আজো বহমান।

শহীদ শেখ আমিনুল ইসলাম বিমানের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। পাঁচ ভাইবোনের মাঝে দ্বিতীয় আমিনুল ইসলাম বিমান জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পিতার কর্মস্থল কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায়। পরবর্তীতে তার পিতা শেখ মোহাম্মাদ ইদ্রিস আলীর চাকরি সূত্রে খুুলনায় বসবাস শুরু করেন। ছোট বয়সেই তার মা মারা যান। শহীদ শেখ আমিনুল ইসলাম বিমান বড় হন খুলনা শহরের নূরনগর ওয়াপদা কলোনিতে। ওয়াপদা মাধ্যমিক শিক্ষা নিকেতন থেকে ১৯৮২ সালে তিনি প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। ১৯৮৪ সালে সরকারি হাজী মুহাম্মদ মুহসিন কলেজ থেকে এইচএসসি উত্তীর্ণ হয়ে তিনি দৌলতপুর দিবা-নৈশ কলেজে স্নাতক সম্পন্ন করেন। শাহাদাতের সময় তিনি সরকারি বিএল কলেজে বাংলা বিভাগে মাস্টার্স অধ্যয়নরত ছিলেন।

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার ঐহিত্যবাহী শেখ পরিবারের সদস্য হওয়ায় শহীদ শেখ আমিনুল ইসলাম বিমান ভাইয়ের পরিবারের সদস্যরা ছিলেন আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। এতদসত্ত্বেও আওয়ামী লীগের আদর্শ তাকে ছুঁতে পারেনি। ছোটবেলা থেকেই তিনি নিজেকে ইসলামী আদর্শের সাথে সম্পৃক্ত করেন। খুব ছোট বয়সে তিনি হেরার আলোয় উদ্ভাসিত এই কাফেলার পতাকাতলে সমবেত হন। মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া শহীদ শেখ আমিনুল ইসলাম বিমান খুলনার আরেক শহীদ শেখ বেলাল উদ্দিনের দাওয়াতে প্রলুব্ধ হয়ে সংগঠনের কর্মী হন। স্কুলজীবন শেষ করতেই অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে তিনি সংগঠনের সাথী শপথ গ্রহণ করেন। এরপর দ্বীনের পথে চলতে থাকেন বিমানের গতিতে। শাহাদাতের সময় তিনি সংগঠনের সদস্যপ্রার্থী ছিলেন এবং সরকারি বিএল কলেজ শাখার ক্যাম্পাস সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।

সংগঠন করতে গিয়ে শহীদ বিমানকে পারিবারিকভাবে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আওয়ামী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না হয়ে শিবির করার অপরাধে তার পিতা তাকে লেখাপড়ার খরচ বন্ধ করে দিয়েছিলেন, কিন্তু তাকে ইসলামী আন্দোলনের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেননি। তিনি টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ নিজেই চালাতেন। সকল প্রলোভন প্রিয় বিমান ভাইকে দ্বীনি আন্দোলন থেকে দূরে সরাতে ব্যর্থ হয়েছে। একদিন শহীদের পিতা বিমান ভাইকে বলেন: ‘তুই ছাত্রলীগে চলে আয়, আমি তোকে জেলা সভাপতি বানিয়ে দিবো’ জবাবে তিনি বললেন: ‘বুঝেছি আপনি আমাকে দিয়ে লাইসেন্স পারমিটের সুবিধা ভোগ করতে চান, আমাকে দিয়ে এটা হবে না। আমি আল্লাহর দ্বীনের এ পথ থেকে সরতে পারবো না।’ 

এলাকার সকল বয়সের মানুষের কাছে বিমান ছিলো অনুপম চরিত্রের অধিকারী এক নিষ্ঠাবান সেবক। ছোটদের তিনি খুব স্নেহ করতেন, তার স্নেহ পেয়ে ওয়াপদা কলোনির প্রায় সকল ছাত্রই শিবিরের কর্মী হয়েছিলো। অসংখ্য ছেলেদের বাসায় বাসায় ঘুরে বিনা পয়সায় টিউশনি করিয়েছেন তিনি। কারো বিপদের খবর শুনলে সবার আগে দৌড়ে যেতেন। খুলনা মেডিকেল কলেজের পাশে বাসা হওয়ায় প্রায়ই অচেনা রোগীদের জন্য বাসা থেকে খাবার নিয়ে যেতেন। নিজের পরনের নতুন জামা কাপড় দরিদ্র দ্বীনি ভাইদের দিয়ে দিতেন। তিনটা টিউশনি করাতেন বিমান ভাই। একটা টিউশনির টাকা দিয়ে নিজে চলতেন, অন্য দুটি টিউশনির টাকা দিয়ে দু’জন কর্মীর (নজরুল ভাই ও বারেক ভাই) লেখাপড়ার খরচ চালাতেন। এমন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী বিমান ভাই কখনো জাঁকজমক জামাকাপড় পরতেন না, অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করতেন।

শাহাদাতের ঘটনা

দিনটি ছিলো ২৫ মার্চ ১৯৯২, ২০ রমজান। প্রতিদিনের ন্যায় সেদিনও ইফতার শেষে মহানগরীর শিবির সভাপতি ইলিয়াস হোসাইন, সেক্রেটারি মিয়া গোলাম কুদ্দুস ভাই নেতৃবৃন্দসহ ২০-২৫ জন অফিসে অবস্থান করছিলেন। সেদিন গোটা শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিলো। কথিত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, রাম-বামের সন্ত্রাসীরা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে খুনের নেশায় বুঁদ হয়ে ঘুরছিলো। তাদের কিলিং টার্গেট তারেপুকুরের মহানগরী জামায়াত ও শিবির অফিস। হঠাৎই কমরেড ফিরোজের নেতৃত্বে কথিত ঘাদানিক সন্ত্রাসীদের একটি বিশাল মশাল মিছিল এসে শিবির অফিসে অতর্কিত হামলা চালায়। আক্রমণকারী সন্ত্রাসীরা অফিসের সিঁড়ির কাছে এলে আমিনুল ইসলাম বিমান নারায়ে তাকবির স্লোগান দিয়ে তাদের পিছু হটাতে চেষ্টা করেন। মাত্র ৬ জন ভাইয়ের প্রতিরোধে সন্ত্রাসীরা প্রাথমিকভাবে পিছু হটলেও তারা পুনর্গঠিত হয়ে আবার হামলা চালায়। সন্ত্রাসীদের একজন জ্বলন্ত মশাল দিয়ে আঘাত করে বিমান ভাইয়ের মাথায়, তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আমিনুল ইসলাম বিমান ভাই, আব্দুল ওয়াদুদ ভাই, জাহাঙ্গীর হোসেন হেলাল ভাইসহ ৫-৬ জন ভাই গুরুতর আহত হন। সাথীরা তাদের উদ্ধার করে দ্রুতই হসপিটালে নিয়ে যায়। বিমান ভাইসহ আহতদের ভর্তি করা হয় খুলনা মেডিকেল কলেজ হসপিটালে। গুরুতর আহত বিমান ভাইয়ের রক্তের ফিনকি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিলো না। খবর এলো রক্ত লাগবে। শুরু হলো রক্ত দেওয়ার প্রতিযোগিতা, এক বিমানকে সুস্থ করতে শতশত বিমান নিজের রক্ত দিতে পাগলপারা হয়ে আছে। সবার চোখে মুখে প্রিয় সাথী বিমানকে বাঁচানোর আকুতি। হঠাৎই খবর এলো প্রিয় বিমান ভাই চলে গেছেন আল্লাহর দরবারে। মুহূর্তেই সাথীদের কান্নার রোলে ভারী হয়ে উঠলো মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণ। শহীদের সাথীদের গগনবিদারী হাহাকারে প্রকম্পিত হলো খুলনার আকাশ বাতাস।

পরদিন ২৬ মার্চ। স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতা দিবস হলেও শহরে নেই কোনো আমেজ, গোটা শহর নীরব-নিস্তব্ধ। বিমানহারা প্রিয় সাথীদের কান্নার রোল শোকাহত করে তুলেছিলো গোটা শহরকে। শহীদের কফিন নিয়ে যাওয়া হলো তার প্রিয় ঠিকানা সেই ওয়াপদা কলোনিতে। কফিন আসতেই তার বন্ধুরা সাক্ষ্য দিলো: আগের দিন তথা ২৫ মার্চ জোহরের নামাজের পর এই মাঠে দাঁড়িয়ে বিমান ভাই তার সাথীদের বলেছিলেন ‘তোমরা আমাকে আর খুঁজবে না, আমাকে খুঁজবে শহীদি মিছিলে’ আর আমি শহীদ হলে আমার কফিনটা একটু ওয়াপদা কলোনি ঘুরিয়ে নেবে। সত্যিই তিনি শহীদ হয়েই ওয়াপদা কলোনিতে এলেন। শহীদ বিমানের লাশ দেখে কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ সবাই শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। হাজারো জনতার উপস্থিতিতে ওয়াপদা কলোনিতেই হয় তার প্রথম জানাজা নামাজ। এরপর শহীদের কফিন কাঁধে হাজার শোকাহত সাথীর মিছিল রওনা হয় শিবির অফিসের দিকে, অফিসের পাশে জাতিসংঘ শিশুপার্কে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় জানাজা। জানাজা পরিণত হয় জনসমুদ্রে। জানাজায় আগত হাজারো সাথীর গগনবিদারী স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে খুলনার আকাশ-বাতাস। জানাজা অনুষ্ঠানে শহীদ শেখ আমিনুল ইসলাম বিমান ভাইয়ের পিতার বক্তব্য সবাইকে বাকরুদ্ধ করে দেয়। ছেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শহীদের পিতা বলেন: আমার সন্তানকে এতোদিনে আমি চিনতে পারিনি, শিবির করার কারণে আমি ওকে অনেক বকাঝকা করেছি। আজকে বিমানের সাথীদের আহাজারি দেখে মনে হচ্ছে ‘আমার সন্তান হারানো বেদনা থেকে ওদের ভাই হারানো বেদনা অনেক বেশি’। আমার ছেলের দুনিয়ার কোনো মোহ ছিলো না। ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর তাকে আমি বললাম ‘তুই পলিটেকনিকে ভর্তি হবে, তাহলে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবি।’ জবাবে সে বললো: ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার কেন হবো, বেশি রোজগারের জন্য? আমার বেশি রোজগার দরকার নেই, রোজগার করতে গিয়ে আমি দুনিয়ার মোহে ডুবতে চাই না, আমি দ্বীনের পথে অবিচল থাকতে চাই! শিবির করার কারণে আমি তাকে অনেক বকাঝকা করেছি, কিন্তু সে কখনো আমার মুখের উপর কথা বলেনি, আমার সাথে বেয়াদবি করেনি। শহীদের পিতা হিসেবে আজ আমি গর্বিত।

জানাজা নামাজ শেষে শহীদ আমিনুল ইসলাম বিমানের কফিন নিয়ে বাকরুদ্ধ জনতার স্রােত এগিয়ে চলে কবরস্থানের দিকে। নগরীর টুটপাড়া কবরস্থানে চোখের পানিতে সমাহিত করা হয় শহীদ আমিনুল ইসলাম বিমানকে। শহীদ বিমানের শাহাদাত জানান দেয় বিমানেরা কখনো মরে না, একেকজন বিমানের শাহাদাত জন্ম দেয় লাখো বিমানের। শহীদ আমিনুল ইসলাম বিমানের শাহাদাত সাথীদের মাঝে যে বেদনার সাগর সৃষ্টি করেছে, এ সাগরে রয়েছে প্রাণের জোয়ার আর প্রেরণার অপ্রতিরোধ্য স্রােত। এ স্রােত একদিন ভাসিয়ে নেবে খোদাদ্রোহিতার শেষ চিহ্নটুকু। 


এ ক ন জ রে

নাম : শেখ শহীদ আমিনুল ইসলাম বিমান।

পিতা : শেখ মোহাম্মাদ ইদ্রিস আলী।

মাতা : জাহানারা বেগম।

ভাই-বোন : ৩ ভাই, ২ বোন।

জন্মতারিখ : ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬।

জন্মস্থান : কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায়, পিতার কর্মস্থলে।

স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম, ডাক ও থানা : টুঙ্গিপাড়া, জেলা : গোপালগঞ্জ।

শিক্ষাজীবন : এসএসসি ১৯৮২ ইং (প্রথম বিভাগ, নূরনগর ওয়াপদা মাধ্যমিক শিক্ষানিকেতন) এইচএসসি ১৯৮৪ ইং (হাজী মো: মুহসিন কলেজ) স্নাতক দৌলতপুর দিবা- নেশ কলেজ, শাহাদাতের সময় তিনি বি.এল. কলেজে বাংলায় মাস্টার্স প্রথম পর্ব অধ্যয়নরত ছিলেন।

সাংগঠনিক জীবন : শহীদ আমিনুল ইসলাম বিমান ১৯৭৯ সালে সংগঠনে যোগদান করেন। শাহাদাতের সময় তিনি সংগঠনের সাথী ছিলেন এবং বি.এল কলেজ ক্যাম্পাস শাখার সেক্রেটারি ছিলেন।

আহত হওয়ার তারিখ ও স্থান : ১৯৯২ সালের ২৫ মার্চ ২০ রমজান সন্ধ্যা ৭টায় মহানগরী শিবির অফিস শান্তিধাম মোড়, খুলনা। 

শাহাদাতের তারিখ ও স্থান : ঐদিন রাত-১২.১০ মিনিট, খুলনা মেডিকেল হাসপাতাল।

আঘাতের ধরন : বোমা হামলা, লোহার রড ও হকিস্টিক দিয়ে  আঘাত।

যাদের দ্বারা : আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, ঘাদানিকসহ বামপন্থী রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত হামলায়।

শহীদক্রম : ৪২তম।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির